logo ০৩ মে ২০২৫
বর্জ্যে প্রাণ যাচ্ছে নদীর, উপায় কী?
তানিম আহমেদ, ঢাকাটাইমস
১১ মার্চ, ২০১৪ ১১:০৪:২৯
image


ঢাকা: বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জের গনি মাঝি ২৫ বছর ধরে নৌকা চালান ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীতে। যুবক বয়সে যখন ঢাকায় আসেন তখনও বুড়িগঙ্গায় টলমলে পানি। ধরা পড়তো প্রচুর মাছ। প্রবীণ বয়সে পেটের টানে এখনও নদীতে ভেসে বেড়ালেও আর ভালো লাগে না গনি মাঝির। নদীজুড়ে নালার মতো দুর্গন্ধ। পেট চালানোর দায়ে তবু কোনো মত সহ্য করে চলা।   

বাবুবাজার ব্রিজের নিচ থেকে ওয়াইজঘাট পর্যন্ত যেতে যেতে কথা হয় গনি মাঝির সঙ্গে। দুঃখ করে তিনি বলেন, ‘এইহানে এই নদীর পানি ভালো আছিলো। হগলে গোসল করতো। আর এহন গোসল তো দূরের কতা, নদীর ধারেই থাহন যায় না’।

সদরঘাট এলাকায় স্থানীয় একজন বলেন, ‘ছোটোবেলায় এই নদীতে কত খেলা করতাম। সাঁতার কাটতাম, মাছ ধরতাম। কিন্তু শহরের যত ময়লা আবর্জনা পড়ে নদীটাকে মেরে ফেলেছে। কেবলই আফসোস হয়। টেলিভিশনে দেখি অন্যান্য দেশে শহরের নদীকে ঘিরে তৈরি হয়েছে বিনোদন কেন্দ্র। আর আমাদের এখানে না পারতে আমরা যাই না নদী তীরে’।  

বুড়িগঙ্গার মতোই দশা তুরাগ নদীর। বর্ষাকাল ছাড়া বছরের বাকি মৌসুমে নদীর পানি থাকে একেবারে কালির মতো। শিল্প কারখানার অপরিশোধিত বর্জ্যরে সঙ্গে রাজধানীর গৃহস্থালী বর্জ্যরে একটি বড় অংশ সরাসরি পড়ে নদীতে। পাশাপাশি আছে পয়ঃবর্জ্যরে বেশিরভাগ ঢাকার পাশের অন্য দুই নদী বালু ও শীতলক্ষ্যা একটু দূরে থাকায় সেগুলোর অবস্থা অতটা খারাপ না। কিন্তু দূষণ থেকে মুক্ত না সেগুলোও। সরকারি হিসাবে ঢাকার চার নদীতে এ রকম নানা ধরনের বর্জ্যমুখ আছে আড়াইশটিরও বেশি।

এসব বর্জ্যমুখ বন্ধে নানা সময় উদ্যোগ নেয়া হলেও কাজের কাজ হয়নি কিছুই। বরং এর দায় কার, সেটা নিয়েই বিতর্ক করছে সরকারি বিভিন্ন সংস্থা। এক সংস্থা এর জন্য দায় দিচ্ছে সিটি করপোরেশনকে তো সিটি করপোরেশন দায় দিচ্ছে ওয়াসাকে, আবার ওয়াসা দায় দিচ্ছে সিটি করপোরেশন আর পরিবেশ মন্ত্রণালয়কে। আবার পরিবেশ মন্ত্রণালয় দায় দিচ্ছে সিটি করপোরেশন আর শিল্প মন্ত্রণালয়কে। কিন্তু সবাই মিলে বসে একসঙ্গে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে না। আর এ কারণে ঢাকা ঘিরে চার নদী নিয়ে রাজধানীবাসীর হতাশাও হচ্ছে চিরস্থায়ী।

জানতে চাইলে ঢাকা সিটি করপোরেশন (দক্ষিণ) এর সহকারী প্রকৌশলী এ এইচ এম আবদুল্লাহ হারুণ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘নদী দূষণে আমাদের কোনো দায় নেই। শহরের ময়লা আমরা নিয়ম মেনে নির্দিষ্ট জায়গায়ই ফেলি। নদীতে ফেলা হয় না এসব। তবে সিটি করপোরেশনের বাইরের দক্ষিণখান, কেরানীগঞ্জ, মাতুয়াইলসহ বিভিন্ন এলাকার বর্জ্য ফেলা হয় নদীতে। এ কারণে তার দায় না থাকলেও কথা শুনতে হয় সিটি করপোরেশনকে’।





সিটি করপোরেশনের কি তাহলে কিছুই করার নেই? জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘এসব এলাকা আমাদের অধীনে আনলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে। কামরাঙ্গীরচর এলাকার মানুষ আগে নদীতেই ফেলতো বর্জ্য। এলাকাটি আমাদের অধীনে আসার পর এখন এলাকার বর্জ্য ফেলা হয় নির্দিষ্ট এলাকাতে’। তিনি বলেন, ‘তবে কেবল সরকারি সংস্থা কাজ করবে-এটা হলে পরিবেশ ঠিক রাখা যাবে না। নগরবাসীকেও পরিবেশ রক্ষায় সচেতন হতে হবে। তাদেরকে বুঝতে হবে পরিচ্ছন্ন নগর না থাকলে তাদেরকেই ভোগান্তি পোহাতে হবে’।

জানতে চাইলে ঢাকা ওয়াসার সহকারী ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামরুল আলম চৌধুরী ঢাকাটাইমসকে বলেন, সমগ্র ঢাকা শহরের ৪০ শতাংশ পয়ঃনিষ্কাশনের আওতায় আছে। যদি সমগ্র ঢাকা পয়ঃনিষ্কাশনের আওতায় আসে তাহলে সমস্যার সমাধান হবে। আর আমরা পয়ঃনিষ্কাশনের একটা মস্টার প্ল্যান আমরা হাতে নিয়েছি। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে সমস্যা সমাধান হবে।

তিনি আরো বলেন, হাজারীবাগ থেকে ট্যানারীপল্লী সরিয়ে নিলে বুড়িগঙ্গার দূষণ ৬০ শতাংশ কমে যাবে। ওয়াসার কোন ময়লা বুড়িগঙ্গা বা অন্যনদীতে পড়ে না, ওয়াসার লাইন দিয়ে যা পড়ে তা হলো সিটি করপোরেশনের ময়লা ।



ভয়াবহ দূষণ : গড়ে প্রতিদিন রাজধানীর বর্জ্যের ৫০ শতাংশ ফেলা হচ্ছে বুড়িগঙ্গায়। এর অর্ধেকই ট্যানারি আর শিল্পবর্জ্য। বাকি বর্জ্যরে মধ্যে আছে মানুষের মলমূত্র, গৃহস্থালি ও মেডিকেল বর্জ্য বেশি।

এই নদীর পানি দূষণের প্রধান কারণ হচ্ছে হাজারীবাগ ট্যানারির বর্জ্য। রাসায়নিক বর্জ্য পরিশোধনের কোনো ব্যবস্থা নেই এই শিল্প নগরীতে। এখান থেকে প্রতিদিন অপরিশোধিত রাসায়নিক বর্জ্য সরাসরি পড়ছে বুড়িগঙ্গায়। নদীতে পড়া বিপজ্জনক বর্জ্যরে মধ্যে আছে হাসপাতালের বর্জ্যও। বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিক থেকে ট্যাবলেট-ক্যাপসুলের খোলস, স্যালাইন, সিরিঞ্জ, ব্যান্ডেজ, সিরাপ সরাসরি ফেলা হয় নদীতে।

একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, হাজারীবাগ ট্যানারি থেকে প্রতিদিন ১০-১৫ হাজার ঘন লিটার, তেজগাঁও শিল্প এলাকা থেকে ৩ হাজার ৫০০ ঘন লিটার এবং অন্যান্য শিল্পাঞ্চল থেকে ২ হাজার ৭০০ ঘন লিটার রাসায়নিক তরল বর্জ্য ফেলা হচ্ছে বুড়িগঙ্গায়। এসব বর্জ্যরে মধ্যে রয়েছে ক্লোশিং লোম, সোডিয়াম সালফেট, ক্রোমিয়াম আক্রাইড, তেল, দস্তা, নিকেল, সীসাসহ নানা ধরনের এসিড। এ কারণে পানির তলদেশে জীববৈচিত্র্য ও ছোট ছোট উদ্ভিদগুলো মরে গেছে।

বিআইডব্লিউটিএ’র যুগ্ম পরিচালক সাইফুল ইসলাম ঢাকাটাইমসকে বলেন, ঢাকা সিটি করপোরেশনসহ আশপাশের এলাকার তরল জাতীয় বর্জ্য অপসারণের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় সব বুড়িগঙ্গায় ফেলা হচ্ছে। বিশেষ করে ঢাকা সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ফেলার বিকল্প জায়গা নিয়ে আজও কোনো রকম চিন্তাভাবনা হয়নি।

বিআইডব্লিউটিএ’র হিসাবে, কলকারখানার বর্জ্য, পলিথিন ও মানববর্জ্য জমা হয়ে বুড়িগঙ্গার তলদেশে ১০ থেকে ১২ ফুট স্তর পড়েছে। এতে নদীর নাব্যতা হ্রাসের পাশাপাশি এর পানিও ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এ অবস্থাতেই নদীর বর্জ্য অপসারণ শুরু করা হয়েছিল। কিন্তু কাজ হয়নি।

পরিবেশ অধিদপ্তরের সমীক্ষা অনুযায়ী বাংলাদেশে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ ও বালু নদীর পানির মান ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। এতে বলা হয়েছে, পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা ৪ দশমিক ৫০ মিলিগ্রামের কথা থাকলেও আছে এক মিলিগ্রামেরও কম। আর দ্রবীভূত হাইড্রোজেন মাত্রা থাকা উচিত অন্তত ৭ মিলিগ্রাম। অথচ বুড়িগঙ্গা নদীর পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ প্রায় শূন্যের কোঠায়।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) সাম্প্রতিক এক পর্যবেক্ষণে বুড়িগঙ্গার পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন পাওয়া গেছে সর্বনি¤œ শূন্য দশমিক ১৪ থেকে সর্বোচ্চ শূন্য দশমিক ৬২ মিলিগ্রাম। আবার নদীতে পিএইচ বা ক্ষারের মাত্রা পাওয়া গেছে ১০ এর আশপাশে, যা থাকার কথা এর চেয়ে অনেক কম। অর্থাৎ নদীতে এসিডের মাত্রা অনেক বেশি। এই অবস্থায় বুড়িগঙ্গায় মাছসহ জলজ প্রাণী ও উদ্ভিদ নেই বললেই চলে।

নদীর প্রাণ কাড়ছে আড়াইশ বর্জ্যমুখ : অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষের হিসাবে বুড়িগঙ্গা, বাল্ ুএবং তুরাগ নদীতে আছে প্রায় ১৫০টিরও বেশি বর্জ্য মুখ। এক শীতলক্ষ্যায় একশটির মতো বর্জ্যমুখ থাকলেও ওই নদীতে ¯্রােত থাকায় পানি তুলনামূলক ভালো। কিন্তু অন্য তিন নদীতে পানি প্রবাহ না থাকায় বর্জ্যরে কারণে দূষণ কেবল বেড়েই চলেছে।  

