ঢাকা: ধানমন্ডির জিগাতলা হয়ে হাজারীবাগ এলাকায় ঢুকতেই নাক কুচকে গেল উৎকট গন্ধে। একটু ভেতরে যেতেই দুর্গন্ধে একেবারে দম বন্ধ হয়ে আসার দশা। পথের পাশে খোলা জায়গাতেই ফেলে রাখা হয়েছে পশুর পশম, চামড়ার উচ্ছিষ্ট পচা-গলা বর্জ্য। সুয়ারেজ নালাগুলোরও ঢাকনা নেই। পশুর চামড়ার বর্জ্যরে দুর্গন্ধই ভারি করে তুলেছে এলাকার পরিবেশ।
স্বভাবতই রুমাল দিয়ে চেপে রাখতে হলো নাক। দেখে স্থানীয় একজন বললেন, ‘কী ভাই, এলাকায় নতুন আসলেন না কি’? হ্যাঁ, আপনারা এখানে থাকেন কী ভাবে-এমন প্রশ্নের জবাবে ওই ব্যক্তি বললেন, ‘বহু দিন ধরে থাকি, অভ্যাস হয়ে গেছে। তা ছাড়া বাড়িঘর এখানে, না থেকে উপায় কী?’।
হাজারীবাগজুড়ে ছোট বড় মিলিয়ে দুইশ চামড়া কারখানা আছে। কিন্তু বর্জ্য পরিশোধনে নেই কোনো ব্যবস্থা। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে, চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার সময় বের হওয়া উচ্ছিষ্টে দূষণে জর্জরিত গোটা এলাকা। বলতে গেলে হাজারীবাগের মাটি, পানি ও বায়ু সবই দূষিত। কিন্তু এর মধ্যেই বসবাস করছে ১৫ থেকে ২০ লাখ মানুষ। যাদের প্রতি মুহূর্তেই থাকতে হচ্ছে স্বাস্থ্যহানির ঝুঁকিতে।
কথা হয় স্থানীয় বাসিন্দা ইসমাইল হোসেনের সঙ্গে। তিনি ফেন্সি লেদার লিমিটেডে চাকরি করেন। এই সময়কে তিনি বলেন, ‘কি আর কমু ভাই। এইহানের মানুষগুলাই অন্যরকম। দূষিত পরিবেশে থাকতে থাকতে সইয়্যা গেছে। প্রথম প্রথম খারাপ লাগলেও এখন গন্ধ নাকে লাগে না।’
এখানকার স্থাপনাগুলোই বলে দিচ্ছে এগুলো দেশ স্বাধীন হওয়ার আগের। পুরনো এই প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিতভাবেই। এখানে নেই উন্নত নালা ব্যবস্থাপনা। এমনকি বর্জ্য ও রাসায়নিক মিশ্রিত পানি শোধনের ব্যবস্থাও (ইটিপি) নেই বেশিরভাগ ট্যানারিতে। যে কারণে ট্যানারির বিষাক্ত পানি সরাসরি গিয়ে পড়ছে আশপাশের নদীতে। শীতলক্ষ্যা, তুরাগ, বালু ও বুড়িগঙ্গার ১১০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ব্যাপকভাবে দূষিত হচ্ছে।
নিত্যসঙ্গী রোগ-ব্যাধি : এলাকা ঘুরে কথা হয় স্থানীয় অনেকের সঙ্গেই। কেউ বলেছেন জীবিকার জন্য থাকছেন সেখানে, কেউ বলছেন অন্য উপায় করতে পারলে ছেড়ে যাবেন এলাকা।
কথা হয় রোমা ট্যানারি লিমিটেডের শ্রমিক মালেক মিয়ার সঙ্গে। জানান, ১২ বছর ধরে এই এলাকায় আছেন। দুটি ছেলে আছে তার। ছেলে দুটোর অসুখ লেগেই থাকে। শুকিয়ে গেছে। ডাক্তার বলেছেন জায়গা বদল করতে। ট্যানারি এলাকার বিষাক্ত পরিবেশ তাদের সহ্য হচ্ছে না। নিরুপায় মালেক মিয়া বলেন, ‘কি করুম ভাই। ইচ্ছা কইরা তো এইখানে থাকি না। ট্যানারিতে কাজ করি। তাই পরিবারও এইখানেই রাখছি।’
আবাসন সংকটের কারণে এখানে বসবাসকারী মানুষগুলো প্রতিনিয়তই কোনো না কোনো জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। তবে জন্ডিস, চর্মরোগ, পেটের পীড়া, রিউমেটিক ফিভার, শ্বাসকষ্টের মতো রোগের প্রকোপ বেশি। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা বলছেন, ট্যানারি এলাকার দূষিত বর্জ্য পানি, বায়ু কিংবা খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে মানুষের দেহে ঢুকলে ক্যান্সারের মতো দুরারোগ্য ব্যাধিও বাসা বাঁধতে পারে। এসব কারণে এই এলাকায় উৎপাদিত শাক-সবজি, ফলমূল এমনকি হাঁস-মুরগির গোশত খাওয়া থেকে বিরত থাকতে পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা।
সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের সহকারী পরিচালক উত্তম কুমার বড়ুয়া ঢাকাটাইমসকে বলেন, হাজারীবাগ ট্যানারি এলাকায় মাটি, পানি দূষিত এমনকি উদ্ভিদেও ঢুকে পড়েছে বিষাক্ত ধাতব পদার্থ। যা খাদ্য চক্রের মাধ্যমে মানুষ ও পশুর দেহে ঢুকলে নানা ধরনের জটিল রোগ এমনকি ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে।
বন ও পরিবেশমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বলেন, ট্যানারি দূষণের কারণে ঢাকা মহানগরী বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। তাই ট্যানারি স্থানান্তরে কোনো যুক্তি, তর্ক বা অজুহাত নয়।
মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে কাজ করে শ্রমিকরা : অন্য যে কোনো শিল্পের তুলনায় চামড়া শিল্পের শ্রমিকদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেশি। এ কারণে ঝুঁকি কমাতে শ্রমিকদের বেশ কিছু আগাম প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হয়। নানা ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ যেন শরীরে না লাগে সে জন্য শ্রমিকদেরকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত আচ্ছাদিত পোশাকে কাজ করার কথা চামড়া কারখানায়। কিন্তু এ নিয়ে যেন কোনো ভাবনাই নেই শ্রমিক এবং মালিকপক্ষের মধ্যে।
ক্রিসেন্ট ট্যানারিজ, রোমা ট্যানারি এবং ফেন্সি লেদারে গিয়ে শ্রমিকদের লুঙ্গি এবং হাফপ্যান্ট পরে কাজ করতে দেখা গেল। কারও কারও গায়ে আছে স্যান্ডো গেঞ্জি আবার কারও কারও গায়ে নেই তাও। কারও কারও পায়ে প্লাস্টিকের গামবুট দেখা গেলেও সেগুলোর ভেতর দিয়ে পানি ঢুকতেও দেখা গেছে। কারও মুখেই ছিল না মুখবন্ধনি বা মাস্ক। বিভিন্ন রাসায়নিক মিশ্রিত চামড়া শ্রমিকরা ধরছে খালি হাতেই।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, চামড়া কারখানায় কাজ করা শ্রমিকরা নানা রাসায়নিকের কারণে জটিল এবং প্রাণঘাতি রোগে আক্রান্ত হয় বেশি। কিন্তু এ নিয়ে যেন কোনো সচেতনতাই নেই শ্রমিকদের মধ্যে।
এভাবে কাজ করেন, নানা অসুখ তো হতে পারে-এমন মন্তব্যের জবাবে সুজন নামে এক শ্রমিক বললেন, ‘খুব চুলকায়। মাঝে মধ্যে হাত-পায়ের চামড়া উইঠ্যা যায়। আবার ঠিক হইয়া যায়। তাই বইল্যা কাম তো বাদ দেওন যাইবো না।’
জুয়েল নামে এক শ্রমিকের সারা গায়ে চর্মরোগের দাগ দেখা গেল। দাগের কারণে একেবারে কালো হয়ে গেছে হাত-পা। চামড়ার রাসায়নিকের কারণেই যে এমন হচ্ছে, সে নিয়ে যেন কোনো ভাবান্তরই নেই জুয়েল এবং তার সহকর্মীদের। নিস্পৃহ ভঙ্গিতেই কাজ করছে তারা।
ট্যানারিতে ঘিরে গড়ে উঠা প্রতিষ্ঠানের চিত্রও একই : ট্যানারি ছাড়াও এসব কারখানাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে প্রায় শতাধিক ছোট ছোট প্রতিষ্ঠান। যেগুলোর কোনোটারই নামধাম নেই। দেয়াল ঘেরা কিংবা কখনো খোলা পরিবেশেই চলছে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার কাজ।
