logo ০২ মে ২০২৫
ত্বকীর খুনিরা চিহ্নিত
হাবিবুল্লাহ ফাহাদ,ঢাকাটাইমস
২৫ মার্চ, ২০১৪ ১০:৪৫:০৫
image


ঢাকা: ‘ছেলেটা ছোট বেলা থেকেই অন্যরকম ছিল। কোনো ধরনের বাজে আড্ডা বা বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে মিশত না। পড়াশোনায় বেশ মন ছিল। পাঠ্যবইয়ের বাইরে অনেক বই পড়ত। লেখালেখিতেও হাত ছিল তার। এমন ছেলে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।’ নারায়ণগঞ্জে খুন হওয়া তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী সম্পর্কে বলছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা আমির হুসেইন।  

ত্বকীদের বাসা নারায়ণগঞ্জ শহরের শায়েস্তা খাঁ সড়কে। ২০১৩ সালের ৬ মার্চ বাসা থেকে সুধীজন পাঠাগারে যাচ্ছিল ত্বকী। কিন্তু আর ফিরে আসেনি সে। দুদিন পর শহরের চারারগোপে শীতলক্ষ্যা নদীর শাখা খালে পাওয়া যায় নিথর ত্বকীকে। খুন করা হয়েছে তাকে। এমন একজন কিশোরকে কে মারতে পারে?

মামলা করেন ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বী। তদন্তে গাফিলতির অভিযোগ উঠে পুলিশের বিরুদ্ধে। এরপর উচ্চ আদালতের নির্দেশে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় র‌্যাপিড একশন বাটালিয়নকে (র‌্যাব)।

এরপরও পেরিয়ে গেছে প্রায় ১০ মাস। তদন্ত অগ্রগতি কোন পর্যায়ে? জানতে চাইলে র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক জিয়াউল আহসান ঢাকাটাইমসকে জানান, ‘তদন্ত কাজ একটি জায়গা নিয়ে যেতে পেরেছে সংস্থাটি। ত্বকী হত্যায় আজমেরী ওসমানসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। শিগগির অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।’

ত্বকী নিখোঁজ হওয়ার পর গত বছরের ৬ মার্চ রাতে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) এবং ৮ মার্চ রাতে একই থানায় হত্যা মামলা করেন রফিউর রাব্বী। এজাহারে আসামি হিসেবে কারো নাম দেওয়া হলেও তিনি অভিযোগ করেন তার বর্তমান ও বিগত সময়ের নাগরিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে ক্ষুব্ধ কোনো গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে ত্বকীকে খুন করেছে। এর এক সপ্তাহ পর ১৮ মার্চ সন্দেহভাজন খুনি হিসেবে কয়েকজনের নামের তালিকার একটি অবহিতকরণপত্র জেলা পুলিশ সুপারকে দেন। সেখানে শামীম ওসমান, তার ছেলে অয়ন ওসমান, জেলা যুবলীগের বহিষ্কৃত প্রচার স¤পাদক জহিরুল ইসলাম ভূঁইয়া ওরফে ক্যাঙ্গারু পারভেজ, জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান ওরফে সুজন, সহসভাপতি রাজীব দাস, অয়ন ওসমানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী রিফাত বিন ওসমান, সালেহ রহমান ওরফে সীমান্তর নাম ছিল।

কিন্তু র‌্যাবের তদন্তে শামীম ওসমান, অয়ন ওসমান ও তার সহযোগীদের কোনো সংশ্লিষ্টতা মেলেনি। বরং শামীম ওসমানের বড় ভাই নাসিম ওসমানের ছেলে আজমেরী ওসমানসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে তথ্য-প্রমাণ বেরিয়ে এসেছে।

এই আজমেরী ওসমান নারায়ণগঞ্জে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য নাসিম ওসমানের ছেলে আর নারায়ণগঞ্জে আলোচিত সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের ভাতিজা। ছেলের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগÑঅথচ এ নিয়ে নাসিম ওসমান কথাই বলতে রাজি নন।

হত্যার পর থেকেই ত্বকীর পরিবারের অভিযোগের আঙুল ছিল ওসমান পরিবারের দিকে। ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বী নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও নাগরিক আন্দোলনের নেতা। মূলত বাসভাড়া বাড়িয়ে চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে প্রতিবাদ করে আসছিলেন তিনি। অভিযোগ আছে, এসব চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত ছিল ওসমান পরিবারের সদস্যরা। এছাড়া মেয়র নির্বাচনে সেলিনা হায়াত আইভীর পক্ষে জনসমর্থন গড়ে তুলতেও কাজ করেছেন রফিউর রাব্বী। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী ছিলেন শামীম ওসমান। কিন্তু তিনি আইভীর কাছে হেরে যান। এসব কারণে ওসমান পরিবার রফিউর রাব্বীকে শায়েস্তা করতে চেয়েছিল বলে অভিযোগ আছে জোরেশোরে।

