logo ০৩ মে ২০২৫
তারেক রহমানকে খালাস দেয়া বিচারকের “অস্বাভাবিক” সম্পদ
মহিউদ্দিন মাহী, ঢাকাটাইমস
১১ মার্চ, ২০১৪ ২২:৫৫:৩৭
image


ঢাকা: অর্থপাচার মামলায় বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে খালাস দেয়া বিচারক মোতাহার হোসেনের কোনো খোঁজ পাচ্ছে না দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তবে তার বিপুল পরিমাণ সম্পদ খুঁজে পেয়েছে কমিশন। একজন বিচারকের আয়ের সঙ্গে এই পরিমাণ সম্পদ থাকা অস্বাভাবিক বলেই মনে করছেন দুদক কর্মকর্তারা।

বিদেশে অর্থপাচারের অভিযোগে গত ১৭ নভেম্বর ব্যবসায়ী গিয়াসউদ্দিন আল মামুনকে সাত বছরের কারাদণ্ড এবং ৪০ কোটি টাকা জরিমানা করলেও একই মামলার আসামি তারেক রহমানকে বেকসুর খালাস দেন বিচারক মোতাহার হোসেন। অথচ এই মামলার মূল অভিযুক্তই ছিলেন তারেক রহমান, আর গিয়াসউদ্দিন আল মামুন ছিলেন সহযোগী হিসেবে চিহ্নিত। মোতাহার হোসেনের চাকরি জীবনের এই শেষ রায় দেয়ার পরই হঠাৎ উধাও হয়ে যান তিনি।

তারেক রহমানের বিরুদ্ধে অর্থপাচার মামলার এমন রায়ের পেছনে তথ্য-প্রমাণ ছাড়া অন্য কোনো যোগসাজশ ছিল কি না, তা যাচাইয়ে নামে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। তদন্তে মোতাহার হোসেনের বিরুদ্ধে এর আগেও ঘুষ নিয়ে রায় দেয়ার তথ্য পাওয়া যায়। এর পরই অনুসন্ধানে নামে দুদক।

টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘যেকোনো পদ বা মর্যাদার ব্যক্তিই হোন না কেন তার যদি আয়ের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ সম্পদ থাকে, তবে সে ব্যাপারে তদন্ত করা দুদকের দায়িত্ব৷ এছাড়া বিচারক মোতাহার হোসেনের ব্যাপারে অন্য কোনো উদ্দেশ্য না থাকলে তদন্ত শুরু করে দুদক ঠিক কাজই করেছে’।

অপর এক প্রশ্নের জবাবে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ২০১১ সালে প্রধান বিচারপতি অন্য বিচারপতিদের সম্পদের হিসাব জমা নেয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বিচারপতিরা প্রধান বিচারপতির কাছে হিসাব জমাও দিয়েছিলেন, যদিও তা প্রকাশ করা হয়নি। তার কথায়, সব পর্যায়ের বিচারকদেরই সম্পদের হিসাব দেয়ার একটি ব্যবস্থা থাকা উচিত। এতে বিচার ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা বাড়বে বলে মনে করেন তিনি। তাই বিচারক মোতাহার হোসেনের সম্পদের তদন্তের মধ্য দিয়ে এই সুযোগ সৃষ্টি হলো।’

জানতে চাইলে দুদক কমিশনার শাহাবুদ্দিন চুপ্পুু বলেন, তারেক রহমানের মামলার বিচারক হিসেবে নয়, সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতেই মোতাহার হোসেনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। তিনি একজন বিশেষ জজের মর্যাদায় বিচারকের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় তার আয়ের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণভাবে অঢেল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। তার বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থপাচার, অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন ও ঘুষ নিয়ে আসামিদের খালাস দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।’

বিপুল সম্পদ মোতাহারের!

মোতাহার হোসেনের বিপক্ষে কেবল তারেক রহমানের মামলায় অবৈধ লেনদেনের সন্দেহের যথেষ্ট কারণ আছে বলে মনে করেন আদালত সংশ্লিষ্টরা। তাছাড়া মোতাহার হোসেনের অতীত কয়েকটি মামলার রায়ও বিবেচনায় এনেছে গোয়েন্দারা। দুদকও কাজ করছে একই অভিযোগের ভিত্তিতে।

দুদক সূত্র জানায়, তিনটি অভিযোগকে আমলে নিয়ে তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে কমিশন। তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধানকৃত প্রথম অভিযোগটি হলো বিদেশে অর্থপাচার। দুদকের কাছে অভিযোগ রয়েছে তিনি লন্ডনে একটি বাড়ি নির্মাণ করেছেন।

