ঢাকা: ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচনে ফল বিপর্যয়ের তিন মাস পর হয় বিএনপির জাতীয় সম্মেলন। বিএনপির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ৩ বছর পর আবার জাতীয় সম্মেলন হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি আর। সম্মেলন না হওয়ায় ৬ বছর ধরে কাউকে মহাসচিব নিয়োগ দিতে পারেনি দলটি। ২০১১ সালের ১৬ মার্চ মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের মৃত্যুর পর ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব হিসেবে দল চালাচ্ছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার পর তাকে নিয়ে কথা ওঠেছে দলের ভেতরে।
বিএনপির সম্মেলন হচ্ছে কি নাÑএমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঢাকাটাইমসকে বলেন, সম্মেলন কবে হবে এবং আদৌ হবে কি না সেটা দলের ও স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত হবে।
কবে নাগাদ সম্মেলন হতে পারে-এ প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, কবে সম্মেলন হতে পারে সেটা আমি এখনই বলতে পারব না, তবে বিএনপির সহযোগী সংগঠনগুলো নিজেদের ভেতর আলোচনার পর সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেবে কবে সম্মেলন হবে।
এটা কেবল মূল সংগঠনের নয়, বিএনপির সব অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের প্রায় সব কমিটির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও পুনর্গঠন হচ্ছে না। কমিটি পুনর্গঠন করতে গেলে কোন্দল আরও বাড়তে পারে, এই আশঙ্কায় কথা ওঠলেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হচ্ছে না।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঠেকাতে ব্যর্থ হওয়ার পর বিএনপিতে এ নিয়ে কথা হচ্ছে। উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে কমিটি পুনর্গঠনের। কিন্তু সে কাজও এগোচ্ছে না তেমন।
ঢাকা মহানগর কমিটি দিয়ে শুরু হবে পুনর্গঠন প্রক্রিয়া : জাতীয় নির্বাচন ঠেকাতে আন্দোলনে নিষ্ক্রিয় নেতাদের বাদ দেওয়ার দাবি ওঠেছে বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ে। নতুন সরকার গঠনের পর বিএনপিকে ঢেলে সাজানোর কথা জানিয়েছেন চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। শুরুতেই তিনি হাতে নিয়েছেন ঢাকা মহানগর কমিটির পুনর্গঠন।
২০১১ সালের ১৪ মে ঢাকা মহানগরে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হলেও দীর্ঘ আড়াই বছরেও হয়নি পূর্ণাঙ্গ কমিটি। আর আন্দোলনে ঢাকা মহানগরীর নেতা-কর্মীদের নিষ্ক্রিয়তার কারণে রীতিমতো ক্ষুব্ধ খালেদা জিয়া। শুরুতেই তাই মহানগর বিএনপিকে ঢেলে সাজাতে হাত দিয়েছেন তিনি।
বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা বলছেন, কমিটি পুনর্গঠন হলে বহু জাঁদরেল নেতা বাদ পড়বেন। আন্দোলন গড়ে তুলতে তরুণদের ওপরই নির্ভর করবেন খালেদা জিয়া। তবে বিষয়টি কবে নাগাদ শেষ হবে তা জানা নেই কারও।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য রফিকুল ইসলাম মিয়া ঢাকাটাইমস জানান, বর্তমানে বিএনপির সহযোগী সংগঠনগুলো সরকারবিরোধী আন্দোলনে অনেকাংশেই ব্যর্থ হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠেছে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের মধ্যে। একই সাথে বর্তমান কমিটিগুলোর মেয়াদও উত্তীর্ণ। এর ফলে বেগম খালেদা জিয়াসহ শীর্ষস্থানীয় নেতারা সহযোগী সংগঠনগুলোকে নতুন আঙ্গিকে সাজাতে চিন্তা-ভাবনা করছেন। শিগগিরই কমিটিগুলো পুনর্গঠন করা হবে।
কৃষক দলের সাধারণ সম্পাদক ও বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শামসুজ্জামান দুদু ঢাকাটাইমসকে বলেন, কমিটির পুনর্গঠন সভা-সমাবেশ ও কাউন্সিলের মধ্য দিয়ে হয় কিন্তু সরকারবিরোধী আন্দোলন বেগবান করতে খুব তাড়াতাড়ি ঢাকা মহানগর কমিটি পুনর্গঠনের পাশাপাশি বিএনপির অঙ্গ-সংগঠনগুলোকেও ঢেলে সাজানো হবে।
অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের অবস্থাও একই :
ছাত্রদলের সর্বশেষ কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণা হয় ২০১১ সালে। নিয়ম অনুযায়ী দুই বছরের মধ্যে নতুন কমিটি দায়িত্ব নেওয়ার কথা থাকলেও এ সময়ের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটিই গঠন করা হয়নি।
নির্বাচনের সময় নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলন চলাকালে ছাত্রদলের নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে রীতিমতো ক্ষুব্ধ খালেদা জিয়া। সম্প্রতি সংগঠনের নেতাদেরকে ডেকে নিজের মনোভাব জানিয়েছেনও তিনি। আন্দোলনের সময় দেওয়া টাকা আত্মসাতের বিষয়েও কথা বলেন খালেদা জিয়া।
ছাত্রদলের মূল কমিটির বেশিরভাগেরই নিয়মিত ছাত্রত্ব নেই। ব্যবসা-বাণিজ্য করেন তারা, বিয়ে করে সংসারও হয়েছে অনেকের। কারো কারো সন্তানও স্কুলে পড়ে। এসব নিয়ে সংগঠনের মধ্যে দলাদলি আর কোন্দল ছড়িয়েছে সব পর্যায়ে। তাই ছাত্রদলকে পুনর্গঠন করে নিয়মিত ছাত্রদের হাতে নেতৃত্ব ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয়ে কথা হচ্ছে নির্বাচনের পর থেকে।
জানতে চাইলে এ বিষয়ে ছাত্রদলের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন উজ্জ্বল ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘যদিও ছাত্রদলের কমিটির মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে কিন্তু ছাত্রদল এবং কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। তাছাড়া আমাদের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়েছিল ২০১৩ সালে। তাই এখনই নতুন কমিটি করা অসুবিধাজনক।’
বিএনপির আরেক সহযোগী সংগঠন যুবদলের সর্বশেষ কমিটি করা হয়েছিল ২০১০ সালের ১ মার্চ। এ কমিটির সভাপতি সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল এবং সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম নীরবকে আর যুবক বলা যায় না কোনোভাবেই। কমিটির অন্য সদস্যদের অবস্থাও একই রকম। সত্যিকার যুবকদের হাতে নেতৃত্ব তুলে দেওয়ার দাবি আছে সংগঠনের ভেতরেই।
যুবদলের সহ-পল্লী উন্নয়ন বিষয়ক সম্পাদক হাজী মো. ইউসুফ ঢাকাটাইমসকে বলেন, সরকারবিরোধী আন্দোলন বেগবান করতে এবং যুবদলকে শক্তিশালী করতে বর্তমান মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি সবার আগে পুনর্গঠন করতে হবে। কারণ বর্তমান কমিটির যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তারা গত ৫ জানুয়ারির নির্বাচন রুখতে ব্যর্থ হয়েছেন এবং সরকারবিরোধী আন্দোলনেও কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি।
বিএনপির সহযোগী সংগঠনের মধ্যে অন্যতম স্বেচ্ছাসেবক দল। ছাত্রদল এবং যুবদলের পর এ সংগঠনকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয় বিএনপি। এ কমিটির সভাপতি হাবিব-উন-নবী খান সোহেল এবং সাধারণ সম্পাদক মীর সরফত আলী সপু সাড়ে তিন বছর ধরে আছেন নেতৃত্বে। এ সংগঠনের সব শেষ কমিটি করা হয় ২০১০ সালের অক্টোবরে। ২০১৩ সালে মেয়াদ শেষ হলেও নতুন কমিটি গঠনের কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি।
স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক মীর সরফত আলী সপু ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘বর্তমানে আমরা একটি মেয়াদ উত্তীর্ণ কমিটি নিয়ে দল পরিচালনা করছি। কিন্তু কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে কাউন্সিলের মধ্য দিয়ে নতুন একটি কমিটি গঠন করার দাবি জানিয়ে আসছি। হয়ত উপজেলা নির্বাচনের পর সম্মেলন হবে।’
