logo ০২ মে ২০২৫
সম্পদ না বোঝা

দিবাকর আচার্য্য, ঢাকাটাইমস
০২ এপ্রিল, ২০১৪ ১০:৫৮:০৬
image


ঢাকা: কাগজে-কলমের হিসাবে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) দ্বাদশ সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন। কিন্তু আগের যেকোনো উত্তরসুরির চেয়ে তার পরিচয়ে একটা ভিন্নতা আছেÑতিনি বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচিত ক্রিকেট বোর্ড সভাপতি।

যদিও সেই ২০১২ সাল থেকেই বিসিবি সভাপতির দায়িত্ব পালন করে আসছেন পাপন; কিন্তু নির্বাচিত সভাপতি হিসেবে তার মেয়াদ শুরু হয়েছে গত বছরের ১৩ অক্টোবর থেকে। ফলে এই ৬ মাসের  দেখাশোনা নিয়ে একটা ‘ষাণ¥াসিক তামামি’ আমরা করে ফেলতেই পারি। তবে সেটা শুরু করার আগে আমাদের বরং উচিত হবে ‘পাপন যেভাবে নির্বাচিত সভাপতি’ বিষয়ে একটু আলোচনা করে আসা।

নাজমুল হাসান পাপন বাংলাদেশের রাজনীতিতে এসেছেন তার বাবা, বাংলাদেশের প্রয়াত মহামান্য রাষ্ট্রপতি এবং সর্বজনশ্রদ্ধেয় রাজনীতিবিদ জিল্লুর রহমানের পথ ধরে। পাপন নিজেই বলেন, তার রাজনীতিতে আসা একটা আকস্মিক ব্যাপার ছিল। তবে ক্রিকেটে পাপনের সংশ্লিষ্টতা এমন আকস্মিক কিছু নয়।

বেশ অনেক দিন ধরেই দেশের শীর্ষ ক্লাব আবাহনী লিমিটেডের সাথে জড়িত ছিলেন তিনি। ক্লাবটির ক্রিকেট কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে ক্লাব সমিতির আন্দোলন-সংগ্রামেও নেতৃত্ব দিয়েছেন। আর এই পথ ধরেই ২০১২ সালে সরকারের মনোনীত সংগঠক হিসেবে প্রথম বিসিবি সভাপতি হন। আরেক সরকার দলীয় সংসদ সদস্য আ হ ম মোস্তফা কামাল আইসিসির সহসভাপতি হয়ে যাওয়ায় শূন্যপদ পূরণে সরকার তাকে পাঠায়।

এর আগেই আইসিসি অবশ্য অনেকবার বাংলাদেশকে তাগিদ দিয়েছে বোর্ড সভাপতি নির্বাচনের জন্য। আইসিসি বেশ আগেই আইন করেছিল যে, সব টেস্ট খেলুড়ে দেশের বোর্ড সভাপতিকে সরাসরি বা পরিচালকদের ভোটে নির্বাচিত হতে হবে। পাপন দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে তখনকার বোর্ডের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে তিনিই নির্বাচনমুখী একটি আহ্বায়ক কমিটির দায়িত্ব নেন। যারা সভাপতিসহ সব পদে নির্বাচন করবেন।

এই আহ্বায়ক কমিটির সামনে একটার পর একটা মাঠে, মাঠের বাইরে বিরাট ঝামেলা এসে দাঁড়াতে থাকে। ফলে নির্বাচনও পেছাতে থাকে। এর মধ্যে নির্বাচন নিয়ে আদালতেও গড়ায় ঝামেলা। অবশেষে উচ্চ আদালতের বিশেষ অনুমতি সাপেক্ষে গত অক্টোবরে অনুষ্ঠিত হয় নির্বাচন। সে নির্বাচনের শুরুতে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন দেশের আরেক শ্রদ্ধেয় ক্রীড়া সংগঠক এবং বিসিবির সাবেক সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী।

দুই আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্যের এই লড়াই হয়ে ওঠে সংবাদ মাধ্যমের মুখরোচক এক ব্যাপার। দুই সংগঠকই পরিশীলিত মানুষ হওয়ায়, কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিয়ে রুচিশীল এক কথায় লড়াই ও গঠনমূলক আক্রমণ-প্রতিআক্রমণে খেলার মতোই মজা তৈরি হয়েছিল। শেষ অবদি অবশ্য সাবের হোসেন চৌধুরী কিছু অনিয়মের অভিযোগ এনে সরে দাঁড়ান নির্বাচন থেকে। ফলে প্রথম নির্বাচিত সভাপতি হওয়ার পথে আর কোনো অন্তরায়ও থাকে না নাজমুল হাসান পাপনের।

এবার আমরা একটু খাতা-কলম নিয়ে বসি। দেখা যাক, ছয় মাসের অভিযান কেমন গেল পাপনের।

হাজারটা দোষ-গুণ পাশে রেখেও হিসাব কষতে গিয়ে আপনাকে প্রথমেই পাপনের উদ্দেশে একটা করতালি দিতে হবে। শুধু এই ছয় মাসে নয়, পাপন তার পুরো সভাপতিত্বকালে একটা ব্যাপার প্রমাণ করতে পেরেছেনÑতিনি জিততে পছন্দ করেন; জয় আনতেও পছন্দ করেন। এর মধ্যে অনেকগুলো জয় কার্যত বাংলাদেশের ক্রিকেটেরই জয়।

