ঢাকা: আজ ২৫ রমজান, বৃহষ্পতিবার। দিনের অবসানে পবিত্র জুমাবার। জু’মাতুল বিদা’ বা পবিত্র রমজান মাসের বিদায়ের বার্তাবাহী জুমা। মুমিন মুসলমানগণ পরম আহ্লাদ ও বিশেষ মর্যাদায় পালন করে থাকেন এ দিবসটি। রমজানুল মুবারক ক্রমাগত শেষ হয়ে আসলে এ দিবসের প্রতি তারা বিশেষ আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকে। এমনিতেই ইসলাম ধর্মে জুমা বা জুমা দিনের গুরুত্ব অনেক বেশি। দুনিয়ার অনেক উত্তান-পতন ও ঘটনার কালসাক্ষী এটি। পৃথিবী সৃষ্টি হয় এই দিনে। কিয়ামত ও এই দিনে সংঘটিত হবে বলে বিখ্যাত তাফসীর ‘ইবনে কাসীর’থেকে জানা যায়। এই দিনের জুমার সালাত ও খুৎবাকে গরিবের হজ বলা হয়ে থাকে । হাদীস শরীফে এসেছে , এই দিন এমন একটি মুহূর্ত আছে, যাতে মানুষ যে দোয়াই করে কবুল হয়।’ আমরা সারাদিন পূতঃপবিত্র থেকে ইবাদত- বন্দেগী আন্জাম দেয়ার মাধ্যমে সে মুহূর্তটি লাভ করতে পারি।
রহমত মাগফিরাত ও নাজাতের মাস রমজানে জুমা’র দিবসের গুরুত্ব বহুগুণে বেড়ে যায়। কারণ, এ মাসের প্রতিটি নেক কাজের সাওয়াব অন্য এগারো মাসের তুলনায় অত্যধিক। বিশেষ করে এ মাসের সমাপনী জুমার আবেদন যে কোন জুমার তুলনায় মুমিন মনে দাগ কাটে বেশি। এজন্য দেখা যায়, এদিন জুমার সালাতে প্রধান প্রধান মসজিদসমূহে মুসল্লিদের ঢল নামে; রাজপথ হয় লাখো মুমিনের জায়নামাজ। মাহে রমজানের সামাজিক ও ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে এ এক মনোমুগ্ধকর সংস্কৃতি।
পবিত্র জুমাতুল বিদার মর্যাদা ও গুরুত্ব বৃদ্ধির পেছনে তিনটি কারণ মুখ্য বলে ওলামাগণ মনে করেন। প্রথমত এই দিন পবিত্র রমজানুল মুবারককে আনুষ্ঠানিক বিদায় জানানোর একটি হৃদয় কাড়া ঐতিহ্য রয়েছে। দ্বিতীয়ত এদিন বিভিন্ন স্থান ও পরিস্থিতি ভেদে সাদকাতুল ফিতরের পরিমাণ ঘোষণা করা হয় এবং তৃতীয়ত এদিন মসজিদে মসজিদে আসন্ন পবিত্র ঈদ-উল-ফিতরের করণীয় সম্পর্কে ওয়াজ- নসীহত করা হয়।
এ সময় ফিতরা দান একটি অত্যাবশ্যকীয় ইবাদত ও দায়িত্ব। রোজা ও নামাজ মুসলমানদের দৈহিক ইবাদতের অন্তর্গত, হজ হল দৈহিক ও আর্থিক ইবাদত। আর যাকাত, ফিৎরা দান হলো আর্থিক ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। রমজানের পূর্ণতা ও সিয়াম সাধনায় তাওফীক দানের কৃতজ্ঞতা স্বরূপ আল্লাহর নামে সাদকাতুল ফিতর আদায় করতে হয়। এ মাসের ইবাদত বন্দেগীতে আমাদের অনিচ্ছাকৃত যে সব ভুলত্রুটি হয়েছে তা পুষিয়ে নেয়ার জন্য কাফ্ফারা স্বরূপ শরীয়তে এ ফিতরা দান ওয়াজিব হয়েছে।
