logo ০২ মে ২০২৫
নতুন সংকটে বিএনপি
হাবিবুল্লাহ ফাহাদ, ঢাকাটাইমস
০৩ এপ্রিল, ২০১৪ ০০:০২:২১
image


ঢাকা: প্রথমে তারেক রহমান এবং পরে খালেদা জিয়া। মুক্তিযুদ্ধের ৪৩ বছর পর এসে হঠাৎ করে দুজন দাবি করে বসলেন যে, বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। দলের শীর্ষস্থানীয় দুই নেতার মুখে এমন দাবি উঠার পর বিএনপি নেতারা পড়েছেন বিপাকে। কীভাবে এই দাবির পক্ষে যুক্তি তুলে ধরবেন তা ভেবেই পাচ্ছেন না তারা। এ কারণে এ নিয়ে কথা বলতেও অস্বস্তিতে পড়েছেন তারা। আর বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য একটি বেসরকারি টেলিভিশন বিএনপির একটি শরিক দলের প্রধানকে আমন্ত্রণ জানালে তিনি ক্ষমা চেয়ে সে আমন্ত্রণ ফিরিয়ে নিয়েছেন।

জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর বিএনপি হঠাৎ বলতে শুরু করে যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা। তখন বিএনপি রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকায় আর গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের তেমন বিকাশ না হওয়ায় এই দাবির প্রতিষ্ঠায় দলের নেতারা মোটামুটি নির্বিঘেœই প্রচার চালাতে পারেন। কিন্তু নব্বই দশক থেকে সংবাদপত্রে এক ধরনের স্বাধীনতা ফেরায় আর দুই হাজার সালের পর থেকে বেসরকারি টেলিভিশনে মুক্তিযুদ্ধকালীন ইতিহাস নিয়ে একের পর এক সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশের পর স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে বিএনপির এই দাবি পড়ে প্রশ্নের মুখে। আর বিষয়টি নিয়ে হাইকোর্টে রিট করার পর শুনানি শেষে উচ্চ আদালতও ঘোষণা করে যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন।

তাছাড়া পাকিস্তানি বাহিনী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বাঙালিদের ওপর আক্রমণের পর পর বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার বিষয়টি উল্লেখ আছে পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তার বইয়েও। ২৬ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রের টেলিভিশন চ্যানেল এনবিসির এক প্রতিবেদনেও বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার সংবাদ প্রচার হয়। তাছাড়া জিয়াউর রহমান ২৭ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাটে স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে যে ঘোষণাপত্র পাঠ করেন, তা তিনি পড়েন বঙ্গবন্ধুর পক্ষেই। এর আগেও একই কেন্দ্র থেকে রাজনৈতিক নেতারা একই ঘোষণা দেন।

এরপরও বিএনপি জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করে। তবে ২৫ মার্চ লন্ডনে এক অনুষ্ঠানে তারেক রহমান জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে দাবি করে বসেন। দুদিন পর রাজধানীতে বিএনপির এক অনুষ্ঠানে একই দাবি করেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।

খালেদা জিয়ার এই বক্তব্যের পর বিএনপি নেতারা বিষয়টি নিয়ে তেমন কোনো কথা বলেননি। কেবল স্থায়ী কমিটির সদস্য রফিকুল ইসলাম মিয়া তার মতো করে একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন, যাও খুব জোরালো নয়। আবার বিএনপির নিজস্ব ওয়েবসাইটেও জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশের সপ্তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে পরিচয় দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশের পর নিজস্ব ওয়েবসাইট আপাতত বন্ধ করে দিয়েছে বিএনপি।      

আর খালেদা জিয়া-তারেকের এই বক্তব্যকে উদ্ভট বলে এর কড়া সমালোচনা করছেন সরকারি দলের নেতারা। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও নানা ব্যাঙ্গাত্মক লেখা প্রকাশ হচ্ছে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে নিয়ে।

বিব্রত বিএনপি নেতারাও

স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর এসে দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতির নাম নিয়ে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান যে বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন তা নিয়ে রীতিমতো বিব্রতকর অবস্থায় আছেন বিএনপির শীর্ষ নেতাদের কেউ কেউ। এ নিয়ে গণমাধ্যমের মুখোমুখি হতেও ইতস্ত বোধ করছেন তারা।

যোগাযোগ করা হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ বিষয়টি নিয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। তিনি বলেন, ‘আমি মাত্র লন্ডন থেকে দেশে ফিরেছি। রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে এখন কোনো বক্তব্য দিতে চাই না। আগে ম্যাডামের কাছে বিষয়টি নিয়ে জেনে নেই।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘ম্যাডাম হঠাৎ করে কেন রাষ্ট্রপতির বিষয় সামনে আনলেন বুঝতে পারছি না। এই মুহূর্তে এটা বলেই বা কী হবে। এ নিয়ে বক্তৃতা বিবৃতি যত বাড়বে বিতর্কও তত জোরালো হবে। এখন এ বিতর্কে জড়ানো উচিত হয়নি। সামনে তো আরও সময় ছিল।’

খালেদা জিয়ার এ বক্তব্য নিয়ে টিভি টকশো ও পত্রিকার পাতার কলামগুলোও বেশ জমে উঠেছে। এর পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি দাঁড় করানোর চেষ্টা করছেন কেউ কেউ। আবার এ নিয়ে কথা বলতে হবে এ জন্য টিভি টকশো এড়িয়ে চলছেন বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের নেতারা।

বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৯ দলীয় জোটের শীর্ষ এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘একটি টিভি থেকে ফোন এসেছিল টকশোতে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে। কিন্তু তাদের না করতে হয়েছে। কারণ, এসব নিয়ে আমি কথা বলতে চাই না। সারাক্ষণ যদি অতীত নিয়েই জল্পনা-কল্পনা করি তবে দেশ এগোবে কীভাবে? উন্নয়নের রাজনীতি থেকে সরে এসে এখন আমরা তোষামোদ আর বিতর্কের রাজনীতিতে জড়াচ্ছি। এটা বেশি দিন চলতে পারে না।’

জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি-এমন তথ্য কোথায় পেলেন-জানতে চাইলে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘দলের চেয়ারপারসন কোনো কথা বলার পর সেটার ব্যাখ্যা দেওয়ার কিছু থাকে না। তিনি তো (খালেদা জিয়া) কোনো উদ্ধৃতি দিয়ে কথাটি বলেননি। যা বলেছেন সরাসরিই বলেছেন। এরপর এ নিয়ে ব্যাখ্যা দেয়ার কী আছে।’

বিএনপির ওয়েবসাইট হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে রিজভী বলেন, ‘ওয়েবসাইটটি কেন হঠাৎ করে সমস্যা করছে তা আমি বলতে পারব না। কারণ, পেইজটি গুলশানের কার্যালয় থেকে দেখাশোনা করা হয়। আমাকে এ ব্যাপারে কিছু জানানো হয়নি।’

তবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য রফিকুল ইসলাম মিয়া তার মতো করে খালেদা জিয়ার বক্তব্যের একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। খালেদা জিয়ার বক্তব্যের একদিন পর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এক মানববন্ধনে তিনি বলেন, ‘১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে প্রবাসী সরকার গঠনের (১০ এপ্রিল) পূর্ব পর্যন্ত কার সরকার ছিল? দিশেহারা জাতিকে পথ প্রদর্শন করেছেন জিয়াউর রহমান। তা প্রমাণ করে সে সময় তিনি দেশের মূল ভূমিকা পালন করেন, দেশের রাষ্ট্রপতি হওয়া বা দেশ চালাতে হয়েছে, সে ব্যবস্থায় তিনি তা করেছেন।’

আওয়ামী লীগের কড়া প্রতিক্রিয়া

বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি নিয়ে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের বক্তব্যের কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ। এমন বক্তব্যের জন্য বিএনপি চেয়ারপারসন ও তার ছেলেকে ক্ষমা চাওয়ার আহ্বানও জানিয়েছে সরকারি দল। ইতিহাস বিকৃতির জন্য দুজনকে গ্রেপ্তার করা প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক হাছান মাহমুদ।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, ‘খালেদা জিয়া ও তার ছেলে পাগলের প্রলাপ বকছেন। আমরা সরকার গঠন করায় তারা হতাশ। তাই উন্মাদের মতো যাচ্ছেতাই বকছেন।’

মুক্তিযুদ্ধের এক সমরনায়কের প্রতিক্রিয়া

জিয়াউর রহমানের মতোই মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন কে এম সফিউল্লাহ। ছিলেন এস ফোর্সের প্রধান। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি যখন ছিলেন সেনাপ্রধান তখন জিয়াউর রহমান ছিলেন তার অধঃস্তন।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে থেকে তাদের বশ্যতা অস্বীকার করে বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন সফিউল্লাহ। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি তাকে ব্যথিত করে। ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, ‘ইতিহাস বিকৃতি এই নোংরা খেলা অতীতেও বাংলাদেশে হয়েছে। যে কারণে আজও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত চালু আছে।’ তিনি বলেন, ‘আমি সত্যি বলতেই একটাই বুঝি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি। উপ-রাষ্ট্রপতি ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। এটাই প্রকৃত ইতিহাস।’

স্বাধীনতার ঘোষণা প্রসঙ্গ টেনে রণাঙ্গনের এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু ২৫ মার্চ রাত ১১টা ৫৫ মিনিট থেকে ১২টা ৫ মিনিটের মধ্যে যে কোনো এক সময় ঘোষণা দিয়েছিলেন আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষণা চট্টগ্রামে পাঠানো হয়েছিল। সেখানকার সেনা কর্মকর্তাদের উজ্জীবিত করতে সেনাবাহিনীর একজন কর্মকর্তাকে দিয়ে ওই ঘোষণাটি পড়ানো প্রয়োজন ছিল। শেষমেশ জিয়াউর রহমানকে দিয়ে সেটি পড়ানো হয়। তাই বলে তিনি তো আর স্বাধীনতার ঘোষক হতে পারেন না। জিয়াউর রহমান বেঁচে থাকতেও কোনো দিন বলেননি তিনি স্বাধীনতার ঘোষক বা বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি।’

তবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জিয়াউর রহমানকে সব ধরনের বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখার পরামর্শ দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এমাজউদ্দীন আহমদ। তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং জিয়াউর রহমানের অবদান অনস্বীকার্য। তাদের নিয়ে বিতর্ক করার কিছু নেই। তারা তো এ দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গ করে ভুল করেননি।’

(ঢাকাটাইমস/০৩এপ্রিল/এইচএফ/এআর/ ঘ.)