ঢাকা: দেশে শিক্ষানীতি করতে সময় লেগেছে প্রায় চার দশক। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের জন্মের পর থেকেই এ নীতি করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত তা করা হয় ২০১০ সালে। এরপর কেটে গেছে আরও প্রায় চার বছর। এ নীতি বাস্তবায়নে এখন কত বছর লাগবে এ নিয়ে কথা হচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে।
শিক্ষানীতি গঠনের পর চার বছরে বেশ কিছু অগ্রগতি হলেও এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। অবকাঠামোগত সমস্যার সমাধান, মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করা, সকল পর্যায়ে দক্ষ শিক্ষক তৈরি, শিক্ষকদের আলাদা বেতন স্কেল গঠন, শিক্ষা আইনের বাস্তবায়নসহ অনেক বিষয়ই এখনো আলোর মুখ দেখেনি। তবে এসব কিছুর পেছনে অর্থকেই দায়ী করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
শিক্ষা সচিব ড. মোহাম্মদ সাদিক ঢাকাটাইমস বলেন, বর্তমান সরকার শিক্ষাখাতে যেসব কার্যক্রম পরিচালনা করছে তা শিক্ষানীতির আলোকেই পরিচালিত হচ্ছে। তার দাবি শিক্ষানীতি অনেকাংশই বাস্তবায়ন হয়েছে। বাকিটাও সামনের দিনগুলোতে পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করা হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রয়োজনের তুলনায় আর্থিক সংকট প্রকট। তাই অনেক কিছুই অর্থনৈতিক কারণে সম্ভব হয়ে ওঠে না। তবে সামনের বাজেটে অর্থ মন্ত্রণালয়ে কাছ থেকে আমাদের যে বাজেট ঘাটতি আছে সেগুলো কমিয়ে নিয়ে আসব।’
বিষয়টি স্বীকার করেছেন শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ। তিনি বলেন, আমাদের প্রয়োজন অসীম। আর সম্পদ সীমিত। তাই অনেক কিছুই সম্ভব হয় না। তবে এই সীমিত সম্পদের মধ্য থেকেই আমরা শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে এগিয়ে যাচ্ছি। ইতিমধ্যে অনেক কিছ্ইু বাস্তবায়ন হয়েছে। বাকি দিকগুলোও পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে বলে জানান তিনি।
শিক্ষাবিদদের মতে, শিক্ষানীতির আলোকে এখনো ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোর পরিচালনা-পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন, মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকায়ন, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষার প্রচলন, ইংরেজি মাধ্যমসহ শিক্ষার সর্বস্তরে বাংলা মাধ্যম বাধ্যতামূলক করাসহ কয়েকটি বিষয় এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এছাড়া জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করতে গেলে শিক্ষাখাতে বর্তমান বাজেটের অতিরিক্ত ৬৮ হাজার কোটি টাকা লাগবে।
অগ্রগতি ফেলে দেওয়ার মতো নয়
শিক্ষানীতি প্রণয়নের পর ১৭ বছরের পুরনো পাঠ্যক্রম যুগোপযোগী করা হয়েছে। এছাড়া অভিন্ন প্রশ্নপত্রে সমাপনী ও জুনিয়র সার্টিফিকেট পরীক্ষা গ্রহণ, নারী শিক্ষার প্রতি জোর দেওয়াসহ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এবং গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে এবার প্রাথমিকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:৪০-এ নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। মাধ্যমিক স্তরেও নারী ও পুরুষ শিক্ষার্থীর অনুপাত কমিয়ে আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। নারী শিক্ষিকার হার ৬০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য ঠিক করা হয়েছে। এগুলো শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে সহায়ক হবে। তবে সরকারের হাতে অনেক সময় রয়েছে। ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে এগিয়ে গেলে তা বাস্তবায়ন সম্ভব।
জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির কো-চেয়ারম্যান খলীকুজ্জমান আহমেদ বলেন, ‘শিক্ষানীতির অংশ হিসেবে নারী উন্নয়ন এবং শিক্ষার সর্বস্তরে বেশকিছু উন্নয়ন কর্মকা-ে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এগুলোর বাস্তবায়ন হলে শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে সহায়ক হবে। তবে আর্থিক যে বিষয়টি দরকার প্রয়োজনের তুলনায় তা কম। সেখানে স্বাবলম্বী হওয়া গেলে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়।
