logo ১০ মে ২০২৫
এ জীবন সাংবাদিকের

মাসুদ কামাল
১৭ জুলাই, ২০১৪ ১৭:০৩:১৯
image


আমার সাংবাদিকতা-জীবনের শুরু ১৯৯০ সালে। সম্ভবত ফেব্রুয়ারি মাস। এর মাস তিনেক আগে আমি বিয়ে করি। আর তারও বছরখানেক আগে শেষ হয় আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ।



 





ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগে পড়ালেখা করলেও, পেশা হিসেবে যে সাংবাদিকতাকেই বেছে নিতে হবে, তেমনটি খুব জোরালোভাবে ভাবিনি তখনো। মনে মনে হয়তো একটা সুপ্ত বাসনা কাজ করেছে, কিন্তু সাংবাদিকতার চাকরি পেতে কিভাবে কোথায় কার কাছে যেতে হবে, সেটাই জানা ছিল না। আসলে জানার তেমন কোনো ফুরসতও পাইনি। এর কারণ অনেকটাই ব্যক্তিগত।



 





বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষে পড়াকালীন আমি প্রেমে জড়িয়ে পড়ি। প্রেমপর্বটা খুব একটা নির্বিঘœ হয়নি। এমনিতেই প্রেমের বিষয়টিকে আমাদের সমাজ ভালো চোখে দেখে না। তার ওপর আমারটি ছিল কিছুটা অসম প্রেম। সম্পর্কের প্রাথমিক পর্যায়েই বিষয়টি আবার অভিভাবকদের কাছে প্রকাশিত হয়ে পড়ে। ফলে আমি পারিবারিকভাবে বেকায়দায় পড়ে যাই। বিশেষ করে অর্থনৈতিকভাবে বিষম এক জটিলতা আমার সঙ্গী হয়।



 





বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনের প্রায় সারাটা সময়ই আমি টিউশনি করেছি। শখে নয়, প্রয়োজনে। পড়ালেখার বাইরে টিউশনি ছাড়া আর যে দুটি কাজ আমি খুব গুরুত্ব দিয়ে করেছি, তা হলো এক. দাবা খেলা, দুই. রাজনীতি করা। শুরুতে রাজনীতিতে জড়াই হলে সিট পাব বলে। সিট পেয়ে কিছুটা থিতু হতে হতে এরশাদের মাধ্যমে দেশে সামরিক শাসন শুরু হয়ে গেল। তখন এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সূতিকাগার ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ফলে অনিবার্যভাবেই, রাজনীতি করাটা নৈতিক দায়িত্ব বিবেচনা করতে শুরু করলাম।



 





আর দাবা খেলতাম শখের বশে। সেই শখটা দ্রুতই নেশায় পরিণত হলো। বেশ কয়েকটা টুর্নামেন্টে অংশ নিয়ে মাঝারী মানের পুরস্কার-টুরস্কারও পেয়ে গেলাম। দাবা খেলতে খেলতেই পরিচয় মতিউর রহমান সাহেবের সঙ্গে। পেশায় প্রকৌশলী এই ভদ্রলোকের হাটখোলা এলাকায় ছিল একটা কালার ফটো ল্যাব। তিনিও দাবা খেলতেন। হয়তো তার খেলার নিয়মিত সঙ্গী লাভের আশাতেই একদিন বললেন তার বাসায় টিউশনি করাতে। তখন অবশ্য আমি অন্যত্র কয়েকটা টিউশনি করতাম। তার প্রস্তাবকে গুরুত্ব দিতে, অন্যগুলো ছেড়ে তার বাসায় টিউশনি শুরু করলাম। প্রথম দিকে তার ছোট বোনকে পড়াতাম, পরে তার দুই ছেলেকে।

এই টিউশনিটা করাতে করাতেই শেষ হয়ে গেল আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাজীবন। তত দিনে মতিউর রহমানের সঙ্গে মিলে আমরা একটা দাবা ক্লাবও গঠন করেছি। সেই ক্লাব প্রথমবার দ্বিতীয় বিভাগে অংশ নিল, আর অনেককেই অবাক করে দিয়ে উন্নীত হলো প্রথম বিভাগে। দাবার নেশাতেই প্রায় প্রতিদিন অনেকটা রুটিন করে যেতে হতো মতি ভাইয়ের বাসায়। তখন অন্য কোনো আয় ছিল না আমার। বিষয়টা মতি ভাইও বুঝতেন। ফলে তার দুই ছেলে পড়ানোর দায়িত্বটা রয়ে গেল আমারই কাছে।



 





এরই মধ্যে শাহানার সঙ্গে আমার প্রেমের বিষয়টা প্রকাশিত হয়ে পড়ল। ছেলে এবং মেয়ে- দুই পক্ষই বেঁকে বসল। অবস্থা এমন দাঁড়াল যে, বিয়ে করাটা অপরিহার্য হয়ে পড়ল। শাহানার তখন বেশ কটা ভালো ভালো সম্বন্ধ আসছিল। আমার মা-বাবাও পাত্র হিসেবে আমাকে মোটামুটি ভালো মনে করতেন। গার্জেনরা সেসব কথা বলে আমাদের বোঝানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু প্রেমে মত্ত যুবক-যুবতীরা যা করে আসছে সেই অনাদিকাল থেকে, আমরাও তাই করলাম। সব যুক্তিই হার মানল আমাদের কাছে। অগত্যা হাল ছেড়ে দিলেন অভিভাবকরা।



 





কিন্তু আমার জন্য চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়াল অর্থনৈতিক পরিস্থিতি। খুবই নাজুক অবস্থায় তখন আমি। ইতিমধ্যে মতিউর রহমান সাহেব একটা সার্ভেয়ার কোম্পানি খুলেছেন। নাম-রিলায়েন্স সার্ভেয়ার। মতিঝিলে একটা অফিসও নিলেন। আমি যেয়ে বসতাম সেখানে। অফিস শেষ হলে ওনার সঙ্গেই চলে যেতাম তার বাসায়। সেখানে টিউশনি সেরে দু-এক গেম দাবা খেলে ফিরতাম বাসায়। বাসা বলতে মিরপুরে খালাতো ভাইদের কাছেই থাকা হতো তখন।

প্রেমের ব্যাপারটা প্রকাশিত হওয়ার পর আলাদা বাসা নিতে হলো। টিউশনি আর সার্ভেয়ার অফিসে একবেলা বসা- এই মিলিয়ে আমার সাকুল্যে আয় ছিল আড়াই হাজার টাকার মতো। এ দিয়ে একা জীবন চালানোই কঠিন, বউ পালব কী দিয়ে? অথচ শাহানার সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি তখন এতটা জটিল যে, বিয়ে না করলেও আর চলে না। পুরো বিষয়টাই জানালাম মতি ভাইকে। তিনি অসাধারণ একটা ভূমিকা রাখলেন। বিয়ে করে ফেলতে বললেন। আরো জানালেন, তার বিশ্বাস, ব্যবস্থা একটা হয়েই যাবে। ঠিকই চলতে পারব আমরা। এর পরও যদি ঠেকে যাই, তাহলে তিনি তো আছেনই।

এমনও বললেন, খুব বেশি সমস্যা হলে আমার বাসায় এসে উঠবে। থাকবে আমাদের সঙ্গে।



 





এভাবেই হয়ে গেল আমার বিয়ে, শাহানার সঙ্গে। একেবারে প্রথম দিন থেকে, খুবই কষ্ট করে, হিসাব-নিকাশ করে চলতে হয়েছে আমাদের। তবে এত অল্প আয় দিয়ে এই যে চলতে পারা, এ জন্য সম্পূর্ণ কৃতিত্বই দেওয়া উচিত শাহানাকে। সে পেরেছে। কিভাবে পেরেছে, তা আজও আমার কাছে বিশাল এক রহস্য। আমার আয় কিন্তু তখনো সেই আড়াই হাজার টাকা। ওই টাকায় বাসাভাড়া দিয়ে দুজনের জীবনযাপন বিস্ময়করভাবেই ম্যানেজ করেছে ও। ঠিক এ রকমই একসময় আমার কাছে এলো সাংবাদিকতায় যোগ দেওয়ার এক প্রস্তাব।

প্রস্তাবটি পেলাম জাহাঙ্গীর ভাইয়ের কাছ থেকে। আমার বড় ভাই, মেজবাহ উদ্দিন হেলাল, থাকেন ময়মনসিংহে। সেখানে তিনি আঞ্চলিক একটি পত্রিকায় কাজ করেন, আর সেই সঙ্গে ঢাকার একটি পত্রিকার জেলা প্রতিনিধি। ভাইজান অবশ্য অনেক আগে থেকেই চাইতেন, যেন আমি পেশা হিসেবে সাংবাদিকতাকে বেছে নিই। কিন্তু এ বিষয়ে আমার দিক থেকে তেমন কোনো উদ্যোগ না থাকায়, তিনি কিছুটা হতাশই ছিলেন। জাহাঙ্গীর ভাই ভাইজানের বন্ধু। দিন কয়েক আগে ভাইজান টেলিফোনে আমাকে জানালেন, ঢাকায় জাহাঙ্গীর ভাই আমার সঙ্গে দেখা করবেন। তিনি ঢাকার কোনো এক পত্রিকায় আছেন। আমি সাংবাদিকতায় পাস করার পরও এ পেশায় যাচ্ছি না বলে, তিনি নাকি খুবই অবাক হয়েছেন।



 





সেই জাহাঙ্গীর ভাই এলেন মতিঝিলে আমার সার্ভেয়ার অফিসে। আসার আগে অবশ্য তিনি আমাকে ফোন করলেন। জানতে চাইলেন, কখন এলে তার সঙ্গে আমি বের হতে পারব।

আমি বললাম, দুপুরের পর।

তিনি সেভাবেই এলেন। অফিস বন্ধ করে আমি তার সঙ্গে নেমে এলাম।

মতিঝিল থেকে রিকশায় শান্তিবাগ। যেতে যেতে হলো নানা কথা। বললেন, তাদের পত্রিকাটি বেশি বড় কিছু নয়। ছোট পত্রিকা। তবে মালিকের টাকা আছে। তাই এটিকে যদি কিছুটা মানসম্মত করা যায়, তাহলে মালিক ভদ্রলোক ইনভেস্ট করবেন। তখন পত্রিকাটির নামডাক হবে। সাংবাদিকদের বেতন-ভাতাও বাড়বে।

বুঝলাম, এখানে যোগ দিলে টাকা-পয়সা যে খুবই কম পাওয়া যাবে- সেটা এক রকম নিশ্চিত। তাই তার প্রস্তাবে খুব একটা উৎসাহ বোধ করলাম না। যেতে যেতে জাহাঙ্গীর ভাই আমাকে পত্রিকাটির নাম বললেন। আরে কি আশ্চর্য, তার কথাগুলো আমি এতটাই নিরাসক্তভাবে শুনছিলাম যে কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি নামটি আর স্মরণ করতে পারলাম না। অবশ্য নাম ভুলে যাওয়ার আরেকটা কারণ ছিল, আসলে এ নামে যে একটি পত্রিকা আছে তা আমি আগে জানতামই না।

আমার মাথায় তখন কেবলই টাকা-পয়সার চিন্তা। দুই চাকরি থেকে যে টাকা পাই, তা দিয়ে কোনোমতে চলে সংসার। এখন কোনো পত্রিকায় যোগ দেওয়া মানে, ওই দুই চাকরি ছেড়ে দেওয়া। পত্রিকা থেকে কত টাকা দেবে কে জানে।

জাহাঙ্গীর ভাইকে জিজ্ঞাসা করলাম, টাকা-পয়সা কেমন দেবে?

ছোট পত্রিকা তো, তেমন একটা দেবে না। তা ছাড়া তুমিও তো পত্রিকার জগতে একেবারে নতুন। কোনো অভিজ্ঞতা নেই। আগে ঢুকে পড়ো, তারপর মাস ছয়েকের মধ্যে বেড়ে যাবে। এখানে মালিকের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক খুবই ভালো। মানিক ভাই এখন নিউজ এডিটর। খুবই বড় সাংবাদিক। তার সঙ্গে কাজ করতে পারাটাও তোমার জন্য ভাগ্যের ব্যাপার।



 





এ রকম আরো অনেক কিছুই বললেন তিনি। বললেন না কেবল বেতনের অঙ্কটা। তাই তার কোনো কথাই আমার মনে তেমন কোনো আগ্রহের জন্ম দিচ্ছিল না। বরং বারবার মনে হচ্ছিল বেতন তাহলে কম-ই হবে। এতটাই কম যে, জাহাঙ্গীর ভাই উচ্চারণ পর্যন্ত করতে পারছেন না। সে ক্ষেত্রে, যা পাব তা দিয়ে সংসার তো চলবে না। মনে হলো, বিষয়টা নিয়ে শাহানার সঙ্গে কথা বলতে পারলে ভালো হতো। সংসার তো সে চালায়, সে-ই বলতে পারবে এই চাকরিটা আমার নেওয়া ঠিক হবে কি না।

রিকশা থেকে নেমে প্রথমেই দৃষ্টি কাড়ল পত্রিকার অফিসটা। ‘দৈনিক নব অভিযান’- ছোট্ট একটা সাইনবোর্ডে লেখা। শান্তিবাগে একেবারে রাস্তার ওপরেই দাঁড়িয়ে ভবনটা। তিনতলা নাকি চারতলা ছিল তখন, এত দিন পরে আর মনে করতে পারছি না। বিল্ডিংটা দেখে মনে হলো, খুব একটা পুরোনো নয়, অনেকটা যেন তাড়াহুড়ো করে তৈরি। এখনো তেমন একটা চুনকাম পর্যন্ত করা হয়নি। ভেতরে ঢুকে সে ধারণা আরো পোক্ত হলো। নির্মীয়মাণ একটা সিঁড়ি দিয়ে তিনতলায় উঠলাম।



 





তিনতলায় ডানে ও বামে দুটি দরজা। ডান দিকেরটি বন্ধ। বাঁ দিকে ঢুকে শুরুতেই একটা ছোট ঘরের মতো, তারপর বাকি অংশ খোলা, অনেকটা হলরুমের মতো। লম্ব^া সেই হলরুমের একদিকে বড় একটা টেবিল, তাকে ঘিরে বেশ কয়েকজন লোক বসে। প্রায় সবাই লেখালেখি করছে। বড় টেবিলটার উল্টো দিকে কয়েকটি ছোট ছোট টেবিল-চেয়ার। সেখানে লোকজন তেমন একটা নেই। পরে জেনেছি, ওই বড় টেবিলটাই নিউজ ডেস্ক, আর ছোটগুলো রিপোর্টারদের। সাব-এডিটর যারা, তারা সবাই মিলে ওই নিউজ ডেস্কে বসেন, আর রিপোর্টাররা বসেন আলাদা আলাদা ছোট ছোট টেবিলে।

জাহাঙ্গীর ভাই আমাকে নিয়ে বসালেন ওই নিউজ ডেস্কেরই একটি চেয়ারে। নিজেও বসলেন পাশে। আমার উপস্থিতিটা খুব একটা সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে হলো বলে মনে হলো না। যারা ওখানে ছিলেন, আমার এবং জাহাঙ্গীর ভাইয়ের প্রতি, তাদের দৃষ্টিতে যেন একধরনের কৌতুক লক্ষ করলাম। বিষয়টা জাহাঙ্গীর ভাই খেয়াল করলেন বলে মনে হলো না। কিন্তু আমাকে পীড়া দিতে থাকল। নিজেকে খুবই ছোট মনে হলো। মনে হলো, এরা সবাই বুঝি আমাকে খুব একটা করুণার পাত্র হিসেবে দেখছে।



 





জাহাঙ্গীর ভাই তখন আমার প্রসঙ্গে কথা বলছিলেন সুদর্শন এক যুবকের সঙ্গে। জাহাঙ্গীর ভাই বলছিলেন বেশি, আর ওই ভদ্রলোক শুনছিলেন। জার্নালিজম থেকে পাস করেছে, খুব ভালো ছাত্র, সুযোগ পেলে খুব ভালো করবে, আমাদের লাইনের ছেলে ইত্যাদি।

মনে হলো, এই শেষের তথ্যটির বিষয়ে ভদ্রলোক উৎসাহী হয়ে উঠলেন। ‘কতটা লাইনের’ তা জানতে মুখ খুললেন তিনি। আর তখনই ঝাঁকুনি খেলাম। দেখলাম, ভদ্রলোক তোতলা। তোতলা মানে ভয়ানক তোতলা। কোনো একটা বাক্যই একবারে বলতে পারেন না। বাক্যে যদি তিনটা শব্দও থাকে, একটিতে যেয়ে তিনি ঠেকবেনই। এ রকম সুদর্শন একজন মানুষের বাগযন্ত্র যে এতটা ক্রটিপূর্ণ হতে পারে, ভাবাই যায় না। তবে ভদ্রলোক নিজের ওই বাচন-বৈশিষ্ট্য বিষয়ে যে খুবই সচেতন তা টের পাওয়া গেল। এ জন্যই সম্ভবত তিনি বলছিলেন কম, শুনছিলেন বেশি।

দ্রুতই জানলাম, ভদ্রলোকের নাম স্বদেশ রায়। তিনি নব অভিযানের সহকারী সম্পাদক। জাহাঙ্গীর ভাই-ই পরিচয় করিয়ে দিলেন। স্বদেশ এসে আমার সঙ্গে হাত মেলালেন। কথা বললেন, আন্তরিক ভঙ্গিতে। কী কী কথা সেদিন স্বদেশ আমাকে বলেছিলেন, এত দিন পরে কেন, সেদিনই কিছুক্ষণ পরে আমাকে জিজ্ঞাসা করলে বলতে পারতাম না। আমি আসলে তার কথা তেমন কিছুই শুনছিলাম না। বরং অনেক বেশি মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করছিলাম তার বাচনভঙ্গিটা। ডেলিভারির সুবিধার্থে কিভাবে সে জটিল শব্দগুলোকে এড়িয়ে যাচ্ছে, তার জিহ্বায় যে শব্দগুলো সহজে উচ্চারিত হয়, খুঁজে খুঁজে ঠিক সেগুলোকেই ব্যবহার করছে- মুগ্ধতা পেয়ে বসল আমাকে।



