logo ০৩ মে ২০২৫
ধীর গতির মহাসড়ক
হাবিবুল্লাহ ফাহাদ, ঢাকাটাইমস
২০ মার্চ, ২০১৪ ১১:৫৬:০৭
image


ঢাকা: দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক যথেষ্ট চওড়া নয়। অথচ রপ্তানি পণ্যের প্রায় পুরো অংশই এই পথ ধরেই যায় চট্টগ্রাম বন্দরে। আর মহাসড়কের কারণে বন্দরে পণ্য পাঠাতে যেমন সময় লাগে বেশি, তেমনি যানজটে আটকে থাকা অবস্থায় অতিরিক্ত জ্বালানি খরচের কারণে বেড়ে যায় পরিবহন ব্যয়ও। এ কারণে মহাসড়কটি দু’লেন থেকে চারলেন করার দাবি পুরনো। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ২০০৮ সালে ক্ষমতায় এসে এই প্রকল্পে হাত দেয়। কিন্তু অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্পটি শেষ করা যাচ্ছে না নানা জটিলতায়।

প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয় আরও আগে, চারদলীয় জোট সরকারের আমলেই। ২০০৬ সালের জানুয়ারিতে প্রকল্পের ঘোষণা দেয়ার পর কাজ শুরু করতেই লেগে যায় ৫ বছর। ২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি কাজ শুরুর পর তা শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয় ২০১৩ সালের জুনে। কিন্তু পরে ওই বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয় সময়। এরপর পেরিয়ে গেছে আরও সাড়ে তিন মাসেরও বেশি। কিন্তু কাজ হয়েছে অর্ধেকেরও কম, ৪৪ শতাংশ। উপায়ান্তর না দেখে তৃতীয় দফায় চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বাড়িয়েছে সরকার। তবে এই সময়ের মধ্যে কাজ শেষ হবে কি না তা নিয়ে সংশয়ে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ককে দেশের অর্থনীতির প্রাণশক্তি হিসেবে দেখেন ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টরা। দু’লেনের মহাসড়কে দিন-রাত লেগে থাকে যানজট। এতে কেবল পণ্য পরিবহন নয়, যাত্রী পরিবহনেও লেগে যায় দীর্ঘ সময়। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত বাসে যাতায়াতে কখনো কখনো লেগে যায় ১২ ঘণ্টারও বেশি। তাছাড়া যানজট এড়াতে উল্টোপাশ দিয়ে গাড়ি চালানোয় মুখোমুখি সংঘর্ষে দুর্ঘটনাও ঘটছে প্রতিনিয়ত।

সব দিক বিবেচনায় রাজধানীর সঙ্গে চট্টগ্রামের উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে এই প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়। কিন্তু শুরু থেকেই আর্থিক সংকট, পরামর্শক নিয়োগ, সড়ক উঁচু করার জন্য পর্যাপ্ত মাটির সংস্থানে সমস্যায় পড়ে প্রকল্প।

কুমিল্লার দাউদকান্দি টোলপ্লাজা থেকে চট্টগ্রাম নগরীর গেট পর্যন্ত ১৯২.৩০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এবং ১০.৮ মিটার ডবল ক্যারেজওয়ে চারলেন প্রকল্পটি কুমিল্লা, ফেনী ও চট্টগ্রাম জেলায় পড়েছে। কাজটিকে মোট ১০টি প্যাকেজে ভাগ করা হয়েছে। এর সাতটি প্যাকেজের কাজ পেয়েছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিনো হাইড্রো করপোরেশন। এছাড়া বাকি তিনটি প্যাকেজের কাজ করছে দেশীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রেজা কনস্ট্রাকশন এবং তাহের অ্যান্ড ব্রাদার্স।

প্রকল্প পরিচালকের কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, প্রকল্পের ৭০ শতাংশ কাজ পাওয়া চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি কয়েকটি প্যাকেজে ঢিমেতালে কাজ করছে। এছাড়া রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে গত বছরের অক্টোবর থেকে এ বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি কুমিল্লা অংশের দুটি প্যাকেজের কাজ পুরোপুরি বন্ধ করে রেখেছিল। এছাড়া বাকি অংশের কাজও করেছে ধীরগতিতে। তবে চীনা প্রতিষ্ঠানের বাইরে দেশীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দেয়া অংশের কাজের অগ্রগতি কিছুটা সন্তোষজনক।

