ঢাকা: আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে জোর করে জলাভূমি ভরাট করে গড়ে তোলা হয় মধুমতি মডেল টাউন। বাহারি বিজ্ঞাপনের ফাঁদে পড়ে সহজ সরল হাজারো মানুষ তাদের সঞ্চিত অর্থ দিয়ে প্লট কিনে এখন পথে বাসার উপক্রম হয়েছে। প্রভাবশালী এ গোষ্ঠীটি আদালতের রায়কেও তোয়াক্কা করছে না। ছয় মাসের মধ্যে প্রকল্প এলাকাকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার সর্বোচ্চ আদালতের রায়কেও আমলে নেয়ার কোনো তাগিদ অনুভব করছে না মধুমতি মডেল টাউন কর্তৃপক্ষ। প্রকল্প এলাকাকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়াতো দূরের কথা উল্টো প্রকল্প এলাকায় স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণে প্লট মালিকদেরকে নানাভাবে প্ররোচিত করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। রায়ের পর দৃশ্যত প্রকল্প এলাকায় উন্নয়ন কাজের গতি আরো বাড়িয়ে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। প্লট মালিকদেরকে তাদের প্লটের উপর স্থায়ী অবকাঠামো গড়তে বাধ্য করার অভিযোগও পাওয়া গেছে।
এ ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের যুক্তি হচ্ছে, আপিল বিভাগের রায় তাদের বিপক্ষে গেলেও পর্যালোচনায় আদেশ তাদের পক্ষেই যাবে। তবে এ নিয়ে রিট আবেদনকারী বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি বলছে, কোনো যুক্তিতেই এখন প্রকল্পে কাজ করা যাবে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি প্লটের মালিক ঢাকাটাইমসকে জানান, ‘হাইকোর্টের নির্দেশ পাওয়ার পর টাকা ফেরত নেয়ার জন্য মধুমতি মডেল টাউন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা টাকা নিয়ে আমাদের সঙ্গে তালবাহানা শুরু করেছে। আমাদেরকে উল্লাপাল্টা বুঝাচেছ।’
তিনি বলেন, ‘মধুমতি কর্তৃপক্ষ আদালতের রায় অনুযায়ী আমাদেরকে টাকা ফের দেয়াতো দূরের কথা উল্টো প্লটের উপর বাড়ি করার জন্য বলছে। তারা বলছেন, প্লটের উপর বাড়ি নির্মাণ করলে আদালত সেটাকে আমলে নিবে এবং কোর্টের উপর একটি বাড়তি চাপ সৃষ্টি হবে। ’ আদালতের ওপর বাড়তি চাপ দিতেই এমনটা করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
প্লট মালিক পরিচয় দিয়ে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় প্রকল্পের সেলস ম্যানেজার মেসবাহ উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি জানান, আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে আমরা রিভিউ আবেদন করেছি। সেটা কোর্ট গ্রহণ করেছে। আশা করছি রায় আমাদের পক্ষেই আসবে। আর আপনারা প্লটের উপর বাড়ি করে ফেলেন। তাহলে লাভ হবে।
প্লটের উপর বাড়ি নির্মাণ করলে তা আদালত অবমাননা হয় কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে মেসবাহ বলেন, ‘ভাই আপনারাতো জানেন যে আমাদের দেশে নিয়ম মেনে কিছুই হয় না। সব কিছুই ম্যানেজ করে করতে হয়।’
গাবতলী থেকে সাভার যেতে আমিনবাজার পার হলেই মেট্রো মেকারস অ্যান্ড ডেভেলপারস লিমিটেডের মধুমতি মডেল টাউন প্রকল্প। নব্বই দশকের শেষ দিকে জমি বিক্রি শুরু করলেও মাটি ভরাট শুরু হয় ২০০৩ সালে। এর আগেই বিক্রি হয়ে যায় প্রকল্পের জমি। কিন্তু ২০০৪ সালে জলাধার ভরাটের অভিযোগে বেলার করা মামলার কারণে আটকে যায় প্রকল্পের কাজ।
২০১২ সালের সাতই আগস্ট প্রকল্পটিকে অবৈধ ঘোষণা করে আপিল বিভাগ। গত বছর এগারোই জুলাই প্রকাশ হয় পূর্ণাঙ্গ রায়। এতে, ছয় মাসের মধ্যে প্রকল্পের জমি আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দেয়া হয়। এই খবর প্রকাশের পর উদ্বিগ্ন ক্রেতারা ভিড় করতে শুরু করে প্রকল্প এলাকায়, প্রকল্প অফিসে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রায়ের পরও প্রকল্প এলাকায় উন্নয়ন কাজ চালিয়ে যাচ্ছে মধুমতি মডেল টাউন। আদালতের আদেশ অমান্য করার কারণ জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক শহীদুল ইসলাম যুক্তি দেখান, রায় পর্যালোচনার সুযোগ এখনও আছে। তবে বেলার নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, মধুমতির এই যুক্তি ঠিক না। আদালতের নির্দেশ না মানায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবি করছি আমরা। কেবল মামলা নয়, এই রায় যেন বাস্তবায়ন হয়, বেলা সেদিকে নজর রাখবে বলেও জানান তিনি।