২০১০ সালের ৩১ মে শিক্ষানীতি মন্ত্রিসভায় অনুমোদন পায়। এরপর ২৭ জুন জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে গঠন করা হয় ৩২ সদস্যবিশিষ্ট উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন জাতীয় কমিটি। শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদকে প্রধান এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী এবং প্রতিমন্ত্রীকে সদস্য করে এ কমিটি গঠন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন, কৌশল নির্ধারণ, প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান এবং কাজের অগ্রগতি পর্যালোচনা করার দায়িত্ব দেওয়া হয় সরকার গঠিত এ কমিটিকে।
ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের লক্ষ্যকে সামনে রেখে চার বছর আগে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০’ প্রণয়ন করে সরকার। ধাপে ধাপে এ নীতি বাস্তবায়নের কথা বলা হয়। প্রস্তাবনা অনুযায়ী, পুরো শিক্ষানীতি বাস্তবায়িত হবে ২০১৮ সালের মধ্যে এবং এতে মোট ব্যয় হবে ৩৮ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু পর্যাপ্ত বাজেটের অভাবে শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন সুপারিশের মধ্যেই রয়ে গেছে। ২০১১-১২ অর্থবছরে শিক্ষা এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা খাতে উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন মিলিয়ে মোট ১৯ হাজার ৮৩৭ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। আর ২০১২-১৩ অর্থবছরে অনুন্নয়ন ও উন্নয়ন ব্যয় মিলিয়ে দুই মন্ত্রণালয়ের জন্য মোট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২১ হাজার ৪০৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ ১১ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকা। এছাড়া ২০১৩-১৪ অর্থবছরে শিক্ষায় বরাদ্দ দেওয়া হয় ১৩ হাজার ১৭৯ কোটি ২৩ লাখ টাকা।
হিসাব মতে, এ বছর বরাদ্দ গত বছরের চেয়ে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে। কিন্তু এবারো শিক্ষানীতি ২০১০ বাস্তবায়নে আলাদা কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি। সামগ্রিকভাবে শিক্ষা খাতের উন্নয়নে নতুন কোনো পরিকল্পনা ২০১৩-১৪ অর্থবছরের বাজেটে নেওয়া হয়নি। কেবল চলমান প্রকল্পগুলো চালিয়ে নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
জাতীয় অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ঢাকাটাইমসকে বলেন, শিক্ষার বিস্তার সারা দেশে মোটামুটি ঘটলেও মান নিয়ে এখনো অনেক প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। মানসম্মত শিক্ষা ছাড়া শিক্ষার আদৌ কোনো মূল্য নেই। প্রতিবছর পাবলিক পরীক্ষায় লাখ লাখ শিক্ষার্থী ভালো ফল করছে। তারা আদৌ মানসম্মত শিক্ষা গ্রহণ করে পাস করছে কি না, তা দেখা জরুরি হয়ে পড়েছে।
প্রাথমিককে অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীত নিয়ে জটিলতা
শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গঠিত সাব-কমিটির মধ্যে শিক্ষা আইন কমিটি, শিক্ষা কমিশন কমিটি, মাধ্যমিক শিক্ষায় সমস্যা দূরীকরণ, প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীতকরণ কমিটি, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা আধুনিকায়ন কমিটি, পাঠ্যপুস্তক আধুনিকীকরণ কমিটি, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আইন প্রণয়ন কমিটি, নিরক্ষরতা দূরীকরণ কমিটি ও শিক্ষক নিয়োগে আলাদা কমিশন গঠনে কমিটি উল্লেখযোগ্য। তবে শুরু থেকেই বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, শিক্ষানীতির যত বিষয় আছে এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীত করা। এটি বাস্তবায়ন করাই হবে সবচেয়ে কঠিন কাজ।
