logo ০৪ মে ২০২৫
আওয়ামী লীগের ফল বিপর্যয় বিদ্রোহীদের কারণে
তানিম আহমেদ, ঢাকাটাইমস
২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪ ১৮:২১:৫৮
image


ঢাকা: উপজেলা নির্বাচনের প্রথম পর্বের ফলাফল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জন্য নিঃসন্দেহে বিব্রতকর। বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের চেয়ে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা জিতেছেন কম উপজেলায়।

১৯ ফেব্রুয়ারি প্রথম পর্বের নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থীরা জিতেছেন ৩৯ উপজেলায়। আর আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা জয় পেয়েছেন ৩৫টিতে। চারটিতে জিতেছে বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী। বিএনপির শরিক জামায়াত জিতেছে ১২টিতে। আর সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় ফল স্থগিত হলেও তাতে এগিয়ে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী।

কিন্তু পূর্ণাঙ্গ ফল দেখলে আফসোস হতেই পারে আওয়ামী লীগ। বেশ কয়টি উপজেলাতেই তারা হেরেছে নিজেদের মধ্যে বিরোধের কারণে।

সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলায় ২৪ হাজার ৩৬৯ ভোট পেয়ে জিতেছেন জামায়াতের প্রার্থী নাজমুল ইসলাম। ৭৬৭ ভোট কম পেয়ে দ্বিতীয় হয়েছেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী ইকবাল আহমদ চৌধুরী। অথচ ভোটের ফল হতে পারত উল্টো। কারণ এখানে আওয়ামী লীগের দুই বিদ্রোহী প্রার্থী পেয়েছেন সাত হাজার ৪৬৭ ভোট। এই উপজেলায় জামায়াত প্রার্থী জিতেছেন।

চট্টগ্রামের মিরসরাইয়েও ঘটেছে একই রকম ঘটনা। এখানে ৫৬ হাজার ১৭৯ ভোট পেয়ে জিতেছেন বিএনপি সমর্থিত নুরুল আমিন। এখানে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী শেখ আতাউর রহমান পেয়েছেন ২৪ হাজার ৭৬০ ভোট। কিন্তু দলের বিদ্রোহী প্রার্থী গিয়াস উদ্দিন পেয়েছেন ৪২ হাজার ৯৫৩ ভোট। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের দুই নেতা বিএনপি প্রার্থীর চেয়ে বেশি পেয়েছেন ১১ হাজার ৬৩৪ ভোট।

পাবনার সাঁথিয়ায় জামায়াত নেতা মোখলেছুর রহমান জিতেছেন ৫৪ হাজার ৫৮৯ ভোট পেয়ে। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের মীর মঞ্জুর এলাহী পেয়েছেন ৩৮ হাজার ২৫৫ ভোট। এখানে আওয়ামী লীগের আরেক নেতা নিজামউদ্দিন পেয়েছেন ১৮ হাজারেরও বেশি ভোট। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের একক প্রার্থী থাকলে সহজেই ভোটের ফল পক্ষে আনতে পারত তারা।

শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলায় বরাবরই শক্তিশালী অবস্থান আওয়ামী লীগের। কিন্তু এবার সেখানে জিতেছেন বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী আনোয়ার হোসেন মাঝি। তিনি পেয়েছে ৪২ হাজার ৪১৫ ভোট। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ সমর্থিত আলতাফ হোসেন তার চেয়ে ছয় হাজার ৯৮১ ভোট কম পেয়েছেন। অথচ এখানে দলের আরেক নেতা হাবিবুর রহমান শিকদার পেয়েছেন সাত হাজার ৫১৩ ভোট। অর্থাৎ একক প্রার্থী থাকলে এখানেও জিতত আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী।

প্রথম দফায় যে ৯৭টি উপজেলাতে ভোট হয়েছে তার মধ্যে ৫০টিরও বেশি এলাকায় ছিল বিদ্রোহী প্রার্থী। মোট কতটিতে বিদ্রোহী প্রার্থীর জন্য আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী হেরেছেন তা নিশ্চিত না হলেও এই সংখ্যাটা নেহাত কম না।

আবার এই নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোটবদ্ধ লড়াই করলেও আওয়ামী লীগ নেমেছে একা। এ অবস্থায় নিজেদের মধ্যে কোন্দল নির্বাচনী লড়াইয়ে ভুগিয়েছে দলটিকে।

