logo ০৩ মে ২০২৫
জঙ্গিদের সহযোগী প্রশাসনে!

আশিক আহমেদ, ঢাকাটাইমস
০৪ মার্চ, ২০১৪ ২২:৪৯:৫৭
image


ঢাকা: ময়মনসিংহের ত্রিশালে প্রিজন ভ্যানে হামলা করে জেএমবির তিন জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনায় তোলপাড় চলছে প্রশাসনে। ২৩ ফেব্রুয়ারি এই হামলার বহু আগে থেকেই জঙ্গিদের প্রস্তুতি চলছিল বলে প্রাথমিক তদন্তে প্রমাণ পাওয়া গেছে। এই ঘটনায় প্রশাসনের একটি অংশও জড়িত কি না, সে সন্দেহও ঘুরপাক খাচ্ছে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তাদের মধ্যে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্তে সন্দেহ করার মতো কিছু তথ্য উঠে আসার পর জঙ্গিদের সঙ্গে প্রশাসনের সম্পৃক্ততা নিয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে রীতিমতো উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন বিভিন্ন রাজনীতিবিদ ও সাবেক সেনা কর্মকর্তারাও। পুলিশের মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকারও বলেছেন, এই ঘটনায় পুলিশ বা প্রশাসনের কোনো গাফিলতি বা সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেলে কঠোর ব্যবস্থা নেবেন তারা।

গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে বন্দি ছিলেন ফাঁসি এবং যাবজ্জীবন দ-প্রাপ্ত দুই জেএমবি নেতা। ২৩ ফেব্রুয়ারি তাদেরকে ছিনিয়ে নিতে হামলাকারীদের সঙ্গে বন্দি জঙ্গিদের নিয়মিত যোগাযোগ হতো বলেও পুলিশের তদন্তে উঠে এসেছে। পুলিশ এও জানতে পেরেছে যে, কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায় বাইরে থাকা জঙ্গিদের কথা হতো মোবাইল ফোনেও। জঙ্গিদেরকে কারাগার থেকে ময়মনসিংহ নেয়ার সময় যথাযথ নিরাপত্তার ব্যবস্থাও করেনি কাশিমপুরের কারা কর্তৃপক্ষ।

প্রশাসনের সহযোগিতায় জঙ্গি নেতাদের ছিনতাইয়ের অভিযোগ সত্য হলে তা বাংলাদেশের জন্য ভয়াবহ বিপদের কারণ বলে মনে করেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী সিকদার। এই অভিযোগ বিশ্বাস করার মতো যৌক্তিক কারণ আছে বলেও মনে করেন তিনি। ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, প্রশাসনের কারও সহযোগিতা ছাড়া এই ঘটনা ঘটনানো কঠিন। জঙ্গিরা দীর্ঘ প্রস্তুতি নিয়েই এই কাজ করেছে।

এই নিরাপত্তা বিশ্লেষক বলেন, ‘জঙ্গিরা কারাগারে বসে মোবাইল ফোনে কথা বলে হামলার পরিকল্পনা করেছে। ভেতর থেকে কেউ সহযোগিতা না করলে কীভাবে এটা সম্ভব হতো? তাছাড়া কোথায় হামলা করতে হবে, পুলিশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা কী থাকবে, সে সম্পর্কে ধারণাও জঙ্গিদের মধ্যে ছিল বলেই মনে হচ্ছে। এই তথ্যও কেউ তাদেরকে পাচার করতে পারে। কারা এসব তথ্য পাচার করছে বা কারা জঙ্গিদের সহযোগিতা করেছে তাদের চিহ্নিত করে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। নইলে জঙ্গিদেরকে ঠেকানো কঠিন হবে’।

বাংলাদেশে ইন্তিফাদা বা সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করতে আল-কায়েদা প্রধান আয়মান আল জাওয়াহিরির বার্তা প্রকাশের আট দিনের মাথায় জেএমবির এ রকম সশস্ত্র হামলা গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত বলেও মনে করেন মোহাম্মদ আলী সিকদার।