 





বিভিন্ন প্রসঙ্গে নানা কথা বলে স্বদেশ আমাকে বুঝতে চেষ্টা করছিল। হু, হ্যাঁ, ছাড়া তেমন বেশি কিছু বললাম না। আমার এই কম কথা বলার বিষয়টি হয়তো তার ভালো লেগে থাকবে। জাহাঙ্গীর ভাইকে বলল, তাহলে এখন থেকেই কাজে বসিয়ে দেন।

স্বদেশকে আমাদের চেয়ে বয়সে খুব একটা বড় মনে হয়নি। কিন্তু সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতায় অনেকটাই যে এগিয়ে সেটা বুঝতে তেমন কষ্টও হয়নি। পরবর্তীকালে স্বদেশের সঙ্গে আমার বেশ একটা ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ও থাকত পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজার এলাকায়। ওই বাসায় বহুবার গিয়েছি। বইপত্রের বেশ একটা বড় সংগ্রহ ছিল স্বদেশের। ব্যক্তিগত সংগ্রহে রবীন্দ্র রচনাবলি প্রথম আমি স্বদেশের বাসাতেই দেখি। স্বদেশ বিয়ে করেছিল আমারও কিছুটা আগে। তবে তখনো ওদের কোনো সন্তানাদি হয়নি। পরে ১৯৯৫-তে যখন আমার মেয়ে মাদলের জন্ম, তার ঠিক পরের সপ্তাহেই ওদের একটা ছেলে হয়।

সাব-এডিটর হিসেবে চাকরি শুরুর পর আমি দীর্ঘ সময় রিপোর্টিং করলেও স্বদেশ সে রকম কখনো করেছে বলে শুনিনি। নব অভিযান ছাড়ার পর প্রথমে সে চাকরি নেয় দৈনিক রূপালীতে। রূপালী তখন খুবই জাঁকজমক করে বের হয়। ওয়েজ বোর্ডের নিয়মকানুন মেনে, সাংবাদিকদের উচ্চ বেতন নিশ্চিত করেই যাত্রা শুরু করে রূপালী। আমিও চেষ্টা করেছিলাম রূপালীতে ঢুকতে, কিন্তু পারিনি। আওয়ামী লাইনের পরীক্ষিতদেরই কেবল জায়গা হয়েছিল সেখানে। আমি সে পরীক্ষায় পাস করতে পেরেছি বলে তারা হয়তো মনে করেনি। আর আমি নিজে থেকে সে ধরনের কোনো পরীক্ষায় অংশ নিতেও রাজি ছিলাম না কখনো। তবে সেটা একান্তই আমার মনের ভেতরের কথা। তখন রূপালীতে চাকরি পাওয়ার শর্তে কেউ যদি আমাকে পরীক্ষা নিতে চাইত, আমি অরাজি হতাম কি না- এত দিন পরে নিশ্চিত করে তা বলা কঠিন।



 





রূপালীর পর স্বদেশ কিছুদিন সচিত্র সন্ধানী নামের একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় কাজ করে। এটির প্রচার সংখ্যা তখন তেমন একটা না থাকলেও আভিজাত্য বিচারে এর অবস্থান বেশ ওপরের দিকেই ছিল। সচিত্র সন্ধানী অনেক পুরোনো একটি ম্যাগাজিন। গাজী শাহাবুদ্দিন ছিলেন এর সম্পাদক। এদেরই সহযোগী প্রতিষ্ঠান সন্ধানী প্রকাশনী। এই ম্যাগাজিনেই ‘যায়যায়দিন’ নামে একটি কলাম লিখতে শুরু করেন শফিক রেহমান। মইন আর মিলা নামের দুই চরিত্রের টেলিফোন আলাপভিত্তিক এই কলামে রাজনীতি, সমাজ, সাহিত্য, প্রেম ইত্যাদি নিয়ে নানা ধরনের তীক্ষè ব্যঙ্গাত্মক কথা থাকত। কলামটি খুবই জনপ্রিয় হয়। পরবর্তীকালে এই নাম দিয়েই রাজনৈতিক একটা সাপ্তাহিক প্রকাশ করেন শফিক রেহমান। সেটিও দারুণ পাঠকপ্রিয়তা পায়। আরো অনেক পরে, শফিক রেহমান এটিকে দৈনিকে পরিণত করেন। সেটি অবশ্য ফ্লপ করে। দৈনিক যায়যায়দিনে অবশ্য আমি নিজেও চাকরি করেছি। সে প্রসঙ্গ আরো পরে আসবে।

বলছিলাম স্বদেশ রায়ের কথা। সচিত্র সন্ধানী পর্যন্ত ঠিকই ছিল, তারপরই সে এমন একটা কাজ করল যে আমরা অনেকেই অবাক হয়ে গেলাম। সন্ধানী ছেড়ে সে যোগ দিল শফিক রেহমানের যায়যায়দিনে। অবাক হলাম এ কারণে যে, যে সময় সে এই কাজটি করল তখন দেশে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার। আর ওই সময়ে শফিক রেহমান ও তার যায়যায়দিন কট্টর বিরোধী আওয়ামী লীগ ও হাসিনার। এত দিন আমরা সবাই স্বদেশকে আওয়ামীপন্থী সাংবাদিক বলেই জানতাম। এমনকি একসময় আওয়ামী লীগের কি একটা প্রকল্পে যেন স্বদেশ চাকরিও করত। তখন সে ধানমন্ডি ৩২ নম্ব^র রোডে বঙ্গবন্ধুর বাসায় নাকি অফিসও করত। এসব কথা স্বদেশ নিজেই শুনিয়েছে আমাকে। সেই স্বদেশ যখন সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগ দিল সাপ্তাহিক যায়যায়দিন পত্রিকায়, আমি বিস্মিত হলাম। যায়যায়দিনে স্বদেশ কয়েকটি বছর কাটিয়েছে। যায়যায়দিন যখন দৈনিকে রূপান্তরিত হলো, তখন অবশ্য সেখানে আর জায়গা হয়নি তার। ২০০৪ সালে, জনকণ্ঠ থেকে আমার বিদায়ের পর সেখানে যোগ দেয় স্বদেশ। সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগ দিয়ে এখন (২০১৪ সালে) সে নির্বাহী সম্পাদক।

জনকণ্ঠ আমার পুরোনো কর্মস্থল। এখানকার অনেকেই আমার একসময়ের সহকর্মী। তাদের মুখে স্বদেশের যে অবস্থান এবং কর্মকা-ের বিবরণ পাই, তা আমার জন্য খুব একটা সুখকর নয়। স্বদেশ যে একসময় আমার খুব কাছের লোক ছিল-এ কথা উচ্চারণ করতে উৎসাহ পাই না।

বিস্ময়কর রকম দ্রুততায় মালিকের কাছের লোকে পরিণত হওয়ার যোগ্যতা তার তখনো ছিল। দৈনিক নব অভিযানেও এর তেমন কোনো ব্যতিক্রম হয়নি। হয়তো সেই আত্মবিশ্বাস থেকেই সে জাহাঙ্গীর ভাইকে বলতে পারল তখন থেকেই কাজে লাগিয়ে দিতে।



 





জাহাঙ্গীর ভাই আমার হাতে টেলিপ্রিন্টারে ছাপা ছোট্ট একটি ইংরেজি কাগজ ধরিয়ে দিলেন। বললেন, অনুবাদ করতে। সঙ্গে দেওয়া হলো নিউজপ্রিন্টের একটা রাইটিং প্যাড। আসলে এ ধরনের কাজের সঙ্গে আমি অপরিচিত নই। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন ডিপার্টমেন্টে একটা টেলিপ্রিন্টার ছিল। সব সময়ই সেখানে রয়টার্স বা এএফপি থেকে আসা নিউজ প্রিন্ট হতো। সেগুলো আমাদের দেওয়া হতো অনুবাদ করতে। নিউজের সেই ছোট ছোট কাগজের টুকরাকে আমরা বলতাম ‘সø্যাগ।’ অনুবাদ মানে আক্ষরিক অনুবাদ নয়, নিউজ ফরম্যাটে অনুবাদ। এটা আমাদের পড়ালেখারই একটা অংশ ছিল।

কাজেই তেমন কোনো অসুবিধাই হলো না। দ্রুতই করে দিলাম। কাজটি করতে পারায়, যতটা না আমি খুশি হলাম, এর চেয়ে বেশি খুশি হলেন জাহাঙ্গীর ভাই। তিনি যেন সবাইকে বোঝাতে চাইলেন, দেখেছো, আমি যাকে এনেছি সে মোটেই আনাড়ি কেউ নয়।

তবে প্রথম ধাক্কাটা খেলাম সেদিন সন্ধ্যার দিকে। নিউজ এডিটর নাজিম উদ্দিন মানিক এসে ওই দরজাসংলগ্ন ছোট ঘরটিতে বসলেন। ডেস্কে আমার মতো নতুন মুখকে দেখেই ক্ষেপে গেলেন। ডাকলেন। আমি কিছুটা ভয়ে ভয়েই গেলাম।

জানতে চাইলেন, কে আমাকে এনেছে? কে বসিয়েছে ডেস্কে?



 





আমি জাহাঙ্গীর ভাইয়ের কথা বললাম। তিনি চিৎকার করে জাহাঙ্গীর ভাইকে ডাকলেন। জাহাঙ্গীর ভাই বললেন স্বদেশের কথা। এরই মধ্যে স্বদেশ সেখানে হাজির। সে বোঝানোর চেষ্টা করল, কী পরিস্থিতিতে আমাকে বসানো হয়েছে। তা ছাড়া আগে থেকেই তো কথা ছিল নতুন লোক নেওয়ার। সে অনুযায়ীই নেওয়া হয়েছে।

মানিক ভাইয়ের বিরক্তির কারণটাও আমার কাছে অমূলক মনে হয়নি। তিনি বলছিলেন, তোমরা লোক নেবে ঠিক আছে। কিন্তু আমি তো নিউজ এডিটর। আমাকে না জানিয়ে কেন? সন্ধ্যায় তো আমি আসছিই। এই এতক্ষণ কি অপেক্ষা করতে পারতে না? তা ছাড়া ছেলেটা কেমন কাজ জানে, সেটাও তো দেখতে হবে।

তাদের এই আলাপচারিতা যখন চলছিল, আমি আবার এসে অসহায়ের মতো বসলাম ডেস্কে। যে অনুবাদটি করছিলাম তখন, সেটা অর্ধেকের মতো হয়েছে। বাকিটুকু করতে হবে কি না বুঝতে পারছি না। দুপুরের তুলনায় টেবিলের চারপাশে তখন লোকসংখ্যাও অনেক বেশি দেখলাম। স্পষ্টতই উপলব্ধি করলাম, এখানে দুটো ভাগ। একদল আমাকে নেওয়ার পক্ষে, আরেক দল বিপক্ষে। এই পক্ষ-বিপক্ষের কাউকেই আমি এর আগে কোনো দিন দেখিনি। এরাও কেউ আমাকে দেখেনি। আমার সম্পর্কে ভালো-মন্দ কিছু জানে না পর্যন্ত। তার পরও তারা কেউ পক্ষে, কেউ বিপক্ষে। বুঝতে অসুবিধা হলো না, এই বিভক্তি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। একদল আওয়ামীপন্থী, আরেক দল আওয়ামীবিরোধী। আমাকে যারা এনেছে, তারা আওয়ামীপন্থী। জাহাঙ্গীর ভাই আমাকে সেভাবেই স্বদেশ ও সংশ্লিষ্টদের কাছে উপস্থাপন করেছেন।



 





কিন্তু আমি তো জানি, জীবনে কখনো আওয়ামী লীগ করিনি। ভাইজান জাসদ করতেন, সেই হিসেবে জাসদের রাজনৈতিক বক্তব্যের সঙ্গে পরিচিত ছিলাম। বাসায় মার্কস, অ্যাঙ্গেলস আর লেনিনের কিছু বইপত্রও ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়লাম। বাসদের ছাত্রসংগঠন সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট করতাম। বাংলাদেশে জাসদ-বাসদের রাজনীতির উন্মেষই ঘটেছে আওয়ামীবিরোধী রাজনীতির মধ্য দিয়ে। সে বিবেচনায়, আমাকে বরং অ্যান্টি আওয়ামী লীগারই বলা যায়। কিন্তু সেসব ইতিহাস কাকে শোনাব আমি? আমি তো এখানে কেউ না। আমি একটা উপলক্ষ মাত্র। কেউ আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করছে না। তারা তারা আলাপ করছে, আলাপ করে বুঝে নিতে চাইছে কার লোক হিসেবে এখানে ঢুকছি আমি। অথবা, কার লোক হিসেবে থাকব এখানে।

এর মধ্যে আমার পাশে বসা এক ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্রয়ের হাসি দিলেন। বললেন, আপনি কাজ করতে থাকেন।

-কাজ করব কি, চাকরি হবে কি হবে না-তারই তো কোনো ঠিক নেই।

-চাকরি নিয়ে আপনি টেনশন করবেন না, ঠিকই হবে। দেখবেন, স্বদেশ ঠিকই ম্যানেজ করবে মানিক ভাইকে। তা ছাড়া মানিক ভাই লোক খারাপ না। উনি আপনাকে পছন্দ করবেন। তবে আমাদেরও ভুল হয়ে গেছে। ওনার জন্য অপেক্ষা করা উচিত ছিল।

এই লোকটির নাম মলয়, মলয় পাঁড়ে।



 





মলয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্কের সেই শুরু। এর মাঝে দুই যুগেরও বেশি সময় পার হয়ে গেছে। অনেকেই ঝরে গেছে আমার জীবন থেকে, আবার অনেকে ঝেড়ে ফেলেছে আমাকে তাদের তালিকা থেকে। কিন্তু মলয়ের সঙ্গে সম্পর্কে তেমন কোনো চিড় ধরেনি।

নব অভিযানের পর মলয়ের সঙ্গে আমার আর একত্রে কাজ করা হয়নি। চেষ্টা করেছি, আমি যেমন করেছি, তেমনি মলয়ও করেছে। কিন্তু কেনো যেন ঠিক ক্লিক করেনি। মাঝে বেশ কয়েক বছর ছিলাম সাপ্তাহিক সুগন্ধায়। আমি ছিলাম সহকারী সম্পাদক। সেখানে বাইরের অনেকের লেখাই ছাপতাম। লেখার বিনিময়ে বেশ ভালো রেটে সম্মানীও দেওয়া হতো। ওই সময়টাতে অর্থনৈতিকভাবে কিছুটা বেকায়দায় ছিল মলয়। আমি চাইলাম, তাকে দিয়ে সুগন্ধায় লেখাতে। সুগন্ধার নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন আলম রায়হান। তিনিই আমাকে নব অভিযান থেকে এখানে নিয়ে এসে চাকরি দিয়েছিলেন। মলয়কে তিনিও চিনতেন। জানতেন মলয়ের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের কথা। বললাম তাকে, মলয়কে দিয়ে লেখাতে চাই। আলম ভাই বিরোধিতা করলেন না। বললেন, মলয়ের হাত তো খুবই ভালো। মলয়কে দিয়ে কিছু কাজও করালাম। আলম ভাইকে দেখালাম। উনি বললেন, এসব আমি ভালো বুঝি না, আপনি ভালো বললে আমার কোনো আপত্তি নেই।

ওই সময়টাতে আমরা বাইরের কোনো প্রতিষ্ঠানে লেখা কম্পোজ করিয়ে ট্রেসিংয়ে নিয়ে আসতাম। তারপর সেই ট্রেসিং বড় একটা ট্রান্সপারেন্ট শিটে বসিয়ে পেস্টিং করতাম। মলয়ের লেখা বেশ কয়েকবার কম্পোজ করিয়ে আনা হয়েছে। কিন্তু যেকোনো কারণেই হোক ছাপা আর হয়নি। বিষয়টা নিয়ে ওর কাছে দীর্ঘদিন আমি খুবই লজ্জায় ছিলাম। কোনো ব্যাখ্যাও দিতে পারিনি।



 





উল্টো ঘটনাও যে ঘটেনি, তা নয়। মলয় তখন অনন্যা নামের একটি পাক্ষিক ম্যাগাজিনে। এটা মূলত মেয়েদের ম্যাগাজিন। আর আমি দৈনিক জনকণ্ঠে। জনকণ্ঠ বড় পত্রিকা। আর সেই বড় পত্রিকার আমি বেশ নামকরা রিপোর্টার। আমার বেশ কিছু রিপোর্ট তত দিনে আলোচিতও হয়েছে। মাঝেমধ্যেই যেতাম মোহাম্মদপুরে অনন্যা অফিসে। মলয় একদিন বলল, আপনি আমাদের এখানে তো লিখতে পারেন। টাকা-পয়সা আমরা ভালোই দিই।

ওর প্রস্তাবটা ভালো লাগল। কী একটা বিষয় নিয়ে, সম্ভবত ফতোয়া ও নারী নির্যাতনজাতীয় কিছু একটা হবে, লিখলাম। ওর কথা অনুযায়ী কিছুটা বড় করেই। দিয়েও এলাম একদিন। তারপর অপেক্ষা করছি তো করছিই। ছাপা আর হয় না। শেষে একদিন জিজ্ঞাসা করতে খুবই বিব্রত ভঙ্গিতে মলয় জানাল, আলতাফ পারভেজ নামে ওদের ওখানে কে একজন আছে, সে-ই নাকি বাগড়া দিয়েছে। আলতাফ পারভেজ লোকটি যে আমার অচেনা, তা নয়। এর সঙ্গে রিপোর্টিংয়ের কাজে একবার ঢাকার বাইরেও গিয়েছি। তখন তাকে আমার প্রতি তেমন ঈর্ষাপরায়ণ মনে হয়নি। তার পরও অনেক কিছুই ঘটে, যার কোনো ব্যাখ্যা নেই।

