logo ২৫ মে ২০২৫
চেতনা লালন করার, রেকর্ড গড়ার নয়
নূরুজ্জামান মামুন
২২ মার্চ, ২০১৪ ১০:৫১:৪৯
image

আগামী ২৬ মার্চ লাখো কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গিত গেয়ে বিশ্ব রেকর্ড গড়া হবে। খবরটি শুনে ভীষণ আনন্দিত হয়েছিলাম। স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন আমার জন্ম হয়নি। সে কারণে অংশ নিতে পারিনি মুক্তিযুদ্ধে। এ ক্ষোভ আমার আজন্মের। যখনই সুযোগ হয় তখনই মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের ঋণ শোধ করার জন্য মন কেঁদে উঠে আমার । গত বছর ৫ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধাদের ডাকে রাজাকারদের ফাঁসির দাবি নিয়ে হাজির হয়ে ছিলাম শাহবাগে। কটা দিন যেতেই দ্বিতীয় প্রজন্মের মুক্তি যোদ্ধাদের চেতনা দেখে বিস্মিত হই। মন কষ্ট নিয়ে ফিরে আসি নীড়ে। এরপর আর যাওয়া হয়নি শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চে। এবারও সিদ্বান্ত নিয়ে ছিলাম জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে উপস্থিত হয়ে লাখো কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গিত গাইবো। রেকর্ড গড়ে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকব। লাগব হবে আমার মন কষ্ট। কিন্তু অনুষ্ঠানের জন্য ইসলামী ব্যাংক থেকে তিন কোটি টাকা নেয়ার ঘটনা আমাকে ভীষণ ভাবিয়ে তোলে। সে কারণেই আজকের এ লেখাটি। গণজাগরণ মঞ্চ থেকে দাবি তোলা হয়েছিল জামায়াতে ইসলামী পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলো রাষ্ট্রীয়করণের। বছর গড়িয়ে গেল কিন্তু সরকার সে দাবিতে কর্নপাত করল না। উল্টো জাতীয় সঙ্গিত গাওয়ার জন্য স্বাধীনতা বিরোধীদের প্রতিষ্ঠান ইসলামী ব্যাংক থেকে নেয়া হল তিন কোটি টাকা। ইসলামী ব্যাংক থেকে টাকা না নিয়ে সরকারি কোষাগার থেকে কি এ অর্থ ব্যয় করা যেত না? এতে কি সরকার বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংকটে পড়তো! নিশ্চয়ই না। অথচ গত সপ্তাহে আইসিসির নির্দেশনা না থাকা স্বত্ত্বেও ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে বঙ্গবন্ধু ষ্টেডিয়ামে আয়োজন করা হল টি ২০টি বিশ্বকাপ ক্রিকেটের উদ্ভোধনী অনুষ্ঠান। ইসলামী ব্যাংকের তিন কোটি টাকা যদি ক্রিকেট অনুষ্ঠানে এবং সেখান থেকে তিন কোটি টাকা লাখো কণ্ঠে জাতিয় সঙ্গীত গাওয়া অনুষ্ঠানে ব্যয় করা হত। তাহলে আমার মত অখ্যাত ব্যক্তিকে এসব নিয়ে কি কলম ধরতে হত! এবার আসা যাক মূল কথায়, আমরা যদি জাতীয় সঙ্গীতকে বুকে লালন না করি৤ তাহলে এ রেকর্ড গড়ে কি লাভ হবে ! গণমাধ্যমে ইসলামী ব্যাংকের তিন কোটি টাকা অনুদানের খবর প্রকাশ হবার পর ফেইসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে তুমল হইচই শুরু হয়৤ দুই মন্ত্রী সাংঘর্ষিক বক্তব্য রাখেন। ব্যাংকটির টাকা ফেরত দেয়া হবে কিনা জানি না৤ তবে বাকি যাদের টাকা নেয়া হয়েছে তাদের টাকা কি বৈধ ভাবে অর্জিত? সে কথা কেউ কি ভেবেছেন একবারও৤ যদি একটি টাকাও অবৈধ থেকে থাকে আর সে টাকা দিয়ে জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে বিশ্ব রেকর্ড গড়া হয় তা কি শুদ্ধ হবে? শুদ্ধ হলেও সীমান্তে কাঁটা তারে ফেলানীদের লাশ ঝোলা কি বন্ধ হবে? আমাদের স্বাধীন ভূমিতে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফ কর্তৃক নির্যাতন বন্ধ হবে? আমাদের সংস্কৃতির উপর কি ভিনদেশিদের আগ্রাসন বন্ধ হবে? সদ্য সমাপ্ত টি ২০টি বিশ্ব কাপ ক্রিকেটের উদ্ভোধনী অনুষ্ঠানে আমাদের মাটিতে আমাদের অর্থেই অপমানিত হল দেশের শীর্ষ সঙ্গিত শিল্পীরা৤ এসব কথা না হয় ভুলেই গেলাম৤ সংবাদকর্মী হিসাবে চলার পথে প্রায়ই দেখি, বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এসেম্বলিতে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশিত হয় না৤ উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আরো ভয়াবহ অবস্থা। