ঢাকা: সরকারের অভিবাসন আইন ভেঙে ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হতে সরকারের একজন মন্ত্রী নানা চাতুরির আশ্রয় নিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। মালয়েশিয়ায় জি টু জি পদ্ধতিতে কর্মী পাঠানো সীমিত করে বেসরকারি পর্যায়ে কর্মী পাঠানোর ব্যাপারে উঠেপড়ে লেগেছেন জনশক্তি রপ্তানি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ওই মন্ত্রী।
বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার সরকারি বিভিন্ন পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জনশক্তি ব্যবসায়ী ওই মন্ত্রী ঘনিষ্ঠমহলে বলেছেন, মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ড. আহমদ জাহিদ হামিদিকে তিনি কব্জায় নিয়েছেন। ইতিমধ্যে গত ১২ মার্চ মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জি টু জি চুক্তির বাইরে দুই হাজার কর্মী পাঠানোর সুযোগ দিতে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনের কাছে একটি চিঠি দিয়েছেন বলে সূত্রে জানা গেছে। বিস্ময়কর হলো এই চিঠি দেয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানিকারক মন্ত্রী প্রভাব খাঁটিয়েছেন বলে ঘনিষ্ঠদের তিনি জানিয়েছেন। তবে জি টু জি চুক্তির বাইরে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে কোনো ভিসা না দিতে দেশটির বাংলাদেশ দূতাবাসের কাছে চিঠি দিয়েছে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়।
সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা ওই মন্ত্রী মালয়েশিয়ায় বেসরকারিভাবে কর্মী পাঠানোর বিষয়টি এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে চান, এমন আকাঙ্ক্ষাই সংশ্লিষ্টদের কাছে ব্যক্ত করেছেন। এনিয়ে জনশক্তি রপ্তানিকারকদের মধ্যেও এক ধরনের চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে বলে জানা গেছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, পেশায় ব্যবসায়ী বাংলাদেশ সরকারের ওই মন্ত্রী নাকি ঘনিষ্ঠদের বলেছেন, বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময় তারেক রহমানরা বেসরকারিভাবে কর্মী পাঠিয়ে শত শত কোটি টাকা কামিয়েছেন। আর আওয়ামী লীগ সরকারের সময় মন্ত্রী হয়ে তিনি চুপচাপ বসে থাকবেন এটা হতে পারে না। ওই মন্ত্রী নাকি ঘনিষ্ঠদের এও বলেছেন, অভিবাসন ব্যয় পাঁচ লাখ না সাত লাখ সেটি দেখা তার কাজ না। তার লক্ষ্য যেনোতেনো প্রকারে টাকা কামানো। মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাইয়ের সঙ্গে ব্যবসায়ীক চুক্তি হয়েছে তাই এনিয়ে চিন্তা নেই বলেও প্রচার করেছেন ব্যবসায়ী ওই মন্ত্রী।
নামমাত্র ৩৩ হাজার টাকা অভিবাসন ব্যয়ে সরকারিভাবে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানো শুর” হয়েছে ২০১৩ সালের এপ্রিল থেকে। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, অভিবাসন ব্যয় নামমাত্র হওয়ায় এখন আর সংশ্লিষ্ট কর্মীদের ভিটেমাটি বিক্রি করতে হচ্ছে না। কিন্তু বেসরকারি পর্যায়ে অতীতে যারা মালয়েশিয়ায় গেছেন তাদেরকে অন্তত সাড়ে তিন থেকে চার লাখ টাকা ব্যয় করতে হয়েছে। সর্বশেষ বিএনপি শাসনের শেষের দিকে ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শুরুর দিকে এ প্রক্রিয়ায় অনেক লোক মালয়েশিয়াতে গিয়েছিল। কিন্তু ভুয়া চাকরিসহ বিভিন্ন কারণে তাদের অনেকে অবৈধ হয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে তারা বাধ্য হয়ে রাস্তায় নেমে আসেন, আশ্রয় নেন ব্রিজের নিচে এখানে-সেখানে। রাস্তায় কর্মীদের লাগাতার অবস্থান ও বিক্ষোভে দেশটিতে সামাজিকভাবে বিপর্যয় নেমে আসে। কিন্তু সরকারের বারংবার চেষ্টার ফলে অবৈধ শ্রমিকদের এক পর্যায়ে বৈধ হওয়ার সুযোগ দেয়া হয়। তাছাড়া দীর্ঘ প্রায় পাঁচ বছর বন্ধ থাকার পর ২০১২ সালে মালয়েশিয়া বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিতে আগ্রহ দেখায়। তবে মধ্যসত্ত্বভোগী বা দালালের মাধ্যমে নয় সরাসরি সরকার পর্যায়ে চুক্তির মাধ্যমে। কারণ, মালয়েশিয়া সরকারও চেয়েছিল মধ্যসত্ত্বভোগীদের খপ্পরে পড়ে বিদেশে গমনেচ্ছুক কর্মীদের হয়রানি ও প্রতারণা বন্ধ হোক। দেশটির তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দাতো সেরি হিশামুদ্দিন তুন হুসেইন বাংলাদেশে জনশক্তি রপ্তানির সঙ্গে জড়িত মধ্যসত্ত্বভোগী ও দালালদের ‘দজ্জাল’ বলেও সম্বোদন করেছিল সংবাদ মাধ্যমের কাছে।
মধ্যসত্ত্বভোগীরা যেন বিদেশে যেতে ইচ্ছুক কর্মীদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা নিতে পারে এজন্য সরকার কর্মীদের নিবন্ধনের পদ্ধতি চালু করে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, একশ্রেণির রিক্রুটিং এজেন্সির আশঙ্কা এভাবে নিবন্ধনের মাধ্যমে কর্মী নেয়া হলে তারা লাভবান হতে পারবেন না। তাই তারা যে করেই হোক বেসরকারিভাবে বিদেশে লোক পাঠানোর সুযোগ সন্ধান করছেন। এদিকে আজ মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আহমদ জাহিদ হামিদি ঢাকা আসছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. দোলোয়ার হোসেন মনে করেন, দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা কাটিয়ে সরকারিভাবে মালয়েশিয়াতে কর্মী পাঠানোর যে প্রক্রিয়া শুর” হয়েছে তার পথে বাধা সৃষ্টির পায়তারা নিঃসন্দেহে আতঙ্কের। তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘মালয়েশিয়াতে সরকারিভাবে কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়া নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। কিন্তু রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর কারণে যদি এটি বন্ধ হয়ে যায় তবে তা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক হবে। যদি দুর্নীতিমুক্তভাবে সরকার বিদেশে কর্মী পাঠাতে পারে তাহলে এখানে বাধা দেয়ার কী আছে? বরং এটি চালিয়ে যাওয়া উচিত।’ তিনি বলেন, ‘বেসরকারি জনশক্তি রপ্তানিকারকদের জন্য তো অনেক দেশ আছে। তারা নতুন দেশে শ্রমবাজার সৃষ্টি কর”ক। তাছাড়া বেসরকারিভাবে কাজ নিয়ে বিদেশ যাওয়ার অভিজ্ঞতাও ভাল না। যারা এই ব্যবসার সঙ্গে আছেন তাদের উচিত বিদেশে গমনেচ্ছুকদের হয়রানি ও প্রতারণার হাত থেকে রেহাই দেয়া।’
অভিবাসীদের কল্যাণে যে আইন:
কাজ বিদেশে যেতে হয়রানি ও প্রতারণার হাত থেকে যেন কর্মীরা রক্ষা পান সে বিষয়টি মাথায় রেখেই গত বছর ‘বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসীকল্যাণ আইন ২০১৩’ করেছিল সরকার। আইন অনুযায়ী, সরকারি খাতায় নিবন্ধন ছাড়া কাউকে কাজের জন্য বিদেশে পাঠাতে পারবে না রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো। এজেন্টের মাধ্যমে বিদেশে যেতে আগ্রহীদের কাছ থেকে পাসপোর্টও তারা নিতে পারবে না। যে দেশে কর্মী পাঠানো হবে, সেই দেশের নিয়োগকর্তার সঙ্গে ওই কর্মীর চুক্তি স্বাক্ষর করবে রিক্রুটিং এজেন্সি। ওই চুক্তির কপি কর্মী পাঠানোর আগেই সংশ্লিষ্ট দেশের বাংলাদেশ মিশন বা দূতাবাসে পাঠাতে হবে এজেন্সিগুলোকে। আর চূড়ান্তভাবে কর্মীকে বিদেশ পাঠানোর আগে প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র দেখিয়ে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো থেকে ইলেক্ট্রনিক কার্ডে একটি বহির্গমন ছাড়পত্র নিতে হবে। আইনে বলা আছে এসব বিধানের কোনোটি অমান্য করলে বিভিন্ন মেয়াদের জেল ও জরিমানায় দণ্ডিত হতে হবে।
(ঢাকাটাইমস/৩১মার্চ/এআর/ঘ.)