অতি সম্প্রতি সরেজমিন মধুমতি মডেল টাউন যান এই প্রতিবেদক। দেখা যায়, প্রকল্পে অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ চলছে বেশ জোরেসোরেই। মধুমতি মডেল টাউনের মধ্যে ঢুকতেই সামনে পরে একটি দৃষ্টিনন্দন বাড়ি। বাড়িটির নির্মাণ কাজও প্রায় শেষ। এখন চলছে বাড়ির দেয়াল নির্মাণের কাজ।
বাড়ির মালিক সম্পর্কে জানতে চাইলে মোজাম্মেল নামে এক শ্রমিক জানান, তারা মালিকের নাম বলতে পারেন না। বলেন, ‘ভাই টাকার জন্যে কাম করি। এতো কিছু জানার দরকার আছে?’ মধুমতি মডেল টাউনে কাজ বন্ধের হাইকোর্টের নির্দেশ সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাই নেই। এই বাড়ির পাশে সাত-আটটি প্লটেই নির্মাণ কাজ চলছে।
এ বিষয়ে কথা বলতে চাইলে মধুমতি মডেল টাউনের বিক্রয় বিভাগের কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন এই প্রতিবেদককে জানান, রায়ের বিষয়ে প্রকল্পের উর্ধ্বতন কর্তা ব্যক্তিরা কাজ করছেন। এ বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না।
প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে ছয় বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ ২০১২ সালের অগাস্টে ঐ আদেশের সংক্ষিপ্ত রায় দেয়।
পূর্ণাঙ্গ রায়ে সাভারের আমিন বাজারে মধুমতি মডেল টাউন আবাসিক প্রকল্পের কার্যক্রম অবৈধ ও বেআইনি ঘোষণার পাশাপাশি বলা হয়, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ১০০ বিঘার বেশি জমি রাখতে পারবে না। বেশি হলে সরকার তা বাজেয়াপ্ত করতে পারবে।
ঐ মামলার মূল রায় লেখেন বিচারপতি এসকে সিনহা ও বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, মোহাম্মদ ইমান আলী ও বিচারপতি মো. শামসুল হুদা রায়ের বিষয়ে সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের সঙ্গে একমত পোষণ করায় তার মতামতই আদালতের মূল রায় হিসাবে বিবেচিত হয়।
পূর্ণাঙ্গ রায়ে বিলামালিয়া ও বেইলারপুর মৌজায় মধুমতি মডেল টাউন এলাকার জলাভূমি ছয় মাসের মধ্যে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে ওই প্রকল্পের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান মেট্রো মেকার্সকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মেট্রো মেকার্স তা না করলে রাজউককে এই দায়িত্ব নিতে বলেছে সুপ্রিম কোর্ট। তবে সেক্ষেত্রেও খরচ মেটাতে হবে মেট্রো মেকার্সকেই।
এ বিষয়ে রাজউকের সদস্য (উন্নয়ন) নাঈম আহমদ খান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমি নতুন যোগ দিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে দপ্তরে আলোচনা করে পরবর্তী কার্যক্রম হাতে নেওয়া হবে।’
রায়ে বলা হয়, ‘ছয় মাসের মধ্যে নিবন্ধন খরচসহ ক্রেতাদের প্রদেয় টাকার দ্বিগুন পরিশোধ করতে মেট্রো মেকার্সকে নির্দেশ দেয়া হচ্ছে।’ হাইকোর্টের রায়ের বেঁধে দেয়া সময় ইতোমধ্যেই শেষ হয়ে গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্পের সেলস ম্যানেজার মেসবাহ উদ্দিন বলেন, ‘রিভিউ আবেদনের নিষ্পত্তির পর বিষয়টি দেখা যাবে। রিভিউ পিটিশনের শুনানির দিন এখনও ঠিক হয়নি। শুনানিতে যে ফলাফল আসে সেভাবেই পদক্ষেপ নেয়া হবে।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) করা একটি রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০০৫ সালের ২৭ জুলাই হাইকোর্ট মধুমতি মডেল টাউন প্রকল্পকে অবৈধ ঘোষণা করে। একই দিস মেট্রো মেকার্সের এ সংক্রান্ত দায়ের করা আরেকটি রিট আবেদন খারিজ করে দেয় আদালত।
২০০৪ সালের ১৪ অগাস্ট রিটটি দায়ের করে বেলা। রিট আবদনে আমিন বাজারের অদূরে বন্যার পানি প্রবাহ এলাকা ভরাট করে বাস্তবায়ন করা ওই প্রকল্পের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা হয়। প্রকল্পটিতে রাজউকের অনুমোদন নেই বলেও রিটে বলা হয়।
(ঢাকাটাইমস/ ৩১মার্চ/এমএম/এআর/ ঘ.)