নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে বিএনপি-জামায়াত জোটের আন্দোলনের সময় ঢাকা মহানগর বিএনপির ‘ব্যর্থতা’ নিয়ে কথা হয়েছে বিএনপির ভেতরে- বাইরে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ঠেকাতে না পারার জন্য রাজধানীতে কার্যকর কিছু করতে না পারাকেই দায়ী করছেন খোদ বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এ নিয়ে দলের শীর্ষ নেতাদের প্রতি অসন্তোষও জানিয়েছেন তিনি। আর ভোটের পর ঢাকা মহানগর কমিটি ভেঙে দিয়ে গঠন করেছিলেন আহ্বায়ক কমিটি।
আহ্বায়ক কমিটি করার পেছনে পরিকল্পনা ছিল এমন- ঢেলে সাজবে মহানগর বিএনপি, আন্দোলনের কর্মসূচি দেবেন খালেদা জিয়া আর সেসব কর্মসূচিতে ব্যাপক লোকসমাগম নিশ্চিত করে ঢাকা অচল করে দেবেন নেতারা আর এর মধ্য দিয়ে বিএনপি তথা ২০ দলের দাবি মেনে নেবে সরকার। কিন্তু সে আশার গুড়েবালি। যে তিমিরে ছিল ঢাকা মহানগর বিএনপি, এখনও আছে সে পর্যায়েই। বরং আহ্বায়ক কমিটি করার পর দলের ভেতরে দ্বন্দ্ব আর নেতাদের মধ্যে বেড়েছে মান অভিমান। আহ্বায়ক কমিটির প্রধান মির্জা আব্বাসকে দলের একাংশ মানলেও ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র (মহানগর বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক) সাদেক হোসেন খোকার অনুসারীরা মেনে নিচ্ছেন না তাকে। এই দুই পক্ষের দ্বন্দ্ব ছাড়াও অতীতের নানা কর্মকা-ের কারণে দলের সব পর্যায়ে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছেন না মির্জা আব্বাস। এসব কারণে মহানগর বিএনপি ঢেলে সাজাতে দেওয়া দায়িত্ব পালনে ব্যর্থই হয়েছেন বলা চলে তিনি।
গত ৫ জানুয়ারি ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস ও বাংলাদেশের ইতিহাসের কালো দিন’ উদযাপন উপলক্ষে ঢাকায় মহাসমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছিল বিএনপি। এই দিন ব্যাপক লোকসমাগমের মাধ্যমে ঢাকায় শক্তি প্রদর্শনই ছিল বিএনপির মূল লক্ষ্য। এজন্য প্রধান দায়িত্ব পালন করার কথা ছিল ঢাকা মহানগর বিএনপির। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই করতে পারেনি তারা। কর্মসূচির আগের দিন থেকে রীতিমতো উধাও ঢাকা মহানগর বিএনপির দুই শীর্ষ নেতা সংগঠনের আহ্বায়ক মির্জা আব্বাস এবং সদস্য সচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেল। এ সময় গুলশান কার্যালয়ে অবরুদ্ধ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কাছেও ঘেঁষার চেষ্টা করেননি কোনো নেতা। খোঁজ মেলেনি কর্মীদেরও। আর এর ফলে ঢাকায় কার্যত বিএনপির অবরোধ ও আন্দোলনে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।
৪ জানুয়ারি রাত থেকে নিজ কার্যালয়ে অবরুদ্ধ আছেন খালেদা জিয়া, দুদিন পর জাতীয় প্রেসক্লাব এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হন দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। আরেক শীর্ষনেতা যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আছেন আত্মগোপনে। এ অবস্থায় দলের অন্য শীর্ষনেতাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে সমন্বয়হীনতা।
বিএনপির সাধারণ নেতা-কর্মীরা বলছেন, দলের এই সংকটকালে যাদের দায়িত্ব পালন করার কথা ছিল তারা পুরোপুরি ব্যর্থ। তারা নিজেদের গা বাঁচিয়ে চলছেন এবং গ্রেপ্তার হওয়ার ভয়কে অজুহাত দেখাচ্ছেন।
পুলিশের ভয়ে নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ে যেতে না পেরে পাশের গলি থেকে সব পর্যবেক্ষণ করছিলেন সবুজ নামে এক কর্মী। তিনি বলেন. ‘রাজধানীতে ঢাকা মহানগর বিএনপি আন্দোলন গড়ে তুলবে, সমাবেশ-মিছিল করবে আর এতে এর শীর্ষ দুই নেতা নেতৃত্ব দিবেন এটাই সবাই আশা করে। অথচ তারা নিজেরাই উধাও হয়ে গেছেন। এখন যদি সাধারণ কর্মীরা রাজপথে নেমে না আসে তবে এর দায়ভার কার।’
সবুজের সঙ্গে থাকা আরেক কর্মী বলেন, ‘নগর বিএনপিতে যে দুইজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তারা নিজেদের কথা ছাড়া অন্য কারো কথা এমনকি দলের কথাও চিন্তা করে না। ফলে তারা রাজপথে নেই। আর এর ফল বিএনপিকে ভোগ করতে হচ্ছে।’
গত কয়েকদিনে ক্রমাগত চেষ্টা করেও মির্জা আব্বাস এবং হাবিব-উন-নবী খান সোহেলের বক্তব্য সংগ্রহ করা যায়নি। এমনকি খোদ দলের নেতা-কর্মীরাই তাদের হদিস পাচ্ছেন না। এর ফলে সাধারণ নেতা-কর্মীদের মধ্যে তৈরি হয়েছে সন্দেহ, দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন।
দায়িত্ব ভুলে গেছেন আব্বাস-সোহেল?