আবার কোথাও কোথাও বিদ্রোহী প্রার্থী না থাকলেও কোন্দলের কারণে দল সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে একজোট হয়ে খাটেনি আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকরা। আর এ কারণে গাজীপুরের কাপাসিয়া, কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ, জামালপুর সদর, সরিষাবাড়ী, নেত্রকোনার কেন্দুয়ার মতো এলাকায় যেখানে বরাবর সহজ জয় পায় আওয়ামী লীগ, সেসব এলাকায় এবার হেরেছে তারা।

আশঙ্কা ছিল আগে থেকেই : দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট অংশ না নিলেও উপজেলায় তাদের লড়াইয়ের ঘোষণার পর থেকেই আওয়ামী লীগের কেন্দ্র থেকে একক প্রার্থী সমর্থন দেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয় জেলা নেতাদের। নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি হলে ভোটের ফল পক্ষে যাবে না, এমন আশঙ্কা আগে থেকেই ছিল ক্ষমতাসীন দলে।

একক প্রার্থী সমর্থনে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা জ্যেষ্ঠ নেতাদের নিয়ে সাত বিভাগে সাতটি কমিটিও গঠন করে দিয়েছিলেন। কিন্তু বিদ্রোহী প্রার্থীদের নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয় তারা। আবার কোথাও কোথাও চাপের মুখে বিদ্রোহীরা সরে দাঁড়ালেও গোপনে তারা কাজ করেন দল সমর্থিত প্রার্থীর বিপক্ষে। আর এর প্রভাব পড়েছে ভোটে।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের রংপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ চৌধুরী ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমরা আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি একক প্রার্থী দিতে। কিন্তু সবার আত্মবিশ্বাস ছিল তারা জিতবে।’

সামনে আরো চার পর্বে হবে উপজেলা নির্বাচন। সামনের দিনগুলোতে বিদ্রোহীদের আয়ত্তে নিয়ে আসতে নতুন কোনো কৌশল দল নেবে কি না, জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বীর বাহাদুর বলেন, ‘আলোচনা চলছে। প্রথম পর্বে নির্বাচনের ফল দেখে দলের প্রতি যাদের ন্যূনতম ভালোবাসা আছে তারা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়ে দলের হয়ে কাজ করবে বলে আশা করি আমরা।’

কেন্দ্রীয় নেতাদের অযাচিত হস্তক্ষেপও কারণ : আওয়ামী লীগের একটি বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক তার এলাকায় ভোটের খারাপ ফল আর বিদ্রোহী প্রার্থীর জন্য দায়ী করেছেন একজন মন্ত্রীর হস্তক্ষেপকে। ঢাকাটাইমসকে ওই নেতা বলেন, ‘ওই মন্ত্রী তৃণমূলের মতামত উপেক্ষা করে নিজের পছন্দমতো প্রার্থী দিয়েছেন। এতে তৈরি হয়েছে বিদ্রোহী প্রার্থীর সমস্যা, আবার মন খারাপ করে অনেকে নির্বাচন থেকে নিজেদের সরিয়ে রেখেছে।’

পাবনাতেও তিনটির মধ্যে দুটি উপজেলায় আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী হেরে যাওয়ায় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকুকে দোষারোপ করছেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা। তারা বলছেন, সাঁথিয়া উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান নিজামউদ্দিনের জনপ্রিয়তা ছিল প্রশ্নাতীত। এবারও তিনি ভোট করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগ নেতা আবু সাইয়িদের পক্ষে কাজ করায় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকুর হস্তক্ষেপে আওয়ামী লীগ সমর্থন দেয় মঞ্জুর এলাহীকে। আর আওয়ামী লীগের এই ভাগাভাগির সুযোগ নিয়েছে জামায়াত।

কোন্দলের কারণে ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফের আটঘরিয়া (পাবনা), আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফের কুষ্টিয়া সদর, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর ভেড়ামারায়, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদের সিংড়ায় বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা জিতেছেন।

সিলেট বিভাগে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ বলেন, ‘মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের আরো বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে। দলের জন্য তাদের কাজ করতে হবে অন্যদের চেয়ে বেশি।’

দ্বিতীয় পর্বেও আছে বিদ্রোহী প্রার্থীর সমস্যা : দ্বিতীয় দফায় ১১৭ উপজেলায় ভোট হবে ২৭ ফেব্রুয়ারি। প্রথম পর্বের মতো এবারও আওয়ামী লীগের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বিদ্রোহী প্রার্থীরা।

পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগ সমর্থিত বেলায়েত হোসেনের পাশাপাশি আছেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের এক নেতাও।

ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈলে বিএনপির একক প্রার্থী থাকলেও নির্বাচনী লড়াইয়ে আওয়ামী লীগ থেকে আছেন একাধিক প্রার্থী।

রংপুর বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘সমস্যা খুব দ্রুতই সমাধান হবে।’

রাজশাহী বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ বলেন, ‘রাজশাহী বিভাগের ২২টি উপজেলার মধ্যে চারটিতে বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছে। আশা করি, তাদের আমরা বসিয়ে দিতে পারব।’

প্রথম পর্বের মতো এবার বিদ্রোহীদের বিষয়ে উদাসীন নয় আওয়ামী লীগ। এরই মধ্যে কয়েকজনকে নির্বাচনী মাঠ থেকে সরিয়ে দিতে পেরেছে দলটি।

চট্টগ্রাম বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক বীর বাহাদুর বলেন, ‘আমি বিদ্রোহী প্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলে সমঝোতার চেষ্টা করছি। আশা করি সমঝোতা হয়ে যাবে।’

নির্বাচনে যারা গো ধরে আছেন তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়াও শুরু করেছে আওয়ামী লীগ। দলের কথা অমান্য করে প্রার্থী হওয়ায় বহিষ্কার করা হয়েছে মানিকগঞ্জ সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জালাল উদ্দিন আহমেদ এবং মহিলা আওয়ামী লীগের সদস্য সালেদা ইসলামকে। বহিষ্কার করা হয়েছে ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল কাদের, নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টাম-লীর সদস্য খন্দকার রুহুল আমিনকেও।

ভোটে এগিয়ে আওয়ামী লীগ : প্রথম পর্বে বেশির ভাগ উপজেলায় বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা জিতলেও ভোট বেশি পেয়েছেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা। সব মিলিয়ে সরকারি দল সমর্থক চেয়ারম্যান প্রার্থীরা পেয়েছেন ২৭ লাখ ৪১ হাজার ২২১ ভোট। আর বিএনপি সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থীরা পেয়েছেন ২৫ লাখ ৪১ হাজার ৬৭৪ ভোট। সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী জামায়াত সমর্থিত প্রার্থীর চেয়ে দুই হাজার ৬০০ ভোটে এগিয়ে আছেন।

সাত বিভাগের পাঁচটিতেই বেশি ভোট পেয়েছে আওয়ামী লীগ। ঢাকা বিভাগের সরকারি দলের সমর্থকরা পেয়েছেন ৯ লাখ ২০ হাজার ৭৭৭ ভোট, আর বিএনপি সমর্থকরা পেয়েছেন ৭ লাখ ৬১ হাজার ৯৮৯ ভোট। বরিশাল বিভাগে আওয়ামী লীগ সমর্থকরা এক লাখ ৯৯ হাজার ৭৭০ ভোট পেলেও বিএনপি সমর্র্থকরা পেয়েছেন ২৫ হাজার ৫০৪ ভোট।

রংপুর বিভাগে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা পেয়েছেন ২ লাখ ৫৩ হাজার ৬১১ ভোট আর বিএনপি সমর্থিতরা পেয়েছেন ২ লাখ ৪৮ হাজার ৩৫৮ ভোট। খুলনা বিভাগে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা তিন লাখ ৫৭ হাজার ২২১ ভোট পেলেও বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা পেয়েছেন তিন লাখ ৭ হাজার ৭৬৮। সিলেট বিভাগে আওয়ামী লীগ সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থীরা পেয়েছেন তিন লাখ ৯৯ হাজার ১৭৯ ভোট। আর বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা পেয়েছেন তিন লাখ ৮৮ হাজার একভোট।

তবে রাজশাহী এবং চট্টগ্রাম বিভাগে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীদের চেয়ে বেশি ভোট পেয়েছেন। রাজশাহীতে বিএনপি সমর্থিত সব প্রার্থীর ভোট ছয় লাখ ৬০ হাজার ৯৬৮ ভোট আর আওয়ামী লীগ সমর্থিতদের ভোট ছিল ৫ লাখ ১১ হাজার ৮১০ ভোট। চট্টগ্রাম বিভাগে বিএনপি ভোট পেয়েছে মোট এক লাখ ৪৯ হাজার ১১৬টি, আর আওয়ামী লীগ সমর্থিতরা পেয়েছেন ৯৮ হাজার ৮৯৩ ভোট।



(ঢাকাটাইমস/২৫ফেব্রুয়ারি/টিএ/এআর/ ঘ.)