কোথাও কোথাও স্তূপ করে রাখা হয়েছে পশুর হাঁড়। যেগুলো পচে গলে গন্ধ বেরিয়েছে। ট্যানারির উচ্ছিষ্ট থেকে কেউ কেউ তৈরি করছেন মাছের খাবারের একটি অংশ (প্রোটিন) ও আঠা। এজন্য খোলা পরিবেশেই পোড়ানো হচ্ছে চামড়া। এছাড়া মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক রাসায়নিকও ব্যবহার হচ্ছে কোনো না কোনো জায়গায়, চৌবাচ্চা ভড়া পানিতে রাসায়নিক ঢেলে চামড়া ডোবানো হচ্ছে। আর শ্রমিকরা খালি হাতেই তুলছে সেই চামড়া। এদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু।
মাছের খাবারের একটি অংশ তৈরিকারী প্রতিষ্ঠানের মালিক রফিকুল ইসলাম জুয়েল ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘শুনেছি ট্যানারিগুলো সরিয়ে সাভারে নেয়া হবে। কিন্তু আমাদের মতো ছোট প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত শোনা যাচ্ছে না।’ সাভারেও কি এভাবে খোলামেলা পরিবেশে কাজ করতে চান? প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সেখানে তো সবই পরিকল্পিত। এভাবে তো আর সেখানে কাজ করা যাবে না। আমরাও তখন উন্নত পদ্ধতিতে কাজ করবো। যেন পরিবেশ দূষণ না হয়।’
বুড়িগঙ্গার মৃত্যু ট্যানারি বর্জ্যইে : যে নদীকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল ঢাকা নগরী, সেই বুড়িগঙ্গাকে বলতে গেলে গলাটিপে হত্যা করেছে এই ট্যারারির দূষণই।
সরকারি এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, সারাদেশে প্রতিদিন তরল বর্জ্য নির্গত হয় সাড়ে আট মিলিয়ন লিটারের কিছু বেশি। এর মধ্যে পৌনে আট মিলিয়ন লিটার উৎপন্ন হয় হাজারীবাগ ট্যানারিতে। কিন্তু এই বিপুল বর্জ্য পরিশোধনে সেখানে নেই কোনো ব্যবস্থা। সরাসরি বুড়িগঙ্গায় ফেলা হয় এই বর্জ্য।
ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। রাসায়নিক বর্জ্যরে কারণে গোটা নদীর পানিই হয়ে পড়েছে পুঁতিগন্ধময়। নদীর পানি হয়ে গেছে অক্সিজেন শূন্য, বেড়ে গেছে ক্ষার। এ কারণে মাছসহ জলজ প্রাণী আর উদ্ভিদের বেঁচে থাকা হয়ে গেছে অসম্ভব।
পরিবেশ বাঁচাতে সরকারি উদ্যোগ কাজে আসেনি মোটেও : পরিবেশ ও নদীগুলোকে দূষণমুক্ত করতে এক দশকেরও বেশি সময় আগে হাজারীবাগ থেকে ট্যানারিগুলো আলাদা শিল্পনগরে সরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ নেয় সরকার। ২০০৩ সালের ১৬ আগস্ট জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় অনুমোদন দেয়া হয় সাভারের হেমায়েতপুরে চামড়া শিল্পনগর প্রকল্প। কথা ছিল ২০০৫ সালের মধ্যে কাজ শেষ হবে। কিন্তু বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে কাজ শেষ না হওয়ায় প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ বাড়ানো হয় আরও পাঁচ বছর। তাতেও কাজ না হলে ২০১২ সাল পর্যন্ত ধরে দেয়া হয় প্রকল্পটির বাস্তবায়ন সময়সীমা। তিন দফায় দেয়া সময় পার হয়েছে। কিন্তু এখনও বাকি রয়ে গেছে বেশকিছু। শিল্প মন্ত্রণালয়ের এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থা (বিসিক)।
গত বছরের ১৩ অক্টোবর বিসিক এবং ট্যানারি মালিকদের দুই সংগঠনের মধ্যে সমঝোতা স্মারক সই হয়। ওই সময় তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়–য়া বলেছিলেন, ২০১৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সাভারে নিয়ে যাওয়া হবে। সম্প্রতি শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমুও বলেছেন মার্চের মধ্যে সাভারে ট্যানারি স্থানান্তর শুরু করতে। এ কাজ তদারকিতে একটি কমিটিও করে দিয়েছেন তিনি। কিন্তু ট্যানারি মালিকরা বলছেন, মুখে বলা সহজ হলেও এ বছরের মধ্যে ট্যানারি স্থানান্তর শেষ করা যাবে না। ট্যানারি সরিয়ে নিয়ে নতুন করে কারখানা তৈরি করতে সময় লাগবে। এর সঙ্গে আর্থিক ক্ষতিপূরণের ব্যাপার তো রয়েছেই। সব মিলিয়ে সবগুলো ট্যানারি হাজারীবাগ থেকে সাভার সরে যেতে আগামী বছরটি পুরো লাগতে পারে।