দ্বিতীয় অভিযোগ হলো তিনি নামে-বেনামে অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন। ঢাকার অভিজাত এলাকায় দুটি স্থানে ফ্ল্যাট বাড়িসহ নিজ জেলা নাটোরে নামে-বেনামে প্রায় ৫০ বিঘা জমি কিনেছেন। এ ছাড়া ছেলেকে বিপুল অঙ্কের টাকা খরচ করে লন্ডনের একটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান মোতাহার হোসেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি ছাড়াই এই টাকা পাঠানো হয়েছে বলেও জানতে পেরেছে দুদক।

দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে তার নিজের ও পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের নামে বেশ কিছু হিসেবে বড় অঙ্কের টাকা জমা রয়েছে। ফ্ল্যাট বাড়ি, জমিসহ ব্যাংক হিসেবে মোটা অঙ্কের টাকা দুদকের কাছে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত বলে প্রমাণিত হওয়ায় অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক।

তৃতীয় অভিযোগে জানা যায়, বিচারপতি মোতাহার হোসেন নিম্নআদালতের বিচারক থাকাকালে বড় বড় কয়েকটি মামলায় ঘুষ নিয়ে আসামিদের খালাস দিয়েছেন। এছাড়া বেশ কয়েকটি মামলায় ঘুষ নিয়ে আসামিদের সাজা কম দেওয়া ও খালাস দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

বছর কয়েক আগে এক ব্যবসায়ীর ছেলেকে খুনের মামলায় খালাস দেওয়ার পেছনে বিপুল অঙ্কের ঘুষ আর ঢাকায় ফ্ল্যাট লেনদেনের প্রমাণও পেয়েছে গোয়েন্দারা।

এ বিষয়ে কথা বলার জন্য যোগাযোগের চেষ্টা করেও মোতাহার হোসেন ও তার পরিবারের কাউকে পাওয়া যায়নি।

জানতে চাইলে দুদকের উপপরিচালক পর্যায়ে একজন কর্মকর্তা ঢাকাটাইমসকে জানান, তারেক রহমানকে খালাস দেওয়া বিচারক মোতাহার হোসেনের যেসব সম্পদেও খোঁজ তারা পেয়েছেন তা তার আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় কোনোভাবেই। মোতাহার হোসেনের কাছে দুদক সম্পদের হিসাব চাইবে বলেও জানান ওই কর্মকর্তা।

মোতাহার হোসেন তো আত্মগোপনে-তিনি হিসাব না দিলে কী করবেন জানতে চাইলে ওই বিচারক বলেন, ‘আমরা কারও কাছে সম্পদের হিসাব চাইলে তিনি তা দিতে বাধ্য। না দিলে তার বিরুদ্ধে মামলা হবে।’

মোতাহার বিদেশে কিন্তু...

অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে গত ২৩ জানুয়ারি মোতাহার হোসেনের সাবেক স্টেনোগ্রাফার আবুল হাসান ও ঢাকা বিশেষ জজ আদালতের স্টেনোগ্রাফার নুরুল ইসলামকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক। চারদিন পর মোতাহার হোসেনের গাড়িচালক সোহরাব হোসেন ও দেহরক্ষী বাদল দেওয়ানকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক। এর আগে ২২ জানুয়ারি মোতাহার হোসেনের দেশত্যাগের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে সংস্থাটি।

কিন্তু ২৭ জানুয়ারির এই জিজ্ঞাসাবাদে সাবেক বিচারকের দুই সাবেক কর্মী জানান, অবসরে যাওয়ার পর পরই গোপনে দেশ ছেড়ে মালয়েশিয়া চলে যান মোতাহার হোসেন।   

মোতাহার হোসেন আদৌ মালয়েশিয়ায় আছেন কি না, বা থাকলে কোথায় আছেন, তা গত এক মাস চেষ্টা করেও জানতে পারেনি দুদক। জানতে চাইলে দুদক কমিশনার শাহাবুদ্দিন চুপ্পু বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান কর্মকর্তা কাজ করছে। তার অনুসন্ধান শেষেই সব কিছু বলা যাবে।’

অনুসন্ধান কাজ কতটা এগুলো-জানতে চাইলে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও দুদকের উপপরিচালক হারুন অর রশিদ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘অনুসন্ধান শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি কিছু বলতে পারবো না। শুধু এতোটুকু বলবো-আমরা কাজ করছি।’

দুদক কর্মকর্তারা বলছেন, মোতাহার হোসেনের অবস্থান জানতে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মীরা চেষ্টা করছেন। তার অবস্থান সম্পর্কে জানা গেলে যেকোনো প্রক্রিয়ায় তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার জোর চেষ্টা করা হবে।