অনন্যা থেকে মলয় ইত্তেফাকে যায়। ইত্তেফাক ওই সময় একটা স্বপ্নের জগৎ। তখন এমনও বলা হতো যে, বাংলাদেশে লোকে সাংবাদিকতা শুরুই করে এমন স্বপ্ন নিয়ে যে-একদিন ইত্তেফাকে চাকরি করতে পারবে। ইত্তেফাকে যেয়ে মলয়ের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন হতে থাকে। কিন্তু তার পরও বিন্দুমাত্র চিড় ধরেনি আমাদের সম্পর্কে।



 





মলয়ের কথায় আমি আশ্বস্ত হলাম। অন্যদের উচ্চ বাক্যালাপ বা ফিসফিসানিকে উপেক্ষা করে ঠিকই অনুবাদের কাজটা করতে লাগলাম। কাজটা শেষ করে যখন অপেক্ষা করছি, তখন ডাক পড়ল মানিক ভাইয়ের কক্ষে। স্বদেশ তখনো সেখানে। পরিস্থিতি মনে হলে অনেকটাই স্বাভাবিক। সেই প্রথম দিনেই আমি স্বদেশের কনভিন্সিং ক্যাপাসিটি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম।

মানিক ভাই আমাকে কিছু প্রশ্ন করলেন। খুবই মামুলি ধরনের প্রশ্ন। নাম কী, বাড়ি কোথায়, লেখাপড়া কোথায় করেছি- এসব। জার্নালিজমে পড়েছি শুনে ছোটখাটো একটা লেকচারও দিলেন। বললেন, এই জার্নালিজমে যারা লেখাপড়া করে, তারা মনে করে সাংবাদিকতার সব কিছুই বুঝি তারা জানে। কিন্তু সেটা মোটেই ঠিক না। পুঁথিগত বিদ্যা আর ব্যবহারিক প্রয়োগ এক জিনিস নয়। এই যে তুমি পাস করে এসেছো, দিন কয়েক কাজ করো, দেখবে কত আকাশ-পাতাল পার্থক্য।



 





আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলাম।

কোনো উত্তর না দেওয়া, বা আর্গুমেন্টে না যাওয়াটা সম্ভবত তার পছন্দ হলো। তিনি আমার দিকে হাত বাড়ালেন। বললেন, দাও দেখি কী কাজ করলে এতক্ষণ।

আমার অনুবাদকর্মটি সঙ্গেই ছিল। ইংরেজি সøাগটিও ছিল সঙ্গে। দুটোই দিলাম তাকে। তিনি দেখলেন, দু-একটা শব্দ পরিবর্তন করলেন। তবে সব মিলিয়ে প্রশংসাই করলেন। একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা জাহাঙ্গীর ভাই, আর কাছে থাকা স্বদেশ রায়- দুজনের মুখেই হাসি ফুটল।

এভাবেই শুরু আমার সাংবাদিকতা-জীবনের।

তবে তখনো নিশ্চিত ছিলাম না যে পরদিন থেকেই অফিস করা আরম্ভ করব কি না।

জাহাঙ্গীর ভাই অবশ্য বললেন, কাল সকাল থেকেই কাজ শুরু করো।

উনি ওই অতটুকুই বললেন। কিন্তু যে বিষয়টি জানা তখন আমার জন্য সবচেয়ে বেশি জরুরি, সেই বেতনের কথাটাই বললেন না। চাকরি আমার একটা হলো বটে, কিন্তু আমি জানি না, কত হতে যাচ্ছে আমার বেতন। এতটুকু তথ্য নিয়ে আর যাই হোক, আমার সেই সময়কার পরিস্থিতিতে, পুরোনো সব কাজকর্ম বাদ দেওয়ার কথা চিন্তাই করা যায় না। কিন্তু টাকা-পয়সার কথা সরাসরি জাহাঙ্গীর ভাই বা অন্য কারোকে জিজ্ঞাসাই বা করি কিভাবে?

আমি তাড়াতাড়ি বিদায় নিতে চাইলাম। কারণ সন্ধ্যায় মতি ভাইয়ের দুই ছেলে শুভ ও সুজনকে পড়ানোর কথা। অবশ্য তারা আমাকে অত দ্রুত ছাড়তে চায়নি। মানিক ভাই তো সরাসরিই বললেন, যাওয়ার আগে যেন আমি কয়েকটা নিউজ অনুবাদ করে দিয়ে যাই। কিন্তু আমি রাজি হলাম না।

জাহাঙ্গীর ভাই আমাকে নিচে পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এলেন। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে জিজ্ঞাসা করলাম বেতনের কথা। তিনি বললেন, তোমাকে তো আগেই বলেছি, আমরা বেতন তেমন একটা দিতে পারব না।

সেটা তো বুঝলাম। কিন্তু কত দিতে পারবেন, সেই ফিগারটা জানা থাকলে আমার পক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হবে।

: এই ধরো হাজার বারো শ হবে।

আমি খুবই হতাশ হলাম। টিউশনি আর একটা খ-কালীন চাকরি মিলে আমার আয় এখন আড়াই হাজার টাকা। বাসা বলতে থাকি মিরপুর ১২ নম্ব^রের শেষ মাথায় ছোট্ট একটা রুমে। আয়তনের বিবেচনায় আমার সেই রুমটিকে রীতিমতো বস্তিই বলা চলে। ওটা আসলে আমার এক চাচার বাসার রান্নাঘরসংলগ্ন একটি কক্ষ। বিয়ের মাস কয়েক আগে এই চাচার বাসায় একটি রুম সাবলেট হিসেবে নিয়ে থাকতাম আমি। বিয়ের সময় চাচা আমাকে বেশ সাহায্যও করেছেন। ওই একটি রুমই এখন আমার সংসার। ছোট্ট পুরোনো একটা খাট, আর একটা স্টিলের আলমারি। আসবাবপত্র বলতে এতটুকুই। থালা-বাসন আর টুকটাক অনেক কিছু রাখা হতো খাটের নিচে। আর কাপড়চোপড় সব স্টিলের আলমারির মধ্যে। মনে আছে আলমারিটা কেনার সময় দেখে নিয়েছিলাম যাতে সেটির দরজায় আয়না লাগানো থাকে। ওই আয়নাটাতেই চেহারা দেখতাম, চুল আঁচড়াতাম, পোশাক ঠিক করতাম।

এত দীন-হীনভাবে জীবনযাপনের পরও ওই আড়াই হাজার টাকায় সংসার চালানো খুবই কষ্টের ব্যাপার ছিল। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, সেই কষ্টের পুরোটাই গেছে শাহানার ওপর দিয়ে। আমাকে সে টেরই পেতে দিতে চায়নি। কিন্তু টের কি আর পেতাম না? না পাওয়ার কোনোই কারণ নেই। আর কিছু বুঝি না বুঝি, সহজ যোগ-বিয়োগটা তো বুঝি।



 





এই যখন অবস্থা, ভেবে পেলাম না, কী করে বলব ওকে এই অতি অল্প বেতনে চাকরির অফারের কথা।

সন্ধ্যায় মতি ভাইয়ের বাসায় যখন বাচ্চাদের পড়াতে গেলাম, একবার ভাবলাম বিষয়টি নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলি। পরে আবার কী মনে করে চেপে গেলাম। রাতে শাহানাকে বললাম সব কিছু। কিন্তু যা ভেবেছিলাম তা হলো না। ও বরং উৎসাহ দিল।

বললাম, কিন্তু এতে যে আমাদের আয় কমে যাবে, সে বিষয়টা কি ভেবে দেখেছো?

 : কেন, আয় কমবে কেন? বরং বাড়বেই কিছুটা।

 : কিভাবে?

 : তুমি েেতা টিউশনি আর এই চাকরিটা ছাড়ছো না।

 : কিন্তু সময় তো ম্যানেজ করা যাবে না।

 : যাবে। ওদের তুমি বিকেলের পরিবর্তে সকালে পড়াবে। তারপর সেখান থেকে মতিঝিলের অফিসে যাবে। সবশেষে ওখান থেকেই যাবে পত্রিকা অফিসে।

শুনতে হিসাবটা খুবই সহজ মনে হয়। কিন্তু বাস্তবে সেটা কতটুকু সম্ভব হবে, বুঝতে পারলাম না। তবে এর বিপরীতে কোনো যুক্তিও দাঁড় করাতে চাইলাম না। কেবল এতটুকু বললাম, বিষয়টা নিয়ে মতি ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলা দরকার।

সব শুনে মতি ভাই খুবই খুশি হলেন। বললেন, এটা তো খুবই ভালো কথা। তোমার ভালো কিছু হোক, তা আমি সব সময়ই চাই। পত্রিকার চাকরিটাকে মূল ধরে, তোমার যেভাবে সুবিধা হয় করে যাও। এতে যদি শুভ-সুজনকে তুমি নিয়মিত পড়াতে নাও পারো, কোনো অসুবিধা নেই। সপ্তাহে যে কয়দিন পারো, যখন তোমার সুবিধা হয়, এসে পড়িয়ে যেও।



 





ভদ্রলোকের উদারতায় আমি অভিভূত। ভাবতেও পারিনি এতটা সহযোগিতা তিনি আমায় করবেন। তার সেই সহযোগিতার মনোভাব পরবর্তীকালেও দেখেছি। বরং বিনিময়ে আমিই আচরণ করেছি অকৃতজ্ঞের মতো। পরে যখন আমার অর্থনৈতিক অবস্থা অনেকটাই ভালো হয়েছে, কি স্বার্থপরের মতো ভুলে গেছি তার সঙ্গে দেখা করার কথা! আগে যেখানে নিয়মিত, অন্তত সপ্তাহে দু-তিন দিন গেছি তার বাসায়, পরে একসময় অবস্থা এমন দাঁড়াল যে, দু-তিন বছরেও একবার দেখা হতো না। যাওয়া হতো না তার বাসায়। অবশ্য আমার দিক থেকেও একটা অভিমান ছিল। তারাও খুব একটা আসতেন না আমার বাসায়, বড়জোর একবার কি দুবার এসেছেন।

দৈনিক নব অভিযানে আমার সাংবাদিকতা-জীবন শুরু হলো সাব-এডিটর হিসেবে। কিছুদিনের মধ্যেই আমাকে একটা আইডি কার্ড দেওয়া হলো, সেই সঙ্গে নেমকার্ডও। কার্ডগুলো পকেটে রাখতে ভালো লাগত, নিজেকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ একজন বলে মনে হতো। কার্ড পেলাম এক মাসের মধ্যেই, কিন্তু বেতন পেলাম না মাস পার হওয়ার পরও। বুঝতে পারলাম না, কাকে বলব বিষয়টি। এর মধ্যে একদিন নিউজ রুমে সাংবাদিক ইউনিয়নের সভা।

তখন অবশ্য সাংবাদিক ইউনিয়ন এখনকার মতো দ্বিখ-িত ছিল না। ছিল ঐক্যবদ্ধ। ফলে ইউনিয়ন নেতাদের মধ্যে এখন যেমন রাজনৈতিক নেতৃত্বের পদলেহনের এক নির্লজ্জ প্রবণতা ও প্রতিযোগিতা দেখা যায়, তখন সেটা ভাবাই যেত না। অথচ ব্যক্তিগুলো কিন্তু একই। আমার পেশাগত জীবনের শুরুতে যাদের নেতা হিসেবে পেয়েছি, এখনো তারাই আছেন নেতা। পার্থক্য কেবল, তারা দুই দলে বিভক্ত হয়ে গেছেন, আর সেভাবে ভাগ করে নিয়েছেন পুরো ইউনিয়নকেই। সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটা দেখছি তাদের আচরণে। রাজনৈতিক মেরুকরণ আগেও ছিল, কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি এতটা বেশরম আনুগত্য ছিল না।

প্রতিটি পত্রিকাতেই তখন একটি করে ইউনিট ছিল। সাংবাদিক শ্রমিকদের কোনো সমস্যা হলে, ইউনিট বসে সমাধানের চেষ্টা করত। সুরাহা করতে না পারলে, ইউনিয়নের নেতারা এসে বসতেন মালিকপক্ষের সঙ্গে।



 





তো, সেই রকমই একটা ইউনিট মিটিং হচ্ছিল। আমি তখনো তেমন কিছু বুঝি না, নতুনের গন্ধ যায়নি গা থেকে। সাংবাদিকদের নানা দাবিদাওয়া নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। মালিকপক্ষ কবে কোন প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তার মধ্যে যে প্রায় কোনোটিই বাস্তবায়িত হয়নি, সে কথাও বলা হচ্ছিল অত্যন্ত ক্ষোভের সঙ্গে। প্রায় প্রত্যেকের মুখেই উচ্চারিত হচ্ছিল বেতন নিয়মিত করার বিষয়টি। তাদের সেই আলোচনা থেকে বুঝতে পারলাম, বেতন এখানে পুরো চার মাসের বাকি। সেটা সম্ভবত ছিল মার্চ মাসের শেষ দিক। জানতে পারলাম, আগের বছর নভেম্ব^রের বেতন তখনো হয়নি। যাদের বেতন হয়নি, তাদের কথা যতটা না ভাবলাম, তার চেয়ে বেশি বিচলিত হলাম আমার নিজের কথা ভেবে। মাত্রই ফেব্রুয়ারিতে শুরু করেছি, মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে ভাবছিলাম বুঝি দু-একদিনের মধ্যেই পেয়ে যাব বেতন, আর আজ এসব কী শুনছি? হিসাব করে দেখলাম, আমার প্রথম মাসের বেতন পেতে পেতে তাহলে জুন মাস লেগে যাবে।

মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেল।



 





এ সময় আমি দারুণ মানসিক সাপোর্ট পেয়েছি শাহানার কাছ থেকে। বারবার বলেছে সে হতাশ না হতে।

বলেছে, লেগে থাকো, ছেড়ো না। দেখবে এখান থেকে ভালো কোনো জায়গায় চাকরি পেয়ে যাবে।

কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম না, ভালো কোনো জায়গায় চাকরি হওয়ার সুযোগটা কোথায়? কেউ তো আমাকে চেনেই না।

তার পরও লেগে থাকলাম। অফিসে সময় দিতে লাগলাম। আমার কাজে অখুশি বেশি কেউ ছিল না। এই সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। আমেরিকা আক্রমণ করে ইরাককে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট তখন জর্জ বুশ (সিনিয়র)। পত্রিকাগুলোতে সেই যুদ্ধের খবর বেশ ফলাও করে ছাপা হতে থাকল। ফলে রিপোর্টিংয়ের চেয়ে ডেস্কের গুরুত্ব বেড়ে গেল। লিড নিউজগুলো বিভিন্ন এজেন্সির পাঠানো সংবাদ থেকে কম্পাইল করার দায়িত্ব প্রায় প্রতিদিনই পড়ত আমার ওপর। এর মাঝে পত্রিকার স্পোর্টস রিপোর্টার চলে গেল। তখন বাধ্য হয়ে আমাকে দেওয়া হলো দেশি-বিদেশি খেলার নিউজ অনুবাদ করতে। খেলার প্রতি আমার আগ্রহ অনেক দিনের। ফলে বেশ উৎসাহ নিয়েই করতাম সেসব। সপ্তাহে যে একদিন ক্রীড়াবিষয়ক পাতা বের হতো, একপর্যায়ে সেটির দায়িত্বও দেওয়া হলো আমাকে। বেতনকড়ি ঠিকমতো না দেওয়ায় কিছুদিন পরপরই লোক কমছিল নব অভিযান থেকে। যখন অর্থনৈতিক রিপোর্টার চলে গেল, তখন অর্থনীতির পাতার দায়িত্বও পড়ল আমার ওপর।

একদিন দুপুরে ডেস্কে বসে। স্পোর্টসের একটা ফিচার অনুবাদ করছিলাম। আমার চেয়ে বয়সে সিনিয়র একজন রিপোর্টার বসেছিলেন তার টেবিলে। আমাকে কাছে ডাকলেন।



 





বললেন, এত মন দিয়ে কী লিখছেন?

-বিশ্বকাপ ফুটবলের ওপর একটা ফিচার।

 : কোথায় ছাপবেন?

 : সাপ্তাহিক খেলার পাতায়।

 : এ জন্য কি আপনাকে বাড়তি কোনো টাকা-পয়সা দেবে?

 : না, তা দেবে না।

 : তাহলে বেগার খাটছেন কেন?

 : আমাকে তো ওই পাতার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

: ও আচ্ছা, দায়িত্ব পালন করছেন? তা আপনার ওপর যে মালিকপক্ষের দায়িত্ব আছে, তা কি তারা পালন করছে?

আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। চুপ করে থাকলাম। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, এখানে চাকরি কয় মাস হলো?

: চার মাস।

: বেতন পেয়েছেন কয় মাসের?

: এখনো পাইনি। শুনেছি আগামী মাসে পাব প্রথম মাসের বেতন।

: তার মনে যখনই আপনি এই পত্রিকা ছেড়ে যাবেন, চার মাসের বেতন বকেয়া থাকবে। আপনার কি মনে হয়, এই বকেয়া থাকা চার মাসের বেতন মালিক আপনাকে কখনো দেবে?