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন একত্রিত হয়ে জাতীয় সঙ্গিত পরিবেশন করেন এমন খবর আমার জানা নেই। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজার হাজার শিক্ষার্থী অধ্যায়ন করেন এবং তাদের শ্রেণিতে পাঠদান ভিন্ন ভিন্ন সময় অনুষ্ঠিত হয়। এসব কারণে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একত্রে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করা সম্ভব নাও হতে পারে। তবে অন্তত প্রতিটি বিভাগের একই শিক্ষাবর্ষের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন একত্রে তো পরিবেশন করতে পারেন জাতীয় সঙ্গীত। এমনটি হয় বলেও আমার জানা নেই। এ ক্ষেত্রে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র তো আরো করুণ। উচ্চ মাধ্যমিক থেকে প্রাথমিক পর্যায়ে অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জাতীয় সঙ্গীত সঠিক ভাবে পরিবেশিত হয় না। বিশেষ করে গ্রামীণ জনপথে৤ এমনকি বহু প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের স্থানটি জরাজীর্ণ। সরকারি-বেসরকারি বহু প্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা নিয়ম অনুযায়ী উত্তোলন করা হয় না। হলেও এসময় পরিবেশন করা হয়না জাতীয় সঙ্গীত। প্রায়ই জাতীয় পতাকা অবমাননার ঘটনা ঘটছে৤ এমনকি জাতীয় পতাকা অবমাননায় জরিমানাও অতিসামান্য। যে কারণে ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময় অজির্ত লাল সবুজের রক্তিম পতাকা অবমাননায় অনেকে সাহস পায়। এজন্য উচিত কঠোর আইন প্রণয়ন। সর্বশেষ গণমাধ্যমে দেখলাম, জাতীয় সংসদের মাননীয় সংসদ সদস্যরাও রেকর্ড গড়ার জন্য জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার প্রাকটিস করলেন। তার মানে কি? আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি দেশের বর্তমান শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগ জাতীয় সঙ্গীত সঠিক ভাবে পরিবেশন করতে পারবে না। উচ্চ শিক্ষা শেষ করে যারা কর্ম জীবনে প্রবেশ করছেন তাদের কথা নাই বা বললাম। সর্বোপরি রেকর্ড সৃষ্টি হয় রেকর্ড ভাঙ্গার জন্য। আমাদের গড়া এ রেকর্ডও হয়তো এক সময় ভেঙ্গে ফেলবে অন্য কোন দেশ (যদিও এমনটা কামনা করি না)। তবে দেশের প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে যদি জাতীয় সঙ্গীতের চেতনা জাগ্রত করা যেত। তবে এ রেকর্ড হত চিরন্তন। পরিশেষে বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা বলে শেষ করছি আজকের এ লেখা। বেশ কয়েক বছর ধরে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে গবেষণার কাজ করছি। সেখানে দিনের কাজ শুরু করার পূর্বে দল বেধে জাতীয় পতাকা নিয়ে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করা হয়। হৃদয়ে তখন দেশে প্রেমের অন্য রকম স্পন্দন সৃষ্টি হয়। অন্তত কয়েক ঘন্টা হৃদয়ে দেশ প্রেম জাগ্রত থাকে। দেশের কথা হৃদয়ে থাকলে অনিয়ম বা দুর্নীতি করার চিন্তাও থাকে না। সে অভিজ্ঞতার আলোকে বলছি, রেকর্ড গড়ার চিন্তাবাদ দিয়ে সরকারের উচিত ছিল একটি আইন প্রণয়ন করা। যে আইনের মাধ্যমে সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানে দিনের কার্যক্রম শুরু করার পূর্বে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন হবে বাধ্যতামূলক। ভবিষ্যতে সরকার আমার এ ভাবনাটি ভেবে দেখতে পারে। তাহলে এক সময় হয়তো বাধ্যবাধকতার কারণে জাতীয় সঙ্গীত হৃদয়ে গেঁথে চেতনায় লালিত হবে৤ দেশপ্রেম জাগ্রত ও সমুন্নত হবে। দুর্নীতি বন্ধ হবে।


 


লেখক: সাংবাদিক