জানা গেছে, চূড়ান্ত সুপারিশ তো দূরের কথা নানা সমস্যায় সিদ্ধান্তহীনতায় পড়েছে এ বিষয়ে গঠিত সাব-কমিটি।
শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাজের গতি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, শিক্ষানীতিতে প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করার কথা বলা হয়েছে, যা কোনোভাবেই বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করতে হলে সরকারি ও বেসরকারিসহ প্রায় ৮০ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নতুন করে শিক্ষক নিয়োগ এবং অবকাঠামোগত সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে। এছাড়া দেশের ২ হাজার ২০০টি নি¤œমাধ্যমিক স্কুল চরম বেহাল অবস্থায় পরিচালিত হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ও কর্মকর্তারা বলছেন, প্রাথমিক শিক্ষা স্তরের (প্রথম-পঞ্চম) সঙ্গে ষষ্ঠ হতে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষা একীভূতকরণ নিয়ে জটিলতায় পড়েছেন তারা।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তসলিমা বেগম ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘শিক্ষানীতির আলোকেই আমরা কাজ করছি। তবে পঞ্চম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীত করা নিয়ে কিছু সমস্যা আছে। সেগুলো কাটানোর কাজ চলছে। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া।
নতুন শিক্ষানীতিতে বলা হয়, দেশের প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীতকরণ করা হবে। শিক্ষানীতি পাস হওয়ার চার বছর পার হলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয় এখনো সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারছে না। একাধিক সদস্য জানিয়েছেন, এ ক্ষেত্রে অবকাঠামো, শিক্ষকদের মর্যাদা ও আর্থিক সংশ্লিষ্টতাই হচ্ছে প্রধান বাধা।
শিক্ষা সচিবও বিষয়টির সাথে একমত পোষণ করেছেন। তিনি বলেন, ‘কিছু সমস্যা রয়েছে। তবে আমি যেহেতু মন্ত্রণালয়ের নতুন দায়িত্বে এসেছি তাই বুঝে উঠতে কিছু সময় লাগছে।’
বাধাটি আসলে কোথায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি বিষয়টি সম্পর্কে এখনো ভালো জানি না। জেনে আপনাকে বলব।’
শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করতে গঠিত সাব-কমিটি বিকল্প বিভিন্ন বিষয় প্রস্তাব করে রিপোর্ট জমা দিয়েছিল ২০১২ সালে। সেখান থেকে যেসব প্রস্তাব এসেছে তার মধ্যে ছিল ২০১৩ শিক্ষাবর্ষ থেকে ধাপে ধাপে অর্থাৎ পরবর্তী তিন-চার শিক্ষাবর্ষে একটি করে শ্রেণিকে উন্নীত করে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা বাস্তবায়ন করা। প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত চলমান শিক্ষাকে মৌলিক শিক্ষা হিসেবে সরকারিভাবে ঘোষণা করা। কিন্তু সে প্রস্তাব এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, যে প্রস্তাব এসেছে তা বাস্তবায়ন করতে হলে যে পরিমাণ অর্থ ও অবকাঠামোগত সুবিধা প্রয়োজন তা নিশ্চিত করতেই ছয় থেকে সাত বছর সময় লাগবে। অনেকে আবার মনে করেন, এটা বাস্তবায়ন করলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেবে। কারণ এ ব্যবস্থাটা তখন দুই মন্ত্রণালয়ের মধ্যে ভাগ হয়ে যাবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কমিটির এক সদস্য বলেন, দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের যে অবকাঠামো আছে তা দিয়ে কোনোভাবেই এটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। আগে অবকাঠামোর উন্নয়ন করা প্রয়োজন। এছাড়া যে শিক্ষক আছেন তাদের দিয়েও অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা নিশ্চিত করা যাবে না। তবে যেসব সংযুক্ত উচ্চ বিদ্যালয় আছে (প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত) সেখানে প্রাথমিক পর্যায়ে এ স্তর বাস্তবায়ন শুরুর কথা ভাবা হচ্ছে।
(ঢাকাটাইমস/০২এপ্রিল/ এমএম/এআর/ ঘ.)