logo ০৩ মে ২০২৫
সময়মতো উৎপাদনে আসতে পারছে না বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো
হাবিবুল্লাহ ফাহাদ, ঢাকাটাইমস
১৩ মার্চ, ২০১৪ ২০:০৫:০৩
image


ঢাকা: বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে সারা দেশে বিদ্যুৎ সংকট ছিল অসহনীয়। এই সংকট দূর করার অঙ্গীকার করেই ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে যায় আওয়ামী লীগ। গত পাঁচ বছরে বিদ্যুৎখাতে উন্নয়ন হয়েছে অভাবনীয়ই। তবে উন্নতি আরও হতে পারতো। সময় মতো বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে এলে বিদ্যুতের এখন যে ঘাটতি আছে তাও পূরণ করা সহজ হতো।  

মহাজোট সরকারের আমলে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। তিন হাজার দুইশ মেগাওয়াটের কিছু বেশি উৎপাদন নিয়ে শুরু করা আওয়ামী লীগের আমলে সর্বোচ্চ উৎপাদন হয়েছে ৬ হাজার ৭০০ মেগাওয়াটের বেশি। ভারত থেকেও এরপর এসেছে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। আরও নতুন কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসার কথা আছে আগামী কয়েক মাসে। সব মিলিয়ে এবার বিদ্যুতের সর্বোচ্চ সরবরাহ সাড়ে সাত হাজার মেগাওয়াট ছাড়াবে বলে আশা করছে সরকার।

তবে সাফল্যের এই চিত্রের বিপরীতে ব্যর্থতাও আছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের কার্যাদেশ দেয়ার পরও সময়মতো উৎপাদনে আসতে পারছে না বেশ কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র। গত ফেব্রুয়ারি মাসে আসার কথা ছিল এমন একটি কেন্দ্রও এখন পর্যন্ত আসতে পারেনি উৎপাদনে। মার্চে আসার কথা এমন একটি কেন্দ্রও আসবে না সময় মতো। কেবল এই দুই মাস না, গত ডিসেম্বরে আসার কথা ছিল এমন কেন্দ্রও এখনও আসেনি উৎপাদনে।  

বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশির ভাগই আর্থিক সংকটে এগোতে পারছে না। আবার যারা কাজ শেষ করে এনেছেন তারাও উৎপাদনে যেতে পারছেন না জ্বালানির অভাবে।

জানতে চাইলে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) চেয়ারম্যান মো. আব্দুহু রুহুল্লাহ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘এ বছরের শুরুর দিকে যেসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বাণিজ্যিক উৎপাদনে আসার কথা ছিল সেগুলো কিছু কারিগরি সমস্যার কারণে সময়মতো আসতে পারেনি। তবে যত দ্রুত সম্ভব উৎপাদনে আসার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আশা করা যাচ্ছে কম সময়ের মধ্যেই বেশ কয়েকটি কেন্দ্র চালু হবে।’

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বুয়েট অধ্যাপক ইজাজ আহমেদ মনে করেন, যারা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ নিয়েছেন কিন্তু করতে গড়িমসি করছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া। তিনি ঢাকাটাইমস বলেন, ‘যারা দরপত্রের মাধ্যমে বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ নিয়েছে তাদের আগেই চিন্তা করা দরকার ছিল কী ধরনের আর্থিক সঙ্গতি থাকা প্রয়োজন ছিল। এখন তাদের আর্থিক সংকটের কারণে তো রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে না।’  

কী অবস্থায় আছে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্যমতে, চুক্তি অনুযায়ী এ বছরের ফেব্রুয়ারি ও মার্চে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে পাঁচটি বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসার কথা ছিল। কিন্তু এখনও গড়ে ২৫ ভাগ কাজ বাকি আছে। আবার এ বছরের ডিসেম্বরে উৎপাদনে আসার কথা এমন আটটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজও চলছে ধীরগতিতে। বেশির ভাগই আছে প্রাথমিক পর্যায়ে।

সরকারিখাতে ১৫০ মেগাওয়াটের সিরাজগঞ্জে পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্টকে ২২৫ মেগাওয়াটে (কম্বাইন্ড সাইকেল) উন্নীত করার কাজ করছে চায়না মেশিনারিজ এক্সপোর্ট ইমপোর্ট করপোরেশন। ২০১২ সালের ৮ আগস্ট এ বিষয়ে চুক্তি হয়েছে। কথা গ্যাস ও ডিজেলচালিত এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি এ বছরের মার্চে উৎপাদনে আসবে। কিন্তু সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী এখনও ২০ ভাগ কাজ বাকি আছে। যা শেষ করতে আরও কয়েক মাস লেগে যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বেসরকারি খাতে রাজশাহীর নাটোরে ৫০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির কাজ করছে রাজ-লঙ্কা পাওয়ার লিমিটেড। গত বছরের ১৫ জানুয়ারি চুক্তি হওয়া এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটির উৎপাদনে আসার কথা ছিল এ বছরের জানুয়ারিতে। কিন্তু সার্বিক দিক বিবেচনায় এক মাস বাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তারপরও বাণিজ্যিক উৎপাদনে আসতে ব্যর্থ হয়েছে কেন্দ্রটি। এখনও ১৪ ভাগ কাজ বাকি আছে। এ জন্য জরিমানা গুনতে হবে প্রতিষ্ঠানটিকে।

