ঢাকা: ‘খাবার খাওয়ার সময় ছেলেকে বাম পাশে বসাতাম। মাছ বেছে খেতে পারতো না। বেছে দিতে হতো। সবজি খেতে চাইতো না। জোর করে খাওয়াতাম। এখন আমার বাম পাশটা খালি খালি লাগে।’ জলে ভেজা চোখে বলছিলেন কাজী মোহাম্মদ রেজওয়ানুল আহসান নাফিসের বাবা কাজী মোহাম্মদ আহসানউল্লাহ।
যুক্তরাষ্ট্রে নিউ ইয়র্কের ফেডারেল রিজার্র্ভ ব্যাংক ভবন বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনার অভিযোগে নাফিসকে ৩০ বছরের কারাদ- দিয়েছে দেশটির একটি আদালত। নর্থ কেরোলিনা ফেডারেল কারেকশনাল ইনস্টিটিউটে জায়গা হয়েছে তার। সেখানে পড়াশোনা, শরীর চর্চা ও ধর্ম চর্চা করে সময় কাটছে নাফিসের।
সম্প্রতি ঢাকার যাত্রাবাড়ীর বাসায় ঢাকাটাইমসের এই প্রতিবেদকের কথা হয় নাফিসের বাবা কাজী মোহাম্মদ আহসানউল্লাহর সঙ্গে। ছেলের কথা বলতে গিয়ে বারবার অশ্রুশিক্ত হচ্ছিলেন তিনি। ‘কী বলবো, আসলে কিছুই বলার নেই। ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। এখন কারো কাছেই কিছু চাই না। শুধু আল্লাহর কাছে নামাজ পড়ে দুহাত তুলে বলি-মাবুদ আমার ছেলেটাকে আমার বুকে ফিরিয়ে দাও।’ বলছিলেন নাফিসের বাবা। জানান, কারাবাসে থাকা ছেলের সঙ্গে মাসে তিনশ মিনিট কথা বলার সুযোগ পান তাঁরা। একবার ১৫ মিনিটের বেশি নয়। দিনে একাধিকবার কথা বলতে পারেন। তবে এক ঘণ্টা পর পর। যুক্তরাষ্ট্রের টেলিকম সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করে ব্যবস্থা করে নিয়েছে। এজন্য মাসে ৬০ ডলার অর্থাৎ ছয় হাজার টাকার মতো ব্যয় হয় তাঁর। ‘তাও ভালো। ছেলেটাকে দেখতে না পাই মুখের কথাটাতো শুনতে পাই।’
কী কথা হয় ছেলের সঙ্গে? মোহাম্মদ আহসানউল্লাহ ঢাকাটাইমসকে বললেন, ‘কুশলাদি বিনিময় হয়। ও অনেকের খবর জানতে চায়’। বলে ‘বাবা আমি ভাল আছি। মাকে বলে চিন্তা করো না, শুধু দোয়া করো।’ কিন্তু চাইলেই কি আর নিশ্চিতে ঘুমোতে পারি।’’ছেলেকে দেখতে যেতে মন চায়? নাফিসের বাবা বলেন, ‘চায় না আবার। কিন্তু ছেলের কথা বাবা তোমরা আমাকে দেখে যাওয়ার পর আমার এখানে থাকতে আরও কষ্ট হবে। মনে হবে এই বুঝি তোমাদের সঙ্গে শেষ দেখা হচ্ছে আমার।’ ছেলের কথা চিন্তা করে আর যাওয়া হয়নি আমেরিকায়।
সংশোধনী কেন্দ্রে থাকলেও পড়াশোনা ঠিকই চালিয়ে যেতে চায় নাফিস। ওই দেশে সে ব্যবস্থাও আছে। টাকা দিয়ে পড়া যায়। আবার টাকা ছাড়াও বেশ কয়েকটি বিষয়ে পড়ানো হয়। বিবিএ পড়া অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েছিল নাফিস। পরে ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে সার্ভার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু এখন কারাগারে ওই বিষয়টি পড়ার সুযোগ নেই। তাই হিউম্যান রিসোর্স (মানবসম্পদ) বিষয়ে পড়তে চায় সে। এজন্য টাকা দিতে হবে। নাফিসের বাবা ঢাকাটাইমসকে জানান, ‘এখন যেখানে আছে সেখানে এই বিষয়টি নেই। ওকে দেড় বছর এখানে বুনিয়াদি নানা বিষয় শেখার পর আবেদন করে অন্য কারগারে যেতে হবে। যেখানে মানবসম্পদ বিষয়টি পড়ানো হয়।’
কী থেকে কী হয়েছে, পত্রপত্রিকার বাইরে আর কিছুই জানা নেই নাফিসের পরিবারের। কখনও সুযোগ হয়নি এনিয়ে নাফিসের সঙ্গে বিস্তারিত কথা বলার। এখন কথা হলেও মামলার বিষয়ে কথা বলতে বারণ আছে। কখনো যদি ফোনালাপ বন্ধ হয়ে যায়-এই চিন্তা থেকে নাফিসের কাছে পরীক্ষামূলকভাবে একটি চিঠিও পাঠানো হয়েছে। দুটি ভাষায় লেখা হয়েছে চিঠিটি। একটি বাংলায়, অন্যটি ইংরেজিতে। ‘শুনেছি বাংলায় পাঠালে ইংরেজিতে অনুবাদ করে পড়া হবে চিঠিতে কী লেখা আছে। তার পর ছেলেকে দেয়া হবে। তাই দুই ভাষাতেই দিয়েছি। দেখি কোনটি আগে পায়।’ বলছিলেন নাফিসের বাবা।
নাফিসকে গ্রেপ্তার করার পর বাংলাদেশ থেকে কূটনৈতিক যোগাযোগ ঠিক রাখতে বেশ দৌড়ঝাঁপ করেছিল নাফিসের পরিবার। কিন্তু বেশ হয়রানির শিকার হতে হয়েছে তাদের। ঢাকাটাইমসকে মোহাম্মদ আহসানউল্লাহ বলেন, ‘‘দিনের পর দিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ধরণা দিয়ে একবারের মতো তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনির সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তিনি শুধু এটা বলেছিলেন, ‘আমরা দেখছি কী করা যায়। চেষ্টা চলছে।’ ব্যস, এটুকুই। তারপর আর কোনো অগ্রগতি দেখিনি। তাই আর কখনো কারো সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করিনি।’ তবে এখনও হাল ছাড়েননি নাফিসের বাবা। তাঁর বিশ্বাস ছেলেকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ফাঁসানো হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে সরকার প্রধান শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে চান তিনি। ‘আমার মনে হয় সরকার চাইলে কিছু করতে পারে। কিন্তু আমি যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাবো সেই উপায়টি নেই। একজন মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে দিনের পর দিন কেটে গেছে, এখন প্রধানমন্ত্রীর দেখা পাওয়া কি এতই সহজ হবে?’ বলছিলেন মোহাম্মদ আহসানউল্লাহ।
(ঢাকাটাইমস/০৫এপ্রিল/এইচএফ/এআর)