ঢাকা: ঢাকার মোহাম্মদপুরে মোহাম্মদিয়া হাউজিং লিমিডেটের এক নম্বর সড়কে ভাড়া থাকেন বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা জামালগীর আলম। প্রতিবছরই গরমের মৌসুমে কিছুদিন পানি নিয়ে ঝামেলায় পড়েন তিনি। কিন্তু এবার সংকট শুরু হয়েছে ভালোভাবে গরম পড়ার আগেই। মার্চের মাঝামাঝি থেকে তার বাসায় পানি আসে না। তাই বাসা ছেড়ে কিছুদিন আত্মীয়ের বাসায়, দু-একদিন বন্ধুর বাসায় ছিলেন তিনি।
কিন্তু কতদিন আর অন্যের বাসায় থাকা যায়। এক সপ্তাহ পর তিনি বাসায় ফিরলেন। কিন্তু পানির খবর নেই। মাঝেমধ্যে সামান্য পানি আসে। কিন্তু চাকরির কারণে তিনি তো আর বাসায় থাকেন না, তাই পানি ধরার লোক নেই। অগত্যা পাঁচ লিটার পানির বোতল কিনে তা দিয়ে কোনো রকমে গোসল সারেন তিনি। একই অবস্থা এ বাসার অন্য বাসিন্দাদের।
কিন্তু এ সমস্যা কত দিন চলবে? যোগাযোগ করা হলে ঢাকা ওয়াসা এ সংকটের কথা স্বীকারই করতে চায় না। সংস্থাটির দাবি, পানি নিয়ে সংকট তো নেই-ই, বরং চাহিদার চেয়ে উৎপাদন বেশি, তাই উৎপাদন কমিয়ে রাখতে হচ্ছে তাদেরকে।
কিন্তু ওয়াসার এই দাবি কীভাবে বিশ্বাস করবেন জামালগীর আলম? ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন খাওয়ার পানি কিনে গোসল করি, এ অবস্থায় ওয়াসার এ দাবি আমাদের সঙ্গে রসিকতা ছাড়া আর কিছু মনে হচ্ছে না। ওরা যে মানুষের ভোগান্তিকে গায়েই মাখে না, এটাই তার প্রমাণ।’
কেবল মোহাম্মদিয়া হাউজিংয়ের এই সড়ক নয়, দুই ও তিন নম্বর সড়ক, পাশের মোহাম্মদিয়া হাউজিং সোসাইটির ছয় ও সাত নম্বর সড়ক, নবোদয় হাউজিং, শেখেরটেকের এক নম্বর ও দুই নম্বর সড়ক, আদাবর, শেওড়াপাড়া, পশ্চিম তেজকুনিপাড়া, বেইলি রোডসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকেও পানি সংকটের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। কোথাও পানি রাতে একবার আসে, কোথাও টানা দুই বা তিনদিন আসেই না। এ অবস্থায় বাসায় থাকাই কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে এসব এলাকার বাসিন্দাদের।
গরম ভালোভাবে পড়তে না পড়তেই পানির এমন সংকট হলে গরম বাড়লে কী হবে সে নিয়ে এসব এলাকার মানুষ রীতিমতো আতঙ্কিত। তবে মোহাম্মদপুর ও আদাবর এলাকার মানুষদের ধৈর্য ধরার অনুরোধ করেছে ওয়াসা। তারা জানায়, নবোদয় হাউজিং এবং শেখেরটেক এলাকায় দুটি পাম্প বসানো হচ্ছে। এগুলোর কাজ শেষ হবে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই। আর তখন এ এলাকায় পানির সংকট থাকবে না বলে জানিয়েছে রাজধানীতে পানি সরবরাহকারী সংস্থাটি।
পশ্চিম তেজকুনিপাড়ার বাসিন্দা মুশফিকুর রহমান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘১৪ মার্চ থেকে তাদের বাসায় পানির সংকট চলছে। দিনের মধ্যে ১০ থেকে ২০ মিনিট পানি আসে। যে পরিমাণ পানি আসে তাতে চাহিদার ১০ ভাগও পূরণ হয় না। পানির সংকটের কারণে তিন চারদিন তাদের বাসায় রান্না হয়নি। এছাড়া এই গরমের মধ্যে তাদের অনেককেই গোসল ছাড়া থাকতে হচ্ছে। ওয়াসার লোকজনের কাছে বিষয়টি বারবার অবহিত করার পরও তাদের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।’
মোহাম্মদপুর ও তেজকুনিপাড়ায় পানির সমস্যার বিষয়ে ওয়াসার জোন-৩ এর নির্বাহী প্রকৌশলী ওয়াব মিয়া বলেন, গ্রীষ্মের কারণে পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় পানির এই সংকট তৈরি হয়েছে। কিন্তু গরমের মৌসুম ঠিকঠাকভাবে পড়ার আগেই এমন সংকট কেন হবে, তার কোনো ব্যাখ্যা তিনি দিতে পারেননি।
পাইপলাইনে পানি না থাকায় ওয়াসার কর্মীদের জন্য ব্যবসার সুযোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মোহাম্মদপুর হাউজিং লিমিটেডের এক নম্বর সড়কে স্বর্ণকুঞ্জের একটি বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক এনামুল ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘পাম্প থেকে গাড়িতে করে পানি আনতে গেলে এখানকার লোকজন পাত্তা দিতে চায় না। বলে যান, দেখি। ফোনও ধরে না মাঝেমধ্যে। ২২ মার্চ ১০-১২ বার ফোন দিয়েছি। বলেছে রাতে পাঠাবে, কিন্তু পরে পানি পাঠায়নি। তাই বাসায় এক ফোঁটা পানিও নাই।’
অন্য একটি বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘একগাড়ি পানির দাম পাঁচশ টাকা হলেও আমরা দেই আটশ টাকা। তাও পানি দেয় না।’ ওদের নাকি চাপ থাকে খুব বেশি।
