ঢাকা: শাহনাজ বেগম একজন গৃহিণী। সাত ও চার বছরের দুটি কন্যা সন্তানের মা। স্বামী ভরণপোষণ দেয় না, উপরন্তু শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে। অনেক কষ্টেই দিন চলে তার। দিগি¦দিক ছুটে চলেন, কিন্তু কোনো কূল-কিনারা পান না।
উপায়ন্তর না দেখে ছুটে চলেন এক পরিচিত আপার কাছে। পরিচিত আপা ১২ জানুয়ারি তাকে নিয়ে যান ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে। সাধারণ ডায়েরি করেন স্বামীর বিরুদ্ধে।
পরে তাকে পাঠান হয় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদে। শাহনাজ এখন কিছুটা অসুস্থ। কথা হলো তার সাথে। উদ্বিগ্ন শাহনাজ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘সব দায়িত্ব ওনারাই নিয়া নিছে। ওনারা বলছে আমার স্বামীর কাছে তিনডা চিঠি যাইব। এর মধ্যে ওনাদের সাথে যদি আমার স্বামী যোগাযোগ না করে তাহলে তাদের পক্ষ থেকেই আমার স্বামীর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিবে।’
শুধু শাহনাজই নয়। এমন অসংখ্য নির্যাতিত নারী আছেন যারা সঠিক বিচারের আসায় এদিক সেদিক ধরনা দেন। কিন্তু সঠিক বিচার পান না। তাদের জন্যই ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার।
শাহনাজের মতো তুলি খাতুন, মমতাজ বেগমসহ এমন অসংখ্য নারী এখন ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের সেবা নিচ্ছেন।
নির্যাতিতদের জন্য ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার
গত পাঁচ বছরে এই সেন্টারটি থেকে সেবা নিয়েছে প্রায় আড়াই হাজার নির্যাতিত নারী ও শিশু।
উইমেন্স সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৪ সালের ২২ মার্চ পর্যন্ত মোট নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে ২ হাজার ৪৮৩ জন।
২০১৪ সালের ২২ মার্চ পর্যন্ত মোট এই সেন্টার থেকে সেবা নিয়েছেন ১১৬ জন। এর মধ্যে মামলা চলছে ৬১টি, নিষ্পত্তি হয়েছে ছয়টি, ৫৯টি তদন্তে আছে।
এই ৬১টি মামলার মধ্যে ধর্ষণ মামলা হয়েছে পাঁচটি, যৌতুক মামলা ২৮টি, অপহরণ মামলা ২০টি, পাচার মামলা একটি এবং অন্য আরো সাতটি মামলা আছে। সব মামলা নিষ্পত্তির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সেন্টারটি।
উইমেন্স সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের এএসআই এবং ডিউটি অফিসার শাপলা খাতুন ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমাদের এখানে আসা অভিযোগগুলোর মধ্যে সাধারণত যৌতুকের কারণে নারী নির্যাতন মামলাগুলো থানায় হওয়ার পরে আমাদের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এসব বিষয়ে কোনোটা আমরা রেখে তদন্ত করি আবার কোনোটা আমাদের নিজস্ব ১০ এনজিও আছে তাদের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।’
এনজিওগুলো হচ্ছেÑঅপরাজেয় বাংলাদেশ, ছোটমনি নিবাস, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, এসিএসআর, বিএনডব্লিউ এলএ, মহিলা পরিষদ, ব্লাস্ট, ফ্যামিলি পরিষদ, ঢাকা আহসানিয়া মিশনসহ ১০টি এনজিও সংস্থাগুলোতে ভুক্তভোগীদের পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
এছাড়া ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছেÑএসোসিয়েশন ফর কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট, এসোসিয়েশন ফর কারেকশন অ্যান্ড সোশ্যাল রেক্লেমেশন, এসিড সারভাইভার্স ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট, মেরিস্টোপস।
আপনারা ভুক্তভোগীদের বিষয়ে কী কী সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকেনÑ জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ডিউটি অফিসার ইয়াছমিন বলেন, ‘সেন্টারে একজনকে সর্বোচ্চ পাঁচদিন রাখা হয় । কিন্তু বিষয়টি দীর্ঘমেয়াদি হলে এরপর তাদেরকে বিভিন্ন এনজিওতে পাঠান হয়।’
ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘এনজিওগুলো ভিকটিমদের বিশেষ করে হারিয়ে যাওয়া ছেলেমেয়েকে তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়। অনেক সময় আমরাও এ কাজ করে থাকি। আবার কিছু ভিকটিম জটিল হওয়ার কারণে আদালতে পাঠান হয়।
ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের পরিসংখানে দেখা গেছে, এখানে অভিযোগ নিয়ে আসাদের বেশিরভাগের বয়স ১৮ বছরের নিচে। তবে গত কয়েক বছরের তুলনায় ২০১৪ সালে এর পরিমাণ অনেক কমে গেছে। ২০১৪ সালে এ পর্যন্ত গড়ে প্রতিমাসে প্রায় ১২ জন কমে ৩৯ জন সেবা নিয়েছে সেন্টারটি থেকে।
তবে এর আগে ২০১৩ সালে এর পরিমাণ ছিল বেশি। সে বছর ৬০৮ জন সেবা নিয়েছে। গড়ে প্রতিমাসে ৫১ জন সেবা নিয়েছে। এর মধ্যে মেয়ে ৫০৩ জন। মামলা হয়েছে ১৪৫টি। এর মধ্যে ধর্ষণ মামলা হয়েছে ৪৫টি, অপহরণ মামলা ৬৬টি। পাচার ছয়টি।
৩৬টি পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়ে এখানে সেবা নিয়েছে। এছাড়া জোর করে পতিতাবৃত্তি করানো ও গৃহকর্মীর নির্যাতনের কিছু মামলার সেবা নেওয়া হয়েছে।
গত বছর সবচেয়ে বেশি এপ্রিল মাসে ১৮টি মামলার বাদী এবং এ বছর ফেব্রুয়ারিতে সর্বোচ্চ ১২টি মামলার বাদী সেবা নিয়েছে।
উইমেন্স সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের এডিসি ফাতিহা ঢাকাটাইমসকে বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে কিছুদিন অভিযোগ কম এসেছিল। এখন হয়ত আরো বেশি আসতে শুরু করবে। আমাদের একটি ৪ সংখ্যার নম্বরের হেল্পলাইন আছে অনেক আগে থেকেই। তবে হেল্পলাইন নম্বরটি কত জানতে চাইলে তিনি তা বলতে পারেননি।
হেল্প লাইনে কি ধরনের অভিযোগ আসে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সাধারণত গৃহকর্মীদের ফোন আসে বেশি। পাশের বাড়ির কেউ ফোন করে আমাদের জানায়। এছাড়া অন্যান্য অভিযোগÑযেমন ধর্ষণ, যৌতুক, অপহরণ ইত্যাদিও আসে।
অভিযোগের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা সরাসরি কোনো ব্যবস্থা নিতে পারি না। সংশ্লিষ্ট থানার সহযোগিতায় আমরা তদন্তে বের হই। তবে তদন্তে যেতে যেতে তাৎক্ষণিক অভিযোগের অপরাধীরা পালিয়ে যায়। আর তদন্তে কিছু পেলে পরে আমরা সিদ্ধান্ত নেই। তবে বেশির ভাগে ক্ষেত্রেই আমরা সফলতার মুখ দেখতে পাই।’
গত জানুয়ারি মাসে ঢাকায় ঘুরতে এসে অপহরণের শিকার একজনকে গত ১০ ফেব্রুয়ারি ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে তার পরিবারের কাছে।
২৭ জানুয়ারি হারিয়ে যাওয়া পাঁচ বছরের এক বাক প্রতিবন্ধী এখনো একটি এনজিওর হেফাজতে আছে।
হটলাইন নম্বর ‘অকার্যকর’
নির্যাতিত নারী ও শিশুদের সহায়তায় বাংলাদেশ পুলিশ ২০০৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি তেজগাঁও থানা সংলগ্ন এই সেন্টারটির কার্যক্রম শুরু করে। ২৪ ঘণ্টাই এ সেবা প্রতিষ্ঠানটি চালু থাকে। এ ছাড়া নির্যাতনের তথ্য জানাতে চারটি হটলাইন চালু করে। নম্বরগুলো হচ্ছে : ০১৭৫৫৫৫৬৬৪৪, ০১৭৫৫৫৫৬৬৪৫, ০১৭৩৩২১৯০০৫, ০১৭৩৩২১৯০৩০।
কিন্তু এই চারটি নম্বরের ব্যাপারে জানেন না অনেক নারী। এর মধ্যে একটি নম্বর সব সময় খোলা পাওয়া যায় না। দুটি নম্বরে একাধিকবার ফোন করা হলেও কেউ ধরেনি। অন্যটিতে পর পর দুইদিন ফোন করা হলেও সবসময়ই ব্যস্ত পাওয়া গেছে।
২০১২ সালের ১৯ জুন থেকে জাতীয় হেল্পলাইন সেন্টার নির্যাতিত নারী-শিশুদের সেবা দিতে পাঁচ সংখ্যার একটি নম্বর চালু করে। নম্বরটি হচ্ছে ১০৯২১। বাংলাদেশ সরকার ও ডেনমার্ক সরকারের যৌথ উদ্যোগে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে মাল্টিসেক্টরাল কর্মসূচির আওতায় নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে নম্বরটি চালু করা হয়েছিল। কিন্তু এ নম্বরটিতেও কল করলে সংযোগ পাওয়া যায়নি।
সূত্রে জানা গেছে, এ সেন্টার কার্যক্রম পরিচালনা করছে ঢাকার ইস্কাটনে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর। হেল্পলাইন হিসেবে নম্বরটি দেয় বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, নির্যাতিত নারী ও শিশু যেন কাছে কিংবা দূরে থেকে সহজেই প্রয়োজনীয় আইনি সেবা পেতে পারেন সেজন্য ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার করা হয়েছিল। এছাড়া নারী ও শিশু নির্যাতন সংক্রান্ত মামলার তদন্ত কার্যক্রম আরো ফলপ্রসূ করতে কাজ করে এই কেন্দ্রটি। কিন্তু হটলাইনের অধিকাংশ নম্বর অকার্যকর থাকায় এ সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে নির্যাতিতরা।
জানতে চাইলে এ সেবা পরিচালনায় নিয়োজিত কর্মকর্তা শাহানারা ঢাকাটাইমসকে জানান, ‘আমরা ইতিমধ্যে এ ব্যাপারে লিফলেট বিতরণ করেছি। বিভিন্ন জায়গায় পোস্টার দিয়েছি। প্রচারণায় একটু সময় লাগছে।’
(ঢাকাটাইমস/ ২৭ মার্চ/ ইরা/এআর/ ঘ.)