সরকারবিরোধী আন্দোলন জোরদারের ঘোষণা দিয়ে গত বছরের ১৮ জুলাই অনেকটা ঢাকঢোল পিটিয়ে গঠন করা হয় ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি। কথা ছিল এক মাসের মধ্যে ওয়ার্ড বিএনপির কমিটিগুলো পুনর্গঠন করে খালেদা জিয়ার কাছে জমা দেবে এই কমিটি এবং এরপর দুই মাসের মধ্যে গঠন করা হবে পূর্ণাঙ্গ কমিটি।
কিন্তু আহ্বায়ক কমিটির প্রধান মির্জা আব্বাস এবং সদস্য সচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেলের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে দল পুনর্গঠনের কোনো কাজই আগায়নি এতটুকু। সোহেল মূলত মহানগর বিএনপির সাবেক সভাপতি সাদেক হোসেন খোকার অনুসারী। খোকার অনুসারীরা তাদের পছন্দের নেতাদের কমিটিতে বসাতে চাইলেও আব্বাসের অনুসারীরা তাদের মেনে নিতে রাজি হচ্ছেন না।
আহ্বায়ক কমিটির কার্যক্রম কেবল বৈঠক, যৌথসভা ও আলোচনা সভার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। সাদেক হোসেন খোকার সমর্থকরা তখন বলছিল, এই কমিটির চেয়ে আগের কমিটিই ভালো ছিল। তারা শুধু মুখেই সরকার বিরোধী আন্দোলনের কথা বলছে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আন্দোলনের কোনো কার্যক্রম নতুন কমিটি হাতে নেয়নি। যদি সরকারবিরোধী আন্দোলনের মন-মানসিকতা তাদের থাকত তাহলে খালেদা জিয়ার নির্দেশে এক মাসের মধ্যেই ওয়ার্ড কমিটিগুলো তারা পনর্গঠন করত।
এক মাস এবং দুই মাসের সময়সীমা পার হয়েছে সেই কবে, এরপর আব্বাস এবং সোহেল এ নিয়ে একাধিকবার বলেছেন, তারা চেয়ারপারসনের কাছে সময় নিয়েছেন। কিন্তু সেই বর্ধিত সময়ও শেষ হয়েছে।
৫ জানুয়ারি উধাও নেতা-কর্মীরা
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এক বছর পূর্তিতে ৫ জানুয়ারি রাজধানীতে পুলিশের অনুমতি না পেলেও সমাবেশের ঘোষণা দিয়েছিল বিএনপি। কিন্তু পুলিশের কঠোর অবস্থানের কারণে তা করতে পারেনি বিএনপি। গুলশান কার্যালয়ে খালেদা জিয়াকে অবরুদ্ধ করে সেখান থেকে বের হতে বাধা দেয় পুলিশ। নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়েও কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।
নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলনের মতোই ৫ জানুয়ারি ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় বিএনপি এবং জামায়াতের কর্মীরা সর্বশক্তিতে চেষ্টা করেছে কর্মসূচি পালনের। এটি করতে গিয়ে পুলিশ আর আওয়ামী লীগ কর্মীদের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষেও জড়িয়েছে তারা। নাটোরে আওয়ামী লীগ কর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিতে প্রাণ হারিয়েছে দুইজন এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ আর রাজশাহীতে প্রাণ হারিয়েছে একজন করে। সংঘর্ষ হয়েছে আরও বিভিন্ন এলাকায়ও। কিন্তু আগের মতোই নিষ্ক্রিয় ছিল ঢাকা মহানগর বিএনপি। ওইদিন সন্ধ্যায় খালেদা জিয়া অবরোধ ডাকলেও তার পক্ষেও রাজধানীতে বিএনপির বলার মতো কোনো অংশগ্রহণ নেই, ফলে প্রথম দিন সড়কে যান চলাচল কম থাকলেও দ্বিতীয় দিন থেকে বাড়তে থাকে তা আর তৃতীয় দিনে রাজধানীর মোড়ে মোড়ে তৈরি হয় যানজটও।
