logo ০৩ মে ২০২৫
খোকা পারেননি হান্নান শাহরা কি পারবেন
নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকাটাইমস
১৯ মার্চ, ২০১৪ ১০:৩৯:৩৬
image


ঢাকা: সাদেক হোসেন খোকার নেতৃত্বাধীন ঢাকা মহানগর বিএনপির বর্তমান কমিটিকে ব্যর্থ বলে মনে করেন বেগম খালেদা জিয়া। গত ১০ ফেব্রুয়ারি মহানগর বিএনপি নেতাদের ডেকে নিয়ে বেগম জিয়া নিজেই একথা জানিয়ে দেন। সাদেক হোসেন খোকা তখন কারাগারে অন্তরীণ ছিলেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাড়াবাড়ির কারণে ঢাকায় আন্দোলন-সংগ্রাম করা যায়নি, মহানগর বিএনপির নেতারা এমন যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করলে রীতিমতো ক্ষেপে গিয়েছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন। বলেছিলেন, সেনানিবাসের বাড়ি থেকে তাকে যখন বেরিয়ে যেতে বাধ্য করা হয় তখন তো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গুলি চালায়নি। তাহলে ওই সময় কেন মহানগর বিএনপির নেতারা নিষ্ক্রিয় ছিল? কেন তাদের রাস্তায় দেখা যায়নি? উপস্থিত নেতাদের উদ্দেশে খালেদা জিয়া বলেন, ‘তোমরা ব্যর্থ।’ মহানগর বিএনপির সদস্যসচিব আবদুস সালাম নিজেদের ভুলত্রুটি স্বীকার করে বেগম জিয়ার উদ্দেশে বলেন, ‘আপনি আমাদের মা, ক্ষমা করে দিয়ে সবাইকে নিয়ে নতুন করে কমিটি করে দিন।’ বেগম জিয়া তাকে ধমক দেন। বলেন, ‘চুপ কর। সব পকেট কমিটি করা হয়েছে। আমি জানি এখন কী করতে হবে।’

এরপর পানি অনেকদূর গড়িয়েছে। কারাগার থেকে বেরিয়ে মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক সাদেক হোসেন খোকা সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি আর দায়িত্ব পালন করতে আগ্রহী নন। নতুন কাউকে দলের চেয়ারপারসন বেছে নেবেন এমন আহ্বানই জানিয়েছেন খোকা। খোকার এ আহ্বানে বিএনপিতে এক ধরনের অস্বস্তি তৈরি হয়েছে ঠিকই কিন্তু কানাঘুষাও চলছে যে, অপাসরণ না করে দলের চেয়ারপারসন তাকে সসম্মানে বিদায়ের রাস্তা করে দিচ্ছেন বলেই এতসব আয়োজন। সাদেক হোসেন খোকার নেতৃত্বাধীন মহানগর কমিটিকে দলের চেয়ারপারসনসহ বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতারা ব্যর্থ বলছেন এ কারণে যে, সরকারবিরোধী আন্দোলন বেগবান করতে রাজধানীতে যে আয়োজন থাকা দরকার সংশ্লিষ্টরা তা কখনোই নেননি। এমনকি মহানগরের বিভিন্ন থানা ও ইউনিট কমিটিতে এমন সব নেতৃত্বকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে যারা মূলত আর্থিক লেনদেনের কারণে পদ পেয়েছেন। একেকটি থানা কমিটি গঠনে কোটি টাকার ওপরেও লেনদেন হয়েছে এমন অভিযোগও আছে। দল চালাতে টাকা লাগেÑএই যুক্তিতে আর্থিক লেনদেন হয়েছে নাকি মহানগরের শীর্ষ নেতৃত্বের পকেট ভারি করতেই ‘পকেট’ কমিটি? সেই ব্যাখ্যা একদিন হয়তো পাওয়া যাবে। কিন্তু দল চালাতে টাকার জোগাড় কীভাবে হবে? ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) হান্নান শাহ নাকি এ চিন্তাতেই দায়িত্ব নেবেন কি নেবেন না তা নিয়ে দোটানায় আছেন। মহানগরের শীর্ষপদ যার হাতে দিয়ে বেগম জিয়া নির্ভর থাকবেন এমন নেতাই নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মির্জা আব্বাস, আবদুল আউয়াল মিন্টু সভাপতির দায়িত্ব নিতে নাকি রাজি নন। হান্নান শাহ টাকার জোগাড় সাপেক্ষে দায়িত্ব নিতে তৈরি আছেন। কীভাবে সেই টাকার জোগাড় হবে তা সবিস্তারে ব্যাখ্যা করতে হান্নান শাহ’র ডিওএইচএস মহাখালীর বাসায় ছুটে গিয়েছিলেন মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক এমএ কাইয়ুম। বিএনপির অভ্যন্তরে এই আলোচনা আছে যে, প্রকারান্তরে মহানগর বিএনপির নেতৃত্বের নাটাই নিজের হাতে রাখতে সাদেক হোসেন খোকা কাইয়ুমের মতো নেতাদের কাজে লাগাচ্ছেন।

