logo ০৩ মে ২০২৫
মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে “সুন্দরী” ঢাকা
তানিম আহমেদ,ঢাকাটাইমস
১৯ মার্চ, ২০১৪ ১১:১১:০৪
image


ঢাকা: ঢাকার রাজপথে রয়েল বেঙ্গল টাইগার। অথচ ভয় পাচ্ছে না কেউ, বরং আদর, কাছে যেতে মানুষের সে কী চেষ্টা। সড়কের ধারে উড়ে বেড়াচ্ছে বিশাল আকারের প্রজাপতি। মানুষ দেখেও ভয় পাচ্ছে না সেগুলো। দূর আকাশের তারা নেমে এসেছে মাটিতে। গাছের ডালে ঝুলছে সব।

দল বেঁধে খেলোয়াড়রা বিশাল আকারের ক্রিকেট ব্যাটবল আর স্ট্যাম্প হাতে নেমে পড়েছেন। তারাও আছেন সড়কের ধারে। না, এর কিছুই সত্য নয়, নানা ধরনের বাতি আর ম্যুরালে ঢাকাকে সাজানো হয়েছে নানা উপায়ে। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট বিশ্বকাপ উপলক্ষে ১৫টি দেশের খেলোয়াড়রা এসেছেন বাংলাদেশে। এসেছে তাদের সমর্থকরাও। বাংলাদেশের রাজধানীকে বিবর্ণ দেখবে তারা, তা কী হয়? তাই ১১৫ কোটি টাকা খরচ করে ঢাকাকে ‘সুন্দরী’ নগরীর পরিচয়ে ফিরিয়ে আনার এই চেষ্টা।

ঢাকার এই পরিচয় ছিল মুঘল আমলেও। সেই আমলে যাতায়াতের সমস্যার মধ্যেও সুদূর দিল্লি থেকে ঢাকায় আসতো পর্যটকরা। কিন্তু ঢাকামুখী মানুষের স্রোত আর অপরিকল্পিত নগরায়নে সৌন্দর্য হারিয়েছে ঢাকা। তবে মাঝেমধ্যেই ঢাকার সাজসজ্জা আকর্ষণ করে নগরবাসীদের। আর দলে দলে আনন্দ করতে বের হয় তারা।

গত তিন বছরে এই ঘটনাটি ঘটেছে দুই বার। ২০১১ সালে ক্রিকেট বিশ্বকাপের আগে এবং টুর্নামেন্ট চলাকালে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় সৌন্দর্যবর্ধন আর আলোকসজ্জা অভিভূত করে মানুষকে। এবারও উৎসব সেই ক্রিকেটকে ঘিরেই। টি- টোয়েন্টি বিশ্বকাপ উপলক্ষে একইভাবে ঢাকার একটি অংশে করা হয়েছে আকর্ষণীয় আলোকসজ্জা। সড়কদ্বীপ আর ফুটপাতগুলোও সেজেছে নতুন রূপে। সড়কের পাশের ভবনগুলোতেও করা হয়েছে নতুন রঙ। আর সব মিলিয়ে দেখার মতো নগরী হয়েছে ঢাকা।

১৪ মার্চ রাত সাড়ে ৮টা, মিরপুরের শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের সামনে উপচেপড়া ভিড়। কেউ এসেছেন একা, কেউ বন্ধু নিয়ে, কেউ বা পরিবার-পরিজন নিয়ে এসেছেন ঢাকার এই নতুন রূপ দেখতে।

যাত্রাবাড়ির দোলাইরপাড় এলাকা থেকে ছেলেমেয়ে নিয়ে আবদুর রহমান ঘুরতে এসেছেন। ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, ‘নিজের শহরে হচ্ছে বিশ্বকাপ। আর ঢাকাকে সাজানো হয়েছে আকর্ষণীয় রূপে। ছেলেমেয়ে দেখতে চাইলো, আর বয়স হয়েছে বলে নিজের স্বাদ-আহ্লাদও তো আর শেষ হয়ে যায়নি। তাই ঘুরতে আসলাম সবাই মিলে।’

স্টেডিয়ামের আশপাশে অনেককে দল বেঁধে গান গাইতে দেখা গেল। মোটরসাইকেলের মিছিলও দেখা গেল। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের হয়ে স্লোগান দিচ্ছিল তারা। চোখ ভরা স্বপ্ন তাদেরÑএই টুর্নামেন্টে ভালো করবে প্রিয় সাকিব-মুশফিকরা।