বাবুবাজার ব্রিজের নিচে আছে ওয়াসার একটি খাল। দিন-রাত পয়ঃ আর আশপাশের বিভিন্ন কারখানার অপরিশোধিত রাসায়নিক বর্জ্য নদীতে পড়ে এই খাল দিয়ে। দুর্গন্ধে সেখানে টিকে থাকাই দায়। তবে আশপাশের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে থাকতে থাকতে কিছুটা অভ্যস্ত হয়ে গেছে। কিন্তু নতুন কেউ গেলে নাখ-মুখ চেপে ধরে তাৎক্ষণিক। কিন্তু দুর্গন্ধ এতটাই প্রকট যে তা চেপে রাখা যায় না কোনো কিছুতেই।

পাশেই আছে ডিঙ্গি নৌকার ঘাট। সেখানে কথা হলো বেশ কয়েকজন যাত্রীর সঙ্গে। একজন বললেন, ‘বছরের পর বছর ধরে এই যন্ত্রণা সহ্য করেই চলছি আমরা। নদী বাঁচাতে নানা সময় সরকার নানা কথা বলেছে, এতে প্রথম প্রথম আমার আশায় বুক বাঁধতাম। এখন আর এসব কথায় দাম দেই না’।

আরেকজন বললেন, ‘সাংবাদিকরা সব সময় আসে, নানা সময় পত্রিকা আর টেলিভিশনে সংবাদও হয়। কিন্তু ওই পর্যন্তই’।

নদী বাঁচাতে বিআইডব্লিউটিএ’র নতুন উদ্যোগ : বুড়িগঙ্গার বড় বর্জ্যমুখগুলোর মধ্যে মোহাম্মদপুরের রামচন্দ্রপুর খাল এলাকার সাতটি এরই মধ্যে বন্ধ করে দিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ। বাকিগুলো বন্ধ করে দেয়া হবে বলে পত্রিকায় বেশ কয়েকদিন ধরে গণবিজ্ঞপ্তি দিচ্ছে সংস্থাটি। কিন্তু বিজ্ঞপ্তি দিলেও আদৌ সবগুলো বন্ধ করা সম্ভব হবে কি না, সে নিয়ে সন্দেহ আছে খোদ সংস্থাটির। কারণ, ঢাকা শহরের ৬৫ শতাংশ এলাকায় নেই আধুনিক পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা। পাশাপাশি গৃহস্থালী বর্জ্য ফেলারও নেই পর্যন্ত জায়গা। এই অবস্থায় নদীতে বর্জ্য ফেলা বন্ধ করে দিলে রাজধানীর পরিবেশে যে প্রভাব পড়বে সে নিয়ে রীতিমতো আতঙ্কিত সংস্থাটি। তারপরও অন্য সংস্থাগুলো যেন দূষণ রোধে কার্যকর উদ্যোগ নেয়, সে জন্য তাদের ওপর চাপ দিচ্ছে বিআইডব্লিউটিএ। আর আস্তে ধীরে একটি দুটি করে বর্জ্যমুখ অপসারণ করছে সংস্থাটি।

বিআইডব্লিউটিএ’র এই চিন্তার সঙ্গে একমত বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন-বাপার সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিনও। তিনিও মনে করেন হুট করে সব বর্জ্যমুখ বন্ধ করলে নগরীতে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। এর বিকল্প আছে জানিয়ে এই সময়কে তিনি বলেন, ‘আমরা সব বর্জ্যমুখে বর্জ্য পরিশোধন প্ল্যান্ট (ইটিপি) বসানোর পরামর্শ দিয়েছিলাম। এটা করা হলে আর সমস্যা হতো না’।

জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএর যুগ্ম পরিচালক এবং নদ-নদী রক্ষা বিষয়ক জাতীয় টাস্কফোর্স-এর সদস্য কাজী ওয়াকিল নওয়াজ এই সময়কে বলেন, ‘নদীকে বাঁচাতেই হবে। সবাই এখন এ নিয়ে কথা বলছে। বিআইডব্লিউটিএ থেকে বেশ কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অন্যরাও এগিয়ে আসলে আশা করি পরিস্থিতির উন্নতি হবে’।

(ঢাকাটাইমস/১১ মার্চ/ টিএ/ এআর/  ঘ.)