’৯৬-এ রাজধানীতে আটটি আসনের মধ্যে সাতটিতে পরাজিত বিএনপি জিতেছিল শুধুমাত্র কোতোয়ালি-সূত্রাপুর আসনে। সাদেক হোসেন খোকা জয়ের পুরস্কারস্বরূপ মহানগর বিএনপির দায়িত্ব পেয়েছিলেন। এরপর সরকারবিরোধী আন্দোলনে সবসময় রাজপথে অগ্রভাগে দেখা গেছে তাকে। তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতা দলের ভেতরে-বাইরে সবসময় প্রশংসা পেয়েছে। রাজনীতির বাইরে পেশাজীবী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, ক্রীড়া সংগঠক, ক্রীড়াবিদসহ সবার সঙ্গে সম্পর্ক করার ক্ষেত্রে সাদেক হোসেন খোকার জুড়িমেলা ভার। এ আলোচনা বিএনপির ভেতরে এবং বাইরে সবসময়ই ছিল। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর প্রথমে মন্ত্রী ও পরে ঢাকার মেয়র হিসেবে সাদেক হোসেন খোকা কতখানি যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন সে প্রশ্ন পরবর্তী সময়ে উঠেছে। আর সাংগঠনিকভাবে আসলেই তিনি কতটা দক্ষ- এবার সে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে খোদ দলের চেয়ারপারসনের মুখেই। ১৭ বছরেরও বেশি মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক আর আট বছরের বেশি মেয়রের দায়িত্ব পালনের পরে খোকা যদি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে থাকেন তাহলে হান্নান শাহ কিংবা অন্য যাদের নাম মহানগর বিএনপির সম্ভাব্য নেতা হিসেবে আলোচনায় আছে তারা যে পারবেন তাঁর কী কোনো গ্যারান্টি আছে? বিএনপিতে সাদেক হোসেন খোকার অনুগামীরা আড়ালে-আবডালে এই প্রশ্নও ছুঁড়ে দিচ্ছেন। তারা বলছেন, আর্থিকভাবে ফুলেফেঁপে ওঠার অভিযোগে খোকা যদি অভিযুক্ত হন তাহলে একই অভিযোগ রয়েছে মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে। আমান উল্লাহ আমান নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানে বীরোচিত ভূমিকা রাখলেও এমপি-মন্ত্রী হওয়ার পর বিপ্লবী চরিত্র আদৌ ধরে রাখতে পেরেছেন কি? আবদুল আউয়াল মিন্টু মাঠের রাজনীতি কখনোই করেননি। আবুল খায়ের ভূঁইয়া, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানীর নামও ঘুরেফিরে এসেছে। কিন্তু মহানগরের নেতাদের একাট্টা করার ক্ষেত্রে তাঁরা আদৌ বড় কোনো ভূমিকা নিতে পারবেন, এমনটাও সংশ্লিষ্টরা মনে করেন না। হাবিব-উন-নবী খান সোহেল নতুন কমিটির সদস্যসচিব হলে কেমন হয় এ আলোচনাও নাকি চলছে। কিন্তু হঠাৎ করে মহানগর বিএনপির নেতৃত্বের সামনের কাতারে তাঁর চলে আসাটা মতিঝিল ও আশপাশের নেতারা কতটা মেনে নেবেন সেটাও ভাববার বিষয়। আর হান্নান শাহ তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে কার্যত অসফল বলেই মনে করেন বিএনপির নেতৃত্বের একাংশ। পাঁচবার সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে মাত্র একবার জয়ী হান্নান শাহ কখনোই কর্মী বান্ধব হিসেবে পরিচিত নন। তাঁর উগ্রতা, অসহিষ্ণু আচরণ বিভিন্ন সময় বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। রাজধানীর মতো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নগর কমিটিতে সবাইকে নিয়ে কাজ করার মতো ধৈর্য ও সহ্য হান্নান শাহ’র কতখানি আছে বিএনপির গুলশান কার্যালয়ে পাড়া দিলে ফিসফাঁস সময়ই শোনা যাচ্ছে। আন্দোলন সংগ্রাম ও রাজপথে কর্মী নামাতে যে সাংগঠনিক দক্ষতার প্রয়োজন সেই পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ একজনকে নতুন করে পরীক্ষা করা বিএনপির জন্য কতখানি সমীচীন সেই প্রশ্নও বিএনপিতে আছে। আবার এমন প্রশ্নও কেউ কেউ করছেন, যাকেই বেগম জিয়া মহানগর বিএনপির দায়িত্ব দিক না কেন তাকে লড়তে হবে সাদেক হোসেন খোকার ছায়ার সঙ্গে। কেমন? মহানগর বিএনপির বিভিন্ন থানা ও ইউনিট কমিটিতে নেতৃত্বের সামনের কাতারে যারা আছেন তাদের ৯০ ভাগই কোনো না কোনোভাবে সাদেক হোসেন খোকা ও তাঁর ঘনিষ্ঠ বিএনপি নেতাদের সুবিধাভোগী বলে পরিচিত। খোকা মেয়র থাকাকালে যারা কাউন্সিলর ছিলেন তারা কার্যত সবাই সাদেক হোসেন খোকার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন ও সুবিধা বিনিময় করেছেন। এভাবে দুপক্ষের মধ্যে যে গভীর দেওয়া-নেওয়ার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তা পরবর্তীতে দল পরিচালনার ক্ষেত্রেও তারা প্রয়োগ করেছেন বলে বিএনপিতেই আলোচনা হয়। গোটা নগরীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এই নেতৃত্বকে কীভাবে উপেক্ষা করবেন যিনি নগর বিএনপির দায়িত্ব পাবেন? সাদেক হোসেন খোকাকে বাদ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নগর বিএনপিতে তাঁর অনুগামীদের বাদ দেওয়া কি সম্ভব হবে? বেগম জিয়ার ভাষায় ‘পকেট’ কমিটি কি দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পাবে? শীর্ষস্থানীয় বিএনপি নেতাদের কেউ কেউ বলছেন, এটি রীতিমতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজ হবে। কারণ, রাতারাতি থানা, ওয়ার্ড ও ইউনিট পর্যায়ে শতভাগ নতুন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে গেলে দলের ভেতর থেকেই প্রতিরোধের চেষ্টা হবে। তাহলে এই ঝুঁকি কি বেগম জিয়া নেবেন? আর সাদেক হোসেন খোকাকে ‘ব্যর্থ’ তকমা দিয়ে বাদ দেওয়ার পর সেই জায়গায় নতুন যাকেই বসানো হোক না কেন তাকে কেন সফল হওয়ার সুযোগ দেবেন খোকার অনুগামীরা। মহানগর বিএনপির নতুন কমিটি গঠন করার ক্ষেত্রে চুলচেরা বিশ্লেষণের বিভিন্ন পর্যায়ে এ ভাবনা বারবার শীর্ষ নেতৃত্বের মাথায় আসছে। ঢাকা মহানগর বিএনপির নেতৃত্ব খোলনলচে বদল নাকি নিচের দিকের কয়েকজন নেতাকে গুরুত্বহীন করে দিয়ে খোকার ওপরে ফের আস্থা রাখা, এমন চিন্তাভাবনাও সংশ্লিষ্টরা করছেন। ‘পকেট’ কমিটি করার ক্ষেত্রে নগর বিএনপি নেতা আবদুস সালাম, এমএ কাইয়ুম, আলী আজগর মাতব্বর ব্যাপক দুর্নাম কামিয়েছেন। আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়িক সম্পর্ক রাখা এমএ কাইয়ুমদের গুরুত্বহীন করে দিয়ে খোকাকে নতুন করে নগর কমিটি ঢেলে সাজাতে দিলে মন্দের ভাল হয় বেগম জিয়াকে এমন কথাও কেউ কেউ বলেছেন। কারণ, নতুন যাকেই দায়িত্ব দেয়া হোক না কেন খোকার অনুগামীরা যদি তাকে শতভাগ সহযোগিতা না করেন তাহলে তার পক্ষে সরকারবিরোধী আন্দোলনে রাজধানীতে নেতাকর্মীদের রাজপথে নামানো কার্যত অসম্ভব হবে।

