দিলরুবা সরমিন: সম্প্রতি টাকার মাপকাঠিকে প্রধান্য দিয়ে “অনলাইন গণমাধ্যম” পরিচালনা নীতিমালার খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। এর বাইরে আর কোন যোগ্যতার ওপর খুব বেশী গুরুত্ব দেয়া হয়েছে বলে আমার মনে হয়নি। বিচিত্র এই দেশের আজব সব কাণ্ড দেখে বিস্মিত হওয়ার কথাও ভুলে গিয়েছি!
এই দেশে সবচেয়ে ভালো লেখাপড়ার সুযোগ পাবে কে? যার টাকা আছে। সবচেয়ে ভালো চিকিৎসা সেবা পাবে কে ? যার টাকা আছে। দামী পোশাক, বাড়ি , গাড়ি, রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা পাবে কে ? যার টাকা আছে। শেষেরটি মেনে নেয়া যায়। কারণ দামী বাড়ি , গাড়ি, পোশাক মানুষের জীবনের জন্য অপরিহার্য নয় । তবে জ্ঞানার্জনের জন্য বা সুস্থ্য থাকার জন্য কেবল টাকাই থাকতে হবে ? সেলুকাস !
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এই আধুনিক যুগে বাংলাদেশ সরকার যখন বিশ্বকে সাধারণ জনগণের হাতের মুঠোয় এনে দিতে বদ্ধ পরিকর, যখন সরকার নিজেই ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন যুব সমাজের চোখে এনে পড়িয়েছে ঠিক সেই সময় “অনলাইন গণমাধ্যম” যার মাধ্যমে যুব সমাজ দেশের যে কোন স্থান থেকে দেশ বিদেশের সংবাদ জানতে ও পড়তে পারছে সেই সময় এই ধরনের একটি নীতিমালা ( যদিও খসড়া) সরকারের জন্য কতটুকু মঙ্গলবার্তা বয়ে আনবে?
যে বা যারা এই নীতিমালা প্রণয়নের সাথে সরাসরি জড়িত ছিলেন তারা সকলেই মেধাবী ও দেশের সম্পদ বলেই আমরা জানি। আর এই সব মেধাবী মানুষগুলো কীভাবে একটি অনলাইন গণমাধ্যম প্রকাশ ও প্রচারের ক্ষেত্রে কেবল টাকাকেই অতি গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি হিসাবে বিচার করলেন? তাহলে তো দেখা যাবে এখানে মেধাবী ছেলেমেয়েরা যারা সরাসরি অনলাইন গণমাধ্যম প্রকাশ ও প্রচারের সাথে জড়িত , যারা সামান্য টাকায় বা বিনা পারিশ্রমিকে দিন রাত অক্লান্ত কাজ করে যাচ্ছে , যাদের কোন বাড়তি টাকা নেই তারা তো অচিরেই ঝরে যাবে এই মাঠ থেকে। আর সেই ফাঁকা মাঠ কেবল টাকার জোড়ে দখল করে নেবে “কোন কোন কালো হাত” যাদের টাকার অনেকটাই আসে বিদেশি কোন দূত এর মাধ্যমে যারা প্রতিনিয়ত বাংলাদেশকে একটি অস্থির সমাজ ব্যবস্থার যাতাকলে ফেলতে ব্যতিব্যস্ত। কী অদ্ভুত সব চিন্তা ভাবনা!