এ অবস্থায় ৫ জানুয়ারি আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করছেন খোদ বিএনপির নেতা-কর্মীরাই। একাধিক কর্মী বলেন, ঢাকা মহানগর বিএনপির কোনো নেতা-কর্মীর মধ্য যোগাযোগ নেই, আছে শুধু দ্বন্দ্ব। সবাই পদ-পদবি পাওয়ার জন্য একে অপরের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে। তারা যদি নিজেরা নিজেরাই যুদ্ধ করে তাহলে সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে কিভাবে?
ঢাকা মহানগর বিএনপির এক উপদেষ্টা বলেন, ‘নগর বিএনপির নেতারা শুধু পদ-পদবি চেয়েছিলেন, আন্দোলন নয়। আর তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল পদ নিয়ে সরকারের সাথে লেজুড়বৃত্তি করে নিজেদের গা বাঁচিয়ে চলা। তাই তাদের কাছে ঢাকা মহানগর বিএনপির আন্দোলন মূল বিষয় ছিল না।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য রফিকুল ইসলাম মিয়া বলেন, ‘মির্জা আব্বাস ও হাবিব-উন-নবী খান সোহেলকে কেন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না তা আমার চেয়ে সাংবাদিক বন্ধুরাই ভালো জানেন। তাই এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না।’
দলের স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য আ স ম হান্নান শাহ বলেন, ‘বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে কারণে-অকারণে মিথ্যা ও বানোয়াট মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। আর রাজপথে নামলেই কোনো কথা না বলেই গুলি করা হচ্ছে। ফলে নেতা-কর্মীরা রাজপথে না থাকাটাই স্বাভাবিক।’
ছাত্রদল কোথায়?
নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলনের সময় কেবল ঢাকা মহানগর বিএনপি নয়, নিষ্ক্রিয়তার জন্য খালেদা জিয়া রুষ্ট হয়েছিলেন ছাত্রদল নেতাদের ওপরও। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর সংগঠনের নেতা-কর্মীদের ডেকে নিয়ে তুলোধুনোও করেন বিএনপি চেয়ারপারসন। এরপর অক্টোবরের মাঝামাঝি রাজিব আহসান সভাপতি আর আকরামুল হাসানকে সাধারণ সম্পাদক করে ঘোষণা করা হয় ২০১ সদস্যের কমিটি।
এই কমিটি ঘোষণার পর ছাত্রদলের কর্মীরা রাজপথে নেমে ‘দুর্বার’ আন্দোলন শুরু করেন। তবে সরকারের বিরুদ্ধে নয়, এই কর্মীদের আন্দোলন ছিল পদ না পেয়ে খোদ নিজ দলের নেতাদের বিরুদ্ধে। দলের বেশ কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে টাকা নিয়ে কমিটিতে নাম দেওয়া, সরকারের সঙ্গে দালালির অভিযোগ এনে রাজধানীতে তাদের বিরুদ্ধে মিছিল-সমাবেশ করেছে পদবঞ্চিত এই নেতা-কর্মীরা। রাজপথে প্রতিদিন তাদের কর্মসূচির কারণে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয় বিএনপির নেতাদের। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত রাজপথ না ছাড়ার ঘোষণাও দিয়েছিল তারা।
নিজ দলের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়া এই নেতা-কর্মীরাও এবার সরকারবিরোধী আন্দোলনে। আত্মগোপনে আছেন সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকও।
সাপ্তাহিক-এই সময়ের সৌজন্যে।