কেবল সরবরাহ সমস্যা নয়, অন্য সংকটও আছে। মালিবাগের শহীদবাগের বাসিন্দা আশরাফুল ইসলাম জানান, তাদের এলাকায় পানি সরবরাহ এখন পর্যন্ত বেশ ভালোই। কিন্তু যে পানি আসে, সেটা পান করার মতো নয়। পানি এতই দুর্গন্ধ যে, ফুটালেও তা দূর হয় না।
মালিবাগ মোড়ে একটি পানির কল থাকলেও ওটা থেকে সবাইকে পানি নিতে দেওয়া হয় না। ফুটপাতে পানির ব্যবসা করে এমন লোকজন এটা দখল করে রেখেছে, বাসাবাড়ি থেকে পানি নিতে এলে তাদের জন্য বিরাট লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।
তবে এসব সংকটের কথা মানতেই চায় না ওয়াসা। তাদের দাবি নারায়ণগঞ্জসহ রাজধানী ঢাকাকে মোট ১১টি জোনে ভাগ করে পানি সরবরাহ করা হয়। ঢাকা মহানগরীতে ২২৫ কোটি লিটার পানির চাহিদার বিপরীতে বর্তমানে ২৪২ কোটি লিটার পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। এর মধ্যে ৬শ ৬০ গভীর নলকূপের মাধ্যমে ৭৮ ভাগ ভূগর্ভস্থ পানি এবং সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট থেকে ২২ ভাগ পানি মূল চাহিদার যোগান দিচ্ছে।
ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচলক তাকসিন এ খান ঢাকাটাইমসকে বলেন, রাজধানীবাসীর পানির চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ পানি উৎপাদন হয়। এ অবস্থায় কোথাও সংকট হওয়ার কারণ নেই।
তবে কোনো কোনো এলাকায় একদিন বা দুইদিন সরবরাহে সদস্যা হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তিনি বলেন, কোথাও পাম্প নষ্ট থাকলে সাময়িক সময়ের জন্য পানির সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। একে আমরা বলি পকেট সমস্যা। যতদিন পর্যন্ত ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করা হবে ততদিন এ সমস্যা থাকবেই।
এ সমস্যা সমাধানে ওয়াসার পরিকল্পনা আছে জানিয়ে সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে পদ্মা ও মেঘনা নদী থেকে পানি আনার জন্য প্রকল্প হাতে নিয়েছেন তারা। প্রকল্প দুটির কাজ ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে।
পানি সংকটের জন্য রাজধানীবাসীরও দায় আছে। নিষিদ্ধ হলেও পানি টেনে নেওয়ার সাকিং মেশিন বসায় অনেক বাড়িতে। এতে সড়কের সামনের দিকের বাড়িগুলোতে পানি সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলেও পেছনের বাড়িগুলো পানি পায় না। অথচ এই মেশিন না থাকলে সবাই সমান পানি পেত। কিন্তু নিষিদ্ধ থাকলেও এ মেশিন বসানোর দায়ে কখনো কাউকে সাজা পেতে হয়নি।
ওয়াসা অবশ্য বলছে, নগরীর পানি সংকটের সমাধান কেবল একটি-দুটি বছরের পরিকল্পনা নয়, এর দীর্ঘমেয়াদি ও স্থানীয় সমাধানের জন্য কাজ চলছে। পদ্মা নদী থেকে পানি এনে দৈনিক ৪৫ কোটি লিটার পানি সরবরাহের লক্ষ্যে মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলার জশলদিয়া পানি শোধনাগার স্থাপন করা হচ্ছে। ২০০২ সালে প্রকল্প হাতে নেওয়া হলেও অর্থসংস্থান করতে না পারায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হয়নি। তবে ২০১২ সালের ২৫ অক্টোবর প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য চীনের সঙ্গে চুক্তি করে সরকার। শোধনাগার নির্মাণ, ৩২ দশমিক ৪১ কিলোমিটার পাইপলাইন বসানোসহ পুরো প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে তিন হাজার ৫০৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে চীনের এক্সিম ব্যাংক থেকে দুই হাজার ৪১৩ কোটি টাকা ঋণ পাওয়া যাবে। এছাড়া ওয়াসা তাদের নিজস্ব তহবিল থেকে ২২ কোটি টাকা দেবে। বাকি এক হাজার ৭৪ কোটি টাকা সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে জোগান দেওয়া হবে। ২০১৬ সালের জুনে এ কাজ শেষ করার কথা রয়েছে।
মেঘনা পানি শোধনাগারের বিষয়ে ওয়াসা সূত্র জানায়, মেঘনা নদীর পানি শোধনাগার বাস্তবায়িত হলে এ প্রকল্প থেকে প্রতিদিন ৫০ কোটি লিটার পানি উৎপাদন হবে। এ প্রকল্পে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে সাড়ে ৬৭ কোটি ডলার। এর মধ্যে ২৫ কোটি ডলার ঋণ দেবে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), ফ্রান্সের ফ্রেঞ্চ ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন (এএফডি) ১০ কোটি ডলার এবং ইউরোপিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক ১০ কোটি ডলার দেবে। বাংলাদেশ সরকার অর্থায়ন করবে সাড়ে ২২ কোটি ডলার। আগামী ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবে।
(ঢাকাটাইমস/২৫মার্চ/এমবি/ ঘ.)