কেবল টাকাই অনলাইন গণমাধ্যম প্রকাশ ও প্রচারের মাপকাঠি? আজ এই টাকার জোরেই কেবল বেশ কিছু টেলিভিশন চ্যানেল যেমন চালু হয়েছিল তেমনি আবার বন্ধ করতেও বাধ্য হয়েছে সরকার। অনলাইন গণমাধ্যম প্রকাশের ক্ষেত্রে মাপকাঠি অনেক কিছুই হতে পারে। কী কী হতে পারে সেটি সরকার ভাববে। আমরা সাধারণ জনগণ চাই হাতের মুঠোয় বিশ্ব। যার প্রতিদিন ১০ টাকা দিয়ে সংবাদপত্র কেনার ক্ষমতা নেই বা পাতা উল্টে পাল্টে খবর পড়ার সময় নেই। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল আছে যেখানে সকালের খবরের কাগজ যায় বিকালে, আর যদি হরতাল বা অবরোধ থাকে সেসব জায়গায় তো সংবাদপত্র পৌঁছায়ই না। শুধু তাই নয় বিদেশে বসবাসরত বাঙ্গালীরা যারা কেবল অনলাইনের ওপরই নির্ভর করেন অনলাইন গণমাধ্যমের দৌলতে প্রতি মুহূর্তের সংবাদ তারা ইচ্ছা করলেই তাৎক্ষণিকভাবে জানতে পারছেন- এতগুলো দিক বিবেচনা করার পরও কি সরকার অনলাইন গণমাধ্যমের ওপর এই গুরুভার চাপিয়ে দেবে?
এটি কোন জ্ঞানী, গুনী বা গণবান্ধব সরকারের করা উচিৎ হবে না। বরং অনলাইন গণমাধ্যম প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রকাশকের শিক্ষাগত যোগ্যতা, রাজনৈতিক পরিচয়, আয়কর প্রত্যায়নপত্র, যে বা যারা অনলাইন গণমাধ্যমটির সাথে জড়িত তাদের পরিচয়, তথ্যসহ সব কিছু জেনে নিয়ে অনলাইন গণমাধ্যমটির নিবন্ধন করা যেতে পারে যার ফি হবে ন্যূনতম। ভাবতেই হবে সরকারকে একটি বিশাল অংশ আজ এই অনলাইন গণমাধ্যমের দৌলতে চাকরি না পেয়েও ঘেরাও করছে না সচিবালয় বা কোন দপ্তর। কারণ তারা অনেকেই এই মাধ্যমে কাজ করছেন। একটি শ্রেণি আজ অনেক কর্ম থেকেই বিরত আছেন বা ব্যস্ত আছেন এই মাধ্যমে নিজের মেধার প্রকাশের সুযোগ পাচ্ছেন বলে। সেক্ষেত্রে কেন সরকারকে “একটি বিশেষ মহল” অনলাইন গণমাধ্যম প্রকাশের ক্ষেত্রে কেবল “টাকার অংকটাই বোঝানোর” চেষ্টা করছেন? কেন বার বার সরকারকে বিপাকে ফেলার এই অপচেষ্টা? মাননীয় তথ্যমন্ত্রী তো ভীষণ মেধাবী, বিচক্ষণ ও দূরদর্শী । তিনি তো অন্তত আমার চাইতে অনেক ভালো জানেন যে, কেবল টাকার মাপকাঠিতেই অনলাইন গণমাধ্যমের প্রকাশের সুযোগ দেয়া উচিৎ কি না ? আশা করি সরকার এই সব জ্ঞানী গুণীদের প্রদত্ত এই “টাকা তত্ত্বকে” সম্মানের সাথে বিদায় দিয়ে “অনলাইন গণমাধ্যম” প্রকাশের ক্ষেত্রে মেধা, যোগ্যতা, সৃজনশীলতা, ব্যক্তির পরিচয় (নিজের, পরিবারের ও সংশ্লিষ্টদের) কে প্রাধান্য দেবে। রাষ্ট্র ও দেশ বিরোধী যে কোন লেখা প্রকাশের ক্ষেত্রে সরকার নিজেই একটি নিয়ন্ত্রণ সেল চালু রাখতে পারে। গড়ে তুলতে পারে একটি অনলাইন মনিটরিং সেল । কত কিছুই তো করা যায় যদি সদিচ্ছা থাকে । কেবল টাকার মাপকাঠি কেন? তাহলে তো আবার সেই ডিজিটাল বাংলাদেশ চলে যাবে কিছু সংখ্যক আইয়ামে জাহেলিয়া যুগের মানুষের হাতে। যারা “পেছন দরজা দিয়েই প্রবেশ করে আর সামনের দরজা বন্ধ করে দেয়”।
আশা করি সরকার বিষয়টি নিয়ে অতি গুরুত্বের সাথেই ভাববেন।
লেকক: দিলরুবা সরমিন, আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী