ঢাকা: ঢাকা থেকে থেকে চট্টগ্রামগামী আন্তঃনগর ট্রেন মহানগর গোধূলির কমলাপুর রেল স্টেশন থেকে ছেড়ে যাওয়ার কথা বিকাল ৩টা ২০ মিনিটে। কিন্তু ২৭ মার্চ বৃহস্পতিবার নির্ধারিত সময়ের এক ঘণ্টা পরও ট্রেনটি দাঁড়িয়েছিল প্লাটফর্মে। ট্রেনটি কখন ছাড়বে, সেটা নির্দিষ্ট করে বলার মতো কেউ ছিল না। যে সময়ে ট্রেনটি ছেড়ে যাওয়ার কথা এরও আধা ঘণ্টা পরে চট্টগ্রাম থেকে ট্রেনটি ঢাকায় আসে।
ট্রেনের একজন গার্ডের কাছে জানতে চাইলে ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, এই ট্রেনটি কখনোই সময় মতো আসে না বা ছেড়ে যায় না। এই বিলম্বের কথা জানেন যাত্রীরাও। তাদের সে রকম মানসিক প্রস্তুতিও থাকে। যাত্রীদেরকে উচ্চবাচ্য না করে প্লাটফর্মে বসে থাকতে দেখা গেল বেশ শান্তভাবে।
একজন যাত্রী বলেন, ‘কী করবো, এটা আমাদের কাছে স্বাভাবিক হয়ে গেছে। দেরি হবে জেনে কেউ কেউ সময় মতো স্টেশনে আসেনই না।’
একই দিন বিকালে ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়ার কথা এমন কোনো ট্রেন ছাড়েনি সময় মতো। সিলেটগামী কালনী এক্সপ্রেস ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিল বিকাল চারটায়। কিন্তু তা ছাড়েনি। নোয়াখালীগামী উপকূল এক্সপ্রেস ছাড়ার কথা ছিল বিকাল ৪টা ২০ মিনিটে। অথচ এ সময়ে লাইনেই আসেনি ট্রেনটি। এ ট্রেনের যাত্রীরাও বসে ছিল প্লাটফর্মে।
তিন দিন আগে ২৪ মার্চের চিত্রটিও একই রকম। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামগামী তূর্ণা নিশিথার ছাড়ার কথা ছিল রাত ১১টা ৩০ মিনিটে । কিন্তু তা ছেড়েছে পৌনে একটায়। স্বভাবতই সকালে সময় মতো পৌঁছতে পারেনি ট্রেনটি। সকাল আটটায় পৌঁছার কথা থাকলেও তা পৌঁছে সাড়ে নয়টায়।
যাত্রীরা জানালেন, বছর দুয়েক আগে ট্রেনের সময়ানুবর্তিতা বেশ ভালো হলেও গত কয়েক মাস ধরে তা হয়ে গেছে যাচ্ছেতাই। বলতে গেলে সময় মেনে ছাড়ে না কোনো ট্রেনই। তবে এসব অভিযোগ মানতে চায় না রেল বিভাগ। তাদের দাবি, দুই একটা ট্রেন দেরি হলেও বাকিগুলো ছাড়ে সময় মতোই।
বাংলাদেশের ট্রেনের সময় নিয়ে একটা কৌতুক প্রচলিত আছে বাংলাদেশর স্বাধীনতার পর থেকেই। নয়টার ট্রেন কয়টায় আসে, এই প্রশ্ন নিয়ে হাস্যরস হয়েছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। সেই অবস্থার উন্নতি কী হয়েছে এখনো। কিন্তু ট্রেনের সময় নিয়ে এখনো আছে নানা উদ্বেগ।
ঢাকা-চট্টগ্রামের মধ্যে চলাচলকারী সুবর্ণ এক্সপ্রেস আর ঢাকা-রাজশাহী রুটে চলাচলকারী সিল্কসিটি, ধূমকেতু আর পদ্মার সময়ানুবর্তিতা বেশ ভালো। এর বাইরে কোন ট্রেন কখন কতক্ষণ বিলম্বে ছাড়ে তা বলা যায় না আগেভাগে। ঢাকা-দিনাজপুর, ঢাকা-রংপুর, ঢাকা-নীলফামারী রুটের ট্রেনের বিলম্ব হয় তুলনামূলক বেশি।
তবে কমলাপুর রেলস্টেশনের ম্যানেজার খায়রুল বশীর ঢাকাটাইমসকে -এর কাছ দাবি করেন, এ স্টেশন থেকে ট্রেন বিলম্বে ছাড়ে কমই। তিনি বলেন, ‘এখান থেকে প্রতিদিন ২৬টি আন্তঃনগর ট্রেন ছাড়ে। আমাদের হিসাবে এর ৯৪ শতাংশই ছাড়ে সময় মতো। কাজেই দু-একটি ট্রেন দেরি করলে আমরা ট্রেনের সময় নিয়ে বড় ধরনের কোনো সমস্যা আছে বলতে পারি না।’