একই অবস্থায় চট্টগ্রামের ৫০ মেগাওয়াট বারাকা-পতেঙ্গা বিদ্যুৎকেন্দ্রটির। বরকতউল্লাহ ডায়নামিকে গত ২০১১ সালের ৩১ জুলাই কাজটি দেয়া হয়। সর্বশেষ সময় অনুযায়ী ২০১২ সালের ২৭ অক্টোবর উৎপাদনে আসার কথা ছিল কেন্দ্রটির। কিন্তু আসতে না পারায় জরিমানার বোঝা মাথায় নিয়ে এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে বাণিজ্যিক উৎপাদনে আসার সম্ভাবনা থাকলেও এখনও ১০ ভাগ কাজ বাকি আছে। ডিজিটাল পাওয়ার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস গগননগরে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র ইতিমধ্যে উৎপাদনে যাওয়ার প্রস্তুতি শেষ করে এনেছে।

সর্বশেষ বেঁধে দেয়া সময় অনুযায়ী ২০১৩ সালের ৭ জানুয়ারি উৎপাদনে আসার কথা ছিল মুন্সীগঞ্জের কাঠপট্টিতে ৫০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্রটির। সিনহা পিপলস এনার্জি লিমিটেডের এই কেন্দ্রটি নির্ধারিত সময়ে বাণিজ্যিক উৎপাদনে আসতে পারেনি। জরিমানার বোঝা মাথায় নিয়ে এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে উৎপাদনে আসার কথা ছিল কাঠপট্টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের। কিন্তু সরকারি হিসেবে এখনও ২০ ভাগ কাজ শেষ করতে পারেনি সিনহা পিপলস এনার্জি।

ইসিপিভি চিটাগাং লিমিটেড কাজ নিয়েছিল চট্টগ্রামের পটিয়ার ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের। নির্ধারিত সময়ে গত বছরের ১৪ জুলাই বাণিজ্যিক উৎপাদনে আসতে পারলে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা বাড়তো ১০৮ মেগাওয়াট। কিন্তু এ বছরের মার্চেও উৎপাদনে আসতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি। সাইট পরিবর্তনের কারণে এখনও ২০ ভাগ কাজ বাকি আছে। জরিমানা থেকে রেহাই মিলবে না তাদেরও। মেঘনাঘাটে ৪৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ করছে সামিট পাওয়ার। নির্ধারিত সময় অনুযায়ী এ বছরের জানুয়ারিতে গ্যাস ও জ্বালানি তেলনির্ভর কেন্দ্রটির একটি অংশ বাণিজ্যিক উৎপাদনে আসার কথা ছিল। কিন্তু এখনও উৎপাদনে যেতে পারেনি তারা। চারভাগের এক ভাগ কাজ এখনও বাকি।  

১০৮ মেগাওয়াটের ঘোড়াশাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ পেয়েছে রিজেন্ট এনার্জি অ্যান্ড পাওয়ার লিমিটেড। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ফেব্রুয়ারির মধ্যে বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাবে বললেও একটুর জন্য এখনও আটকে আছে।

আর্থিক সংকটে উদ্যোক্তারা

কাজ নিয়ে সময়মতো করতে না পারায় প্রকল্প ব্যয় দিন দিন বাড়ছে। তাই বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ শেষ করতে একের পর এক সময় নিলেও হিমশিম খাচ্ছেন উদ্যোক্তারা। এজন্য ব্যাংকগুলো থেকেও প্রয়োজনীয় ঋণ সুবিধা পাচ্ছেন না তারা। তাই ঝুঁকছেন বিদেশি ব্যাংকগুলোর দিকে। সেখান থেকে টাকা এনে কাজ করতে গিয়েই দেরি হচ্ছে অনেক প্রতিষ্ঠানের। বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ করছেন এমন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে এ সব তথ্য মিলেছে।

জানতে চাইলে পিডিবির সদস্য (কোম্পানি অ্যাফেয়ার্স) তমাল চক্রবর্তী বলেন, অধিকাংশ কেন্দ্রই অর্থ সংকটে কাজ শুরু করতে পারছে না। পিডিবির পক্ষ থেকে নিয়মিত চাপ দেয়া হচ্ছে। সময়মতো কাজ শেষ করতে না পারলে চুক্তি অনুযায়ী জরিমানাও আদায় করা হবে বলে জানান তিনি।

উৎপাদনে আসার তাগিদ

ঘোড়াশাল ১০৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রকে বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ।  এছাড়া বরকতউল্লা ডায়নামিকের পতেঙ্গা ৫০ মেগাওয়াট এবং সিনহা পিপলস এনার্জির কাঠপট্টি ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রে দ্রুত উৎপাদন শুরুর জন্য তাগিদ দেয়া হয়েছে। ইসিপিভি চিটাগাংয়ের জুলদা ১০০ মেগাওয়াট কেন্দ্রটিও শেষপর্যায়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানা গেছে।  

পিডিবি মূল্যায়নে অগ্রগতি হচ্ছে

সম্প্রতি পিডিবির এক মূল্যায়নে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো স্থাপনে অগ্রগতি দেখা গেছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে উৎপাদনে আসতে না পারলেও অনেক কাজ প্রায় গুছিয়ে এনেছে। শিগগির বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাওয়ার সম্ভাবনাও আছে কয়েকটির।  পিডিবির মূল্যায়নে বলা হয়, মাঝারি ১০ বিদ্যুৎকেন্দ্র ‘সি’ ক্যাটাগরি থেকে বের হতে পারছে না। উদ্যোক্তারা বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র বানাতে ব্যর্থ হওয়ার পর মাঝারি আকারের বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি করে সরকার। এমন ১৮টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে ১০টিই সি ক্যাটাগরিতে আছে। ২০১২ এবং ২০১৩ সালে এদের বাণিজ্যিক উৎপাদনে আসার কথা ছিল।

(ঢাকাটাইমস/১৩মার্চ/এইচবি/এআর/ ঘ.)