এই যে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ হচ্ছে, ৬ এপ্রিলের ফাইনাল দিয়ে যার সমাপ্তি ঘটবে; এই টুর্নামেন্টটিকেই পাপনের সবচেয়ে বড় জয় বলে সামনে আনা যেতে পারে। অন্তত দুটি মহাকা- ঘটেছিল যাতে টি- টোয়েন্টি বিশ্বকাপ বাংলাদেশ থেকে সরে যাওয়াটা সময়ের ব্যাপার ছিল।

প্রথম সমস্যা ছিল ভেন্যু। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল এরকমÑঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটে ছেলেদের খেলা হবে এবং মেয়েদের খেলা হবে কক্সবাজারে নতুন হওয়া স্টেডিয়ামে। কিন্তু কার্যত দেখা গেল, নানা আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় সিলেট ভেন্যুর সংস্কার ও কক্সবাজার ভেন্যুর নির্মাণই শুরু হয়েছে প্রায় সাত-আট মাস দেরি করে। ফলে আইসিসির পর্যবেক্ষক দল সাফ জানিয়ে দিলÑবাংলাদেশ তৈরি নয়।

তখন ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের অন্তর্বর্তীকালীন দায়িত্ব পালন করা জগমোহন ডালমিয়া বললেন, তারা তৈরি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ আয়োজন করতে।

পাপন এবং তার দুই জন বোর্ড পরিচালক তখন রীতিমতো সংগ্রাম করে, অনেকটা যুক্তির জোরেই লড়াইটা টিকিয়ে রেখেছিলেন। আইসিসিকে তারা বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে, মানে সেপ্টেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ হয়ে যাবে। বলাই বাহুল্য, তা হয়নি। এরপরও সাংগঠনিক দক্ষতা ও পারস্পরিক বোঝাপড়ায় বিশ্বকাপ ধরে রেখেছিলেন পাপনরা। এমনকি আইসিসি ভেন্যুর ব্যাপারে আপোস করেও শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপ বহাল রাখে এখানে।

এই ঝামেলা মিটতে না মিটতে শুরু হয়ে যায় নিরাপত্তাজনিত বিশাল অনিশ্চয়তা। দেশের নির্বাচনকে সামনে রেখে একদম সহিংস ও সংঘাতময় হয়ে পড়ে দেশ। তখন প্রতিদিন সহিংসতায় মৃত্যুর খবর আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে জায়গা করে নিচ্ছিল।

এ অবস্থায় বিশ্বকাপ তো দূরে থাক, এশিয়া কাপ, এমনকি শ্রীলঙ্কার বাংলাদেশ সফরও বাতিল হয়ে যাবে বলেই মনে হচ্ছিল। বাইরের দেশগুলো তো বটেই, এশিয়ারই পাকিস্তান ঘোরতর আপত্তি করছিল তখন বাংলাদেশে আসার ব্যাপারে। এমনকি বাংলাদেশের চিরমিত্র শ্রীলঙ্কা পর্যন্ত বলে ফেলল, তারা এশিয়া কাপ ও বিশ্বকাপ আয়োজন করতে প্রস্তুত। যে শ্রীলঙ্কা সফরে না এলে বাকি বড় দুটি আয়োজন হবেই না, তারাই যখন এমন কথা বলল, তখন আয়োজক বিসিবির ওপর ঘোর শঙ্কা। এ শঙ্কাও দূতিয়ালি করে কাটিয়ে দিলেন পাপন।

বড় দাগে এগুলো পাপনের বিজয়। এ ছাড়া সভাপতি হিসেবে তার বড় গুণ খুঁজতে গেলে যেকোনো ঘটনায় দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে সমাধানের চেষ্টা এবং জনপ্রিয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রবণতাকে চিহ্নিত করা যায়।

আবার উল্টো এই দুটি পয়েন্টই তার বিপক্ষে সমালোচনার ব্যাপারও বটে। দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখাতে গিয়ে জাতীয় দল বা অন্য পর্যায়ে অনাকাক্সিক্ষত চাপ তৈরি করে ফেলেন তিনি, এমন অভিযোগ আছে। জনপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে ক্রিকেটীয় সিদ্ধান্তকে পাশ কাটিয়ে ফেলেন বলেও নিন্দুকেরা বলছেন।

তবে পাপনের বিপক্ষে সবচেয়ে বড় অভিযোগ এখন পর্যন্ত স্বজনপ্রীতি। এই স্বজনপ্রীতির প্রমাণ হিসেবে লোকজন বিসিবির বিভিন্ন স্থানে পরিচিতি, কর্মসূত্রে ঘনিষ্ঠ এবং ব্যক্তিগতভাবে পছন্দের লোকদের এনে বসানোটা সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয়।

শেষ পর্যন্ত পাপনের এই বিজয়, নাকি সমালোচনা, কোনটা জয়ী হবে, সেটা সময় বলবে।

(ঢাকাটাইমস/ ০২ এপ্রিল/ ডিএ/এআর/ ঘ.)