ভাড়া বাড়লেও বাড়েনি যাত্রীসেবা
লোকসান কমাতে ২০১২ সালের অক্টোবর থেকে ট্রেনের ভাড়া ৫০ শতাংশ বাড়ায় রেলপথ মন্ত্রণালয়। কিন্তু কার্যত ভাড়া বেড়ে যায় প্রায় ১০০ শতাংশ। রেল বিভাগের কর্মীরা জানান, ১৯৯৩ সালে ভাড়া বাড়ানোর পর কোনো কোনো রুটে যাত্রী কমে যাওয়ায় তখন ভাড়ার ওপর ৩৫ শতাংশ ছাড় দেওয়া হয়। এবার তুলে নেওয়া হয়েছে সে ছাড়। এ কারণে ভাড়া দ্বিগুণ হয়েছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে।
এমনিতে সরকারি কোনো সংস্থার সেবার মূল্য বাড়ানো হলেও ট্রেনের ভাড়া বাড়ানোর বিষয়টিতে তেমন প্রতিক্রিয়া হয়নি। কারণ, বাসের তুলনায় ট্রেনের ভাড়া অর্ধেকেরও কম আর ১৯ বছর ধরে একই ভাড়ায় চালানো-কোনোটাই স্বাভাবিক নয়, এই বোধ ছিল যাত্রীদের মধ্যে। কিন্তু ভাড়া বাড়ানোর পর যাত্রীসেবার মান কতটা বৃদ্ধি পেল সেই প্রশ্ন এখন উঠছে জোরেশোরে।
আগের মতোই ট্রেন ছাড়ছে নির্ধারিত সময়ের দেরিতে। ট্রেনের ভেতরের নোংরা পরিবেশেরও তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। ট্রেনের পরিবেশ দেখতে ২৯ মার্চ সকালে বিমানবন্দর স্টেশন থেকে কমলাপুর পর্যন্ত আসার পথে নানা অব্যবস্থাপনার চিত্র দেখা যায়। পাখা থাকলেও এই গরমেও চলছিল না একটাও। একজন যাত্রী বলেন, ‘বাসে আসলে যানজটে পড়তে হয়। তাই কষ্ট করে হলেও ট্রেনেই আসতে হয় আমাদের।’
বিমানবন্দর স্টেশনে ট্রেনটি থামার পরম মাইকে ঘোষণা দেওয়া হয়, হাওর এক্সপ্রেস নেত্রকোণা থেকে এসেছে। কমলাপুরে নেমে স্টেশন ম্যানেজার খায়রুল বশীরের কাছে ট্রেনের এই অবস্থার কারণ জানতে চাইলে তিনি দাবি করেন, ‘ট্রেনে কোনো সমস্যা নেই।’
কমলাপুর স্টেশনে অপেক্ষমাণ আরিফ নামে এক যাত্রী বলেন, ‘ঢাকা-ময়মনসিংহের আগের ভাড়া ছিল ৬০ টাকা, এখন তা বেড়ে ১১০ টাকা হয়েছে। ভাড়া বাড়লেও বাড়েনি সেবার মান।’ সিটে বসে থাকা এ যাত্রী উপরে আঙুল উঁচিয়ে বললেন, ‘বগির অধিকাংশ ফ্যান চলে না। রাতে বাতিও জ্বলে না।’
রাকিব নামে আরেকজন বলেন, ‘জামালপুরগামী কমিউটার ট্রেনে আগের ভাড়া ছিল ৭০ টাকা। এখন হয়েছে ১৫০ টাকা। কিন্তু আগের মতোই আসনগুলো বেহাল। সিট ছিঁড়ে নারকেলের ছোবড়া বেরিয়ে গেছে কোনো কোনোটির। কোচের ভেতরে স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশ। দুর্গন্ধ তো আছেই।’
কমিউটার ট্রেনটির কয়েকটি বগি ঘুরে দেখা গেছে, বেশিরভাগ জানালার কাচই ভাঙা। নষ্ট অ্যালুমিনিয়ামের শাটারও।
তবে কমলাপুর রেল স্টেশনের ম্যানেজার খায়রুল বশীর এসব অভিযোগের কিছুই স্বীকার করতে চান না। তিনি বলেন, ‘আমাদের সেবার মান এখন অনেক ভালো। সব ট্রেনেই পানির সুবিধা আছে। হয়ত মাঝেমধ্যে দুই একটি বগিতে সমস্যা হতে পারে। সেগুলোও সাময়িক।’
তবে রেলওয়ের মহাপরিচালক তফাজ্জল হোসেন নানা সমস্যার কথা স্বীকার করেছেন। তিনি জানান, ভারত থেকে আড়াইশ কোচ আনতে চুক্তি করেছেন তারা। এটা এলে যাত্রীদের সব সংকট দূর হয়ে যাবে বলে আশা করেন তিনি।
লোকাল ট্রেনের কথা ভাবেও না কেউ
আন্তঃনগর ট্রেনের পাশাপাশি স্বল্প এবং দূরপাল্লায় চলে মেইল আর লোকাল ট্রেনও। প্রতিটি স্টেশন ধরে, তাই এসব ট্রেনে যাত্রী হয় আন্তঃনগরের চেয়ে বেশি। তাছাড়া ভাড়া কম হওয়ায় স্বল্প আয়ের মানুষ এসব ট্রেনে চলতে পারে বেশি।
