ঢাকা: উপজেলা নির্বাচনের প্রথম পর্বের তুলনায় দ্বিতীয় পর্বে সহিংসতা হয়েছে বেশি। দ্বিতীয় পর্বের তুলনায় তৃতীয় পর্বে তা বেড়েছে আরও। এই পর্বে প্রচারণা চলাকালেই সহিংসতার নানা ঘটনায় ছড়িয়েছিল উদ্বেগ। কিন্তু নির্বাচন কমিশন ছিল নীরব। এর মধ্যে আবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ সব ছেড়ে চলে গেছেন যুক্তরাষ্ট্রে। যাওয়ার আগে এক মাসের ছুটির কথা জানিয়েছেন তিনি। কিন্তু দেশজুড়ে এই নির্বাচন চলাকালে সিইসি দেশে থাকবেন না, এটা কল্পনায়ও ছিল না নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের মধ্যে।
সিইসির এই হঠাৎ বিদেশযাত্রা নিয়ে কথা হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিএনপি-জামায়াত জোট বর্জন করায় উপজেলা নির্বাচনই প্রধান দুই দলের মধ্যে জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের সুযোগ। তাই দুই দলই এই নির্বাচনে নামে আটঘাট বেঁধে। কিন্তু প্রথম দুই পর্বে সরকার সমর্থকদের তুলনায় বিএনপি সমর্থকরা বেশি উপজেলায় জেতার পর বিব্রত হয় সরকারি দল। এ অবস্থায় তৃতীয় পর্বে ভোটের আগে সিইসির দেশত্যাগে সরকারের কোনো চাপ ছিল কি না তা নিয়েও হচ্ছে নানা কথা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কমিশনার ঢাকাটাইমসকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা এবং সাবেক একজন মন্ত্রীর আচরণে কমিশন রীতিমতো বিব্রত। প্রায় সময়ই সরকারের প্রভাবশালী ওই দুই ব্যক্তির খবরদারির কারণে কমিশন অনেক ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। সিইসি না থাকায় অনেক ক্ষেত্রে কমিশন প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। তাছাড়া সিইসির সঙ্গেও সরকারের কিছুটা ঝামেলা চলছে বলেও ইঙ্গিত দেন তিনি।
সিইসির দেশত্যাগের পরের দুই দফা নির্বাচনে বেশির ভাগ উপজেলায় জিতেছে সরকার সমর্থকরা। এর মধ্যে ২৩ মার্চ চতুর্থ দফার ভোটে বিএনপি সমর্থিতদের তুলনায় সরকার সমর্থিতরা জিতেছে দ্বিগুণেরও বেশি উপজেলায়। কিন্তু এই ফল উল্টো সরকারের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে। কারণ, ১৫ থেকে ২০টি উপজেলায় সরকার সমর্থকরা কেন্দ্র দখল করে দেদার সিল মারার অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে ছবিও প্রকাশিত হয়েছে গণমাধ্যমে।
সিইসির অবর্তমানে নির্বাচন কমিশন কিন্তু এসব অভিযোগ পাত্তাই দেয়নি। উল্টো ভারপ্রাপ্ত নির্বাচন কমিশনার আবদুল মোবারক চতুর্থ দফার ভোটকে বলেছেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ, নির্বাচন ভালো হয়েছে।’
কেন বিদেশে সিইসি
নির্বাচন কমিশন বলছে, পারিবারিক কাজে ৩ মার্চ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আছেন সিইসি। ফিরতে পারেন আগামী এপ্রিলে। তত দিনে শেষ হবে উপজেলা নির্বাচন। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম সিইসির বিদেশ সফর নিয়ে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, ‘সিইসি ক্লান্ত, তাই ছুটিতে আছেন।’
উপজেলা নির্বাচন চলাকালে সিইসির ‘ছুটি’ নিয়ে বিভিন্ন মহলে কানাঘুষার অন্ত নেই। শোনা যাচ্ছে, নির্বাচনে ক্ষমতাসীনদের অযাচিত হস্তক্ষেপের ব্যাপারে সন্তেুাষজনক সমঝোতা না হওয়ায় ‘বাধ্যতামূলক ছুটিতে’ পাঠানো হয়েছে সিইসিকে। নাকি ‘দোষ এড়াতে’ নিজেই দেশ ছেড়েছেন কমিশনের দ-মু-ের এই কর্তা? এসব প্রশ্ন মুখে মুখে।
তবে সিইসির দায়িত্বে থাকা আবদুল মোবারক ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু না থাকলেও দেশ চলছে, জিয়াউর রহমান না থাকলেও বিএনপি চলছে। একইভাবে সিইসি না থাকলেও নির্বাচন ঠিকই হচ্ছে। আমি না থাকলেও কমিশন থেমে থাকবে না।’
বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য মাহবুবুর রহমান মনে করেন, দায় এড়াতে দেশের বাইরে গেলেও এজন্য ভবিষ্যতে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে জবাবদিহিতার মুখোমুখি হতে হবে। তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘এই নির্বাচন কমিশন যে দায়িত্বহীন, আজ্ঞাবহ এবং বিতর্কিত তা অনেক আগে থেকেই আমরা বলে আসছি। এবার সিইসির রহস্যজনক ছুটি তারই প্রমাণ দিয়েছে। সরকার বলছে নির্বাচন কমিশন স্বাধীন অথচ কমিশনের অবস্থান বলে দিচ্ছে তারা সরকার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।’
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য নূহ-উল আলম লেনিন ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘সিইসি এমন একটি পদে আছেন যেখান থেকে প্রধানমন্ত্রী চাইলেও তাকে সরাতে পারবেন না। তিনি যা করছেন নিজের ইচ্ছাতেই করছেন। সরকার তাকে বিদেশে পাঠিয়েছে- বিএনপির এমন বক্তব্যের কোনো ভিত্তি নেই।’
সহিংসতা আর কারচুপির অভিযোগ বাড়ছেই
নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, চার দফা নির্বাচনে অনিয়ম ও ব্যালট পেপার ছিনতাইয়ের ঘটনায় ১০৩টির মতো ভোটকেন্দ্র স্থগিত করা হয়। চতুর্থ দফা নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম ও সহিংসতার অভিযোগে তিনটি উপজেলায় ভোট স্থগিত করা হয়। প্রথম ধাপে ১০, দ্বিতীয় ধাপে ৩৫, তৃতীয় ধাপে ২৬টি, চতুর্থ ধাপে ৩২টি ভোটকেন্দ্র স্থগিত ছিল।
এর আগে দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনের দিন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় নোয়াখালী সদর এবং তৃতীয় ধাপের নির্বাচনের আগেই গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলা নির্বাচন স্থগিত করা হয়। তবে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী প্রথম ধাপে ৬৫, দ্বিতীয় ধাপে ১০০, তৃতীয় ধাপে ২০০ এবং চতুর্থ ধাপে ২৩৮ মোট প্রায় ৬০৩ কেন্দ্রে অনিয়মের ঘটনা ঘটে।
এসবের জন্য অভিযোগের তীর বরাবরই ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী, সাংসদ ও নেতা-কর্মীদের দিকে। প্রথম দফা নির্বাচনের সময় সিইসি দেশে ছিলেন। ১৯ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনে অনিয়মের কারণে শতাধিক লোককে আচরণবিধি লঙ্ঘনের জন্য দ- দেওয়া হয়েছিল। জরিমানা করা হয় এক লাখ ২৫ হাজার টাকা।
২৭ ফেব্রুয়ারি ১১৫ উপজেলায় ভোটে ১০০টির মতো কেন্দ্রে নানা অনিয়ম হয়েছে। প্রতিপক্ষের প্রার্থীর ওপর হামলার ঘটনাও ঘটেছে। এজন্য ২৮ জনকে দ- ও দেড় লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।
তৃতীয় দফায় ১৫ মার্চ ৮১টি উপজেলায় অনিয়ম হয়েছে দুই শতাধিক কেন্দ্রে। অথচ কমিশন মাত্র তিনজনকে দ- দিয়েছে। জরিমানা করেছে প্রায় এক লাখ টাকা। প্রথম দুই দফা নির্বাচন চলাকালে সিইসি দেশে থাকলেও তৃতীয় ও চতুর্থ দফা নির্বাচনে তিনি ছিলেন না। আর ওই সময়েই অনিয়ম ও সহিংসতার ঘটনা বেশি ঘটেছে।
তবে সিইসির অনুপস্থিতির কারণে নির্বাচনে সহিংসতার দায় মানতে নারাজ দায়িত্বপ্রাপ্ত সিইসি আবদুল মোবারক। তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘সিইসি নেই এজন্য সহিংসতা হচ্ছে এসব অমূলক যুক্তি। যেসব জায়গায় অনিয়ম হয়েছে অভিযোগের ভিত্তিতে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। ভবিষ্যতেও কেউ নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গ করলে ছাড় দেওয়া হবে না। সরকারি বা বিরোধী দল যেই হোক না কেন কমিশন কারো সঙ্গে খাতির করবে না।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে দায়িত্বপ্রাপ্ত সিইসি ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। অন্যায় করলে আজ হোক কাল হোক শাস্তি পেতেই হবে। এখন যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসছে আমরা সেগুলো রেকর্ড রাখছি। আইন লঙ্ঘন করলে একসময় না একসময় বিচারের মুখোমুখি হতেই হবে। অতীত থেকে সবার শিক্ষা নেওয়া উচিত।