ঢাকা:২০১৪ সালে বেশ কয়েকটি আলোচিত ঘটনা ঘটে প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে। এর মধ্যে চার সচিবের মুক্তিযোদ্ধা সনদ জালিয়াতি, মুক্তিযোদ্ধার ক্রেস্টে স্বর্ণ জালিয়াতি, গুলশানে বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার সাথে আমলাদের বৈঠক, সাতজন সচিবের সিনিয়র সচিব পদে পদোন্নতি, বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা আইন সংশোধন এবং বছরজুড়ে তিন স্তরের পদোন্নতি প্রভৃতি ঘটনা ছিল বছরজুড়ে সচিবালয়ের বহুল আলোচিত ঘটনা।
চার সচিবের মুক্তিযোদ্ধা সনদ জালিয়তি
গত ১৩ অক্টোবর, জালিয়াতি করে মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়ে পদোন্নতি পাওয়া তিন সচিব ও এক যুগ্ম সচিবের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে কেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে না তা জানতে চেয়ে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এর ভিত্তিতে যেসব সচিবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে তারা হলেন স্বাস্থ্যসচিব মো. নিয়াজ উদ্দিন মিঞা, সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সচিব এ কে এম আমির হোসেন, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব কে এইচ মাসুদ সিদ্দিকী। উল্লেখ্য, তারা স্বেচ্ছা অবসরে গেছেন। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (ওএসডি) আবুল কাসেম তালুকদারকে বাধ্যতামুলক অবসর দেওয়া হয়।
মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামানের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে ওই সময় জনপ্রশাসন সচিব বলেন, প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় চুক্তি-ভিত্তিক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে নিযুক্ত হন তিনি। তাই তার বিষয়টি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের। তার বিষয়টি এখনো ওই অবস্থায়ই রয়েছে। এদিকে বছরের শেষে দিকে সারা বিশ্বে আলোচিত ঘটনা হচ্ছে-
গত ১০ মে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে সরকার স্বাধীনতার চার দশক পূর্তি উপলক্ষে সাত পর্বে বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ও স্বনামধন্য ৩৩৮ বিদেশী ব্যক্তিত্ব ও সংগঠনকে অন্যান্য উপহার সামগ্রীর সঙ্গে একটি করে ক্রেস্ট প্রদান করেছিল।
বিদেশী বন্ধুদের মুক্তিযুদ্ধের সম্মাননা স্মারক হিসেবে দেওয়া প্রতিটি ক্রেস্টই ভেজাল হিসেবে চিহ্নিত করেছে এ সংক্রান্ত তদন্ত কমিটি। বাংলাদেশ মান নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিএসটিআই এর পরীক্ষায় একটি ক্রেস্টে মাত্র সোয়া তিন আনা স্বর্ণের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। অথচ নীতিমালা অনুযায়ী প্রতিটি ক্রেস্টে এক ভরি সোনা ও ৩০ ভরি রুপা থাকার কথা। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু বিএসটিআই কর্তৃক পরীক্ষাকৃত ক্রেস্টেই নয়, প্রতিটি ক্রেস্টেই ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাজ্যের নাগরিক জুলিয়ান ফ্রান্সিসকে দেওয়া ক্রেস্টটি তদন্তের অংশ হিসেবে পরমাণু শক্তি কমিশন পরীক্ষা করে দেখেছে, সেখানে সোনার কোনো অস্তিত্বই নেই।
ক্রেস্ট জালিয়াতির জন্য তদন্ত কমিটি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মিজানুর রহমান ও বর্তমান সচিব কেএইচ মাসুদ সিদ্দিকীসহ ক্রেস্ট সংক্রান্ত দরপত্র কমিটির প্রত্যেককেই দায়ী করেছে।
প্রশাসনে সিনিয়র সচিব সাতজন