জানতে চাইলে ট্যানারি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, ‘একটি কারখানা ভবন তৈরি থেকে শুরু করে যন্ত্রপাতি স্থাপনসহ সব কাজ শেষ করতে দেড় থেকে দুই বছর লাগে। ফলে ২০১৫ সালের পুরোটা সময় লেগে যেতে পারে।’
আর ট্যানারি সরিয়ে নিতে আর্থিক সঙ্গতির বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দিলেন বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্ট এসোসিয়েশনের (বিএফএলএলএফইএ)-এর সভাপতি মুহাম্মদ আবু তাহের। ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, ‘ট্যানারি সরিয়ে নেওয়ার জন্য অল্প সুদে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দরকার। এর পুরো খরচ ট্যানারি মালিকদের পক্ষে মেটানো সম্ভব নয়। যদি পুরো খরচ তাদের সামলাতে হয় তবে তাদের পক্ষে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা দায় হয়ে পড়বে।’
মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ট্যানারিগুলোতে তিনটি ইউনিট কাজ হয়। কাঁচা চামড়া থেকে হোয়াইট ব্লক চামড়া তৈরি, ক্রাস্ট এবং ফিনিশড। সাভারের শিল্পনগরীতে কারখানা নির্মাণ শুরু হলে ধাপে ধাপে এ সব ইউনিট সরিয়ে নেয়া হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ক্রিসেন্ট ট্যানারি লিমিটেডের একজন কর্মকর্তা ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘সরকার যতই সময় বেঁধে দিক না কেন, মালিকরা কারখানা সরিয়ে নিতে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ না পেলে এখান থেকে সরবে না।’
৮২টি ট্যানারির নকশা অনুমোদন : এরই মধ্যে ৮২ জন ট্যানারি মালিক তাদের প্লটের বিপরীতে নকশা পরিকল্পনা বিসিকে জমা দিয়েছেন। এর মধ্যে ৩৫টি নকশা পরিকল্পনা ইতিমধ্যে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। অনুমোদিত এসব প্লটের নকশা অনুযায়ী দ্রুত নির্মাণ কাজ শুরু হবে।
জানতে চাইলে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু ঢাকাটাইমসকে বলেন, স্থানান্তর শুরু হলে যেসব ট্যানারি-মালিক সাভারের চামড়া শিল্পনগরীতে প্লট পাননি, তাদের জন্য প্রকল্প সংলগ্ন এলাকায় আরও জায়গা নেয়া হবে। চলতি বছরের মধ্যে ট্যানারিগুলো সাভারে নেয়া না গেলে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো বাংলাদেশ থেকে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি বন্ধ করে দিতে পারে।
