ঢাকা: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় ১৯৯৩ সালে। সেই সংসদ বিলুপ্তির দুই দশকেও আর নির্বাচনের উদ্যোগ নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। গত নভেম্বরে তফসিল ঘোষণার পরও নির্বাচন না হওয়ায় হতাশ শিক্ষার্থীরা।
উপাচার্য থাকাকালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ-জাকসু নির্বাচনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন ড. আনোয়ার হোসেন। ২ জানুয়ারি ভোটের তারিখ ধরে গত ১৩ নভেম্বর তফসিল ঘোষণার পর অবশ্য উপাচার্যবিরোধী আন্দোলনের কারণে আর হয়নি সে নির্বাচন।
বিশ্ববিদ্যালয়টিতে সর্বশেষ ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়েছে সেই ১৯৯৩ সালে। সেই সংসদ বিলুপ্তির দুই দশকেও আর নির্বাচনের উদ্যোগ নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সর্বশেষ গত নভেম্বরে তফসিল ঘোষণার পরও নির্বাচন না হওয়ায় হতাশ শিক্ষার্থীরা।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ড. আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি যাতে জাকসু নির্বাচন হয়। কিন্তু আন্দোলন ও পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে তা করা সম্ভব হয়নি। বাধ্য হয়েই নির্বাচন স্থগিত করা হয়।’
তবে বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘জাকসু নির্বাচন এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমি সব মহলের সাথে আলোচনা করে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে পদক্ষেপ নেব।’
কেবল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় না, বাংলাদেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজগুলোতেও প্রতি বছর এই ছাত্র সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও হচ্ছে না দুই যুগ ধরে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্বৈরাচারী শাসনের পর ১৯৯০ সালের পর থেকে দেশে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শাসক নির্বাচন হয়ে আসলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পুরো উল্টো পরিস্থিতি। নানা সময় আন্দোলন, দাবি এমনকি আদালতে গিয়েও প্রতিনিধি নির্বাচনের অধিকার পায়নি শিক্ষার্থীরা।
’৯০-এর পর প্রতিটি সরকার ক্ষমতায় এসে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দেয়ার আশ্বাস দিয়েছিল। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পরও এমন আশ্বাস দেয়া হয় সরকারের বিভিন্ন স্তর থেকে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও নির্বাচন করার কথা জানিয়েছিল।
নির্বাচিত প্রতিনিধি না থাকায় ছাত্র সংগঠনগুলো অগণতান্ত্রিক এবং স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠছে বলে অভিযোগ আছে। এর পাশাপাশি দেশে নতুন রাজনৈতিক নেতৃত্ব গড়ে ওঠার ক্ষেত্রেও বাধা তৈরি হচ্ছে।
জানতে চাইলে ডাকসুর সাবেক জিএস খায়রুল কবির খোকন বলেন, ছাত্র সংসদ নির্বাচন একটি জাতির নেতৃত্ব গঠনের অন্যতম সংঘ। এটা না থাকায় নতুন ও মেধাবী নেতৃত্ব তৈরি হয় না। তাই ছাত্র সংসদ নির্বাচন খুবই জরুরি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন হওয়া উচিত। কারণ এর মধ্য দিয়েই ছাত্র অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যায়। আর বন্ধ হয় লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি।’
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনও এই নির্বাচনের পক্ষে। কমিশনের চেয়ারম্যান এ কে আজাদ চৌধুরী এই সময়কে বলেন, ছাত্র সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিত্ব সৃষ্টি করা ও সহাবস্থান নিশ্চিত করার জন্যই আমরা নির্বাচন চাই। কিন্তু সব ছাত্র সংগঠনের সহযোগিতা না পাওয়ায় নির্বাচন করা যায়নি। ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হয়ে ছাত্র রাজনীতিসহ জাতীয় রাজনীতির বিরাট ক্ষতি হচ্ছে বলেও মনে করেন তিনি।
দেশে বর্তমানে মোট ৩৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশে পরিচালিত দেশের প্রধান চার বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু থেকে কার্যকর ছিল ছাত্র সংসদ। ১৯৮৯ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচন বন্ধের মধ্য দিয়ে একে একে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের ছাত্র সংসদ কার্যক্রম বন্ধ হয়ে পড়ে। এরপর স্থাপিত নতুন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে আর কোনো ছাত্র সংসদ গঠিত হয়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ-ডাকসু নির্বাচন চেয়ে ২০১৩ সালের ১২ মার্চ হাইকোর্টে রিট করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৫ জন শিক্ষার্থী। ৮ এপ্রিল প্রাথমিক শুনানি শেষে সুনির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানে কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা কেন অবৈধ হবে না তা জানতে চায় আদালত। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচনের কোনো ব্যবস্থাই করতে পারেনি, যদিও উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ২০০৯ সালে দায়িত্ব নেয়ার পরই নির্বাচন দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বশেষ ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় ১৯৯০ সালের ৬ জুন। এরপর ১৯৯১, ১৯৯৪ ও ১৯৯৫ সালে তিন দফায় তফসিল ঘোষণা করলেও হয়নি নির্বাচন। ১৯৯৭ সালে বঙ্গবন্ধু হলে ছাত্রদল নেতা আরিফ হোসেন তাজ খুনের পর একটি তদন্ত কমিটি ৬ মাসের মধ্যে নির্বাচন দেয়ার সুপারিশ করলেও সেই ৬ মাস আসেনি ১৭ বছরেও।