ঢাকা:এবারই প্রথম নয়। এর আগেও তাঁর নানাকা-ে ‘থ’ মেরেছে সবাই। কখনো পিস্তল উঁচিয়ে সড়কে ফেলে রাখা গাছ সরানো, কখনো চিকিৎসককে শৌচাগারে আটকে রেখে লাঞ্ছিত করা আবার কখনো প্রকাশ্য সভায় ‘হরতালকারীদের’ বাড়ি বাড়ি গিয়ে ‘হত্যার’ হুমকি দিয়ে আলোচনায় এসেছেন তিনি। আর এবার নিজ বাড়িতে ডেকে বিদ্যুৎ বিভাগের একজন উপসহকারী প্রকৌশলীকে ভরা মজলিসে পিটিয়ে মাথা ফাঁটিয়ে দিলেন। এই ‘তিনি’ হচ্ছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ এবং তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। তবে এত কিছুর পরও নির্লিপ্ত তিনি। আসলেই তিনি মন্ত্রী বটে! এমন মন্তব্য তাঁর ঘনিষ্ঠদের।
প্রকৌশলীর মাথা ফাটিয়ে দেওয়ার ঘটনায় রীতিমতো অসন্তোষ ছড়িয়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে। ভুল তো হতেই পারে, এজন্য শাস্তিরও ব্যবস্থা আছে। সেটা চাইলে দাপ্তরিকভাবেও নেওয়া যেত। তাই বলে গায়ে হাত তুলতে হবে! মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে আহত ওই উপসহকারী প্রকৌশলীর সহকর্মীদের। তাই মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকীর ‘বিচার’ দাবি করেন তারা। এজন্য সাতদিনের আলটিমেটামও দিয়েছিলেন ডিপ্লোমা প্রকৌশলী সমিতি এবং আইডিইবি, টাঙ্গাইল জেলা শাখা। পরে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী, পিডিবির চেয়ারম্যান এবং ডিপ্লোমা প্রকৌশলী সমিতির যৌথ বৈঠকে আলোচনার ভিত্তিতে সাময়িকভাবে আন্দোলন স্থগিত করা হয়।
ওই বৈঠকে উপস্থিত টাঙ্গাইলের কালিহাতী পিডিবির বিতরণ বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘এসব ব্যাপারে কথা না বলার জন্য উপর থেকে আমাদের ওপর চাপ আছে। নির্যাতিত হব কিন্তু বিচার চাইতে পারব না। কারণ, আমরা সরকারের চাকর আর তাঁরা মন্ত্রী। এটাই হচ্ছে ক্ষমতা, বুঝলেন ভাই।’
জানতে চাইলে ডিপ্লোমা প্রকৌশলী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফজলুর রহমান বলেন, ‘আপাতত আমরা আন্দোলন স্থগিত করেছি। আমরা বলেছি, টাঙ্গাইলের স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা যেন ভবিষ্যতে পিডিবির কর্মকা-ের ওপর কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ না করেন। প্রতিমন্ত্রী ও পিডিবির চেয়ারম্যান এ ব্যাপারে আশ্বস্ত করায় আমরা আন্দোলন তুলে নিয়েছি।’
মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকীর পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে কি না জানতে চাইলে ফজলুর রহমান বলেন, ‘উনি মন্ত্রী মানুষ। তিনি আবার কী ব্যাখ্যা দেবেন?’