চামড়া শিল্পনগরীর আকার-আয়তন : ২০০ একর জায়গাজুড়ে চামড়া শিল্পনগর গড়ে তোলা হয়েছে সাভারের হেমায়েতপুরে। শিল্পনগরে ২০৫টি প্লটে ১৫৫টি কারখানা স্থাপন করা হবে। ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় দূষিত বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি) ছাড়া সব অবকাঠামো তৈরি শেষ। গত বছরের ১৩ আগস্ট একনেক সভায় দ্বিতীয় দফায় চামড়া শিল্পনগর প্রকল্পের সংশোধনী অনুমোদন দেওয়া হয়। এখন প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ১ হাজার ৭৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা। এর মধ্যে ২৫০ কোটি টাকা ট্যানারি মালিকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। বাকি টাকার মধ্যে ৬৬৩ কোটি ৪০ লাখ সরকার দেবে এবং ১৬৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা সরকার ঋণ হিসেবে দেবে। এই ঋণটাই শুধু ট্যানারি মালিকদের পরিশোধ করতে হবে।
ট্যানারি সরাতে ওয়ার্কিং টিম করতে শিল্পমন্ত্রীর নির্দেশ : রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে ট্যানারিগুলো দ্রুত সাভারের চামড়া শিল্পনগরে নিয়ে যেতে সম্প্রতি একটি কর্মদল (ওয়ার্কিং টিম) করার নির্দেশ দিয়েছেন শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু। বিসিক, শিল্প মন্ত্রণালয় এবং ট্যানারি শিল্পমালিকদের সমন্বয়ে এ কমিটি করতে বলেন। একই সঙ্গে সিইটিপি নির্মাণ কাজ শুরু করতে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশ দেন তিনি। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কোনো গড়িমসি হলে ছাড় দেয়া হবে না বলে জানান শিল্পমন্ত্রী। তিনি চান মার্চের মধ্যেই ট্যানারি স্থানান্তর শুরু হোক।
ট্যানারি সরানোর জন্য জাইকা থেকে ঋণ : বিসিকের সঙ্গে ট্যানারি শিল্পমালিকদের যে চুক্তি হয়েছে সে অনুযায়ী কারখানা স্থানান্তরের জন্য যে পরিমাণ অর্থ লাগবে তাতে সরকার ২৫০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেবে। আর প্রকল্প বাবদ ৮০ শতাংশ খরচ (৬৬৩ কোটি টাকা) দেবে সরকার। বাকি ১৬৫ কোটি (২০ শতাংশ) টাকা মালিকরা দেবে।
বিএফএলএলএফইএ-এর সভাপতি মুহাম্মদ আবু তাহের বলেন, ট্যানারিগুলো সাভারের শিল্পনগরে নিতে গেলে প্রচুর টাকা লাগবে। নিজস্ব অর্থায়নে ২০০ ট্যানারি সরানো সম্ভব নয়। তাই জাপানের উন্নয়ন সংস্থার (জাইকা) কাছে ১০০ কোটি টাকা ঋণ চেয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ১০ বছর আগে সরকারের পক্ষ থেকে ২৫০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। অথচ এখন তা পর্যাপ্ত নয়।
এ ব্যাপারে শিল্পমন্ত্রী বলেন, ট্যানারি মালিকরা কারখানা সরিয়ে নেয়া শুরু করলে পর্যায়ক্রমে ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে। এছাড়া ওয়ার্কিং টিম উদ্যোক্তাদের যেকোনো ধরনের সমস্যা দূর করতে প্রশাসনিক পর্যায়ে কাজ করবে।
চামড়া ও জুতা রপ্তানিও হতে পারে রপ্তানি খাত : বর্তমানে বিশ্বে ছয় হাজার কোটি ডলারেরও বেশি পাদুকার চাহিদা আছে। এর ৭৫ শতাংশই চীন এককভাবে জোগান দিচ্ছে। বাংলাদেশ ২০১২-২০১৩ অর্থবছরে চামড়া, পাদুকা ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে ৯৮ কোটি ২০ লাখ ডলার আয় করেছে। উদ্যোক্তারা জানান, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এ খাতের কয়েকশ কোটি ডলার মূল্যের পণ্য রপ্তানির সুযোগ রয়েছে। পোশাকশিল্পে মত এটিও হতে পারে শক্তিশালী রপ্তানি খাত।
কিন্তু হাজারীবাগের এই পুঁতিগন্ধময় পরিবেশের কারণে এই রপ্তানিই পড়তে পারে হুমকিতে। কারণ, বিদেশি ক্রেতারা এরই মধ্যে জানিয়ে দিয়েছে, পরিবেশের উন্নতি না হলে বাংলাদেশ থেকে চামড়া কিনবে না তারা।
(ঢাকাটাইমস/ ০৪ মার্চ/ এইচএফ/ এআর/ ঘ.)