: দেবে না কেন, নিশ্চয়ই দেবে।

: ঘোড়ার ডিম দেবে।

এখানে তিনি মালিককে উদ্দেশ করে কিছু খিস্তি আওড়ালেন।

বললেন, আরে ভাই বোঝেন না কেন, এখানে চাকরি দেওয়ার নাম করে এরা আপনাকে ব্যবহার করছে। তাই আপনারও দায়িত্ব হবে এদের ব্যবহার করা। ফোরকানিয়া মাদ্রাসা চেনেন? এটাকে ওই ফোরকানিয়া মাদ্রাসা মনে করবেন। এখানে কেউ থাকতে আসে না। এখানে থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে।

এরপর বললেন, এক কাজ করেন, যে লেখাটা লেখছেন সেটা এখানে দেওয়ার দরকার নেই। বরং এক জায়গায় পাঠাচ্ছি, সেখানে যেয়ে লেখাটি দেবেন। ছাপা হলে ওরা টাকা দেবে। ওই টাকাটা আপনার দরকার।

এই বলে তিনি নিউজপ্রিন্টের একটা কাগজ নিয়ে লিখলেন ‘পারভেজ আলম চৌধুরী।’ বললেন, এই লোক সাপ্তাহিক সন্দ্বীপের নির্বাহী সম্পাদক। তার কাছে যেয়ে আমার নাম বলবেন, আর এই লেখাটা দেবেন। আমার নাম জানেন?

সত্যি কথা বলতে কি, আমি তার নাম জানি না। এত দিন, প্রায় চার মাসের বেশি সময় ধরে একসঙ্গে এক অফিসে কাজ করি, অথচ আমি তার নাম জানি না। কিন্তু কথাটা বলব কিভাবে? কী মনে করবে সে?

আমার নাম আলম রায়হান। পারভেজ আলম চৌধুরীর কাছে যেয়ে বলবেন, আলম রায়হান পাঠিয়েছে।

ঘাড় কাত করে সম্মতি জানালাম। কিন্তু আলম রায়হানের কথা আমি অর্ধেক মানলাম। তিনি বলেছিলেন, হাতের ওই লেখাটি নিয়ে যেতে। পারভেজ আলম চৌধুরীর কাছে আমি গিয়েছিলাম, তবে ওই লেখাটি নিয়ে যাইনি। ওটি আমি সে সপ্তাহের খেলার পাতাতেই ছেপেছিলাম। তখন বিশ্বকাপ ফুটবলের সময়। আমি নেদারল্যান্ডসের ওই সময়কার তারকা ফুটবলার রুড গুলিতের ওপর একটা ফিচার লিখে নিয়ে গেলাম সাপ্তাহিক সন্দ্বীপে।

সাপ্তাহিক সন্দ্বীপের অফিস মতিঝিলে। আমি গেলাম দুপুরের দিকে। আলম রায়হানের কথা বলতেই পারভেজ আলম চৌধুরী আমাকে তার রুমে ডাকলেন। বেশ হাসিখুশি ভদ্রলোক, তবে কথা কম বলেন। দু-এক কথার পরেই লেখাটি চাইলেন। আমি পকেট থেকে ভাঁজ করা লেখাটি বের করে দিলাম। নিউজপ্রিন্ট প্যাডের ১০ কি ১২ পৃষ্ঠা ছিল লেখাটির আয়তন।



 





জিজ্ঞাসা করলেন, কোথা থেকে লিখেছি? কোনো বিদেশি খেলার ম্যাগাজিন থেকে কি না?

: না, আমাদের অফিসে যে এএফপি, রয়টার্সের নিউজ আসে, সেগুলো থেকে তথ্য নিয়ে নিজের মতো করে লিখেছি।

: আপনাদের দৈনিকে কি এটা ছাপা হয়েছে?

: না, হয়নি। মাত্র কালই পেয়েছি এই ইনফরমেশনগুলো। আজ সকালে বাসায় বসে বসে লিখেছি।

তিনি দু-এক পাতা উল্টেপাল্টে দেখলেন। তারপর একটা লাল কলম নিয়ে ‘নেদারল্যান্ডস’ শব্দটি কেটে ‘হল্যান্ড’ লিখলেন।

আমি বললাম, দেশটির নাম কিন্তু আসলে নেদারল্যান্ডস।

জবাবে বললেন, জানি। কিন্তু আমাদের দেশের পাঠকরা হল্যান্ড নামের সঙ্গেই বেশি পরিচিত।

: তবু আমাদের কি উচিত নয়, পাঠককে সঠিক তথ্যটি দেওয়া? প্রচলিত হলেও ভুলটিকে ধরিয়ে দেওয়া?

আমার এই তর্কের স্বভাব অনেক দিনের। এই স্বভাব দিয়ে এই জীবনে আমি অনেককে বিরক্ত করেছি। জীবনে অনেক কিছু হারিয়েছি। কিন্তু তার পরও স্বভাবটিকে ত্যাগ করতে পারিনি।

পারভেজ সাহেব বিরক্ত হলেন কি না বুঝতে পারলাম না। আমার লেখাটা পড়ছিলেন, মুখ তুলে কেবল বললেন, আমাদের পত্রিকা হল্যান্ডই লেখে।

আমি আর কথা বাড়ালাম না। সালাম দিয়ে চলে এলাম।

ফেরার সময় ভাবছিলাম, লেখাটি কবে ছাপা হবে কে জানে? আদৌ হবে কি না, তা নিয়েও সন্দেহ হলো। সন্দেহ নেই, ভদ্রলোককে আমি বিরক্ত করেছি। তাছাড়া ছাপা হলেই যে টাকা পাব, তারই বা নিশ্চয়তা কোথায়?

পরদিন অফিসে যেয়ে আলম ভাইকে জানালাম যে, লেখা দিয়ে এসেছি। তিনি কেবল শুনলেন, কোনো মন্তব্য করলেন না।

দিন দশেক পর, আলম ভাই একদিন জিজ্ঞাসা করলেন, লেখা যে দিয়ে এলেন তার খবর কী? ছাপা হয়েছে?

: জানি না তো।

: জানেন না মানে? লেখা দিলেন, ছাপা হলো কি না খোঁজ নেবেন না?

আমি চুপ করে থাকলাম। সেদিনই গেলাম সন্দ্বীপ অফিসে। পারভেজ সাহেব আগের সপ্তাহের একটা সাপ্তাহিক সন্দ্বীপ আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন। দেখলাম, আমার লেখাটা ছাপা হয়েছে। লেখার নিচে আনিসুর রহমান বা এ ধরনের একটা নাম। কোথাও আমার নাম নেই।

: আমার নাম তো নেই। এটা কার নাম?



 





পারভেজ সাহেব বললেন, এটা কারো নাম না। লেখার সঙ্গে আপনি তো আপনার নাম দিয়ে যাননি। এদিকে আপনি যেদিন ওটা দিলেন, সেদিনই ছিল লেখা জমার শেষ দিন। সঙ্গে সঙ্গেই কম্পোজ করাতে দিয়েছি। পেস্টিংয়ের সময় দেখলাম নাম নেই কোনো। কী আর করা, যা হোক একটা নাম বসিয়ে দিয়েছে।

নিজের ওপর খুবই রাগ হলো, আসলেই তো লেখার কোথাও আমার নামটি লেখিনি। ওখানে বসেই লেখাটি পড়লাম। না, ‘নেদারল্যান্ডস’ ছাড়া আর কোথাও কোনো চেঞ্জ করা হয়নি।



 





পারভেজ সাহেব বললেন, পরে লেখা দেওয়ার সময় নিজের নামটা স্পষ্ট করে লেখবেন।

আমি লক্ষ করলাম, আগেরবারের মতো, এবারও তিনি আমার নামটা জিজ্ঞাসা করলেন না।

কিছুটা মেজাজ খারাপ করেই সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামলাম। হঠাৎ মনে হলো, টাকার কথা তো কিছু জিজ্ঞাসা করা হয়নি। আসলে শুরুতে জিজ্ঞাসা করিনি, অভদ্রতা হবে মনে করে। কিন্তু ততক্ষণে ঠিক করে ফেলেছি, এখানে আর লিখবই না। তাই ভদ্রতা-অভদ্রতার বিষয়টিকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে তর তর করে সিঁড়ি বেয়ে আবার ওপরে উঠে এলাম। দেখি ভদ্রলোক মাথা নিচু করে কী যেন লিখছেন। আমি সামনে যেয়ে দাঁড়ালাম। তিনি মুখ তুললেন না। একমনে লিখেই যাচ্ছেন। সাত-আট সেকেন্ডের মতো দঁাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে আচমকা বললাম, আচ্ছা আমার লেখার জন্য কোনো বিল কি পাব না?

-পাবেন। মাস শেষে বিল হবে। তখন এসে অ্যাকাউন্টসে যোগাযোগ করবেন।



 





এরপর তো আর কথা থাকে না। চলে এলাম। ফিরতে ফিরতে ভাবলাম, অ্যাকাউন্টসে যেয়ে কী বলব? বিল তো হবে ওই বায়বীয় লোকটির নামে, যার কোনো অস্তিত্বই নেই। আনিসুর রহমানের টাকা মাসুদ কামালকে কেন দেবে তারা?

এই ভাবনাটির কারণে পরে আর সন্দ্বীপে যাওয়াই হয়নি, না লেখা দিতে, না বিল আনতে।

এই পারভেজ আলম চৌধুরীর সঙ্গে পরে আমার অনেকবার দেখা হয়েছে। খুবই ভালো মানুষ। আমি যেমন তার কাছে একবার লেখা দিতে গিয়েছিলাম, পরে তিনিও অনেকবার আমার কাছে এসেছেন তার লেখা দিতে। আমি তখন সাপ্তাহিক সুগন্ধায়। বাইরের কোনো লেখা যাবে না যাবে, সেসব দেখার দায়িত্ব ছিল তখন আমার। পারভেজ ভাই তখন বেকার। সন্দ্বীপ বন্ধ হয়ে গেছে, কিংবা সন্দ্বীপে তার চাকরি নেই-এ রকম কিছু একটা হবে। সুগন্ধা ছিল প্রধানত একটা রাজনীতিনির্ভর সাপ্তাহিক। কিন্তু পারভেজ ভাইয়ের লেখার বিষয়বস্তু হতো রাজনীতিবহির্ভূত। সেসব লেখা, সুগন্ধার চরিত্রের সঙ্গে ঠিক যায় না। তার পরও ছাপতাম। আমাদের যুক্তিটা ছিল, এভাবে একজন বেকার সাংবাদিকের কিছুটা উপকার তো হলো। আমরা যখন বেকার হয়ে যাব, এ রকমই আমাদের কোনো এক সহকর্মী হয়তো সাহায্য করার চেষ্টা করবেন।



 





অবশ্য পারভেজ ভাইয়ের উপকার বেশি দিন করার সুযোগ পাইনি। দৈনিক যুগান্তর বের হলে, তিনি তার ক্রীড়া বিভাগের দায়িত্ব পান। যুগান্তর বেশ জাঁকজমকের সঙ্গে বের হয়। এই দৈনিকে যোগ দেওয়ার পর ওনার সঙ্গে আমার দু-একবার দেখা হয়েছে। আগের মতোই আছেন, বড় নির্বিরোধী লোক। কোনো ঝুটঝামেলায় নেই। দেখা হলে, কুশল জিজ্ঞাসা করেছেন।

সন্দ্বীপে আর কোনো লেখা আমি দিয়েছি কি না, পরে তার বেশ কয়েকবারই জানতে চেয়েছেন আলম ভাই। আমার না-সূচক উত্তর স্পষ্টতই ওনাকে বিরক্ত করেছে।

দৈনিক নব অভিযানে ছিলাম আমি ছয় মাসের একটু বেশি। আসলে একেবারে সুনির্দিষ্ট দিন তারিখ মনে নেই। তবে এতটুুকু মনে আছে, ওখান থেকে সাকুল্যে দুই মাসের বেতন তুলতে পেরেছিলাম। আর বাকি ছিল চার মাসের। ওটা আর কখনোই পাইনি। জানতাম পাব না, তাই আর পাওয়ার চেষ্টাও করিনি।

আমার এই ছয় মাস চাকরিজীবনে পত্রিকার মালিক এ এস এম রেজাউল হকের সঙ্গে দেখা হয়েছে মাত্র দুবার। আমি অবশ্য তাকে দেখেছি আরো কয়েকবার। তবে তিনি আমাকে খেয়াল করেছেন এবং কথা বলেছেন মাত্র দুবার। একবার তিনি নিউজ রুমে এসেছিলেন কী যেন এক কারণে, দেখেন মাথা গুঁজে কাজ করছি আমি। আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন।

বললেন, এই ছেলে তুমি কে?

আমি থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। জানালাম, নতুন জয়েন করেছি। ডেস্কে, সাব-এডিটর হিসেবে।

মানিক ভাই তখন পাশেই ছিলেন। তিনি ব্যাখ্যা দিলেন। আমাদের লোকবল একেবারেই নেই, লোক লাগবে, তাই ওকে নিয়ে নিলাম। জার্নালিজম থেকে পাস করা। কাজে খুব ভালো।



 





রেজাউল হক বললেন, মানিক সাহেব, আপনাকে তো আমি আগেই বলেছি, এই রকম জার্নালিজম পড়া ছেলেমেয়েদের নেন। তা না করে, কোথা থেকে আবোল তাবোল লোক দিয়ে আমার অফিস ভরে ফেলেছেন।

তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, দেখ আমি এতটা বুড়ো হওয়ার পর এডিটর হয়েছি। আর তুমি এত কম বয়সেই হয়ে গেছ সাব-এডিটর।

এরপর খুব দারুণ একটা রসিকতা করা গেছে ভেবে নিজেই হো হো করে হাসতে লাগলেন।

এ কথা সত্য যে, রেজাউল হক বেশ একটা বয়স্কই ছিলেন। বয়স তখন তার ৬০-৬৫ তো হবেই। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, সাংবাদিকতা করতে করতেই হয়েছে তার এই বয়স। নব অভিযানই তার প্রথম পত্রিকা। প্রথম একটি পত্রিকা শুরু করেই তিনি এর মালিক হওয়ার পাশাপাশি সম্পাদক বনে গেছেন। এখন যেমন সম্পাদক হতে হলে সাংবাদিকতার ন্যূনতম একটা অভিজ্ঞতা লাগে, তখন সে রকম কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না।

পত্রিকার সম্পাদক হওয়ার আগে ছিলেন তিনি ওষুধের ব্যবসায়ী। ওষুধের দোকান ছিল। তাহলে সেখান থেকে মিডিয়া লাইনে আসার ইচ্ছা হলো কেন? আসলে আচমকা ক্ষমতার কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়ার পর, সেটাকে সামাজিক স্বীকৃতি দিতেই বোধকরি ছিল তার এই প্রচেষ্টা।

তখন এরশাদের শাসনামল। ওই সময় এরশাদ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন মেজর জেনারেল (অব.) মাহমুদুল হাসান। এর আগে ছিলেন তিনি ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র। সেটাও ওই এরশাদের বদান্যতায়। সম্পর্কে মাহমুদুল হাসান ছিলেন নব অভিযান পত্রিকার সম্পাদকের বোনের জামাই। এমনও শুনেছি পত্রিকার প্রকৃত মালিক আসলে ওই মাহমুদুল হাসানই। টাকা-পয়সা সবই তার, চালাচ্ছে তার সম্বন্ধি। প্রকৃত সত্য যা-ই হোক, বাইরের লোকজন কিন্তু জানত, নব অভিযান হচ্ছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পত্রিকা। আর রেজাউল হক কিংবা তার ছেলে মারুফও এ রকম একটা প্রচারকে বেশ উপভোগ করত।

এখানে মারুফ ছেলেটার কথা একটু বলা দরকার। সে বয়সে আমাদের চেয়ে কিছুটা ছোট-ই হবে। সুদর্শন এক যুবক। কিন্তু লেখাপড়া খুব বেশি একটা আছে বলে মনে হয়নি। বাবা একটা দৈনিক পত্রিকার মালিক-সম্পাদক। তাই সেই জোরে মারুফ নিজেই বনে গেছে নব অভিযানের বিরাট এক হোমড়াচোমড়া। ব্যবস্থাপনা সম্পাদক কিংবা নির্বাহী সম্পাদক গোছের কিছু এটা পদও সে বাগিয়ে নিয়েছে। নিয়মিত সে অফিসে আসত, মাস্তানের মতো এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াত। একে ধমকাত, ওকে বের করে দিত। আবার মাঝেমধ্যে সাংবাদিকদের কাছে যেয়ে, বিভিন্ন সংবাদ নিয়ে আলোচনা করত। জ্ঞানগর্ভ দু-একটা মন্তব্যও করত। সব মিলিয়ে আমাদের কাছে এই ছেলেটি ছিল এক বিরক্তিকর উপদ্রব।



 





মাঝে একদিন গভীর রাতে সে তার এক সাঙ্গাতকে নিয়ে রাস্তা দিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছিল। পথে তাকে আটকালো টহল পুলিশ।

জিজ্ঞাসা করল, এত রাতে কোথা থেকে এলেন?

-অফিস থেকে।

-পত্রিকা অফিস থেকে?

-হ্যাঁ।

-আপনি সাংবাদিক?