পবিত্র ঈদ-উল-ফিতরের দিন সকালে যাদের কাছে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার সমপরিমাণ টাকা অথবা সাড়ে সাত তোলা সোনা বা সমপরিমাণ টাকা কিংবা অনাবশ্যক আসবাবপত্র থাকে এবং উক্ত ব্যক্তি ঋণগ্রস্ত না হয়, তার ওপর ফিৎরা দান ওয়াজিব হয়ে পড়ে। নিজের এবং নাবালক সন্তানদের ফিৎরা আদায় করতে হয়। মিসকিন, ঋণী ব্যক্তি কিংবা মুসাফিরকে ফিৎরা দেয়া যায়। গরিব আত্মীয়দের মাঝে বন্টন করা উত্তম।
আসলে রমজানের শুরুতে এবং শেষ পর্যায়ে সামর্থ্যবানদের উচিত দান-সদকা, যাকাত ফিৎরা দানে অত্যধিক উদার ও রহমদিল হওয়া। এ সময় ধনীদের হাতে বিভিন্ন খাত হতে পয়সা আসে, পক্ষান্তরে অভাবীদের অভাবের মাত্রা বেড়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতেই ধনিকশ্রেণীর উদ্দেশে নজরুল বলেছিলেন :
‘বুক খালি করে আপনাদের আজ দাও যাকাত
করো না হিসাবী আজ হিসাবের কর্ণপাত
একদিন করো ভুল হিসাব...।’
মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার পর ঈদ-উল-ফিতর হলো রোজা ভাঙ্গার উৎসব। নামেই বুঝা যায়, এদিন কোন সচারাচর আনন্দোৎসবের দিবস নয়, এ হলো রোজাদারের সাধনার সুফলের বহির্প্রকাশ, সিয়ামের মাসের বহুবিধ শিক্ষা প্রতিফলনের পহেলা মঞ্জিল; খুশি ও ইবাদতের সমান্বিত এক নির্মল আনন্দধারা।
একইভাবে সত্যিকারের ঈদের আনন্দ রোজাদারের আমল বৃদ্ধি করে, নাজাতের পথকে করে সুগম। ঈদের (পূর্ব) রাতকে ইসলাম ঘোষণা করেছে পুরষ্কার বিতরণের রজনী হিসেবে। ঈদ-উল-ফিতর প্রসঙ্গে বিখ্যাত সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাদি) এক দীর্ঘ হাদীসে বর্ণনা করেন : যখন ঈদের সকাল নামে মহান আল্লাহ প্রতিটি দেশে দেশে ফেরেস্তা প্রেরণ করেন। তাঁরা অবতরণ করে পথের ধারে দাঁড়িয়ে থাকেন। তাঁরা ডাকতে থাকেন। তাঁদের আহ্বান মানুষ ও জ্বীন ব্যতীত আল্লাহর সব মাখলুকই শুনতে পায়। তাঁরা বলেন : ওহে উম্মতে মুহাম্মাদী! বের হয়ে এসো অতি মর্যাদাবান প্রতিপালকের নিকট। তিনি অধিক পরিমাণে দান করে থাকেন। আর মারাতœক অপরাধও ক্ষমা করেন....।’
সত্যিকার অর্থে রোজা শেষে আমদের সামনের ঈদ যেন বরকতময় এবং আনন্দময় হয় সেজন্য সামনের বাকি কয়েকটি দিন ধৈর্যের সঙ্গে অতিবাহিত করতে হবে, অঞ্জলি ভরে গ্রহণ করতে হবে কালকের জুমাতুল বিদার ফযিলত ও একই সঙ্গে শব-ই-ক্বদরের অফুরন্ত সওয়াব ও বরকত।
অধ্যাপক মনিরুল ইসলাম রফিক