কিন্তু ভাড়া কম, তাই আদরও যেন কম। গরিব মানুষ চলে, তাই সেবার মানের দিকে রেল বিভাগের যেন কোনো ভ্রƒক্ষেপই নেই। গণমাধ্যমও এসব ট্রেনে যাত্রী ভোগান্তি নিয়ে তেমন কোনো প্রতিবেদনও করে না। অথচ আন্তঃনগরের চেয়ে লোকাল আর মেইল ট্রেনের সংখ্যা বাংলাদেশে বেশি।
ঢাকা-কিশোরগঞ্জ রুটে চলাচলকারী ঈশা খাঁ এক্সপ্রেসের টয়লেটে ঢুকে পানি পাওয়া যায়নি। ট্রেনের কোনো পাখাই চলে না, রাতের বেলায় জ্বলে না বাতিও। আসনগুলোর অবস্থাও যাচ্ছেতাই। কোনোটি ছেঁড়া, কোনোটিতে উঁইপোকার বাসা।
ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটে চলাচলকারী বলাকা এক্সপ্রেসেও একই চিত্র দেখা গেল। ট্রেনের কয়েকটি বগিতে উঠে দেখা যায়, সিট ভাঙা, আর পুঁতিগন্ধময় পরিবেশ। দিনের পর দিন এসব সমস্যা চলে এলেও কর্তৃপক্ষ পরিবেশের উন্নতিতে কোনো চেষ্টাও করে না।
বলাকা ট্রেনের যাত্রী রহিমা খাতুন আক্ষেপ করে বলেন, ‘ভাই টেহা-পয়সা তাকলে কি এই গাড়িত উঠতাম। গরিবরে কেউ মানুষ মনে হরে না।’
তবু স্বপ্ন দেখাচ্ছে কর্তৃপক্ষ
পাকিস্তান আমলে দূরপাল্লার যাতায়াতে নৌ আর রেল যোগাযোগই ছিল যাত্রীদের ভরসা। স্বাধীনতার পরও এক দশক অব্যাহত থাকে তা। কিন্তু আশির দশক থেকে ট্রেনের বদলে সড়ক যোগাযোগ বাড়ানোর দিকে নজর দেয় সরকার। আর ধীরে ধীরে অবহেলার শিকার হয় রেল। এক সময়ের লাভজনক রেল যোগাযোগ বিরাট লোকসানে পড়ে। একে একে বন্ধ হয়ে যায় পাঁচ শতাধিক স্টেশন। আধুনিক ট্রেন যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ার কোনো উদ্যোগও নেওয়া হয়নি পরের তিন দশকে। রেলের বেশিরভাগ ইঞ্জিনের আয়ু ফুরিয়ে যাওয়ায় ট্রেন চালানোই মুশকিল হয়ে উঠে।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে ২৫টি ইঞ্জিন কেনার উদ্যোগ নেয়। এসব ইঞ্জিন আসতে আসতে লেগে যায় আরও ১০ বছর। তবে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনে ক্ষমতায় এসে রেলকে সংস্কারের কথা জানায় সরকার। ২০১১ সালের ডিসেম্বরে করা হয় আলাদা মন্ত্রণালয়।
এরপর চালু করা হয় বেশ কয়েকটি আন্তঃনগর ট্রেন, স্বল্প দূরত্বে চালু করা হয় ডেমু ট্রেন। কিন্তু ট্রেন বেড়ে যাওয়ায় আরেক সমস্যা তৈরি হয়। বেশিরভাগ এলাকায় লাইন একটি, তাই স্টেশনে একটি ট্রেনকে দাঁড় করে রেখে অন্য ট্রেনকে পার করতে হয়। এতে বেড়ে যায় যাত্রার সময়।
তবে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে এক বছরের মধ্যে এই সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ। ঢাকা থেকে ভৈরব আর কুমিল্লার লাকসাম থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত ডবল লাইনের কাজ চলছে। এ কাজ শেষ হলে আরও দ্রুতগামী ট্রেন চালু হবে বলে জানিয়েছে রেল বিভাগ। তখন ট্রেনের সময়ানুবর্তিতা বাড়বে বলেও জানান তারা।
আর এই ডবল লাইনের কাজ শেষ হলে ঢাকা-চট্টগ্রামের মধ্যে আরও বেশি মালবাহী ট্রেন চালানো যাবে এবং তাতে রেলের লোকসান কমবে বলেও আশা করছে রেল বিভাগের কর্মীরা।
(ঢাকাটাইমস/০৩এপ্রিল/টিএ/এআর/ ঘ.)