তিন বছর আগে রবিউল হাসানের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল আঁখির। এর আগেও রবিউল বিয়ে করেছিল একটি। সেটি গোপন করে আঁখির সঙ্গে প্রেম করেন তিনি। প্রথম প্রথম চলছিল ভালোই। এর মধ্যে রবিউলের প্রথম বিয়ের খবর জেনে পেলেন আঁখি। সংসারে শান্তির কথা ভেবে মেনে নেন তাও। কিন্তু শান্তি আর থাকেনি। হঠাৎ একদিন স্বামী বলেন ৫০ হাজার টাকা এনে দিতে হবে বাপের বাড়ি থেকে। প্রথমে মুখের কথা, এরপর শুরু হয় নির্যাতন। একটি ছেলেও হলো তাদের। দেখতে দেখতে ছেলের বয়স হলো দেড় বছর। ছেলের মুখও রবিউলের টাকার চাহিদা থামাতে পারেনি।
যৌতুক না পেয়ে ১১ ডিসেম্বর ছেলে অভিউলসহ আঁখিকে বাসা থেকে বের করে দেন রবিউল। আঁখি বলেন, ‘হেয় ৫০ হাজার টাকা চায়। না দিলে প্রথম বউয়ের লগে ঘর করব। বাচ্চা পেটে থাকতে লাথিও মারছে। ৫০ হাজার টাকা না দেওয়ায় বাচ্চাসহ আমারে বাইর কইরা দিসে। ঢাকা শহরে আমার কেউ নাই। দেড় মাসের বাচ্চা দেইখা আমারে কেউ কামেও লয় না। বাচ্চারে বাঁচামু কেমনে?’
দফায় দফায় টাকা দিয়েও স্বামীর মন পাওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন নাসরিন। কিন্তু নির্যাতন আর টাকার চাহিদা দুই-ই বেড়ে চলছিল দিনে দিনে। চাহিদা মতো যৌতুকের টাকা না পেয়ে এক পর্যায়ে আঁখির মতো নাসরিনকেও বাসা থেকে বের করে দেয় শ্বশুর-শাশুড়ি ও স্বামী।
গত চার বছরে দাম্পত্য জীবনের সুখস্মৃতি মনে রাখতে পারেন না নাসরিন। তার শরীরের বিভিন্ন অংশে নির্যাতনের ক্ষতগুলো তাকে জানিয়ে দেয় কি দুঃসহ অভিজ্ঞতা ছিল তার। ২০১০ সালের জুলাই মাসে ইব্রাহিম দাড়িয়ার সঙ্গে বিয়ে হয় নাসরিনের। তার ভাষায়, ‘ব্যবসার কথা বলে টাকা নিছিল। কিন্তু আর ফেরত দেয় নাই। আমার হাতের আংটিসহ কিছু গয়না বেচে দিছি। কিছু বললেই মাইরা ফেলার হুমকি দেয়, আর মারে।’
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীকে বরাবর থাকতে হয় চাপে। ঘরে বা বাইরে মানসিক চাপের পাশাপাশি তার প্রতি যৌন বা শারীরিক নির্যাতন চলছে সভ্যতার শুরু থেকেই। পশ্চিমা সমাজে আইনের প্রয়োগে পরিস্থিতির অনেকটা উন্নতি হলেও বাংলাদেশের মতো অঞ্চল যেখানে সুশাসনের অভাব আছে, সেসব এলাকার পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি আশানুরূপ। নানা আইন করেও নিজ ঘরে আপনজনের হাতে নির্যাতন ঠেকানো যায়নি সেভাবে। স্বামীর হাতে নির্যাতনে বাংলাদেশের নারীরা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শীর্ষে রয়েছে বলে সম্প্রতি জাতিসংঘের সংস্থা ইউএন উইমেনের এক জরিপে উঠে এসেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জরিপেও দেখা যায়, ৮৭ শতাংশ গৃহবধূ স্বামীর নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।
সরকারি-বেসরকারি হিসাবে দেখা গেছে, বিগত পাঁচ বছরে সারা দেশে ৯৩ হাজার ৬৮৬টি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে।
২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে সারা দেশে নারী নির্যাতনের ঘটনায় মামলা হয়েছে ১৮ হাজার ১০০টি। শুধু রাজধানীতেই জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত নারী-শিশু নির্যাতনের ঘটনায় মামলা হয়েছে এক হাজার ৩৫৪টি। আর গত পাঁচ বছরে খুন, ধর্ষণ ও নির্যাতনের মামলা হয়েছে ২৯ হাজার ৪০৮টি। তবে বেশিরভাগ মামলার নিষ্পত্তি হয়নি।
মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরে স্বাধীনতার পর থেকে ২০১৪ সালের জুন পর্যন্ত ৩০ হাজার ৬৫৪ জন নির্যাতিতা নারী অভিযোগ করেছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত পাঁচ বছরে নির্যাতনের শিকার হয়েছে সাড়ে ২৯ হাজার।
কয়েকটি ঘটনা
রাজধানীর গুলশান থানার নগদা, কালাচাঁনপুর এলাকায় প্রতারণার অভিনব ফাঁদ পেতে এক সন্তানের জননীকে বিয়ে করার পর আট মাস ঘরে অবরুদ্ধ রেখে নির্যাতন চালান নূরু মিয়া। শারীরিক সুস্থতার সনদে সই করিয়ে নেওয়ার ছলে যথাক্রমে তালাক ও কাবিননামায় সই করিয়ে, পরিবারবিচ্ছিন্ন ওই গৃহবধূকে বন্দি করে রাখেন তিনি।