তবে ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের সঙ্গে সমঝোতার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন পিডিবির চেয়ারম্যান মো. আব্দুহু রুহুল্লাহ। তিনি বলেন, ‘ওই ঘটনাটি ছিল একটা ভুল বোঝাবুঝি। মন্ত্রী কাউকে পেটাননি। আর ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের আন্দোলন সম্পর্কে আমার জানা নেই।’
এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ এবং তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
কী ঘটেছিল ওইদিন
টাঙ্গাইলের বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত ২৮ মার্চ সন্ধ্যায় লতিফ সিদ্দিকী কালিহাতী বিদ্যুৎ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীকে তাঁর কালিহাতীর বাসভবনে ডেকে পাঠান। কিন্তু নির্বাহী প্রকৌশলী এলাকার বাইরে থাকায় তিনি উপসহকারী প্রকৌশলী পূর্ণচন্দ্র পালকে মন্ত্রীর বাসায় যেতে বলেন। পূর্ণচন্দ্র পাল জানান, নির্বাহী প্রকৌশলীর কথামতো তিনি দুজন লাইনম্যানকে সাথে নিয়ে ওই বাসায় যান। এ সময় মন্ত্রী তার কাছে ইছাপুর ১১ কেভি ও কামার্থি ফিডারের বিদ্যুতের লোডশেডিং এবং ট্রান্সফরমার বরাদ্দ বিষয়ে জানতে চান। এ ব্যাপারে জবাব দেওয়ার সময় হঠাৎ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন লতিফ সিদ্দিকী। একপর্যায়ে হাতে থাকা লাঠি দিয়ে তাকে পেটান। পিটুনিতে পেটে আঘাত পান এবং মাথা ফেটে রক্ত ঝরা শুরু করে ওই উপসহকারী প্রকৌশলীর। পরে লাইনম্যান দুজন ও উপস্থিত আরেকজন তাকে নিয়ে কালিহাতী হাসপাতালে যান। একই দিন রাত আটটার দিকে মন্ত্রী লোক পাঠিয়ে পূর্ণচন্দ্রকে আবার তাঁর বাসায় যেতে বলেন। হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে বাসায় গেলে মন্ত্রী তার কাছে দুঃখ প্রকাশ করেন।
উপসহকারী প্রকৌশলীকে পিটিয়ে আহত করার সময় কালিহাতী উপজেলা পরিষদের নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান মোজাহারুল ইসলাম তালুকদার, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রফিকুল ইসলাম, কালিহাতীর পৌর মেয়র আনছার আলী ছাড়াও ২০-২৫ জন দলীয় নেতা-কর্মী ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী উপস্থিত ছিলেন।
লতিফ সিদ্দিকীর আরো যত কা-
টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতাল পরিদর্শনে গিয়ে একজন আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তাকে শৌচাগারে আটকে রেখে লাঞ্ছিত করেছিলেন মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী। এ ঘটনায় ওই সময় তাৎক্ষণিকভাবে হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নীরব থাকলেও বিষয়টিকে মোটেও ভালোভাবে নেননি তারা। সূত্রে জানা গেছে, চিকিৎসককে লাঞ্ছিত করার অভিযোগে পিডিবি কর্মকর্তাদের মতো তারাও আন্দোলনে নামবেন।
মানুষ পেটানো বা লাঞ্ছিতই নয়, বাড়ি বাড়ি গিয়ে হরতালকারীদের ‘হত্যার’ হুমকি দিয়েছেন তৎকালীন পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল। কিন্তু সকালে মন্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করার পর বিকালে তা খারিজ করে দেওয়া হয়।
গত বছরের ২৬ আগস্ট জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সেমিনারে লতিফ সিদ্দিকী বলেছিলেন, ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল পৃথিবীর সবচেয়ে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ। তাই ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে যারা হরতাল দেবে, তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হত্যা করতে হবে। কারণ, হরতালকারীরা আদালত অমান্যকারী ও রাষ্ট্রদ্রোহী।’ এর আগে ১৬ আগস্ট এক আলোচনা সভায়ও তিনি হরতালকারীদের বিরুদ্ধে একই ধরনের হুমকি দেন।
অপরদিকে, নবম জাতীয় সংসদে সর্বশেষ বাজেট অধিবেশনে লতিফ সিদ্দিকী বলেছিলেন, তিনি আর সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবেন না। সাংসদ হিসেবে এটাই তাঁর শেষ বক্তব্য। তবে শেখ হাসিনা দলীয় রাজনীতিতে যেভাবে তাঁকে চান, সেভাবেই কাজ করবেন তিনি। কিন্তু এরপর আবারও নিজের অবস্থান পাল্টে ফেলেন তিনি। গত বছরের ২০ নভেম্বর সংসদে দাঁড়িয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আগামী জাতীয় নির্বাচনে ভোটযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে চিরদিনের মতো নিপাত করতে নির্বাচনে অংশ নেব।’
(ঢাকাটাইমস/০২এপ্রিল/এইচএফ/এআর/ ঘ.)