ঢাকার এই নতুন সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে যেতে হবে রাতের বেলা। আঁধার নামলেই হাজারো মরিচ বাতি দিয়ে তৈরি করা নানা রঙ আর ঢংয়ের প্রতিকৃতি, রঙ-বেরঙয়ের ব্যানার-ফেস্টুন আর নিয়ন বাতি নগরীতে আনে অন্য রকম আবহ।

এই নতুন ঢাকা দেখতে খামারবাড়ি এলাকায় ঘুরতে দেখা গেল একদল তরুণকে। দল বেঁধে তারা ঘুরেছে এখানে- সেখানে। গাছের মধ্যে ‘তারা’র পাশে দাঁড়িয়ে একজোট হয়ে ছবি তুলছিল তারা। ‘তারা’গুলোকে ছুঁয়ে দেখারও চেষ্টা করছিল কেউ কেউ।

একজন বলেন, ‘ইস, সবসময় যদি ঢাকা এমন থাকত! অন্তত অবসর সময়ে আমরা ঘুরতে পারতাম মন ভরে। পৃথিবীর বড় বড় নগরীগুলোতে স্থায়ী বহু স্থাপনা আছে। আমাদের এখানে যে কবে হবে!’  

বিশ্বকাপ উপলক্ষে নান্দনিকতার ছোঁয়া লেগেছে বিমানবন্দর থেকে শাহবাগ এবং হোটেল রূপসী বাংলা থেকে শুরু করে মিরপুরের শেরেবাংলা স্টেডিয়াম পর্যন্ত। সড়কের দু পাশে বাঙালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে প্রাধান্য দিয়ে নানা রঙ ও ঢঙের সাজ। নিয়ন বাতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মরিচ বাতি দিয়ে নানা রকম আলোকসজ্জা। সড়ক বিভাজনে রঙিন আলোর রোশনাই। পানির ফোয়ারার ভেতর থেকে বের হচ্ছে বাহারি আলোকরশ্মি। গাছে ও বহুতল ভবনে জ্বলছে লাল-নীল-সবুজ মরিচ বাতি। এভাবে প্রায় পুরো শহরেই তৈরি হয়েছে আলো-আঁধারের অন্য রকম আবহ। এককথায় রাতের ঢাকায় দৃষ্টিনন্দন ও বর্ণিল এ সাজ আরো প্রস্ফুটিত হচ্ছে।

ঢাকা সাজানোর এই কাজ করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোর। তাদের সঙ্গে ছিল নৌবাহিনীসহ সরকারি- বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা। সার্বিক তত্ত্বাবধান করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে শাহবাগ পর্যন্ত মূল সড়কের বিভাজক এবং দুই পাশ দৃষ্টিনন্দনভাবে সাজানো হয়েছে। থাকছে বাঙালি সংস্কৃতিকে তুলে ধরার বিভিন্ন কাঠামো। বিজয় সরণি র‌্যাংগস ভবন পয়েন্টের চৌরাস্তাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে সাজানো হয়েছে। সেখানে থাকছে পানির  ফোয়ারা ও আলোকরশ্মি। এই দু-এর সম্মিলনে মোহনীয় হয়ে ওঠেছে চারপাশ। বিজয় সরণি ও রোকেয়া সরণির সংযোগস্থল বিমানবন্দর চত্বরকেও আকর্ষণীয় করে তোলা হয়েছে। বিমানবন্দর চত্বর থেকে মিরপুর-১০ নম্বর গোল চত্বর হয়ে মিরপুর-২ নম্বর পর্যন্ত এলাকাকেও দৃষ্টিনন্দনভাবে সাজানো হয়েছে। বাঙালি সভ্যতার নানা নিদর্শন যেমন কৃষক-বাউল  থেকে শুরু করে বাংলাদেশের ক্রিকেটও স্থান পেয়েছে এ ক্রিকেটসজ্জায়। ঢাকা শহরে সাজসজ্জার এ কাজে প্রথমেই গুরুত্ব দেওয়া হয় সড়কগুলোর ওপর।