যৌতুকের দাবিতে স্বামী স্বপন মিয়া ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনের দেওয়া আগুনে দগ্ধ ১৯ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মারা যান টঙ্গীর খাদিজা আক্তার সুমী।
নির্যাতন বলতে কেবল বিবাহিত নারী নয়, বাদ যাচ্ছে না শিশু-কিশোররাও। নির্যাতনের আরেক নাম ধর্ষণ। এর শিকার প্রধানত শিশু-কিশোরীরা। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য মতে, সাত থেকে ১২ বছরের শিশুরা বেশি ধর্ষিত হচ্ছে। দিন দিন বেড়েই চলেছে এর হার। জনগণের নিরাপত্তার দায়িত্ব যাদের সেই পুলিশ ও র্যাব সদস্যদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ আছে ভুরি ভুরি।
গ্রাম বা শহর, ঘরে বা বাইরে এমনকি বাস লঞ্চেও ঘটে আক্রমণ। ঘরে ঢুকে বাবা-মা কিংবা স্বামীকে বেঁধে রেখে, রাস্তা আটকে স্বজনকে বেঁধে ধর্ষণের ঘটনাও ঘটছে। বেড়াতে গেলে ফুঁসলিয়ে শিশুদের ধর্ষণের ঘটনাও ঘটছে।
২০১৩ সালের ২৪ জানুয়ারি ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে (মানিকগঞ্জ এলাকায়) চলন্ত বাসে এক পোশাককর্মীকে ধর্ষণ করে দুই বাসকর্মী। ধর্ষণের দায়ে গত ১৩ ফেব্রুয়ারি মানিকগঞ্জের একটি আদালত বাসচালক দীপু মিয়া ও তার সহকারী কাশেম আলীকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেন।
২৩ অক্টোবর মানিকগঞ্জ সদর উপজেলায় সপ্তম শ্রেণির এক ছাত্রীর গলায় চাকু ঠেকিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ উঠার পর সজিব হোসেন নামে একজনকে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশে দেয় এলাকাবাসী। ধর্ষিতা সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হয় এবং বিয়ে হয় না বলে নানা দিক থেকে প্রতিবাদ করেও চুপসে যাচ্ছে। কিছু কিছু পরিবার প্রথমে মামলা করলেও হুমকি, লজ্জা ও ভয়ের কারণে চালিয়ে যায় না মামলা।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিচালক নূর খান বলেন, ‘নারী নির্যাতন আগেও ছিল এখনো আছে। আগে গণমাধ্যমে প্রকাশ কম হতো। এখন বেশি হচ্ছে। তাছাড়া লজ্জা বা ভয় থেকে বেশিরভাগ নির্যাতন ও ধর্ষণের বিষয়ে গোপন করে যায়। তাই আমরা সঠিক হিসাবটা এখনো পাচ্ছি না।’ তিনি বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ বিষয়ে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না। মামলা নিতে চায় না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইম্যান অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান তানিয়া হক বলেন, ‘সাধারণত নি¤œবিত্তরা নারী নির্যাতনের মতো জঘন্য কাজে বেশি ঝুঁকে পড়ছে। যাদের মধ্যে নেই কোনো নীতি, শিক্ষা কিংবা আইনি কোনো ধারণা। সবার মাঝে নীতি শিক্ষা ও আইনি ধারণা দিতে হবে।’
প্রতিরোধে উদ্যোগ চলছে সমানতালে
মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরে স্বাধীনতার পর থেকে ২০১৪ সালের জুন পর্যন্ত ৩০ হাজার ৬৫৪ জন নির্যাতিত নারী অভিযোগ করেছে। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে এক হাজার ৭৯টি। মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (জনসংযোগ) মাহমুদা বেগম বলেন, ‘আমাদের এখানে নির্যাতিতরা আসেন সহযোগিতার জন্য। কখনো দেখা যায় থানায় মামলা নিতে চায় না। তখন আমাদের কাছে এলে আমরা সুপারিশ দিলে মামলা নেয়। এসব মামলার বেশিরভাগই নিষ্পত্তি হয় না। যার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি পলাতক থাকেন। তাদের নোটিশ পাঠানো হলেও নোটিশের জবাব দেন না। ফলে এক সময় মামলাটি আদালতে চলে যায়। তখন আমাদের আর করার কিছু থাকে না।’