সম্ভাব্য আসামিদের তালিকায় নাসিম ওসমান বা আজমেরী ওসমানের নাম ছিল না। এখন র‌্যাব বলছে তারা জড়িত। বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন? প্রশ্ন ছিল রফিউর রাব্বীর কাছে। তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘১৮ মার্চ পুলিশের কাছে আমরা অবগতিপত্র দেওয়ার দুই-একদিনের মধ্যে নিশ্চিত হই ওই ঘটনার সঙ্গে আজমেরী ওসমানও যুক্ত। গত বছরের ২৬ মার্চ এক জনসভায় আমরা বলেছিলাম, আজমেরী ওসমানের টর্চার সেলেই ত্বকীকে হত্যা করা হয়েছে। পরে গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের জবানবন্দিতেও এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

ত্বকী হত্যা তদন্ত পূর্ণাঙ্গ হয়নি অভিযোগ করে রফিউর রাব্বী বলেন, ‘এই হত্যায় অয়ন ওসমান (শামীম ওসমানের ছেলে) অবশ্যই জড়িত। কারণ, র‌্যাবের তদন্তে দেখা গেছে, নারায়ণগঞ্জের শ্রমকল্যাণ কেন্দ্রের এলাকা থেকে ত্বকীকে অপহরণ করা হয়েছে। আর এ জায়গাটা অয়ন ওসমান এবং তাদের লোকজনের ওঠাবসার জায়গা।’

তবে র‌্যাব কর্মকর্তা জিয়াউল আহসান বলেন, ‘আজমেরী ওসমানের পরিকল্পনা, নির্দেশনা ও উপস্থিতিতেই ত্বকীকে হত্যার প্রমাণ পেয়েছেন তারা। অয়ন ওসমানের বিরুদ্ধে স¤পৃক্ততার তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি।’



তদন্তে ১১ জনের নাম    

র‌্যাবের তদন্তে আজমেরী ওসমান ছাড়াও আরো যাদের নাম উঠে এসেছে এরা হলোÑরাজীব, কালাম সিকদার, মামুন, অপু, কাজল, শিপন, জামশেদ, ইউসুফ হোসেন, সুলতান শওকত ওরফে ভ্রমর ও তায়েবউদ্দিন ওরফে জ্যাকি। এদের মধ্যে আজমেরী ওসমানসহ প্রথম সাতজন পালিয়ে বেরাচ্ছেন। বাকিদের মধ্যে ভ্রমর সম্প্রতি জামিনে বের হয়েছেন। অন্যরা আছেন কারাগারেই।

র‌্যাব কর্মকর্তারা জানান, ইউসুফ হোসেন সন্ত্রাসী হিসেবে এলাকায় পরিচিত। তিনি আজমেরী ওসমানের ঘনিষ্ঠ। সুলতান শওকত নারায়ণগঞ্জ জেলা জাতীয় পার্টির সাবেক সভানেত্রীর ছেলে। আজমেরী ওসমানের ডান হাত হিসেবে তার পরিচিতি আছে। তায়েব উদ্দিনের পরিবারের সঙ্গে ওসমান পরিবারের পুরনো স¤পর্ক। তার বিরুদ্ধেও চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসের অভিযোগ আছে। চাঁদাবাজির অভিযোগ আছে কালাম সিকদারের বিরুদ্ধেও। আরেক অভিযুক্ত মামুন আজমেরী ওসমানের খালাত বোনের জামাই। আরেক অভিযুক্ত কাজলের ভাই যুবলীগ নেতা। অভিযুক্ত অপু আজমেরী ওসমানের অপরাধজগতের তথ্যদাতা। রাজীব ও শিপনকে আজমেরী ওসমান নিয়মিত বেতন দিত বলে তথ্য পেয়েছে র‌্যাব। অভিযুক্ত জামশেদ আজমেরী ওসমানের গাড়িচালক।

জামিন নিয়ে লাপাত্তা ভ্রমর

ত্বকী হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার সুলতান শওকত ওরফে ভ্রমর জামিনে বেরিয়ে লাপাত্তা হয়ে গেছেন। তিনি এই মামলায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। গত ১৩ মার্চ হাইকোর্ট ভ্রমরকে জামিন দেয়। পরে ২০ মার্চ বিকালে নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগার থেকে বের হন তিনি। কিন্তু ভ্রমরের পরিবারের দাবি, কারাগার থেকে বের হওয়ার পর বাসায় আসেনি ভ্রমর।

ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বী বলেন, ‘রাষ্ট্র বা সরকার ত্বকী হত্যার বিচার চায় না বলেই ভ্রমর জামিন পেয়েছেন।’

নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার নুরুল ইসলাম ঢাকাটাইমসকে জানান, তিনি ভ্রমরের জামিনের বিষয়টি আগে থেকে জানতেন না।  