-না, আমি সাংবাদিক নই। তবে আমি সাংবাদিকদের চালাই।

বেশ একটা ডাটের সঙ্গেই কথাগুলো বলছিল মারুফ। কিন্তু পুলিশ এতে সন্তুষ্ট হতে পারল না।

বলল, আপনি তাহলে গাড়িতে ওঠেন।

সে রাতের বাকি সময় তাকে থাকতে হয়েছে থানা হাজতে। মারুফের সহযোগী অবশ্য দ্রুত অফিসে ফোন করে জানিয়েছে সব ঘটনা। অফিসে তখন রিপোর্টারদের অনেকেই ছিলেন। তাদের যে কেউ একজন ফোন করলেই হয়তো ছেড়ে দেওয়া হতো মারুফকে। কিন্তু কোনো সাংবাদিকের মধ্যেই সে ধরনের কোনো আগ্রহ দেখা গেল না। বেশ কিছু সময় পরে, দু-একজন অবশ্য ফোন করার ভান করেছেন। কোনাে এক নম্ব^রে কিছুক্ষণ ডায়াল করে রিসিভার ধরে রেখেছেন কানে। তারপর একসময় বলেছেন, না কেউ তো ফোন তুলছে না।



 





পরে জেনেছি, থানায় বসে মারুফ নাকি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে তার আত্মীয়তার কথাও বলেছে। কিন্তু পুলিশ বিশ্বাস করেনি তার কথা। সে সময় মোবাইল ফোনের প্রচলন শুরু হয়নি। টিএন্ডটি ফোনই ছিল একমাত্র ভরসা। তাই মারুফের পক্ষেও অত রাতে সম্ভব হয়নি নিজের বক্তব্যের পক্ষে কোনো প্রমাণ জোগাড় করা।

পরদিন ছাড়া পেয়ে, অফিসে এসে মারুফ ও তার সম্পাদক বাবা বেশ একটা হৈচৈ করেছিল নিউজ রুমে। সম্পাদক সাহেব বলছিলেন, একজন সাংবাদিক যদি কেবল থানায় ফোন করত, তাহলেই তার ছেলেকে আর এত কষ্ট করতে হয় না। কিন্তু কেউই ফোন করেনি। তিনি আরো জানালেন, এমনকি পুলিশের পক্ষ থেকে রাতে নব অভিযানে ফোন করা হয়েছিল। কোনো একজন সাংবাদিক ধরে নাকি বলেছিল, মারুফ নামে কাউকে সে চেনে না। এরপরই পুলিশ মারুফের কোনো কথাকেই আর পাত্তা দেয়নি। ড্রাগ-এডিক্ট মনে করে আটকে রেখেছে।

সম্পাদক সাহেব খুব দুঃখ করে বললেন, আপনারা পারলেন এমন বেইমানি করতে?

সম্পাদক সাহেবের সেই আন্তরিক দুঃখ আদৌ কোনো সাংবাদিককে স্পর্শ করেছিল বলে মনে হয় না। তবে লক্ষ করেছি, এর পর থেকে নিউজ রুমে মারুফের আনাগোনা অনেকটাই কমে গিয়েছিল।

সম্পাদক রেজাউল হক লোকটা দেখতে ছিল ছোটখাটো। কথাবার্তায় বেশ চৌকস। তবে পড়ালেখা খুব একটা ছিল বলে মনে হয়নি কখনোই। পত্রিকার মালিক হওয়ার আগে যে তার ওষুধের দোকান ছিল, সেটা টের পাওয়া যেত। ওষুধের সঙ্গে মাঝেমধ্যে তিনি পত্রিকাকে গুলিয়ে ফেলতেন। রাতে যখন আসতেন নিউজ এডিটরের রুমে, জানতে চাইতেন কোন নিউজের কী ট্রিটমেন্ট দেওয়া হচ্ছে। তাকে সিঙ্গেল কলাম (সংক্ষেপে যাকে আমরা এস/সি লিখতাম) বা ডাবল কলাম (ডিসি) বলা যেত না। তিনি বলতেন, ওয়ান সি, টু সি। তার যুক্তি ছিল, তিন কলাম যদি থ্রি সি হয়, চার কলাম পাঁচ কলাম যদি ফোর সি বা ফাইভ সি হয়, তাহলে ওয়ান সি কিংবা টু সি তে অসুবিধাটা কোথায়?



 





সে চলে গেলে, দেখতাম এ নিয়ে সিনিয়ররা বেশ হাসাহাসি করতেন। তারা বলতেন, ওষুধে তো ওয়ান সিসি, টু সিসি হয়, তাই তিনি এটাকেও ওই হিসাবের মধ্যে আনতে চাইছেন।

সিনিয়র সাংবাদিকরা যে তাকে নিয়ে, তার জ্ঞানের বহর নিয়ে কিছুটা হলেও রসিকতা করেন, এটা বোধকরি সম্পাদক সাহেব বুঝতে পারতেন। তাই মাঝারি পর্যায়ের সাংবাদিকদের মাঝেমধ্যে তিনি তার রুমে ডাকতেন। তাদের সঙ্গে নানা ধরনের জ্ঞানের কথা বলতেন। এসব জ্ঞানের কথার মাধ্যমে তিনি সম্ভবত  বোঝাতে চাইতেন, সিনিয়র যারা তাকে নিয়ে হাসাহাসি করে তাদের চেয়ে জ্ঞানগম্মি কিছু কম নেই তার। আমি মাঝারি পর্যায়েও ছিলাম না, তাই তার খাসকক্ষে ডাক পড়েনি কখনো। তবে মলয়রা যেত। আলাপের বিষয়বস্তু কেমন ছিল? মলয় জানাল, একবার নাকি তিনি মোগল স¤্রাট আকবরের স্থাপত্যব্যবস্থা নিয়ে গল্প করেছিলেন। তার সামনে উপবিষ্ট সাংবাদিকদের তিনি বলছিলেন, আকুব্বর (আকবর) বাদশা যমুনার পাড়ে বিরাট এক রাজপ্রাসাদ বানালেন। সেটা এমন ছিল যে, প্রসাদের ভেতর থেকে একটা সুড়ঙ্গ তৈরি করা হয়েছিল। সেই সুড়ঙ্গের সিঁড়ি বেয়ে যাওয়া যেত একেবারে যমুনার পার পর্যন্ত। প্রায়ই তিনি সেটা দিয়ে যমুনায় যেতেন ‘গঙ্গাস্নান’ করার জন্য!

বেতনকড়ি দেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্ব নির্ণয়ে তিনি নিজস্ব একটা পদ্ধতি তৈরি করে নিয়েছিলেন। সবার আগে পরিশোধ করতেন যে ছেলেটা প্লেট তৈরি করত, তার বেতন। এমনকি সব সাংবাদিকের যখন চার মাসের বেতন বকেয়া ছিল, তখন ওই ছেলেটির কোনো বকেয়া থাকত না। সম্পাদকের যুক্তি ছিল, অন্যদের একজন কাজ না করলে, অন্য কেউ সেটা ম্যানেজ করতে পারে। কিন্তু ও যদি প্লেট না তৈরি করে তাহলে তো আমার পত্রিকাই বের হবে না।

সন্দেহ নেই যুক্তিটি খুবই অকাট্য।

নব অভিযানের ভবনটি ছিল বড় অদ্ভুত টাইপের। নব অভিযান প্রথম যাত্রা শুরু করে পুরান ঢাকার লালকুঠি এলাকা থেকে। পরে সেটি শান্তিবাগের নিজস্ব ভবনে স্থানান্তর হয়। আমি লালকুঠিতে কখনো যাইনি। শান্তিবাগের এই দালানটি ছিল কিছুটা লম্ব^া টাইপের। লম্ব^ায় যদি ৫০ ফুট হয়, পাশে হবে বড়জোর ২০ ফুটের মতো। ভবনের বাইরে কোনো ডিস্টেম্পার ছিল না। ভেতরের অবস্থাও একই রকম। তার পরও এ নিয়ে রেজাউল হকের গর্বের শেষ ছিল না। তিনি বলতেন, এ রকম বিল্ডিং ঢাকা শহরে কয়টা পাবেন? পুরো বিল্ডিংটা করেছি আমি কংক্রিট দিয়ে। ইটের কোনো ব্যবহার নেই, সব পাথরের ঢালাই।

তার এই গর্বের বিষয়টা প্রথমে আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। পরে একজন ব্যাখ্যা করে দিলেন। তিনি বললেন, পাইলিং করে তৈরির পরও মানুষ দেয়ালটা ইটের গাঁথুনি দিয়ে করে, কিন্তু ইনি সেটা করেননি। দেয়ালটাও করেছেন তিনি ঢালাই দিয়ে।

অতঃপর বিষয়টা পরিষ্কার হলো আমার কাছে। তবে বুঝতে পারলাম না, কেন করেছেন তিনি এ রকম? কী প্রয়োজন ছিল এর?

এই যে এত গর্বের ভবন তার, বিস্ময়কর হলেও সত্য, এতে সাংবাদিক-কর্মচারীদের জন্য কোনো টয়লেট ছিল না। মাত্র একটি টয়লেট ছিল, সম্পাদকের রুমে। সেখানে তিনি আর তার ছেলে ছাড়া আর কেউ যেতে পারত না। তাহলে অন্যদের জন্য কী ব্যবস্থা?

একেবারে নিচতলায় গেটের পাশে ভবনের দেয়াল আর বাউন্ডারি ওয়ালের মাঝখানে দেড় ফুট পাশের একটা প্যাসেজ ছিলে। প্যাসেজের নিচে ড্রেন। সেখানেই ড্রেনের ওপরের একটু জায়গা ভেঙে উন্মুক্ত করে দেওয়া ছিল। জরুরি প্রয়োজনে প্র¯্রাব করা যেত সেখানে। তবে সেটা কেবল ছেলেরাই করতে পারত। ওই রকম উন্মুক্ত জায়গায় জলত্যাগে কারো আপত্তি থাকলে, তার জন্য চেপে রাখা ছাড়া আর কোনো চিকিৎসা ছিল না। তবে মেয়েরা কী করে এ সমস্যার সমাধান করত, তা আমার কাছে ছিল এক বিষম রহস্য।



 





বাথরুম নিয়ে একটা গল্প আছে। সেটাও অবশ্য মলয়ের কাছে শোনা। রেজাউল হক সাহেব একবার ঠিক করলেন, পত্রিকাটিকে আর সি গ্রেডে রাখবেন না। বরং কিছু সার্কুলেশন বাড়ানোর চেষ্টা করবেন। কেউ একজন তাকে বুদ্ধি দিল, সার্কুলেশন বাড়াতে হলে ভালো একজন সার্কুলেশন ম্যানেজার দরকার। অন্য পত্রিকায় যারা এ কাজে বেশ দক্ষতা দেখাতে পেরেছে, তেমন একজনকে নিয়ে আসতে হবে। সে অনুযায়ী বাংলার বাণী পত্রিকার সার্কুলেশন ম্যানেজারের সঙ্গে আলোচনা শুরু হলো। ভদ্রলোক শান্তিবাগের নব অভিযান অফিসে এলেন সম্পাদকের সঙ্গে চূড়ান্ত কথা বলতে। রেজাউল হক ভাবলেন, একজনকে আনলেই যদি সার্কুলেশন বাড়ে, তাহলে তাকে বেশি বেতন দিতে ক্ষতি কি? ফলে তার বাড়তি চাহিদাও মেনে নিলেন তিনি।

আলোচনার শেষ পর্যায়ে ওই ভদ্রলোকের টয়লেটে যাওয়ার দরকার পড়ল। তিনি জানতে চাইলেন, টয়লেটটা কোথায়। রেজাউল হক তার পিয়ন ডেকে বললেন, টয়লেট দেখিয়ে দিতে। পিয়ন তাকে নিচতলার সেই বিখ্যাত প্যাসেজে নিয়ে গেল।

বলল, এখানেই দাঁড়িয়ে কাজ সারেন।



 





টয়লেট দেখানোর কাজ শেষ করে পিয়ন চলে গেল। এরপর ওই ভদ্রলোক আর সম্পাদকের রুম পর্যন্ত দ্বিতীয়বার যাননি। ওখান থেকেই চলে গিয়েছিলেন।

নব অভিযান থেকে প্রথম যেদিন বেতন পেলাম, সে অভিজ্ঞতা ভুলবার নয়। আমাকে বেতন দেওয়া হলো চেকে। আইএফআইসি ব্যাংকের চেক। সে সময়ে এটিকে আধুনিক ব্যাংকের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হতো। চেকটি হাতে নিয়ে বেতনের অঙ্কটি দেখে রীতিমতো হতাশ হলাম। মাত্র বারো শ টাকা। তখন এখনকার মতো অনলাইন ব্যাংকিং ছিল না। ফলে আইএফআইসি ব্যাংকের মতিঝিল শাখায় যেয়েই চেক ভাঙাতে হবে। গেলামও পরদিন সকালে। বেয়ারার চেক ছিল সেটি। ব্যাংকের যে লোকের কাছে জমা দিলাম চেকটি, তিনি সেটি হাতে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই আমাকে ফেরত দিলেন। বললেন, টাকা নেই।

আমি অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম।

আমার অবস্থা দেখে তিনি বললেন, চেক করে দেখার কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ সকাল থেকে এই অ্যাকাউন্টের চেক নিয়ে কমপক্ষে ২০-২২ জন এসেছে। টাকা না থাকায় সবাই ফিরে গেছে।

অফিসে এসে আমি বিষয়টা নিয়ে অন্যদের সঙ্গে কথা বললাম। যে কয়জন চেক পেয়েছে, তাদের সবারই একই অভিজ্ঞতা। সে রাতে আর সম্পাদক এলেন না। এর পরের দিনও না। এলেন পুরো সাত দিন পর। তখন চেকের পরিবর্তে নগদ টাকা দেওয়া হলো।

নব অভিযানে কিছুদিন পরপরই নতুন নতুন মুখ দেখতাম। আসত, দিন কয়েক থাকত, তারপর চলে যেত। চলে যেত তারা এখানকার অব্যবস্থা দেখেই। আমি যোগ দেওয়ার মাস তিনেকের মধ্যেই চলে গেলেন মানিক ভাই। তিনি চলে গেলেন রাগ করে। যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাকে আনা হয়েছিল, তার বেশির ভাগই বাস্তবায়িত না হওয়াতেই চলে যান তিনি।

মানিক ভাই আমার জীবনের প্রথম নিউজ এডিটর। একসময় তিনি নাকি বঙ্গবন্ধুর খুব কাছের লোক ছিলেন। তখনো নাকি তার এই ঘন ঘন চাকরি ছাড়ার অভ্যাস ছিল। এ নিয়ে একটি ঘটনা আছে। বঙ্গবন্ধু নাকি একবার তাকে দেখে বলেছিলেন, ‘মানিক, এখানে খানিক, ওখানে খানিক।’ বিষয়টি সম্পর্কে একবার মানিক ভাইকে জিজ্ঞাসা করতে, তিনি হাসলেন। বললেন, কোথায় শুনলি?

তারপর তিনি বেশ রসিয়ে রসিয়ে পুরো ঘটনা বলতে লাগলেন।

মানিক ভাই ছিলেন বেশ সহজ-সরল। দিলখোলা। খুব বেশি প্যাঁচঘোচ বুঝতেন না। যা বলতেন, খোলাখুলিই বলতেন। আর ছিলেন খুবই হাতখোলা। পকেটে ১০ টাকা থাকলে, পুরোটাই খরচ করে ফেলতেন অবলীলায়। আবার যদি দরকার পড়ত, যে কারো কাছেই হাত পাততেন। যা নিতেন অনেক সময় আবার সেটা ফেরত দিতে ভুলে যেতেন। মনে আছে, একবার আমাকেই বললেন, এই তোর কাছে টাকা আছে?

রাস্তায় যখন বের হয়েছি, কিছু টাকা তো পকেটে থাকারই কথা। বললাম, আছে।



 





: কত আছে?

: শ চারেক হবে।

: ঠিক আছে, আমাকে শ তিনেক ধার দিতে পারবি?

মানিক ভাই আমার কাছে টাকা চেয়েছে, ভাবতেই যেন কেমন লাগল। হাসিমুখেই দিয়ে দিলাম।

সে সময় তিন শ আমার কাছে অনেক টাকা। মাসের শুরুতেই শাহানা আমাকে নির্দিষ্ট একটা অ্যামাউন্ট দিয়ে দিত সারা মাসের যাতায়াত ভাড়া আর হাত খরচের জন্য। তা থেকেই দিয়েছি তাকে। পরদিন থেকেই আমি আশা করতে থাকলাম, যে কোনদিন হয়তো মানিক ভাই আমাকে ডেকে টাকাটা ফেরত দিয়ে দেবেন। পরের কয়েক দিন কারণে-অকারণে তার রুমে গেলামও কয়েকবার। কিন্তু টাকা সম্পর্কে কোনো কথাই বললেন না। মাসের বাকি কটি দিন চলতে সেবার আমার খুবই কষ্ট হয়েছিল।

দিন পনেরো পরে, কোনো এক কলিগ, মলয় নাকি শামসুদ্দিন ভাই ঠিক মনে নেই, এর কাছে বললাম কথাটা। শুনে সে বলল, মানিক ভাই হয়তো ভুলেই গেছেন। ওনার এই স্বভাব। আপনি বরং তার কাছে টাকাটা চান। তিনি কিছুই মনে করবেন না। দেখবেন, সঙ্গে সঙ্গে দিয়ে দেবেন।

এখানে শামসুদ্দিন ভাইয়ের কথা একটু বলা যায়। সাব-এডিটরদের মধ্যে এই লোকটিকে আমার ভালো লাগত। আমার তুলনায় একটু বয়স্ক। শুনেছিলাম, তিনি নাকি কোনো এক কলেজে অধ্যাপনা করতেন। সেসব ছেড়ে এসেছেন সাংবাদিকতা করতে। ডেস্কে আমাদের সঙ্গে যারা ছিল তাদের মধ্যে বেশির ভাগই অফিসে কোনো কাজ করত না। তারা কি কাজ পারত না, নাকি ইচ্ছা করেই করত না, বলা মুশকিল। এই কাজ না করা সংস্কৃতির মধ্যে যে লোকগুলো ছিল ব্যতিক্রম, শামসুদ্দিন ভাই তাদেরই একজন। খুবই বিনয়ী ছিলেন। যাত্রাবাড়ীর দিকে থাকতেন। ভাড়া নয়, ওখানে ছিল তার পৈতৃক ভিটা। মাঝেমধ্যে বিকেলে আমরা অফিস থেকে বের হয়ে পাশেরই একটা রেস্টুরন্টে বসে ডালপুরি আর চা খেতাম। কথা বলতাম নানা প্রসঙ্গে।

শামসুদ্দিন ভাই সম্পর্কে আমার খুবই উচ্চ ধারণা ছিল। আমি মনে করতাম, চাইলে এই লোকটি যেকোনো বড় পত্রিকায় কাজ করতে পারেন। কেন যে এখানে পড়ে রয়েছেন, তা ঠিক বুঝতাম না। বিষয়টি তাকে বলেছিও কয়েকবার। তিনি মৃদু হাসতেন। উল্টো তিনি বলতেন আমার কথা।

বলতেন, আপনি কেন যাচ্ছেন না? আপনিও তো ভালো করবেন।



 





: যাব কী করে, কেউ তো ডাকছে না।

: ডাক পাবেন আপনি। দুদিন আগে আর পরে। তা ছাড়া নিজের দিক থেকেও যোগাযোগ রাখতে হয়।

সেই ডাক পেলাম, নব অভিযানে চাকরির ছয় মাসের মাথায়।

তবে সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে বরং নব অভিযানের আরো কয়েকজন কলিগের কথা বলা যেতে পারে।

তারও আগে শেষ করে নিই শামসুদ্দিন ভাইয়ের কথা। নব অভিযান ছাড়ার পর তার সঙ্গে চার-পাঁচবার দেখা হয়েছে। আমি চলে যাওয়ার কিছুদিন পর তিনিও ছেড়েছেন ওই পত্রিকা। এরপর সিরিয়াসলি আর কোথাও চাকরি করেছেন বলে শুনিনি। দু-একবার দেখা হয়েছে প্রেসক্লাবে। হয়তো সাংবাদিকদের কোনো প্রোগ্রাম আছে, অনেক ভিড়ের মধ্যে দেখলাম শামসুদ্দিন ভাই হাঁটাহাঁটি করছেন একা একা। কাছে গেলাম।

: শামসুদ্দিন ভাই কেমন আছেন?

: ভালো। আপনি?

: আমি ভালো। কখন এসেছেন?

: এই তো অনেকক্ষণ।

: আমিও তো অনেক সময় হলো এসেছি। তাহলে এতক্ষণ আপনাকে দেখিনি কেন?

: হয়তো অন্য বিষয় নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, তাই। আমি কিন্তু আপনাকে অনেক আগেই দেখেছি।

: দেখেছেন যদি তাহলে ডাক দিলেন না কেন?

: না, কিছু যদি মনে করেন। সবাই কেমন আপনার সঙ্গে কথা বলছে। তাদের মধ্যে আমি তো কিছুই না। আপনাকে বিরক্ত করতে চাইনি।

আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। শামসুদ্দিন ভাই বলছেন আমাকে এ কথা? তার কথা শুনে দুঃখ পেলাম। সেই সঙ্গে হতাশও হলাম। এটা কি ওনার হীনম্মন্যতা? নাকি অতি ভদ্রতা?

বললাম, শামসুদ্দিন ভাই, এসব আপনি কী বলছেন? আমাকে এত পর করে দিচ্ছেন কেন?

: না, আপনারা এখন অনেক বড় হয়েছেন। বড় পত্রিকায় চাকরি করেন, বড় রিপোর্টার।

: তাতে কী হয়েছে? আমি তো আপনার কাছেই কাজ শিখেছি। সেটা তো মুহূর্তের জন্যও অস্বীকার করতে পারব না। তা ছাড়া আপনি যদি চাইতেন, আমার চেয়েও বড় পত্রিকায় বড় পদে যেতে পারতেন।

: কি জানি। তবে এই কথাটা কেবল আপনিই বলেন, আর কেউ না। মাঝে অনেক দিন গ্যাপ গেছে, এখন হয়তো আর পারবও না। আত্মবিশ্বাসও আর সেভাবে অনুভব করি না।

জানালেন, কয়েক বছর ধরে তিনি আর কিছ্ইু করেন না। না সাংবাদিকতা, না অন্য কোনো চাকরি। মাঝে চাকরির জন্য পুরোনো কলিগদের কাছে গিয়েছিলেন, কিন্তু তেমন পাত্তা পাননি। বরং একসময় যারা তার অনুগ্রহ পেতে তাকিয়ে থাকত, তারাও এখন চোখ উল্টে নিয়েছে। বেশ কয়েক জায়গায় ঘোরাফেরা করে এখন চাকরির আশা ছেড়ে দিয়েছেন। নিজেদের একটা বাড়ি যেহেতু আছে, সেখানেই থাকেন। তেমন বেশি কোনো আয় নেই, কোনোভাবে চলে যায়।

‘কোনোভাবে’ই যে জীবন যাপন করছেন তিনি, তা তার দিকে তাকালেই বোঝা যায়। মনে হলো, লোকটা যতটা না অর্থকষ্টে আছে, তার চেয়ে বেশি আছে মনোকষ্টে। পুরোনো বন্ধুদের কাছ থেকে পেয়েছেন একের পর এক উপেক্ষা। মনোবল আর আত্মবিশ্বাস বলতে কিছু আর অবশিষ্ট নেই।

বললাম, পুরোনো কাদের কাছে গেছেন জানি না, আমার কাছে তো আসেননি কোনো দিন। আচ্ছা মলয়ের কাছে গেছেন?



 





: না, যাইনি।

: মলয় যে ইত্তেফাকে তা জানেন?

: শুনেছি।

: তাহলে যাননি কেন?

: ওই কারণেই তো যাইনি। সে এখন ইত্তেফাকের মতো বড় পত্রিকায়। যদি বিরক্ত হয়। যদি ভাবে, অনুগ্রহ চাইতে গেছি। কী দরকার।

শামসুদ্দিন ভাইকে আমার অফিসে আসতে বললাম। কেবল বললাম না, রীতিমতো অনুরোধ করলাম। তিনি আমার সেই অনুরোধ রেখেছিলেন। এসেছিলেন বেশ কয়েকবার। আমি চেষ্টা করেছি জনকণ্ঠে তাকে ঢোকাতে। পারিনি। পরে পাঠিয়েছিলাম ওনাকে বাংলার বাণীতে। ওখানে অবশ্য চাকরি হয়েছিল। বাংলার বাণী আর জনকণ্ঠ তখন কাছাকাছি অফিস, দুটোই মতিঝিলে। মাঝেমধ্যে নিজের কাজ সেরে আমার অফিসে আসতেন তিনি। অফিসের সামনে রাস্তায়, ফুটপাতের ওপর তখন সেই রাতের বেলায় বেশ কিছু দোকান বসত, চা সিগারেট নাশতা ইত্যাদি বিক্রি করত। ওখানে বসে মাঝেমধ্যে চা-বিস্কুট খেতাম। তারপর চলে যেতেন।

বাংলার বাণীতে বেশি দিন কাজ করতে পারেননি শামসুদ্দিন ভাই। ওরা অবশ্য তাকে বেশ গুরুত্বই দিত। কিন্তু দিত না কোনো টাকা-পয়সা। মাঝে একদিন প্রেসক্লাবে ওনার সঙ্গে দেখা। জানালেন, চাকরি ছেড়ে দেবেন।

আমি অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, কেন?

: আজ চার-পাঁচ মাস হয়ে গেল, কোনো টাকা-পয়সা দেয় না।

: শামসুদ্দিন ভাই, করেন না আর কয়টা দিন। বাংলার বাণীর অবস্থা যে ভালো না, এটা সবাই জানে। ওরা কাউকেই টাকা-পয়সা তেমন একটা দেয় না। আর আপনি তো ওখানে স্থায়ীভাবে থাকতে যাননি। কদিন থাকেন ওখানে, তারপর চলে যাবেন অন্য কোথাও। ভালো কোথাও যেতে হতে হলে, কোনো একটা পত্রিকা থেকেই যেতে হবে। বেকারদের কেউ নিতে চায় না।

: সবই বুঝি। ওরাও জানে যে, ওদের ওখানে আমি থাকব না। তাই বিনা পয়সায় খাটিয়ে নিচ্ছে। সামান্য কিছু দিলেও হতো, কিন্তু একেবারে বিনা পয়সায় কাজ করতে আত্মসম্মানে বাধে।

আমি আর কী বলব। কিছুমাত্র ভুল তো বলেননি তিনি।

এরপর কদিন পরই তিনি ছেড়ে দেন বাংলার বাণীর চাকরিটি।

শামসুদ্দিন ভাইয়ের সঙ্গে আর কোনো দিন দেখা হয়নি।

নব অভিযানের ডেস্কে কাজ করতেন রোকন, নুরুল আমীন রোকন। এই লোকটি সঙ্গে আমার পরিচয় একেবারে প্রথম দিনেই। আমি ডেস্কে বসে কাজ করছি। আমার পাশেই একটা চেয়ারে বসে সে খুব মনোযোগ দিয়ে সিগারেট বানাচ্ছে। তার সামনে একটা সø্যাগ পড়ে আছে অনেকক্ষণ ধরে। প্যাডে সে কেবল ডেটলাইনটুকু লিখেছে। তারপর সমগ্র মনোযোগ নিবিষ্ট করেছে ওই সিগারেট তৈরিতে। এরিনমোর এর একটা কৌটা থেকে টোব্যাকো লিফ বের করে সিগারেট পেপারে খুবই কসরত করে প্যাঁচাচ্ছে। সিগারেটটা বানানো শেষ হতে সেটি আমার দিকে এগিয়ে দিলেন, নিন।

আমি তো সিগারেট খাই না। খুবই বিনয়ের সঙ্গে বললাম।



 





এবার তার অবাক হওয়ার পালা।

: বলেন কী? সিগারেট খান না? তাহলে সাংবাদিকতা করবেন কিভাবে?

আমি কিছু বললাম না।

তবে রোকন বলল।

: আমি যদি আপনার পাশে বসে সিগারেট খাই, আপনার অসুবিধা হবে না তো?

: না হবে না। আপনি খান, আমার কোনো অসুবিধা নেই।

কথাটা কিন্তু খুব একটা ভুল বলিনি। এমনিতে সিগারেট আমি যে খাই না, তা-ই নয়, আমার পাশে বসে কেউ ধূমপান করলে খুবই অসহ্য লাগে। কিন্তু রোকনকে আমি মানা করিনি ওর কারণে নয়, এরিনমোরের কারণে। এই একটা টোব্যাকোর গন্ধ আমার কাছে ভালো লাগে। আমার কৈশোরে আব্বাকে দেখতাম মাঝেমধ্যে এই টোব্যাকো কিনে এনে সিগারেট বানিয়ে খেতেন। আব্বাকে আমি তিন ধরনের টোব্যাকো দিয়ে সিগারেট বানাতে দেখেছি। ক্যাপস্ট্যান, এরিনমোর আর ফ্লাইং ডাচম্যান। এর মধ্যে এরিনমোরের গন্ধটা আমার কাছে খুবই ভালো লাগত। এরও কিছুকাল আগে, তখন আমরা মুক্তাগাছায় থাকতাম, দাদুর জন্য সুগন্ধি জর্দা কিনতাম। সেখানেও চমৎকার একটা গন্ধ থাকত। মুক্তাগাছা জর্দা বা তামাক বানানোর জন্য বিখ্যাত ছিল। তখন ‘খাম্মিরা তামাক’ বলে একধরনের তামাক খুবই বিখ্যাত ছিল। আমি অনেক দিন বাজারে যেয়ে ওই বিশেষ ধরনের তামাক বানাতে দেখেছি। নানা রকম কেমিক্যাল বা সুগন্ধি দিয়ে ওই তামাক বানানো হতো। সুগন্ধিগুলো এক ধরনের মাদকতা সৃষ্টি করত। পরবর্তীকালে, ওই সুগন্ধ পেয়েছি এরিনমোর টোব্যাকোর মধ্যে।

কিন্তু রোকনের পাশে বসে সিগারেট খাওয়াটা আমার কাছে খুব একটা বেশি দিন ভালো লাগেনি। দিন কয়েক পরেই দেখলাম, এরিনমোর উধাও। সাধারণ সিগারেট ফুকছে সে, আর যথারীতি বিরক্ত লাগছে আমার। একবার আমি জানতেও চাইলাম, আর এরিনমোর খাচ্ছেন না যে?

: খাব কী করে? ওটা কেনার অত টাকা কোথায়? ওই এক কৌটা একজন গিফট করেছিল, তাই কদিন খেলাম। দেখি কিনব আবার।

রোকন হয়তো পরে কখনো এরিনমোর কিনে থাকবে। কিন্তু আমি আর কোনো দিন তাকে দেখিনি।

রোকন এখনো সাংবাদিকতা পেশাতে আছে। সর্বশেষ যখন দেখেছি, তখন কোনো এক পত্রিকার নিউজ এডিটর। তা ছাড়া সাংবাদিক ইউনিয়নের বড় ধরনের নেতাও একজন।



 





এবার বলি জাহাঙ্গীর ভাইয়ের কথা। নব অভিযানে জাহাঙ্গীর ভাই বেশ ক্ষমতাধর ছিলেন। আমার পরবর্তী সাংবাদিক জীবনেও দেখেছি, ক্ষমতাধর না হলে সংবাদপত্রে কাউকে চাকরি দেওয়া সম্ভব হয় না। কোন পদে কাজ করছেন- সেটা যতটা না গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মালিকের সঙ্গে তার সম্পর্কটা কেমন- সেটা। জাহাঙ্গীর ভাইয়ের এই দ্বিতীয় যোগ্যতাটা তখন বেশ ভালোভাবেই ছিল। মানিক ভাই নিউজ এডিটর ছিলেন, কিন্তু লোক আনা, বাদ দেওয়ার ক্ষমতাটা যেন ছিল জাহাঙ্গীর ভাই আর স্বদেশের ওপর। তবে বিষয়টা কিভাবে সম্ভব হয়েছিল, তা তখন আমি ঠিক বুঝতাম না। তবে দেখতাম, জাহাঙ্গীর ভাইয়ের ওপর অফিসের বেশির ভাগ সাংবাদিকই দারুণ বিরক্ত। তারা জাহাঙ্গীর ভাইয়ের হম্বিতম্বি^ পছন্দ করতেন না। অপছন্দের লোকের হাত ধরে আমি ঢুকেছি বলে, শুরুতে আমিও বেশির ভাগ সহকর্মীর স্বতঃস্ফূর্ত অনুমোদন পাইনি। আমাকে দেখত তারা কিছুটা সন্দেহের দৃষ্টিতেই। এমনকি যারা আওয়ামী লাইনের সাংবাদিক ছিল, তাদের অনেকে পর্যন্ত ছিল এই দলে। আর এদের শীর্ষে ছিলেন সম্ভবত আখতার ভাই।

আখতার আহমেদ খান ছিলেন আমাদের শিফট ইনচার্জ। বলতে গেলে, নিউজ এডিটরের পরেই তার অবস্থান। মানিক ভাইকে পর্যন্ত দেখেছি, আখতার ভাইকে সমীহ করে কথা বলতে। জেনেছি, ইউনিয়নেও তিনি নাকি ছিলেন খুবই প্রভাবশালী। তবে খুবই বিনয়ী ছিলেন আখতার ভাই। তার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট হওয়া সত্ত্বেও আমাকে ‘আপনি আপনি’ করে বলতেন। তার সঙ্গে কাজ করতে যেয়ে বারবার বিস্মিত হয়েছি। এই লোকটির নিউজ সেন্স ছিল খুবই ভালো। ইংরেজিতে অসাধারণ দক্ষতা। আমি ভেবে পেতাম না, তিনি কেন এমন ছোট একটি পত্রিকায় কাজ করছেন?

দৈনিক পত্রিকায় ডেস্কে কাজ করতে গেলে ইংরেজি জানাটা খুবই জরুরি। বরং বলা চলে, এটাই একেবারে প্রাথমিক শর্ত। ইংরেজি না জানলে, বিদেশি সংবাদমাধ্যম থেকে পাওয়া নিউজের অনুবাদ করবে কিভাবে? কিন্তু এই প্রাথমিক শর্তটি নব অভিযানের কতজন সাব-এডিটরের পক্ষে পূরণ করা সম্ভব হয়েছিল, তা বলা কঠিন। এ বিষয়টি প্রথম আমার সামনে তুলে ধরে মলয়। কয়েকজনের নাম উচ্চারণ করে সে বলে, একটু খেয়াল করে দেখবেন, এরা একটা সø্যাগ নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকে। এক লাইন একে জিজ্ঞাসা করে, তো আরেক লাইন ওকে জিজ্ঞাসা করে। এরপর একসময় নিচে যায় চা খেতে। ওখানে আধাঘণ্টা এক ঘণ্টা পার করে আবার এসে বসে। এভাবে কাটিয়ে দেয় সময়।

তার এই বক্তব্য আমার কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকল। জিজ্ঞাসা করলাম, তাহলে তারা চাকরি করে কেন? আর এই চাকরিই বা কেন করে? অন্য কিছু করলেই পারে। অন্য কোনো সেকশনে। মফস্বল সেকশনে কাজ করলে তো আর অনুবাদের ঝামেলায় যেতে হবে না।

কিন্তু মফস্বলে আপনি কয়জনকে পাঠাবেন? এখানে সাব-এডিটর যারা আছেন, তাদের ৬০ শতাংশই তো ওই দলে।

মলয় আরও জানাল, আসলে আগে সাব-এডিটরদের তেমন একটা অনুবাদ করতে হতো না। ছোট এই পত্রিকায় আগে বিদেশি সংবাদমাধ্যমের সার্ভিসও নেওয়া হতো না। এদিক-ওদিক থেকে, আগের দিনের পত্রিকা থেকে নকল করে ডেস্কের কাজ চালানো হতো। তাই তখন এদের জারিজুরি ধরাও পড়েনি। কিন্তু মানিক ভাই, আখতার ভাই আসার পর পাল্টে গেছে পরিস্থিতি।

পুরো বিষয়টাই তখন আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল। বুঝতে পারলাম, শামসুদ্দিন ভাই, আমি, মলয়সহ হাতেগোনা আর কয়েকজনকে কেন ছুটি দিতে চাইতেন না মানিক ভাই কিংবা আখতার ভাই।



 





এরা আমার কাজের প্রশংসা করতেন, তবে সম্ভবত ততটা বিশ্বাস করতেন না। অবিশ্বাসের এ বিষয়টা আমার ওপর চেপে বসেছিল, প্রথম দিন জাহাঙ্গীর ভাইয়ের হাত ধরে ঢুকেছিলাম বলে।

আর এত দিন পরে, আমার ভাবতেই অবাক লাগছে, নব অভিযানে আমি প্রথম প্রকাশ্য বিরোধে জড়িয়ে পড়েছিলাম আখতার ভাইয়ের সঙ্গে!