গত ১৯ জুন সিনিয়র সচিব হিসেবে নিয়োগ পান সাতজন। এরা হলেন- ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, মাহবুব আহমেদ রয়েছেন ব্যাংক বিমা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে, ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব হয়েছেন মো. শফিউল আলম, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে গেছেন হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন, মোজাম্মেল হক খান রয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে, মো. আবুল কালাম আজাদ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিনিয়র সচিব এবং মনজুর হোসেন রয়েছেন স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব হিসেবে।
আমলাদের সাথে খালেদা জিয়ার বৈঠক
গত ৪ ডিসেম্বর সরকারি আচরণবিধি লঙ্ঘন করে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাথে একদল সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী বৈঠক করেছেন। পরে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (ওএসডি) এ কে এম জাহাঙ্গীরকে বাধ্যতামুলক অবসরে পাঠানো হয়। একই অপরাধে বিজন কান্তিকেও অবসরে পাঠানো হয়।
বিচারপতিদের অভিসংশন আইনের অনুমোদন
গত ১৮ আগস্ট বিচারপতিদের অভিসংশন বা অপসারণের ক্ষমতা দিয়ে সংবিধানের ১৬তম সংশোধনী আইনের খসড়ার অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা।
বর্তমান সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের স্থলে ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদটি পুনঃস্থাপিত করা হয়েছে। একইসঙ্গে এই সংশোধনীর ফলে রাষ্ট্রের তিন স্তম্ভ সংসদ বিভাগ, বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগ একে অন্যের কাজে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকবে।
মূল সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে যে, ২ নম্বর অনুচ্ছেদে উল্লেখিত প্রমাণিত অসদাচরণ বা অসামর্থ্যের কারণে সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার অনূন্য দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সমর্থিত না হলে এবং সংসদের প্রস্তাবক্রমে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ ছাড়া কোনো বিচারককে অপসারন করা যাবে না। ৩ অনুচ্ছেদের ২ দফার অধীন প্রস্তাব সম্পর্কিত পদ্ধতি এবং কোনো বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্য সম্পর্কে তদন্ত বা প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।
প্রসঙ্গত, গত মহাজোট সরকারের আমলে হাইকোর্টে একটি মামলার বিচারকাজ পরিচালনা করতে গিয়ে দেশের স্পিকারকে কটাক্ষ করে বক্তব্য দেওয়ার পর সরকারের একটি অংশ বিচারকদের অপসারণের ভার সংসদের হাতে ন্যস্ত করার দাবি তোলে। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ স্পিকার থাকাকালে তাঁর দেওয়া এক রুলিংকে কেন্দ্র করে সংসদ ও বিচার বিভাগের মধ্যে বিতর্ক শুরু হয়। তখন সংসদ সদস্যরা সম্মিলিতভাবে ৯৬ অনুচ্ছেদ পুনর্বহালের দাবি তোলেন। নবম সংসদে সংবিধান সংশোধনের লক্ষ্যে গঠিত বিশেষ কমিটিও একই সুপারিশ করে। কিন্তু সংসদ সেটা আমলে নেয়নি। চলতি দশম সংশোধনের শুরুতে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির পক্ষ থেকে একই বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়ার তাগিদ দেওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় বর্তমান সরকার উচ্চ আদালতের বিচারকদের অভিশংসনের বিষয়ে সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নেয়।
দ্রুত বিচার সংশোধন আইন
গত ১৭ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে দ্রুত বিচার সংশোধন আইনের খসড়ার অনুমোদন দেওয়া হয়। বর্তমান মেয়াদের আইনের মেয়াদ আরো ৫ বছর বাড়িয়ে আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নকারী অপরাধ (দ্রুতবিচার, সংশোধন) আইন- ২০১৪ এর ওই খসড়ার নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। এই আইনটি অপরাধ দমনের লক্ষ্যে দুই বছরের জন্য ২০০২ সালে প্রথম জারি করা হয়েছিল। পরে ২০০৪, ২০০৬ ও ২০১২ সালে এর কার্যকারিতা বাড়ানো হয়। এই আইনটির মেয়াদ থাকবে ২০১৯ সালের ৭ এপ্রিল পর্যন্ত।
(ঢাকাটাইমস/৩১ডিসেম্বর/এইচআর/এমএটি)