মূল ভেন্যু মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামের আশপাশের রাস্তাগুলো এরই মধ্যে কার্পেটিং করে ঝকঝকে করে ফেলা হয়েছে। একই সঙ্গে সড়ক প্রশস্তকরণ, ফুটপাত আধুনিকায়ন, সংস্কার করা হয়েছে নর্দমাগুলোও।  মিরপুর-১২ নম্বর থেকে কালসী প্রধান সড়ক প্রশস্ত করা হয়েছে।

সৌন্দর্যের ছোঁয়া লেগেছে সড়ক, ফুটপাত, সড়ক বিভাজক এবং সড়কদ্বীপে। মিরপুর থেকে বিজয় সরণি হয়ে এয়ারপোর্ট  রোড, মিরপুর-১০ নম্বর থেকে ইব্রাহিমপুর হয়ে ক্যান্টনমেন্টের ভেতর দিয়ে বনানী রেলক্রসিং, মিরপুর-১৪ নম্বর থেকে এয়ারপোর্ট রোডসহ এসব এলাকার অলিগলিগুলোও নতুন করে কার্পেটিং করা হয়েছে। সড়কদ্বীপের গাছপালার আবর্জনা পরিষ্কার, পানি ছিটানো, পরিপাটি করে সেগুলোর আধুনিকায়ন করা হয়েছে।

এছাড়া এসব এলাকার ট্রাফিক সাইন, রোড মার্কিং ও সড়কদ্বীপে রঙ লাগানো হয়েছে। সড়ক বিভাজকের ভেতরে লাগানো হয়েছে দৃষ্টিনন্দন দেশি-বিদেশি গাছ। প্রতিটি বিদ্যুতের পোলে বসানো হবে নতুন বাতি। পোল থেকে ঝুলবে লতাগুল্মের টব।

‘ইম্পুরুভমেন্ট অব রোড ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড বিউটিফিকেশন ওয়ার্কস অ্যারাউন্ড মিরপুর শেরেবাংলা ন্যাশনাল ক্রিকেট স্টেডিয়াম অ্যান্ড মেজর রোডস অব ঢাকা সিটি ফর আইসিসি ওয়ার্ল্ডকাপ টি-২০ বাংলাদেশ-২০১৪’ নামের প্রকল্পটির অধীনে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা ও দুটি আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম সংলগ্ন রাস্তার অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা হয়। প্রায় ২৩ কিলোমিটার রাস্তার অবকাঠামোগত উন্নয়ন, ২৩ দশমিক ৫০ কিলোমিটার রাস্তার ট্রাফিক সাইন, রোডমার্কিং আলোকায়ন ও বিদ্যুতায়ন এবং ২০ দশমিক ৫০ কিলোমিটার রাস্তা আলোয় সজ্জিতকরণ, সৌন্দর্যবর্ধন এ প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত ছিল।

তবে কেবল ক্রিকেট উৎসব নয়, ঢাকায় এ রকম সাজ হয়েছে নানা সময়। ২০০৫ সালেও সার্ক সম্মেলন উপলক্ষে একইভাবে সুন্দরীর সাজ নেয় ঢাকা। তখনও নগরবাসী প্রাণভরে উপভোগ করেছে তাদের প্রিয় নগরীকে। সেই সাজসজ্জার সৌন্দর্য এখনও রয়ে গেছে ঢাকায়।

স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন মনে করেন, ঢাকার সুন্দরী নগরীর পরিচয় স্থায়ীভাবে ফিরিয়ে আনা খুব একটা কঠিন নয়। সরকারের একটি পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা আর নগরবাসীর মধ্যে সচেতনতাবোধও প্রিয় নগরীটির বিশৃঙ্খলা দূর করে ঢাকাকে একটি আকর্ষণীয় নগরীতে পরিণত করতে পারে।

ঢাকাটাইমসকে মোবাশ্বের হোসেন বলেন, ‘টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ উপলক্ষে যে কাজ করা হচ্ছে সেগুলো সুন্দর হলেও তা স্থায়ী হবে না। আর এটা মানুষ ভুলেও যাবে।’ তিনি বলেন, ‘ভালো সড়কগুলোতে বারবার উন্নয়ন কাজ না করে ভাঙা সড়কগুলোর দিকে নজর দিতে হবে। তাহলে কেবল এক অঞ্চলের মানুষ নয়, উন্নয়নের সুফল পাবে গোটা নগরবাসী।’

(ঢাকাটাইমস/১৯ মার্চ/ টিএ/এআর/  ঘ.)