মাটি ভরাট হয়নি বহু জায়গায়

ফেনীর মহিপাল থেকে ধুমঘাট ব্রিজ পর্যন্ত অনেক স্থানে পানি জমাট বেঁধে আছে। মিরসরাইয়ের সুফিয়া সংযোগ সড়ক থেকে ফেনাপুনি ব্রিজ পর্যন্ত জমিতে চলছে ধানের আবাদ। অথচ এই জায়গাটি প্রকল্পের আওতাধীন। এছাড়া কুমিল্লা সদরের দক্ষিণে বেলতলী উপজেলা এলাকায় মাটির স্তূপ জমে আছে। মাটি শুকিয়ে ধুলা হয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে বাতাসে। সুয়াগাজী এলাকায় ভরাট মাটিতে গজানো ছোট ছোট গাছপালাই বলে দিচ্ছে বহু দিন ধরে ফেলে রাখা হয়েছে এগুলো। প্রকল্পের এই অংশগুলো চীনা প্রতিষ্ঠান সিনো হাইড্রোর।  

এ মাটি ভরাট নিয়েও নানা অনিয়মের অভিযোগ আছে। প্রকল্পের শুরুতে সড়ক উঁচু করতে মাটির সংকট দেখা দেয়। তখন বলা হয়েছিল, মেঘনা, গোমতী ও ফেনী নদীর তলদেশ থেকে মাটি তুলে সড়কে ফেলা হবে। প্রয়োজনে বঙ্গোপসাগরের তীরে জমাট বাঁধা মাটিও ব্যবহারের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি সড়ক সংলগ্ন পাহাড় কেটে মাটি আনতে থাকে। এজন্য অবশ্য ছাড় পায়নি সিনো হাইড্রো। পরিবেশ অধিদপ্তরের জরিমানাও গুনতে হয়েছিল তাদের।

ফ্লাইওভার-ফুটওভারের কাজ আরও পরে

প্রকল্প বিবরণীতে দেখা যায়, ১৯২.৩০ কিলোমিটার মহাসড়কে ৪৬৩ মিটার দৈর্ঘ্যরে তিনটি ফ্লাইওভার হবে। ৩৩ মিটার দৈর্ঘ্যরে আন্ডারপাস হবে দুটি এবং স্টিলের ফুটওভার ব্রিজ হবে ৩৩টি। এছাড়া বাস থামার জন্য ৬১টি জায়গা তৈরি করার কথা। কিন্তু এখনও বাকি ফ্লাইওভার, আন্ডারপাস, ফুটওভার ব্রিজ এবং বাস স্টপের কাজ।

জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক ইবনে আলম হাসান ঢাকাটাইমসকে  বলেন, ‘সব কাজ শেষ না করে এগুলোতে হাত দেয়া যাবে না। তাছাড়া এগুলো বানাতেও খুব বেশি সময় লাগবে না।’

বর্ষা এলে কী হবে

কাজ শেষ করতে যে ৯ মাস বাকি আছে তার ৩ মাসেরও বেশি বৃষ্টির মৌসুম। গত দিন বছরেই এই সময়টায় মহাসড়কের কাজ বন্ধ ছিল বলা যায়। কারণ, বৃষ্টির পানিতে সড়কের কাঁচা অংশে কাদার সৃষ্টি হয়। সড়ক উঁচু করার জন্য নিয়ে আসা মাটিও বৃষ্টির পানিতে নেমে যায়। তাই ওই সময় কাজ করা কতটুকু সম্ভব হবে তা নিয়ে শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।

রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতাও বাধা

নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে গত অক্টোবর থেকে জানুয়ারির শুরু পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোটের আন্দোলনের প্রভাব পড়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাজেও।

সড়কের বিভিন্ন জায়গায় গাড়ি ভাঙচুর, আগুন দেয়া এবং সড়ক কেটে ফেলার ঘটনাও ঘটেছে। এসব কারণে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক চারলেন করার কাজ প্রায় বন্ধ ছিল। জানুয়ারির নির্বাচনের পর পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল হতে শুরু করলেও কাজে পুরোদমে গতি আসেনি। এর মধ্যে বিএনপি-জামায়াত জোট আবার আন্দোলনের হুমকিও দিচ্ছে। এ নিয়েও চিন্তিত প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।