বিএনপির আরেক আলোচিত সহযোগী সংগঠন শ্রমিক দলের কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে দেড় বছর আগে। এ সংগঠনের সর্বশেষ কমিটি গঠন করা হয় ২০১০ সালের ৬ জুন। এরপর আর কমিটি কেন গঠন করা হয়নিÑজানতে চাইলে শ্রমিক দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান বলেন, ‘বর্তমান কমিটি পুনর্গঠনের বিষয়ে এক সপ্তাহ আগে আমরা সমাবেশ করেছি। আগামী এপ্রিল নাগাদ সম্মেলন করার কথা ভাবছি।’ তিনি বলেন, ‘বর্তমান কমিটি মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ায় সংগঠনের মধ্যে এর প্রভাব পড়েছে। আমরা চাচ্ছি সংগঠনকে শক্তিশালী করতে নতুন নেতৃত্বকে সুযোগ দেওয়া হোক।’
বিএনপির আরেক সহযোগী সংগঠন তাঁতী দলের অবস্থা আরও খারাপ। এ সংগঠনের কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে সাড়ে তিন বছর আগে। ২০০৮ সালের ২৩ মে গঠিত কমিটি কাজ করছে এখনো। সংগঠনের সহ-সভাপতি মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম মিন্টু বলেন, ‘বর্তমান কমিটি অনেকাংশে সরকারবিরোধী আন্দোলনে রাজপথে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে তাঁতীদলের তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা চাচ্ছে বেগম খালেদা জিয়া দলকে শক্তিশালী করার জন্য যোগ্য নেতাদের হাতে সংগঠনের দায়িত্ব দিক।’
কৃষক দলের সর্বশেষ কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণা হয় ২০০৭ সালে। নিয়ম অনুযায়ী তিন বছরের মধ্যে নতুন কমিটি দায়িত্ব নেওয়ার কথা থাকলেও এ সময়ের মধ্যে কমিটিই গঠন করা হয়নি। ২০০৭ সালে কৃষক দলের সভাপতির মৃত্যুর পর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পান মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তিন বছরের মধ্যে নতুন কমিটির দায়িত্ব নেওয়ার কথা থাকলেও এখনো ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং সাধারণ সম্পাদক হিসেবে শামসুজ্জামান দুদু দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। তবে শামসুজ্জামান দুদু ঢাকাটাইমসকে বলেন, খুব শিগগিরই সম্মেলনের মধ্য দিয়ে নতুন কমিটি গঠন করা হবে।
মৎস্যজীবী দলের সর্বশেষ কমিটি করা হয়েছিল ২০১১ সালের ১৩ ডিসেম্বর। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দুই বছরের মধ্যে নতুন কমিটির দায়িত্ব নেওয়ার কথা থাকলেও এখনো সভাপতি হিসেবে আলহাজ রফিকুল ইসলাম মাহতাব এবং ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মো. নুরুল হক মোল্লা দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। নেতৃত্ব নিয়ে দলাদলির কারণে এ সংগঠনটিও অকার্যকর হয়ে পড়েছে। কমিটির সহ-সভাপতি রফিকুল ইসলাম মাহতাব বলেন, ‘আমরা চাচ্ছি দলকে উজ্জীবিত করতে নতুন নেতৃত্ব আসুক। কিন্তু বেগম খালেদা জিয়া যেভাবে চাইবেন আমরা সেভাবেই কাজ করব এবং দলকে সাজাবো।’
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত শিরিন সুলতানা মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদিকা। তিনি এই দায়িত্ব পান ২০১০ সালের ২৬ এপ্রিল। এরপর থেকে এই সংগঠনে বলতে গেলে তার একাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কমিটি পুনর্গঠন নিয়ে বেশ কয়েক দফা অন্য নেত্রীরা দাবি জানিয়েছেন। তবে শিরিন সুলতানা মনে করেন, তিনি যথাযথভাবেই কাজ করছেন। এই সময়কে তিনি বলেন, ‘আমাদের কমিটিকে নতুন আঙ্গিকে ঢেলে সাজানো হবে কি না সেই বিষয়ে চেয়ারপারসনের কোনো নির্দেশনা এখনও আমরা পাইনি। চেয়ারপারসন যদি চান তাহলে অবশ্যই আমরা মহিলা দলকে আরো বেশি শক্তিশালী করার জন্য নতুন নেতৃত্বকে সুযোগ দিতে প্রস্তুত থাকব।
জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থা-জাসাসের সভাপতি এম এ মালেক ঢাকাটাইমসকে বলেন, দলকে ঢেলে সাজাতে এবং নতুন নেতৃত্বের জন্য আমরা আবেদন করেছি। তা সত্ত্বেও দলের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত আমাদের কিছু জানানো হয়নি।
(ঢাকাটাইমস/১৮ মার্চ/কেএস/এআর)