বেশিরভাগ সময়ে দেখা যায়, অভিযোগকারী নারীকে ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। ফলে একসময় ওই নারী আর সামনে এগুতে চান না। তবে দিনে দিনে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে বলে মনে করছেন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, আগে নারীরা নির্যাতিত হলেও মুখ বুঝে সহ্য করতেন। কিন্তু এখন নারীরা সচেতন হয়েছে। নির্যাতন হলেই আইনের আশ্রয় নিয়ে অভিযোগ করছেন। আবার অভিযোগের ভিত্তিতে নানা ব্যবস্থা নেওয়ায় অনেকে নারীদের নির্যাতন করতে ভয়ও পাচ্ছে। তবে আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করা গেলে পরিস্থিতির আরও উন্নতি সম্ভব বলে মনে করেন কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশ পুলিশ ২০০৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি তেজগাঁও থানা সংলগ্ন একটি ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার চালু করেন নির্যাতিত নারী ও শিশুদের সহায়তা দেওয়ার জন্য। গত পাঁচ বছরে এই সেন্টারটি থেকে সেবা নিয়েছে প্রায় আড়াই হাজার নির্যাতিত নারী ও শিশু।
২০১২ সালের ১৯ জুন থেকে জাতীয় হেল্পলাইন সেন্টার নির্যাতিত নারী-শিশুদের সেবা দিতে পাঁচ সংখ্যার একটি নম্বর চালু করে। নম্বরটি হচ্ছে ১০৯২১। বাংলাদেশ ও ডেনমার্ক সরকারের যৌথ উদ্যোগে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে মাল্টিসেক্টরাল কর্মসূচির আওতায় নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে নম্বরটি চালু করা হয়। সেন্টার কার্যক্রম পরিচালনা করছে ঢাকার ইস্কাটনে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর। হেল্পলাইন হিসেবে নম্বরটি দেয় বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)।
সেন্টারের পরিসংখানে দেখা গেছে, এখানে অভিযোগ নিয়ে আসাদের বেশিরভাগের বয়স ১৮ বছরের নিচে। তবে গত কয়েক বছরের তুলনায় ২০১৪ সালে এর পরিমাণ প্রথম তিন মাস কম থাকলেও শেষ দিকে অনেক বেড়েছে। ২০১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৮১২ জন সেবা নিয়েছে সেন্টারটি থেকে, যা ২০১৩ সালে ছিল ৬০৮ জন।
ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছেÑঅ্যাসোসিয়েশন ফর কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট, অ্যাসোসিয়েশন ফর কারেকশন অ্যান্ড সোশ্যাল রেক্লেমেশন, অ্যাসিড সারভাইভার্স ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট-ব্লাস্ট, মেরিস্টোপস।
উইমেন্স সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সহকারী উপকমিশনার বেগম কানিজ ফাতেমা বলেন, ‘ইদানীং অভিযোগ বেশি আসছে। সাধারণত গৃহকর্মীদের ওপর নির্যাতনের ফোন আসে বেশি। পাশের বাড়ির কেউ ফোন করে আমাদের জানায়। এছাড়া অন্যান্য অভিযোগÑযেমন ধর্ষণ, যৌতুক, অপহরণ ইত্যাদিও আসে।’
২৪ ঘণ্টাই ০১৭৫৫৫৫৬৬৪৪, ০১৭৫৫৫৫৬৬৪৫, ০১৭৩৩২১৯০০৫, ০১৭৩৩২১৯০৩০ এই নম্বরগুলো খোলা থাকে বলে জানান এই কর্মকর্তা। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে নারীদের সেবাদানে ওয়ান স্টপ ক্রাইসিসেও বহু নারী সেবা নিয়েছে।
প্রকল্প পরিচালক আবুল হেসেন জানান, ধর্ষণ, অ্যাসিড-সন্ত্রাস ও নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশের সরকারি আটটি হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসিতে) গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চিকিৎসা নিয়েছে ২১ হাজার নারী-শিশু।
অপরাজেয় বাংলাদেশ, ছোটমনি নিবাস, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, এসিএসআর, বিএনডব্লিউএলএ, মহিলা পরিষদ, ফ্যামিলি পরিষদ, ঢাকা আহছানিয়া মিশনের মতো সংগঠনগুলোও কাজ করছে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাসুদা এম রশিদ চৌধুরী বলেন, ‘ঘরেই নারীরা নির্যাতিত হচ্ছে বেশি। এ জন্য ছেলে সন্তানকে নারীদের সম্মান দিতে ঘরেই শিক্ষা দিতে হবে ছোট বেলা থেকেই।’
নারী নির্যাতন আগেও ছিল এখনো আছে। আগে গণমাধ্যমে প্রকাশ কম হতো। এখন বেশি হচ্ছে। তাছাড়া লজ্জা বা ভয় থেকে বেশিরভাগ নির্যাতন ও ধর্ষণের বিষয়ে গোপন করে যায়। তাই আমরা সঠিক হিসাবটা এখনো পাচ্ছি না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এ বিষয়ে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না। মামলা নিতে চায় না।
নূর খান
পরিচালক, আইন ও সালিশ কেন্দ্র
সাপ্তাহিক এই সময়ের সৌজন্যে