তবু স্বপ্ন দেখছেন প্রকল্প পরিচালক

ঢাকা-চট্টগ্রাম চারলেন প্রকল্পটি এখন দেখাশোনার দায়িত্বে আছেন ইবনে আলম হাসান। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত নন তিনি নিজেও। ঢাকাটাইমসকে এই প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘এত বড় প্রকল্পের কাজ করতে গিয়ে একেক সময় একেক ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। তার ওপর নভেম্বর থেকে জানুয়ারির শুরু পর্যন্ত দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিও ভালো ছিল না। তাই কাজ করতে অনেক সমস্যা পোহাতে হয়েছে। সবকিছুর পরও প্রকল্পের কাজ থেমে থাকেনি। কিন্তু ভবিষ্যৎ নিয়ে অতটা নিশ্চয়তা দেয়া যাবে না।’

সময়মতো প্রকল্প শেষ হবে এমন আশা নেই যোগাযোগ মন্ত্রণালয়েরও। মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘তিন বছরে ঢাকা-চট্টগ্রাম চারলেন মহাসড়কের কাজ অর্ধেকও শেষ করা যায়নি। তাই এ বছরের বাকি ৯ মাসে ৫০ শতাংশেরও বেশি কাজ শেষ করা কঠিন হবে।’

আরেকজন কর্মকর্তা মনে করেন, আগামী বছরের জুনের আগে দেশের সবচেয়ে বড় মহাসড়কটি চারলেন করার কাজ শেষ হওয়ার সুযোগ নেই।

দৃশ্যমান অগ্রগতি

পুরো সড়কের কাজ প্রায় অর্ধেক শেষ হলেও চীনা প্রতিষ্ঠান সিনো হাইড্রো শেষ করতে পেরেছে ২৯ শতাংশ। দেশীয় প্রতিষ্ঠান রেজা কনস্ট্রাকশন ও তাহের ব্রাদার্স তাদের মোট কাজের ৫০ থেকে ৭০ ভাগ শেষ করে এনেছে। মাটি ভরাটের কাজ এখনও ১০ শতাংশ বাকি আছে। তবে প্রায় ৫০ কিলোমিটার সড়কে বিটুমিনাস কার্পেটিং শেষ হয়েছে। ২৩টি সেতুর মধ্যে ১৫টির কাজ শেষ, বাকিগুলোর কাজ চলছে। এগিয়েছে কালভার্ট তৈরির কাজও। ২৪৪টির মধ্যে ২৩২টি কালভার্ট বানানো হয়েছে। প্রকল্প পরিচালকের দাবি, প্রকল্প এলাকার প্রায় সব জায়গার কাজেই হাত দেয়া হয়েছে। ধরা হয়নি এমন কাজ নেই।

সিংহভাগই সরকারের অর্থায়ন

বড় মাপের এ প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছিল ২ হাজার ৩৮২ কোটি টাকা। কিন্তু সড়ক তৈরির সরঞ্জামাদির দাম বাড়ায় ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকায়।

এর মধ্যে ৪০০ কোটি টাকার যোগান দেওয়া হবে জাপানের ঋণ মৌকুফ তহবিল থেকে। বাকি টাকার পুরোটাই সরকারকে যোগান দিতে হবে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার আগেই প্রায় ২২৬ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।

তবে প্রকল্প পরিচালক ঢাকাটাইমসকে জানান, প্রকল্প বাস্তবায়নে কোনো আর্থিক সংকট নেই। এ পর্যন্ত বাজেটের ব্যয় হয়েছে ৪৭.০৯ শতাংশ।

আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি

২০০৮ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচনের আগে ক্ষমতায় এলে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কটি চারলেন করার অঙ্গীকার করে আওয়ামী লীগ। ক্ষমতায় এসে গুরুত্ব বিবেচনায় প্রকল্পটির বাস্তবায়ন শুরু হয়। দশম সংসদ নির্বাচনের আগেও আওয়ামী লীগের ইশতেহারে এই প্রকল্পের বিষয়ে বলা হয়েছে। প্রকল্পের আশানুরূপ অগ্রগতি হয়েছে দাবি করে কাজ দ্রুত শেষ করার অঙ্গীকার করা হয়।

(ঢাকাটাইমস/ ২০মার্চ/ এইচএফ/এআর/  ঘ.)