তারেকের মামলার প্রশ্নবিদ্ধ রায়

চারদলীয় জোট সরকারের আমলে টঙ্গীতে ৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ পাইয়ে দিতে চীনা প্রতিষ্ঠান হারবিন পাওয়ার ইক্যুইপমেন্ট লিমিটেডের কাছে ৮০ কোটি টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ ছিল তারেক ও মামুনের বিরুদ্ধে। হারবিনের স্থানীয় এজেন্ট নির্মাণ কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের চেয়ারপারসন খাদিজা ইসলাম জানিয়েছেন, কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্য পরামর্শক ফি হিসেবে তিনি এই টাকা দিয়েছেন। মামুন দেশে লেনদেন করতে রাজি না হওয়ায় চীনের হারবিন কোম্পানির স্থানীয় এজেন্ট হিসেবে সাত লাখ মার্কিন ডলার ২০০৩ সালের ৩১ জুলাই সিঙ্গাপুরের সিটি ব্যাংকে জমা করেন।

এই মামলায় আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের তদন্ত সংস্থা এফবিআইয়ের প্রতিনিধি ডেবরা লাপ্রোভোত্তে। ২০১১ সালের ১৬ নভেম্বর তিনি আদালতে তথ্য-প্রমাণ দাখিল করেন। ডেবরা তার সাক্ষ্যে বলেন, ২০০৩ সালের ১৮ আগস্ট সিঙ্গাপুরে মামুনের ব্যাংক হিসাবে টাকা জমা হয়। এই হিসাবের অনুকূলে সিটিব্যাংক এনএ দুটি ক্রেডিট কার্ড ইস্যু করে। প্রথমটি (৪৫৬৮৮১৭০০০০৬৪১২৪) মামুনের। দ্বিতীয়টি (৪৫৬৮৮১৭০১০০৬৪১২২) তারেক রহমানের।

ডেবরা আদালতে জানান, ২০০২ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে তারেক ওই ক্রেডিট কার্ডে বিপরীতে ৫০,৬১৩.৯৭ ডলার খরচ করেন। এর সিংহভাগ খাদিজারই পাঠানো টাকার অংশ। অথচ রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ২০০৭ সালে দাখিল করা তারেকের একটি সম্পদ বিবরণীর তথ্য এসেছে। এর বরাতে তাকে খালাস দেওয়া হয়।

পর্যবেক্ষণে বলা হয়, সিঙ্গাপুরে সিটিব্যাংক এনএতে গিয়াসউদ্দিন আল মামুন তার হিসাবে ওই অর্থ জমা করেন। মামুন ওই টাকার বৈধ উৎস দেখাতে পারেননি বলে তাকে সাজা দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু আসামি তারেক রহমান কাজ পাইয়ে দিতে খাদিজা ইসলামের কাছে কোনো অর্থ দাবি করেননি। তদন্ত কর্মকর্তা বলেছেন, খাদিজা ইসলাম মামুনকে ঘুষ দিতে বাধ্য হন। কিন্তু তদন্ত কর্মকর্তা বলেননি যে, আসামি তারেক রহমান খাদিজার কাছে অর্থ দাবি করেছেন।

রায়ে বলা হয়, সাক্ষী ডেবরা লাপ্রোভোত্তে সাক্ষ্যে বলেছেন যে, তারেক রহমান ৫০ হাজারের বেশি মার্কিন ডলার ব্যয় করেছেন। এ বিষয়ে কিছু কাগজপত্র তিনি আদালতে দাখিল করেছেন। কিন্তু তারেক রহমান ২০০৭ সালের ৭ জুন দাখিল করা সম্পদ বিবরণীতে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে খরচ করা টাকার কথা উল্লেখ করেছেন। ফলে ২০০২ সালের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন অনুযায়ী কোনো অপরাধ করেননি। তার বিরুদ্ধে তদন্ত কর্মকর্তা প্রাথমিকভাবে অভিযোগ প্রমাণ সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করেছেন।

দুদকের প্রধান কৌঁসুলি ও বর্তমানে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সে সময় জানান, তারেক রহমানের সম্পদ বিবরণীর বিষয়টি সাক্ষ্য হিসেবে আদালতে উপস্থাপনই করা হয়নি। কিন্তু এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে আদালত কিছু কিছু বিষয় বিবেচনায় নিয়ে রায় দিয়েছেন।

দুদকের অপর কৌঁসুলি মোশাররফ হোসেন বলেন, তারেক রহমানের সম্পদ বিবরণীর বিষয়টি মামলায় বিবেচ্য ছিল না। অথচ আদালত সম্পদ বিবরণীতে ওই অর্থেয় বিষয় উল্লেখ রয়েছে বলে তারেক রহমানকে খালাস দিয়েছেন বিচারক।

এই মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ের বিপক্ষে অবশ্য উচ্চ আদালতে আপিল করেছে দুদক। আপিল গ্রহণ করে তারেক রহমানকে হাজিরা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট।

(ঢাকাটাইমস/১১মার্চ/ এআর )