বিষয়টা আর কিছু নয়, হাজিরা খাতায় আমার উপস্থিতি স্বাক্ষর নিয়ে। আমার তখন নির্ধারিত ছুটির দিন ছিল বুধবার। কোনো এক মঙ্গলবারে মানিক ভাই আমাকে বললেন, কাল কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে, তুই অফিসে আয়। অফ ডেটা পরদিন নে।

আমি রাজি হলাম।

পরদিন অফিসে এসে আমি বুধবারের ঘরে স্বাক্ষর করলাম, আর পরদিন বৃহস্পতিবারের ঘরে ‘অফ’ শব্দটি লিখে রাখলাম। শুক্রবার অফিসে এসে দেখি, আমার সেই ‘অফ’ লেখার ওপর কে যেন লাল কালিতে বড় করে ‘এ’ লিখে রেখেছে। অর্থাৎ বৃহস্পতিবার দিন আমাকে অনুপস্থিত দেখানো হয়েছে।

আমার মেজাজ খিচড়ে গেল। এমনিতেই কাজ করে বেতন পাই না, তিন মাসের বেশি বকেয়া পড়ে আছে, তার ওপর এভাবে অন্যায়ভাবে ‘অ্যাবসেন্ট’ করা!

জিজ্ঞাসা করলাম, কে করল আমাকে অ্যাবসেন্ট?

কে যেন বলল, আখতার ভাই।

আমি বললাম, বৃহস্পতিবার যদি আমি অ্যাবসেন্ট হয়ে থাকি, তাহলে আমার অফ ডে কোথায় যাবে? ওটা তো আমার পাওনা। ঠিক আছে, তাহলে আমি আগামীকাল অফ ডে নেব। এই বলে আমি পরদিন, অর্থাৎ শনিবারের ঘরে ‘অফ’ লিখে রাখলাম।

সে সময় আমার ডিউটি ছিল দিনে, অর্থাৎ বিকেল ৫টার দিকে কাজ শেষ করে আমি চলে যেতাম। আমি যাওয়ার ঘণ্টাখানেক পর আসতেন আখতার ভাইসহ রাতের শিফটের লোকেরা।

যথারীতি শনিবার আমি অফিসে গেলাম না। রবিবারে যেয়ে দেখি, একই অবস্থা। আমার লেখা অফের ওপর লাল কালির ‘এ’ লেখা। আমাকে রীতিমতো গোয়ার্তুমি পেয়ে বসল। গজগজ করতে লাগলাম। ঠিক করলাম, সোমবারের ঘরে ‘অফ’ লিখব। আর মুখে বললাম, দেখি উনি কত দিন আমাকে অ্যাবসেন্ট দেখাতে পারে। বেতন এমনিতেই পাই না, অ্যাবসেন্ট দেখালে কাটবে আর কি?

আমার পাশ থেকে কে যেন একজন বলল, এক কাজ করেন, বিষয়টা নিয়ে আপনি মানিক ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলেন।

মানিক ভাই ততক্ষণে চলে এসেছেন। আমি তার কাছে গেলাম। তিনি সব কথা শুনলেন। বললেন, তোর অফ ডে যে আমি কেটেছিলাম, তা আখতার জানত না। তাই সে এটা করেছে। তুই তার সঙ্গে কথা বললেই সব মিটে যেত। ঠিক আছে, তুই অফিস কর। তোর ওই দুই দিন যাতে অ্যাবসেন্ট দেখানো না হয়, সে ব্যবস্থা আমি করছি।

বিষয়টা নিয়ে আমার সঙ্গে আখতার ভাইয়ের কখনোই কোনো কথা হয়নি। উনিও আমাকে কিছু বলেননি, আমিও না। তবে আমাদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি একটা হতো পারত। সেটা হয়নি মলয়ের কারণে। মলয়ের সঙ্গে তখন আমার খুবই ভালো সম্পর্ক ছিল। বিষয়টি সবাই জানত। আখতার ভাই-ই সম্ভবত আমার আচরণ নিয়ে তার বিরক্তির বিষয়টি মলয়কে বলে থাকবেন। সে সময় তিনি এমনও ইঙ্গিত হয়তো করেছিলেন যে, আমি প্রতিপক্ষ ইউনিয়নের লোক। মলয় তাকে নিশ্চিত করে যে, তার ধারণা ঠিক নয়। আমি তাদেরই লোক।

এসব কথা পরে আমাকে মলয়ই জানায় একসময়।

আমি নব অভিযান ছাড়ার পরেও আখতার ভাইয়ের সঙ্গে আমার বহুবার দেখা হয়েছে। তার আচরণ দেখে কখনো মনে হয়নি যে, কোনো কারণে আমার ওপর মন খারাপ করে আছেন তিনি। বরং যতবার দেখা হয়েছে, টের পেয়েছি তার আন্তরিকতা।

আখতার ভাই খুব সিরিয়াসলি ইউনিয়ন করতেন। তবে ইউনিয়নে ধান্ধাবাজ নেতা হিসেবে যাদের চিনতাম, তিনি সে দলে ছিলেন না। সম্ভবত এ কারণে তিনি তেমন কিছু বৈষয়িক সুবিধাও লাভ করেননি। নব অভিযান ছাড়ার পর তিনি বিভিন্ন জায়গায় কাজ করেছেন। একসময় আমি তাকে দেখেছি দ্য ডেইলি অবজারভারে কাজ করতে। সবশেষ ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে প্রথমবারের মতো কিছু পেলেন। প্রেস সেক্রেটারি হিসেবে নিয়োগ পেলেন নিউইয়র্কে। এটা তার এত দিন নিঃস্বার্থভাবে ইউনিয়ন করার পুরস্কার কি না বলতে পারব না, তবে নিউ ইয়র্কের সুখ তার বেশিদিন সহ্য হয়নি। মাস কয়েকের মধ্যে, সেই বিদেশ বিভূঁঁইয়ে তার মৃত্যু হয়। আখতার ভাইয়ের এমন মর্মান্তিক মৃত্যু আমাকে খুবই স্পর্শ করে।

বলছিলাম জাহাঙ্গীর ভাইয়ের কথা।



 





অফিসে তিনি পরিচিত ছিলেন ‘মালিকের লোক’ হিসেবেই। তবে মালিকের কাছ থেকে তিনি কোনো সুবিধা পেয়েছেন বলে আমার কাছে কখনো মনে হয়নি। সে বিচারে জাহাঙ্গীর ভাইকে আমার কিছুটা বোকা টাইপের লোক বলেই মনে হতো। মাঝে তার মনে হলো, মফস্বল বিভাগটা ঠিকমতো চলছে না। অমনি ঘোষণা দিলেন, ওই বিভাগটার দায়িত্ব তিনি নিতে চান। বিভিন্ন সিস্টেম করে তিনি তা নিয়েও নিলেন।

মফস্বল বিভাগের দায়িত্ব নেওয়ার পর, ওই সেকশনে যারা কাজ করতেন, তাদের ঘুম হারাম হয়ে গেল। এত দিন তারা মফস্বল সংবাদদাতাদের পাঠানো রিপোর্টগুলো যেনতেনভাবে, কখনো কেবল ডেটলাইন পরিবর্তন করে, কখনো বা দু-একটা শব্দ পরিবর্তন করে ছেড়ে দিতেন এখন জাহাঙ্গীর ভাই দায়িত্ব নিয়ে আইন জারি করলেন, মফস্বল রিপোর্টারদের লেখা কিছু হয় না, তাই সব লেখা এই সেকশনের সাব-এডিটরদের নতুন করে লিখতে হবে।

আইন তো জারি হলো, কিন্তু এটা বাস্তবায়ন যে কতটা অসম্ভব, সেটা কার্যক্ষেত্রে যেয়ে টের পাওয়া গেল। এমনিতে মফস্বলের সব কপি ছেড়ে দেওয়ার কথা দুপুরের মধ্যে, কিন্তু মাত্র দুজন সাব-এডিটর সব রিপোর্ট রি-রাইট করতে যেয়ে দেখা গেলে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু ম্যাটার তখনো অর্ধেকও শেষ হয়নি।

এ রকম সময়ে জাহাঙ্গীর ভাই একদিন আমাকে চাইলেন তার বিভাগে। বললেন, যারা আছে এরা কোনো কাজের নয়, মাসুদকে পেলে আমি পারব।

প্রস্তাব শুনে আমি যতটা আঁতকে উঠলাম, তার চেয়ে বেশি বিরক্ত হলেন মানিক ভাই। তিনি স্পষ্ট বলে দিলেন, সেন্ট্রাল ডেস্ক থেকে মাসুদকে ছাড়া যাবে না।

জাহাঙ্গীর ভাইয়ের ওই ‘মফস্বল অভিযান’ বেশি দিন স্থায়ী হলো না। যে বিষয়টাকে তিনি খুবই সহজ মনে করেছিলেন, সেটা যে কত বিশাল জটিল, তা টের পেতে তার সময় লাগল না। কিন্তু তত দিনে বিষয়টা নিয়ে তার জেদ চেপে গিয়েছিল, নির্ভর করছিল তার মানসম্মানও। উনি সম্ভবত ওখান থেকে বের হয়ে আসার একটা ছুতো খুঁজছিলেন।

সে সুযোগটা পেয়েও গেলেন একসময়। রিপোর্টিং নিয়ে কী একটা ঝামেলা হচ্ছিল। তখন চিফ রিপোর্টার ছিলেন বকুল ভাই। তার পুরো নাম খায়রুল আলম বকুল। বকুল ভাই ছিলেন ইউনিয়নের অন্য প্যানেলের লোক। ওই পদে আওয়ামী প্যানেলে কোনো একজনকে আনা দরকার। কিন্তু রিপোর্টারদের মধ্যে সে রকম কেউ ছিল না। সবাই যখন বিকল্প লোকের সন্ধানে গলদঘর্ম, এগিয়ে এলেন জাহাঙ্গীর ভাই। তাকে বানানো হলো চিফ রিপোর্টার।

পুরো বিষয়টাই ছিল দারুণ অপ্রত্যাশিত। কেউ ভাবতেই পারেনি, একদিনের রিপোর্টিংয়ের অভিজ্ঞতাও নেই যে লোকের, তাকে বানানো হবে চিফ রিপোর্টার। জাহাঙ্গীর ভাই কিন্তু তার স্বভাব অনুযায়ী উঠেপড়ে লাগলেন রিপোর্টারদের শায়েস্তা করতে। যত দূর মনে পড়ে, রিপোর্টিং সেকশনে তার পরিণতি হয়েছিল মফস্বল বিভাগের চেয়েও মর্মান্তিক।



 





তবে নব অভিযানে জাহাঙ্গীর ভাইয়ের অবস্থান যা-ই থাক না কেন, আমার কাছে তিনি ছিলেন বিরাট কিছু। খুবই শ্রদ্ধা করতাম আমি তাকে। আজ এত দিন পরেও স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, সাংবাদিকতার হাতেখড়ি আমার তার হাতেই হয়েছে। অনুবাদের হাত ছিল তার খুবই ভালো। আমাকে নিজে হাতে অনেক কিছু শিখিয়েছেন। তাছাড়া ওখানে তিনিই ছিলেন আমার গার্জেন। তিনি নিজেও আমাকে ছোট ভাই ছাড়া আর কিছু হয়তো মনে করতেন না। বড় ভাইয়ের অধিকার নিয়েই তিনি আমাকে শাসন করতেন, কাজ শেখাতেন।

আমি নব অভিযান ছেড়ে আসার পর অস্থির চিত্তের এই লোকটিও আর বেশি দিন সেখানে থাকতে পারেননি। পরে অনেক দিন তার কোনো খবর নিতে পারিনি। বছর কয়েক পরে, হঠাৎ একদিন জানতে পারলাম, তিনি ময়মনসিংহ থেকে দৈনিক সবুজ নামে একটি পত্রিকা বের করছেন। সেখানে ভাইজান, মানে আমার বড় ভাইও আছেন। ভাইজানের কাছে জানতে চাইলাম, কেমন হবে পত্রিকাটি? জাহাঙ্গীর ভাই-ই বা কেমন করছে। ভাইজান যা বললেন, তা রীতিমতো হতাশাজনক।

জাহাঙ্গীর ভাই ওখানেও সেই ‘শুদ্ধ’ সাংবাদিকতার চর্চা শুরু করেছেন। রিপোর্টার হিসেবে যাদের নিয়েছেন তাদের নানা রকম জটিল ক্লাস করাচ্ছেন। শেখাচ্ছেন সাংবাদিকতা। ঝোঁকের বসে মালিক ভদ্রলোকও বেশ খরচাপাতি করছেন। কিন্তু এভাবে কত দিন চলবে কে জানে?

বাস্তবে হয়েছিলও তাই, বেশিদিন চলেনি। একটা জেলা শহর থেকে দৈনিক সবুজ বের হয়েছিল বেশ ভালোভাবেই। কিন্তু যতটা ইনভেস্টমেন্ট, যতটা ভালো  প্রোডাকশন, তার কিছুমাত্র তো হয়নি ফিডব্যাক। তাই মালিকের পক্ষে বেশিদিন সম্ভব হয়নি সে ক্ষতির বোঝা বহন করা। পত্রিকা তিনি বন্ধ করেননি, তবে জাহাঙ্গীর ভাইয়ের সেখানে থাকা সম্ভব হয়নি।



 





এরও বেশ কয়েক বছর পর, আমি তখন দৈনিক আমার দেশ-এ, হঠাৎ একদিন জাহাঙ্গীর ভাইয়ের ফোন। জানলাম, উনি এখন অধ্যাপক বি চৌধুরীর সঙ্গে। রাষ্ট্রপতির পদ ছেড়ে, বিএনপির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে, বি. চৌধুরী তখন বিকল্পধারা গঠন করেছেন। জাহাঙ্গীর ভাই ওখানে চাকরি নিয়েছেন প্রেস সেক্রেটারি হিসেবে। বিকল্পধারার মিডিয়ার দিকটা দেখেন তিনি।

জাহাঙ্গীর ভাইয়ের আমন্ত্রণে বেশ কয়েকবার গেলাম বিকল্পধারার প্রোগ্রামে। সত্যি কথা বলতে কি, সাধারণত এসব প্রোগ্রামে আমাদের যাওয়া হয় না। গেলাম কেবল জাহাঙ্গীর ভাইয়ের কারণেই।

কিন্তু সেখানেও বেশিদিন থাকা হয়নি তার। একদিন শুনলাম, বিকল্পধারা ছেড়েছেন তিনি, যোগ দিয়েছেন যায়যায়দিন-এ। এর মাস কয়েক আগেই আমি ছেড়েছি যায়যায়দিন। যায়যায়দিন-এ চিফ রিপোর্টার ছিলেন জাহাঙ্গীর ভাই। কিন্তু এখানেও থাকতে পারেননি বেশি দিন। সেখান থেকে বের হয়ে কিছুদিন বেকার থেকে আবার গিয়েছেন বিকল্পধারার চাকরিতে।

এরই মধ্যে একবার হঠাৎ করে খেয়াল করলাম, মানিক ভাই অফিসে আসছেন না। রাতে মেকআপ করছেন আখতার ভাই। শুরুতে আমি ভাবলাম, মানিক ভাইয়ের বুঝি অসুখ করেছে, তার এই অনুপস্থিতি নিতান্তই সাময়িক। তাই এ নিয়ে আর মাথা ঘামানোর প্রয়োজন বোধ করলাম না। আসলে, তখন পর্যন্ত সাংবাদিকতা পেশা, বিশেষ করে বাংলাদেশে সাংবাদিকতার পরিবেশ সম্পর্কে আমার জ্ঞান নেই বললেই চলে। বুঝতে পারলাম তখন, যখন এক সন্ধ্যায় দেখলাম নিউজ এডিটরের চেয়ারে অন্য এক ভদ্রলোক বসে আছেন। টকটকে ফর্সা এই ভদ্রলোকের চেহারায় একধরনের আভিজাত্যের ছাপ আছে। তাকে ঘিরে বসে সিরিয়াস ভঙ্গিতে কথা বলছে জাহাঙ্গীর ভাই, স্বদেশসহ আরো কয়েকজন। কিছুক্ষণের মধ্যেই জানতে পারলাম, এই ভদ্রলোকের নাম রঞ্জন কিশোর চৌধুরী।

-ইনি আগে কোথায় ছিলেন? জানতে চাইলাম আমি।

আশপাশের কেউ-ই এর জবাব দিতে পারল না। দু-একজন জানাল, তারা জীবনে প্রথমবারের মতো দেখছেন একে। এমনকি তার নাম পর্যন্ত নাকি কখনো শোনেনি তারা।



 





বিষয়টা আমার কাছে খুবই রহস্যময় মনে হলো। এ রকম একজন এলেবেলে লোককে স্বদেশসহ জাহাঙ্গীর ভাইয়েরা নিয়ে আসবে? অবিশ্বাস্য ঠেকল।

পরে অবশ্য জানতে পারলাম, বছর কয়েক ধরে সরাসরি সাংবাদিকতার সঙ্গে নেই রঞ্জনদা। তবে আগে ছিলেন, খুব ভালো সাংবাদিক হিসেবে বেশ নামডাকও হয়েছিল। বর্তমানে কি একটা এনজিওতে কাজ করছেন। অনেক অনুরোধ করে তাকে নিয়ে আসা হয়েছে এখানে।

কাজ করতে যেয়ে দু-একদিনের মধ্যেই টের পেলাম, রঞ্জনদা সম্পর্কে যতটুকু যা শুনেছি গত কয়েক দিনে, তাতে অতিরঞ্জন তেমন কিছু নেই। নিউজ এডিটর হিসেবে খুবই মেধাসম্পন্ন। মানিক ভাইয়ের সঙ্গে তুলনা করলে, দুজন দুই মেরুর মানুষ। মানিক ভাই ছিলেন অস্থির প্রকৃতির, আর রঞ্জনদা ধীরস্থির।

নব অভিযানে রঞ্জনদার সঙ্গে আমার তেমন বেশি দিন কাজ করার সুযোগ হয়নি। পরে অবশ্য দৈনিক আল আমিন-এ তার সঙ্গে আবার কাজ করেছি। সেটা আরো পরের কথা।

এখন বরং বলা যাক, আমার নব অভিযান ছাড়ার কাহিনি।

নব অভিযান ত্যাগ করতে হবে- এমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এখানে যোগ দেওয়ার দুই মাসের মধ্যেই। কিন্তু যাবটা কোথায়? কে নেবে আমাকে? কেউ-ই চেনে না, কারো সঙ্গে তেমন একটা পরিচয় পর্যন্ত নেই। মাঝে দুবার অবশ্য সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হলো আলম রায়হানের কারণে। তৃতীয় প্রচেষ্টার সফলতার আগে বরং প্রথম দুবারের কথা বলে নিই।

ডেস্কে আখতার ভাই আমার কাজে খুবই সন্তুষ্ট ছিলেন। একদিন আমি একটু আগেই অফিসে গেছি। যেয়ে দেখি আমারও আগে এসে বসে আছেন আখতার ভাই। কাছে ডেকে নিয়ে নানা বিষয়ে খুঁটিনাটি কথা বললেন। বিয়ে করেছি, সংসার আছে- এসব বিষয় তিনি আগেই জানতেন। জেনে কিছুটা অবাকই হয়েছিলেন। তার ধারণা ছিল, আমার বয়স খুবই কম, বড় জোর ২৩-২৪। আসলে তখন আমার ৩০ বছর। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য এই, বয়সের তুলনায় অনেকটাই কম মনে হতো আমাকে। আখতার ভাইয়ের বিস্ময়ের আরেকটা কারণ ছিল যে, তিনি আমার চেয়ে সাত আট বছরের বড় হওয়া সত্ত্বেও তখনো বিয়ে করেননি।



 





তিনি বললেন, এখানে কাজ করে তো আপনার সংসার চলবে না। অন্য কোথাও কি চেষ্টা করেছেন?