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়েছে সর্বশেষ ১৯৮৯ সালে। তখন ভিপি ও জিএস নির্বাচিত হন যথাক্রমে বিএনপির বর্তমান যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ এবং বিচার প্রশাসনে কর্মরত রুহুল কুদ্দুস বাবু।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ-চাকসু নির্বাচন ১৯৯০ সালের পর আর হয়নি। তখন ভিপি ও জিএস হন যথাক্রমে নাজিম উদ্দীন এবং আজিম উদ্দীন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ-জাকসু নির্বাচন হয়েছে সর্বশেষ ১৯৯৩ সালে। সেখানেও একাধিকবার তফসিল ঘোষণা করলেও নির্বাচন আর হয়নি।
ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক সমিতি, সিন্ডিকেট, সিনেট, ডিন, কর্মচারী সমিতির নির্বাচন হচ্ছে নিয়মিত। ছাত্রদের অভিযোগ, ডাকসু নির্বাচন দিলে শিক্ষকদের কর্তৃত্ব কমে যাবে, এই আশঙ্কাতেই নির্বাচন দিচ্ছে না প্রশাসন।
নিজের দায় স্বীকার করে না কেউ : ছাত্র সংসদ নির্বাচন কেন হচ্ছে না, এমন প্রশ্নের জবাবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দায়ী করছে ছাত্র সংগঠনগুলোকে। আবার সরকারি দলের ছাত্র সংগঠন দায়ী করে বিরোধী ছাত্র সংগঠনকে, আর বিরোধীরা দায়ী করছে সরকার সমর্থকদেরকে।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, ‘ইচ্ছা থাকলেও রাজনৈতিক নানা সমস্যার কারণে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিতে পারিনি আমরা। এই নির্বাচনের জন্য সব ছাত্র সংগঠনকে যার যার অবস্থান থেকে কাজ করতে হবে। কিন্তু তারা একমত হতে পারে না কোনো বিষয়ে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ছাত্রলীগের সভাপতি বদিউজ্জামান সোহাগ বলেন, ‘আমরা ছাত্র সংসদ নির্বাচন চাই। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অস্থিতিশীলতার অজুহাতে নির্বাচন দেন না। এটা খুবই দুঃখজনক ঘটনা। আমরা বর্তমান প্রশাসনের কাছে অনেক বার ছাত্র সংসদ নির্বাচনের জন্য দাবি জানিয়েছি।’
আরেক বড় ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের সভাপতি আবদুল কাদের ভূঁইয়া জুয়েল দাবি করেছেন তারা ছাত্র সংগঠন নির্বাচনের পক্ষে। তবে এর আগে বেশ কিছু দাবি পূরণ করতে হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আগে সকল ছাত্র সংগঠনের সহাবস্থান নিশ্চিত করতে হবে।
বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে আপনাদের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ ছিল, তখন কেন এ সবের সমাধান করে নির্বাচনের দাবি ছাত্রদল তোলেনিÑজানতে চাইলে সংগঠনের সভাপতি বলেন, তখনও আমরা দাবি জানিয়েছিলাম। কিন্তু ছাত্রলীগের বিরোধিতার কারণে নির্বাচন হয়নি।
ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হাসান তারেক বলেন, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন চালু করা এখন সময়ের দাবি। নতুন নেতৃত্ব ও ছাত্রছাত্রীদের অধিকার আদায়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই।
নির্বাচন না হওয়ায় কী কী থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা : একাডেমিক কার্যক্রমের প্রধান কেন্দ্র হিসেবে ছাত্র সংসদগুলো রেখেছে নানা ভূমিকা, তৈরি করেছে নতুন নেতৃত্ব ও চেতনা। কিন্তু নির্বাচন না হওয়ায় সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ন্যায্য অধিকার রক্ষায় কোনো যোগ্য প্রতিনিধিত্ব গড়ে ওঠতে পারছে না। ডাকসুর মতো শক্তিশালী প্লাটফর্ম অকার্যকর থাকায় আবাসিক হলগুলোতে সীমাহীন দুর্নীতি ও অনিয়ম বিরাজ করলেও সাধারণ ছাত্রদের প্রতিবাদের কোনো উপায় নেই। ফলে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তারা।
ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়ায় ছাত্র সংগঠনগুলোর জবাবহিদিতা কমে গেছে বলেও মনে করেন শিক্ষার্থীরা। জবাবদিহিতা না থাকায় ছাত্রদের জোর করে মিছিলে নেয়া, হলের বৈঠকে অংশ নিতে বাধ্য করা, কথা না শুনলে হয়রানি ও মারপিট, চাঁদা আদায়ের অভিযোগ আছে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের বিরুদ্ধে।
হলগুলোতে সাংস্কৃতিক কর্মকা-ও বন্ধ প্রায়। আন্তঃহল প্রতিযোগিতা শেষ কবে হয়েছে বলতে পারে না কেউ। আবার ছাত্রদের নানা দাবি-দাওয়া শিক্ষক বা প্রশাসনের কাছে তোলারও নির্দিষ্ট কোনো উপায় নেই।
ছাত্র সংসদ না থাকলেও চাঁদা দিতে হয় শিক্ষার্থীদের: ছাত্র সংসদ সচল না থাকলেও শিক্ষার্থীদেরকে প্রতি বছরই নির্ধারিত হারে চাঁদা দিয়ে যাচ্ছে। বরং এই চাঁদা গত বিশ বছরে বেড়েছে।
জিয়া হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মোতাহার হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘ভর্তির সময় শিক্ষার্থীদের থেকে ডাকসু নির্বাচনের জন্য টাকা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আমাদের সাথে প্রতারণা করছেন।’
জাকসুর সাবেক নেতা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মানোষ চৌধুরী ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘ছাত্র সংসদের জন্য যে টাকা নেওয়া হয় সেটা যদিও গৌণ, তারপরেও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ওই টাকাটা নেয়া অনৈতিক। কারণ এখন তো আর জাকসু নেই।
(ঢাকাটাইমস/১৩ মার্চ/ এমএম/ এআর/ ঘ.)