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা ঢাকাটাইমসকে জানান, ধারাবাহিক পরাজয় ঠেকাতে ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে। গত পাঁচ বছরে নির্বাচন কমিশন অনেক স্থানীয় সরকার নির্বাচন করেছে। কিন্তু কোথাও নিরপেক্ষতা নিয়ে খুব বেশি প্রশ্ন কেউ তুলতে পারেনি। কিন্তু এখন উপজেলা নির্বাচনে সরকারের অবৈধ হস্তক্ষেপের কারণে নির্বাচন কমিশনকে অনেক ধকল পোহাতে হচ্ছে। ভবিষ্যতেও এ নিয়ে কথা তোলা হবে। তাই কমিশন চাচ্ছে নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হোক। এ নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে কমিশনের সম্পর্কের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। তাই বাধ্য হয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন।
বাড়ছে সহিংসতা, পাল্টাচ্ছে ফলাফল
অভিযোগ আছে, প্রথম দফা নির্বাচন মোটামুটি সুষ্ঠু হলেও পরের দুই দফা নির্বাচনের পরিবেশ ছিল বেশ উত্তাল। ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনী ফল নিজেদের অনুকূলে রাখতে নির্বাচনে প্রকাশ্যে হস্তক্ষেপ শুরু করেছে। এতে ফলাফলের চিত্রও পাল্টে গেছে। এ পর্যন্ত নির্বাচনী সহিংসতায় আটজন নিহত হয়েছে এবং আহত হয়েছে পাঁচ শতাধিক। এর মধ্যে দ্বিতীয় ধাপে একজন, তৃতীয় ধাপে তিনজন এবং চতুর্থ ধাপে চারজন নিহত হয়।
প্রথম দফা নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিতরা ৪০ উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে জয় পায়। সেবার আওয়ামী লীগ সমর্থিতরা জিতে ৩৫টি এবং অন্যান্য দলের প্রার্থীরা ১৯টি উপজেলায়। দ্বিতীয় দফাতেও বিএনপি এগিয়েছিল ৫২টি উপজেলায় জয় পেয়েছে। আওয়ামী লীগ ৪৬টি উপজেলায় জয়ী হয়। অন্যান্য দলের প্রার্থীরা ১৮টি উপজেলায় জয়ী হয়। তৃতীয় দফা নির্বাচনে ৩৭টি উপজেলায় জয়ী হয় আওয়ামী লীগ। বিএনপি জয় পায় ২৬টি উপজেলায় এবং অন্য দলগুলো ১৫টি উপজেলায় জয়ী হয়। চতুর্থ দফায় ৯১টি উপজেলায় নির্বাচন হয়। এর মধ্যে স্থগিত হয় তিনটি উপজেলার নির্বাচন। বাকি ৮৮টি উপজেলার মধ্যে আওয়ামী লীগ ৫৩টি, বিএনপি ২২টি, জামায়াত পাঁচটি এবং অন্যরা ৯টিতে জয় পেয়েছে।
চতুর্থ দফায় বড় জয় পেয়ে বিএনপির চেয়ে এগিয়ে গেছে আওয়ামী লীগ। এ পর্যন্ত ৩৭৯টি উপজেলার ফল ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ জয় পেয়েছে ১৭২টি, বিএনপি ১৪০টি, জামায়াত ৩৩টি এবং অন্যরা জিতেছেন ৩৪টি উপজেলায়।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ মনে করেন, এর জন্য নির্বাচন কমিশনই দায়ী। তারা নীরব দর্শকের ভূমিকায় না থাকলে হয়ত এই সহিংসতার পুনরাবৃত্তি ঘটত না। তিনি বলেন, ‘স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সেই পুরনো ভোট জালিয়াতি ও শক্তি প্রয়োগের সংস্কৃতি ফিরে এসেছে। প্রশাসনের পাহারায় সরকারি দলের কর্মী-সমর্থকরা ব্যালট ছিনতাই করছেন, বুথ দখল করে সিল মারছেন- এমন খবর পত্রপত্রিকায় ছাপা হচ্ছে।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) সহকারী রিটার্নিং অফিসার নিয়োগের সমালোচনা করে তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘কোনো ইউএনওর পক্ষে উপজেলা চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সহজ নয়। কারণ তারা একই সঙ্গে একই পরিষদে কাজ করেন।’
জানতে চাইলে বিএনপি নেতা মাহবুবুর রহমান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের আচরণে জনগণ হতাশ। অতীতে জাতীয় নির্বাচনেও তারা একটি দলের হয়ে কাজ করেছে। তাদের কারণেই সহিংসতায় মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে।’
(ঢাকাটাইমস/ ২৬ মার্চ/ এইচএফ/ এআর/ ঘ.)