যেভাবে হত্যা করা হয় ত্বকীকে

র‌্যাব জানায়, ত্বকী হত্যার জন্য আজমেরী ওসমান তার ঘনিষ্ঠ সুলতান শওকত, কালাম সিকদার, ইউসুফ, মামুন ও রাজীবের সঙ্গে পরামর্শ করে দিন-তারিখ ঠিক করেন। নারায়ণগঞ্জের ইকবাল রোডে ওসমান পরিবারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান উইনার ফ্যাশনকে (আজমেরী টর্চার সেল) হত্যার স্থান হিসেবে ঠিক করা হয়। ঘটনার সময় ইকবাল রোডের দুই মাথায় বাঁশ ফেলে গাড়ি ও সাধারণের চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়।

পরিকল্পনা অনুযায়ী, ইউসুফ হোসেন ওরফে লিটন, কালাম সিকদার, মামুন, রাজীব ও জামশেদ গত বছরের ৬ মার্চ সন্ধ্যার পর বাসা থেকে ৪০০ গজ দূরে জেলা শ্রমকল্যাণ কেন্দ্রের সামনে থেকে ত্বকীকে অপহরণ করে উইনার ফ্যাশনে নিয়ে যায়। এ কাজে আজমেরী ওসমানের গাড়ি (এক্স ফিল্ডার) ব্যবহার করা হয়। রাত ১১টার দিকে আজমেরীর উপস্থিতিতে ত্বকীকে পেটানো হয়। একপর্যায়ে হাত-পা বাঁধা ত্বকীকে গলা টিপে হত্যা করেন কালাম সিকদার। মৃত্যু নিশ্চিত হলে আজমেরীর নির্দেশে মধ্যরাতে মরদেহ বস্তাবন্দি করে আজমেরীর গাড়িতে করে নদীতে ফেলার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। গাড়ি চালান জামশেদ। পাশে ছিলেন সুলতান ও শওকত ভ্রমর। পেছনে বসেন ইউসুফ লিটন, রাজীব, কালাম সিকদার ও মামুন।

র‌্যাব খোঁজ নিয়ে জেনেছে, তারা শহরের চারারগোপ এলাকায় একটি তেলের দোকানের পাশে ১৬ তলা ভবনের সামনে গাড়ি রেখে বস্তাবন্দি মরদেহ নৌকায় তোলে এবং চারারগোপ জোড়াখালের পানিতে ফেলে দেন। সেখান থেকে সবাই উইনার ফ্যাশনে ফিরে আসেন। র‌্যাব অভিযান চালিয়ে আজমেরীর টর্চার সেল থেকে হত্যায় ব্যবহৃত তিনটি গজারির লাঠি জব্দ করে। তবে ত্বকীকে অপহরণ এবং মরদেহ বহনের গাড়িটি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

পুলিশ কী করেছে

মামলাটি প্রথম তদন্ত করেন সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এস এম মঞ্জুর কাদের। হত্যায় জড়িত সন্দেহে পুলিশ রিফাত, সীমান্ত (হাজি রিপনের ছেলে) ও আজমেরী ওসমানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ইউসুফ হোসেন ওরফে লিটনকে গ্রেপ্তার করে। লিটন পরে জামিনে মুক্তি পান। পুলিশের তদন্তে অগ্রগতি না হওয়ায় বাদীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জুন মাসে হাইকোর্ট মামলাটি তদন্তের জন্য র‌্যাবের কাছে হস্তান্তরের নির্দেশ দেন। তদন্ত শুরু করে র‌্যাব প্রথমে গ্রেপ্তার করে ইতিপূর্বে জামিনে মুক্তি পাওয়া লিটনকে। তিনি আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক  জবানবন্দিতে ত্বকী হত্যা স¤পর্কে কিছু তথ্য দেন। ওই জবানবন্দির ভিত্তিতে র‌্যাব জুলাইয়ে জামতলায় সীমান্তর বাসায় অভিযান চালায়। ৭ আগস্ট র‌্যাব কলেজ রোডে আজমেরী ওসমানের নির্যাতনকেন্দ্রে অভিযান চালিয়ে বস্তাভর্তি নাইলনের রশি, রক্তাক্ত জিনসের প্যান্ট, রক্তমাখা দুটি গজারির লাঠি উদ্ধার করে। দেয়াল ও শোকেসে অসংখ্য গুলির আলামত জব্দ করা হয়। এরপর র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হন আজমেরীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী সুলতান শওকত ওরফে ভ্রমর। ভ্রমর ১২ নভেম্বর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে ত্বকী হত্যার বর্ণনা দেন।

হত্যার বিচার দাবিতে ত্বকীমঞ্চ

ত্বকী হত্যার পর তার বিচারের দাবিতে নারায়ণঞ্জে গঠন করা হয় সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকীমঞ্চ। গত বছর এপ্রিল থেকে প্রতি মাসের ৬ থেকে ৮ তারিখের মধ্যে এই হত্যার বিচার দাবিতে চাষাঢ়া মোড়ে শহরের প্রধান শহীদ মিনার চত্বরে নানা কর্মসূচি পালন করছে এই মঞ্চ। ত্বকী হত্যার বিচার শুরু হওয়া পর্যন্ত এই আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে ত্বকীমঞ্চ।

(ঢাকাটাইমস/২৫মার্চ/এইচএফ/এআর/  ঘ.)