আমি না-সূচক মাথা নাড়লাম।

: দৈনিক আজাদ-এর অফিসটা চেনেন?

আমি চিনতাম, ঢাকেশ্বরী রোডে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন ওই রাস্তা দিয়ে প্রায় প্রতিদিনই লালবাগ যেতাম, টিউশনি করাতে।

: ওখানে যাবেন, সাইফুল ইসলাম তালুকদারের সঙ্গে দেখা করবেন। সে আমাদের ইউনিয়ন করে। তাকে আমার কথা বলবেন।

আমি আস্তে করে বললাম, আজাদের অবস্থা কি আমাদের চেয়ে ভালো?

: না, ভালো না। আমাদের মতোই। কিন্তু ওটার নাম আর পরিচিতি নব অভিযানের চেয়ে বেশি। আর ওদের বেতনটা রেগুলার। ওখানে একবার ঢোকেন, তারপর ওখান থেকে অন্য কোথাও যাওয়া সহজ হবে।

পরের দিনই চলে গেলাম ঢাকেশ্বরী রোডে দৈনিক আজাদ অফিসে। দেখা করলাম সাইফুল ইসলাম তালুকদারের সঙ্গে। আমাকে দেখে প্রথমে তিনি কিছুটা বিরক্তই হলেন। আখতার ভাইয়ের কথা বলতেই নরম হলো তার চেহারা। তার পরও সংক্ষেপে জানালাম আমার আকাক্সক্ষার কথা। তিনি বললেন, এখন তাদের ওখানে কোনো স্কোপ নেই। পরে যদি কখনো হয় জানাবেন।

জানতে চাইলাম, আমি মাঝে মাঝে এসে খোঁজ নেব কি না।

: না, তার দরকার হবে না। কিছু হলে আমিই জানাব।

‘কিছু হলে আমিই জানাব’- এই কথার অর্থ আমি পরে হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেছি। বহুবার দেখেছি অনেককে এমন কথা বলতে। তাদের কেউই যে পরে আর নিজে থেকে কারোকে কিছু জানাননি, সেটাও দেখেছি এই চর্মচক্ষেই।

ফিরে এসে বিষয়টা আদ্যোপান্ত জানালাম আখতার ভাইকে। সব শুনে তিনি যে কিছুটা বিরক্তই হলেন, তা টের পেলাম। দ্বিতীয়বার জিজ্ঞাসা করলেন, সাইফুল এসব কথা বলল?

: হ্যাঁ, বললেন তো।

তিনি আর কিছু বললেন না।

দ্বিতীয় ব্যর্থ প্রচেষ্টার উদ্যোক্তা মলয়। মলয় উদ্যোক্তা হলেও তাকে কারণ বলা যাবে না। তার কারণে ব্যর্থ হয়নি, সে চেষ্টা করেছিল ঠিকই।

এক সকালে মলয় জানাল, দৈনিক সমাচার নামে একটা পত্রিকা আছে। ওটি বেশ নতুনভাবে বের হবে, টাকা-পয়সাও আছে ভালো। যাবেন ওখানে?

আমার তো না যাওয়ার কোনো কারণ নেই। কিন্তু কিভাবে কার মাধ্যমে যাব-সেটাই তো জানি না।

মলয় বলল, নেরু ভাইকে চিনেন তো? তিনিই সব ঠিকঠাক করছেন।

নেরু ভাই নব অভিযানের পাশাপাশি সমাচারেও কাজ করেন। সেখানে এখন তিনিই সব।



 





নেরু ভাইকে চিনতাম। পুরো নাম মশিউর নেরু। এই ভদ্রলোক নব অভিযানের একজন রিপোর্টার। তাকে চিনতাম, কিন্তু ব্যক্তিগত পর্যায়ে কথাবার্তা তেমন হয়নি। তাকে দেখে তেমন চৌকস কখনো মনে হয়নি। এমন একজন লোক, কিভাবে একই সঙ্গে দ্ইু পত্রিকায় কাজ করে, আবার সমাচারের মতো পত্রিকার নবযাত্রায় রীতিমতো নেতৃত্ব দিচ্ছে- আমি হিসাব মিলাতে পারছিলাম না।

কিন্তু তখন হিসাব মেলানোর চেয়ে বেশি দরকার আমার একটা নতুন চাকরি পাওয়া। তাই অত কিছু হিসাব-নিকাশ না মিলিয়ে এক সকালে মলয়ের সঙ্গে চলে গেলাম মিটফোর্ডে। ওখানেই ছিল তখন সমাচারের অফিস। যেয়ে দেখলাম, নেরু ভাই খুবই ব্যস্ত। একে এই দায়িত্ব দিচ্ছে, ওকে ওই দায়িত্ব দিচ্ছে। মলয় সেখানে ঢোকামাত্র তাকে বলল, এত দেরি করলেন কেন? তারপর তাকে কী কী করতে হবে তা বুঝিয়ে দিলেন।

এর মাঝে মলয় একবার আমাকে দেখালেন, বললেন, মাসুদকে নিয়ে এসেছি।

নেরু প্রথমে আমাকে যেন দেখতেই পেলেন না। নাছোড়বান্দার মতো মলয় দ্বিতীয়বার বলার পর বললেন, এখন তো আর সুযোগ নেই। দেখি পরের ধাপে নেওয়া যায় কি না।



 





মলয় আমাকে সান্ত¦না দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, চিন্তা করবেন না, এখানে আপনার হবে। আমি নেরুকে বুঝিয়ে বলব।

আমি জানি মলয় আমার জন্য বলবে। প্রয়োজনে একবার নয়, একাধিকবার বলবে। কিন্তু তত দিনে এতটুকুও বুঝতে শিখেছি যে, এখানে আমার হবে না। মলয়ের জন্য আমার মায়া হতে থাকল।

এভাবে মলয় আমার আগেই নব অভিযান ছাড়ল।

একদিন দুপুরের দিকে অফিসে বসে কী যেন একটা অনুবাদ করছি। পুরো নিউজ রুমে বলতে গেলে আমি একা। এমন সময় ঢুকলেন আলম রায়হান। রিপোর্টারদের জন্য এটা খুবই অসময়। তাই তাকে দেখে কিছুটা অবাকই হলাম। তিনি তার ডেস্কে বসে কী সব কাগজপত্র গোছালেন। কয়েক মিনিট পর উঠলেন। এলেন আমার কাছে, বললেন, কী করছেন?

-এই একটা নিউজ লিখছি।

-চলেন একটু নিচ থেকে ঘুরে আসি।

ভাবলাম, নিচে যে চায়ের দোকান আছে, ওখানেই বোধ করি যেতে বলছে। আমি উঠলাম। নিচে নেমে উনি রিকশা নিলেন। বললেন, ওঠেন।

আমি ইতস্তত করতে লাগলাম।

: কোথায় যাবেন?

: এই তো কাছেই। ওঠেন।

: কখন ফিরবেন?

প্রশ্ন করছি বটে, কিন্তু ততক্ষণে আমি রিকশায় উঠে বসেছি। আসলে ভদ্রলোকের বলার মধ্যে এমন একটা জোর ছিল যে, বেশিক্ষণ তা উপেক্ষা করা যায় না।

রিকশা চলতে শুরু করতেই তিনি বললেন, চাকরি করবেন? আপনার জন্য একটা চাকরি ঠিক করেছি। চলেন ওখানে আপনাকে নিয়ে যাই।

আমি চুপ করে থাকলাম, কিছু বললাম না।

: আচ্ছা, এখানে আপনি কত পান?

: ১২০০ টাকা।

: ঠিক আছে, বেতন এর চেয়ে বেশি হবে।

: কিন্তু এখানে আমি তো একটা কাজ ফেলে এসেছি। অর্ধেক অনুবাদ করেছি, বাকিটা করে আসি।

: তার তো আর কোনো দরকার নেই। আপনি তো আর এখানে আসবেনই না। তাই ওই কাজটা অর্ধেক হলো কি পুরোটা হলো-তাতে কি আসে যায়?

আমার আর বলার কিছু থাকল না। বুঝতে পারলাম না, কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আমাকে। কী কাজ-ই বা করতে দেওয়া হবে। আর পারব কি না কে জানে?

আলম ভাই যেন আমার মনের কথা পড়তে পারলেন। বললেন, গল্প লেখতে পারেন?



 





-টুকটাক জীবনে দু-একবার লিখেছি? কিন্তু কেন?

-ওই ওতেই চলবে।

রিকশা যেয়ে থামল মতিঝিলে। ৫৫ মতিঝিল, শরীফ ম্যানশন। সিঁড়ি দিয়ে হেঁটে তিনতলায় উঠলাম। যে অফিসটায় ঢুকলাম, তার দরজায় লেখা ‘মোয়াজ্জেম গার্মেন্ট লি.।’ ভেতরে ঢোকার পর ছোট আর একটা সাইনবোর্ড দেখলাম, তাতে ‘প্রিন্স কর্পোরেশন’ বা এই ধরনের কিছু একটা লেখা ছিল। বুঝতে পারলাম না, গার্মেন্টে আমার কী কাজ? আর এ রকম প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গল্প লিখতে পারা না পারারই বা কী সম্পর্ক থাকতে পারে?

অব্যক্ত সব প্রশ্নেরই জবাব পেয়ে গেলাম কিছুক্ষণের মধ্যে। ওটা আসলে সাপ্তাহিক সুগন্ধার অফিস। সাপ্তাহিক এই পত্রিকাটি এর আগেও দু-একবার দেখেছি। দেখেছি আলম ভাইয়ের হাতেই, নব অভিযান অফিসে। সেখানে পত্রিকার প্রিন্টার্স লাইনে ছাপা ছিল আলম রায়হান নামটি-চিফ রিপোর্টার হিসেবে। তখন একবার তাকে জিজ্ঞাসাও করেছিলাম, আপনি দুই জায়গায় চাকরি করেন?

: কেন, আপনার কি মনে হয় এই নব অভিযানের টাকা দিয়ে আমার সংসার চলে?



 





সেই সুগন্ধায় নিয়ে এসেছেন আলম ভাই। কিন্তু সম্পাদক, সহকারী সম্পাদক হিসেবে যাদের নাম দেখেছি ওই পত্রিকাটিতে, তেমন কাউকে তো চোখে পড়ছে না। আলম ভাই ছাড়া ওখানে সাংবাদিক ধরনের আর কাউকে দেখলাম না। ওই অফিসে ঢুকেই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন আলম ভাই। আমাকে সুগন্ধার পুরোনো একটি সংখ্যা ধরিয়ে দিয়ে বললেন, এটি পড়েন। দেখেন আমাদের স্টাইলটা। এই স্টাইলটাকেই অনুসরণ করতে হবে।

আগের সংখ্যাটি পড়তে পড়তে আমি শুনছিলাম আলম ভাই ও সেখানে কর্মরত অন্যদের কথাবার্তা। অল্প সময়েই সবকিছু স্পষ্ট হয়ে গেল। সুগন্ধার মূল ব্যক্তি যারা, তারা হঠাৎ করেই আজ সকালে চাকরি ছেড়ে বের হয়ে গেছে। বের হয়ে গেছে তারা নতুন একটা পত্রিকা প্রকাশ করতে। ওটির নাম সূর্যোদয়। এমন এক সময়ে গেছে তারা, যখন সুগন্ধা প্রকাশের নির্ধারিত দিনের আর মাত্র দুদিন আছে। এ রকম সময়ে সুগন্ধার মালিক চাইলেও নতুন লোক নিয়ে পত্রিকাটি বের করতে পারবেন না। পত্রিকার সবাই একসঙ্গে চলে গেলেও যাননি কেবল আলম ভাই। তিনিই দায়িত্ব নিয়েছেন পত্রিকাটি বের করার।

আলম ভাইয়ের কর্মতৎপরতা দেখে মনে হলো, ম্যাগাজিনের গুণগত মান নয়, এ মুহূর্তে তার প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে যেনতেন প্রকারে নির্ধারিত দিনে পত্রিকাটিকে বাজারে দেওয়া। তিনি হন্যে হয়ে খুঁজতে লাগলেন, পুরোনো কোনো ট্রেসিং আছে কি না, অথবা কারো লেখা কোনো কপি আছে কি না। খুব বেশি একটা পেলেন না। পেলেন কেবল রামকৃষ্ণ সাহা নামের এক লেখকের কিছু হাতে লেখা কাগজ। এই লোকের লেখা ধারাবাহিকভাবে ছাপা হতো সুগন্ধায়। প্রতি সংখ্যায় এক পৃষ্ঠা করে। তিনি প্রায় তিন পৃষ্ঠার মতো লেখা কম্পোজ করতে পাঠালেন। তারপর পুরোনো পত্রিকা থেকে কিছু লেখা কেটে কেটেও দিলেন কম্পোজ করতে। এভাবে রীতিমতো জোড়াতালি দিয়ে ৩২ পৃষ্ঠার প্রয়োজনীয় ম্যাটার জোগাড় করতে নামলেন। নতুন করে লেখলেন কেবল, কাভার স্টোরিটি। এ কাজটি তিনি নিজেই করলেন। আমাকে বললেন, একটা সম্পাদকীয় লিখতে।

আলম ভাই কথাটি এমনভাবে বললেন, যে কাজটি খুবই সহজ। কিন্তু আমি বুঝতে পারলাম না ঠিক কোন বিষয়ের ওপর লিখব সম্পাদকীয়।

সে অনুযায়ী আমি জানতে চাইলাম আলম ভাইয়ের কাছে, তিনি ব্যস্ত ছিলেন। বললেন, লিখে দিন যা কিছু একটা।

আমি ওনাকে আর বিরক্ত করলাম না। লিখতে বসলাম। আমার জীবনের প্রথম লেখা সম্পাদকীয় সেটা। এর আগে নব অভিযানে যা কিছু কাজ করেছি, সেখানে সম্পাদকীয়র মতো কিছু ছিল না। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সাপ্তাহিক পত্রিকায় সম্পাদকীয় পড়েছি, সে অনুযায়ী লিখলাম একটা। আলম ভাইয়ের সামনে দিলাম। কিন্তু উনি ভালোভাবে দেখলেন বলেও মনে হলো না।



 





প্রথম দিন কাজ বলতে করতে হলো অতটুকুই। সন্ধ্যার দিকে চলে এলাম বাসায়। অফিস ত্যাগের আগে আলম ভাই জানিয়ে দিলেন আমার বেতনের বিষয়টি। বললেন, ওখানে তো ১২০০ টাকা পেতেন। এখানে পাবেন ১৮০০ টাকা। চলবে?

সন্দেহ নেই, আমি খুশি হলাম। খুবই খুশি। আগে যেখানে সারা মাস গাধার খাটুনি খেটে পেতাম ১২০০ টাকা, এখন সেখানে পাব তার দেড় গুণ।

শুরু হলো আমার সুগন্ধার চাকরিজীবন।







লেখক পরিচিত : মাসুদ কামাল বর্তমানে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল বাংলাভিশনের সিনিয়র নিউজ এডিটর। ১৯৯০ সালে দৈনিক নব অভিযান পত্রিকা দিয়ে শুরু হয় তার সাংবাদিকতা জীবনের। এরপর কাজ করেন সাপ্তাহিক সুগন্ধা, দৈনিক আল আমিন, দৈনিক জনকণ্ঠ, দৈনিক আমার দেশ, দৈনিক যায়যায়দিন পত্রিকায়।