অনিয়মের শেষ নেই : তিন জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেয়ার পর পরই এই ঘটনায় পুলিশের গাফিলতির অভিযোগ নিয়ে তদন্ত চালায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি কমিটি। এই কমিটির প্রতিবেদেনে জঙ্গিদেরকে ছিনতাইয়ের ঘটনায় কারা প্রশাসনের সংশ্লিষ্টতার মতো গুরুতর অভিযোগ উঠে এসেছে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, জেএমবির শীর্ষ তিন নেতাকে পরিবহণে যথাযথ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়নি। এর আগে এমন আসামিদেরকে কড়া নিরাপত্তার মধ্যদিয়ে স্থানান্তর করা হলেও জেএমবির তিন নেতাকে পরিবহণে নিরাপত্তা কর্মী ছিল কেবল তিনজন।

জেলার প্রধান পুলিশ কর্মকর্তা থাকতেও জঙ্গিদেরকে গাজীপুর থেকে ময়মনসিংহে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে নিরাপত্তার বিষয়টি কারা প্রশাসনের সাথে সমন্বয় করেন গাজীপুরের ভারপ্রাপ্ত রিজার্ভ ইন্সপেক্টর। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্তকারী কর্মকর্তাদেরকে গাজীপুরের ভারপ্রাপ্ত রিজার্ভ ইন্সপেক্টর কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।

জানতে চাইলে কাশিমপুর কারাগারের সুপার আবদুর রাজ্জাক ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘তিন জঙ্গিকে পরিবহণের আগে আমরা ময়মনসিংহের জেলা পুলিশকে চিঠি দিয়েছিলাম। কিন্তু তারা সে চিঠি পাননি বলে জানিয়েছেন’।

কারাগারেই মোবাইল ফোন ব্যবহার : তিন জঙ্গিনেতাকে ছিনিয়ে নেওয়ার পরপর টাঙ্গাইলে সখিপুর থেকে গ্রেপ্তার করা হয় জেএমবির সদস্য জাকারিয়াকে। তিনিই এই হামলার পরিকল্পনা ও নেতৃত্ব দেন বলে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পেরেছে।

জাকারিয়া পুলিশকে জানান, সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে ঘটনার এক সপ্তাহ আগে থেকে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে ঘটনাস্থল ও আশপাশের এলাকা পর্যবেক্ষণ (রেকি) এবং আসামি আনা-নেওয়ার গাড়ির (প্রিজন ভ্যান) গতিবিধি ও এর নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশের জনবল ও অস্ত্র সম্পর্কে ধারণা নেওয়া হয়।

এ ছাড়া কারাবন্দি জেএমবির নেতা হাফেজ মাহমুদ ওরফে রাকিব হাসান মুঠোফোনে বাইরের সহযোগী জঙ্গিদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করেন। ধরা পড়ার পর তার কাছ থেকে মুঠোফোনটি উদ্ধার করে পুলিশ। এই বিষয়টিই ভাবিয়ে তুলেছে প্রশাসনকে। কারণ, কারাগারে মোবাইল ফোন ব্যবহার ঠেকাতে সরকার সেখানে জ্যামার বসিয়েছে। কেউ এটি অকার্যকর করে দিলেই কেবল মোবাইল ফোন ব্যবহার করা সম্ভব। কারা প্রশাসনের মধ্যে কারও যোগসাজশ ছাড়া এটা অসম্ভব বলেও মনে করছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তার। এদেরকে খুঁজে বের করার উপর জোর দিচ্ছেন তারা।

তবে কাশিমপুর কারাগারের জেল সুপার আবদুর রাজ্জাক জঙ্গিদের সঙ্গে কারা প্রশাসনের কারও যোগসাজশের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। জানতে চাইলে ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, ‘কারাগারে জ্যামার বা তরঙ্গ প্রতিরোধ যন্ত্র কাজ করছে ঠিকঠাকভাবেই। আর এ কারণে কারাগারে বসে মোবাইল ফোন ব্যবহার করা সম্ভব না। পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ আসামিদের ওপর নজরদারি করতে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা লাগানো আছে’।

কাশিমপুর কারাগারের জেলসুপার অস্বীকার করলেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্তেও কারাগারে মোবাইল ফোন ব্যবহারের এই অভিযোগ উঠে এসেছে এবং কীভাবে এটা হলো সে ব্যাখ্যাও কারা কর্তৃপক্ষের কাছে চেয়েছে তদন্ত কমিটি।

চলছে পুলিশের তদন্ত

জেএমবি জঙ্গিদের ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনায় পুলিশের অবহেলা নাকি প্রশাসনের ভেতরের কোনো অংশ জড়িত ছিল তা তদন্তে কাজ করছে পুলিশের একটি কমিটি।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডির উপ-মহাপরিদর্শক সাইফুল ইসলাম ও পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক গোলাম ফারুক এবং সহকারী মহাপুলিশ পরিদর্শক (অপরাধ-পূর্ব) আলিম মাহমুদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি ২৭ ফেব্রুয়ারির মধ্যে প্রতিবেদন দেয়ার কথা থাকলেও তারা আরও সময় চেয়েছে।

জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপুলিশ পরিদর্শক (অপরাধ-পূর্ব) আলিম মাহমুদ ঢাকাটাইমসকে জানান, তদন্ত কাজ অনেক দূর এগিয়েছে। কিন্তু কিছু প্রশ্নের জবাব এখনও পাওয়া যায়নি। তাই এখনই আমরা মন্তব্য করতে চাচ্ছি না’।

আটক হয়নি পুুরস্কার ঘোষিতরা

তিন জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেয়ার পর পরই তাদেরকে আটকে অভিযানে নামে পুলিশ। চার ঘণ্টার মধ্যে টাঙ্গাইলের সখিপুর থেকে আটক হন ফাঁসির দ-প্রাপ্ত রাকিব হাসান। তার সঙ্গে আটক হক জাকারিয়া নামে জেএমবির এক সদস্য। তার নেতৃত্বেই এই হামলা হয়েছে বলে জানতে পেরেছে পুলিশ।

পালিয়ে যাওয়া অন্য দুই জঙ্গিকে ধরিয়ে দিতে সেদিনই মাথাপিছু দুই লাখ টাকা করে পুরস্কার ঘোষণা করে পুলিশ। পরদিন পুরস্কারের অংক বাড়িয়ে পাঁচ লাখ টাকা করা হয়। জঙ্গিদেরকে দেশত্যাগ ঠেকাতে সীমান্তে জারি করা হয় ‘রেড অ্যালার্ট’। বিমানবন্দরকেও সতর্ক করে দিয়েছে পুলিশ। কিন্তু এতে কাজের কাজ হয়নি কিছুই। ধরা পড়েনি পালিয়ে যাওয়া বা হামলাকারী কেউ।

আফগানিস্তান-পাকিস্তানেও জঙ্গিবাদ প্রশাসনের সহযোগিতায়

আফগানিস্তানে রাষ্ট্র ক্ষমতা নিয়ে গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার, বোরহানউদ্দিন রাব্বানী ও আবদুর রশিদ দোস্তামের মধ্যে দ্বন্দ্বের এক পর্যায়ে নব্বই দশকের শুরুর দিকে আফগানিস্তানে কওমি মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদের নিয়ে গঠিত হয় তালেবান। সে সময়ের তিন পক্ষের সেনাদের মধ্যে যুদ্ধের কারণে ত্যক্ত-বিরক্ত আফগানিস্তানের জনগণ এবং প্রশাসনের একটি অংশের সহযোগিতা পায় তালেবানরা। পরে তিনজনের অনুগত বাহিনীকে গুঁড়িয়ে দিয়ে তালেবান ১৯৯৬ সালে কাবুল দখল করে জারি করে শরিয়া আইন। কঠোর শাসনের কারণে দ্রুত তালেবানদের বিরুদ্ধে তৈরি হয় জনমত। তালেবানরা নিজ দেশে জঙ্গি শাসনের পাশাপাশি আশপাশের বিভিন্ন দেশেও জঙ্গি তৎপরতা ছড়িয়ে দেয়। আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনকেও আশ্রয় দেয় তারা। ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে টুইন টাওয়ারে হামলায় লাদেন জড়িত থাকার অভিযোগ উঠার পর তাকে ধরিয়ে দিতে তালেবানদের কাছে দাবি জানায় যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু তালেবানরা রাজি না হওয়ায় ওই বছরেই আফগানিস্তানে হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র এবং তালেবান শাসনের পতন হয়।

পাকিস্তানেও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, প্রশাসন এবং সেনাবাহিনীর একটি অংশ বিভিন্ন জঙ্গি গোষ্ঠীকে সরাসরি সহযোগিতা করেছে বলে অভিযোগ আছে। আর এ কারণে জঙ্গিরা ধীরে ধীরে শক্তি সঞ্চয় করে এখন গোটা রাষ্ট্রকেই হুমকিতে ফেলে দিয়েছে।

(ঢাকাটাইমস/ ০৪ মার্চ/ এএ/ এআর/ ঘ.)