গয়েশ্বর রায়, মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, রফিকুল ইসলাম মিয়াসহ অনেক নেতাকেই মহানগর বিএনপির কর্মকা-ের সঙ্গে যুক্ত করার কথা শোনা যাচ্ছে। কিন্তু বিএনপির ভেতরে এ প্রশ্নও আছে এ নেতারা কি তাদের দায়িত্ব ঠিকঠাক পালন করতে পেরেছেন? যদি তা না হয় তাহলে ঢাকা মহানগরের ক্ষেত্রে কীভাবে তাঁরা সফল হবেন? সবমিলিয়ে ঢাকা মহানগর বিএনপি পুনর্গঠন করতে গিয়ে এক জগাখিচুড়ি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ‘ব্যর্থ’ সাদেক হোসেন খোকাকে  এক্ষেত্রে সফল বলে মনে করছেন বিএনপির একাংশের নেতারা। আর্থিকভাবে ফুলেফেঁপে ওঠা নেতারা আর কখনোই রাজপথে সক্রিয় হতে পারবেন? সেই নৈতিক অবস্থান কী তাদের আছে? বিএনপির তৃণমূল স্তরের নেতা-কর্মীরা এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে ফিরছেন।

(ঢাকাটাইমস/ ১৯ মার্চ/ জিএম/এআর/  ঘ.)