স্কুল-কলেজে ভর্তি ফি কত? মাসে বেতন কত? পরীক্ষা দিতে নিবন্ধন করতে কত টাকা দিতে হবে? অন্য কোনো সময় কত টাকা দিতে হবে? কেউ যদি এই প্রশ্নের সহজ জবাব পেতে চান তাহলে তাকে গলদঘর্ম হতে হবে। কারণ সরকারি নির্দেশ, আদেশ, অনুরোধ এমনকি আদালতের নির্দেশনা কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে সারা দেশেই যে যেভাবে পারছে সেভাবেই ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করছে নানা ধরনের ফি। এতে স্বল্প আয়ের বা গরিব মানুষরা পড়েছে বিপাকে।
পরীক্ষা বা ভর্তিতে অতিরিক্ত টাকা আদায় নিয়ে প্রতি বছরই সংবাদ প্রকাশ হয় গণমাধ্যমে। প্রতিবারই সরকারি কর্মকর্তারা বলেন ব্যবস্থা নেবেন। কিন্তু কখনো কিছু করা হয়েছে সে উদাহরণ নেই। দু বছর আগে ঢাকার মণিপুর স্কুলে ভর্তিতে অতিরিক্ত টাকা আদায় কেন্দ্র করে ঘটেছিল তুলকালাম। তখন শিক্ষা মন্ত্রণালয় তদন্ত শেষে সরকার নির্ধারিত ফির চেয়ে বেশি নেওয়া টাকা ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দেয় স্কুল কর্তৃপক্ষকে। কিন্তু সে নির্দেশের পরোয়া করেনি মণিপুর স্কুল। আর অভিভাবকরা হয়রানির আশঙ্কায় ক্ষোভ চেপেই সন্তানদের সে স্কুলে পড়াচ্ছেন।
এবারও এসএসসি পরীক্ষার নিবন্ধনে বোর্ড নির্ধারিত ফির চেয়ে দ্বিগুণ, কোথাও কোথাও তিনগুণ টাকা নেওয়ার অভিযোগ ওঠেছে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। রাজধানী থেকে প্রত্যন্ত গ্রামÑসব জায়গাতেই একই চিত্র। শিক্ষার্থীদের আর্থিক সংগতির বিবেচনা না করে তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে বোঝা। এবারও আগের মতোই সরকারি কর্মকর্তাদের কেউ কেউ বলেছেন, তাদের কাছে অভিযোগ নিয়ে যায়নি কোনো অভিভাবক। কেউ কেউ বলেছেন, এমনটি হলে ব্যবস্থা নেবেন। কিন্তু আদতে করা হয়নি কিছুই।
এ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশের পর এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিতে ফরম পূরণ বাবদ অতিরিক্ত ফি আদায় বন্ধে হাইকোর্ট স্বপ্রণোদিত হয়ে আদেশ দেয় গত ১০ নভেম্বর। কিন্তু তার তোয়াক্কা না করায় গত ১৪ ডিসেম্বর বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমানের বেঞ্চ রাজধানীর ২৬ স্কুলের প্রধান শিক্ষক এবং পরিচালনা কমিটির সভাপতিকে হাইকোর্টে তলব করেন। তাদের আগামী ৬ জানুয়ারি সকাল সাড়ে ১০টায় সশরীরে আদালতে হাজির হতে বলা হয়েছে।
স্কুলগুলো হচ্ছেÑমিরপুর মণিপুর হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজ, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সিদ্ধেশ্বরী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়, মিরপুর বাঙলা স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, খিলগাঁও ন্যাশনাল আইডিয়াল হাইস্কুল, রাজউক উত্তরা মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মিরপুর আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়, মিরপুর শহীদ স্মৃতি উচ্চ বিদ্যালয়, লালবাগ রায়হান স্কুল অ্যান্ড কলেজ, হলিক্রস স্কুল অ্যান্ড কলেজ, আনন্দময়ী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়, আহম্মেদ বাওয়ানী একাডেমি, আজিমপুর ওয়েস্টার্ন হাইস্কুল, ক্যামব্রিয়ান স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মোহাম্মদপুর উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়, মিরপুর আলিমউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়, আরমানিটোলা স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজ, দি চাইল্ড ল্যাবরেটরি হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজ, মিরপুর জান্নাত একাডেমি, ওয়াই ডব্লিউ সি এ হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজ ও হাজি বিল্লাত আলী উচ্চ বিদ্যালয়।
১০ নভেম্বর হাইকোর্টের আদেশের পর এই ২৬ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কেবল ৬টি অতিরিক্ত ফি আদায়ের বিষয়ে প্রতিবেদন দিয়েছিল। আর ৭টি স্কুল এ বিষয়ে দিয়েছে ব্যাখ্যা। কিন্তু বাকিরা কিছুই করেনি। এ বিষয়ে জানতে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপিকা দিলারা হাফিজকে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি ধরেননি।
যার যত খুশি ফি আদায়
সরকারি-বেসরকারি সব স্কুল-কলেজে নার্সারি থেকে একাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থী ভর্তিতে সরকার নির্ধারিত ফির অতিরিক্ত টাকা আদায় চলছে সারা দেশেই। এসএসসি আর এইচএসসির নিবন্ধনের সময় বিষয়টি আলোচনায় এলেও এই ভর্তি ফি, মাসিক বেতন বা অন্যান্য সময় নেওয়া টাকার বিষয়টি গণমাধ্যমে উঠে আসে না তেমন।
সরকারি নিয়মে রাজধানীর স্কুলে ভর্তিতে কোনোভাবেই পাঁচ হাজার টাকার বেশি না নেওয়ার কথা থাকলেও মানছে না নামিদামি প্রতিষ্ঠানগুলো। স্কুল ও কলেজে ভর্তিতে সবচেয়ে বেশি ফি নিয়ে থাকে রাজধানী মিরপুরের মণিপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজে। প্রতিষ্ঠানটিতে ভর্তি ফি ছাড়াই ডোনেশনের নামে নিচ্ছে ২০ হাজার টাকা। তবে কোনো রসিদ দেওয়া হয় না। এ বিষয়ে সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে একটি বেসরকারি টেলিভিশনের সাংবাদিককে নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে এ স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি সংসদ সদস্য কামাল আহমেদ মজুমদারের বিরুদ্ধে।
ভিকারুননিসা নূন স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে বাংলা ভার্সনে ভর্তির জন্য ১২ হাজার ২০০ টাকা ও ইংরেজি ভার্সনে আদায় করা হয় ১৪ হাজার ১০০ টাকা।
মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তিতে ৬৭ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়। আইডিয়াল স্কুলের মূল শাখায় বাংলা মাধ্যমে ১৩ হাজার ৭০০ টাকা, কলোনি শাখায় ৬ হাজার ৭০০ টাকা এবং মুগদা শাখায় ৩৪ হাজার টাকা আদায় করা হয়। ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুলের বনশ্রী ক্যাম্পাসে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত ১২ হাজার ১০০ টাকা, উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলে ৯ হাজার টাকা, অগ্রণী স্কুল অ্যান্ড কলেজে ৭ হাজার ৮৮০ টাকা, উদয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ে ৬ হাজার ২০০ টাকা, মতিঝিল মডেলে শ্রেণি ভেদে প্রাথমিকে ১২ হাজার টাকা আদায় করা হয়।
অনেক প্রতিষ্ঠান আবার কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। রাজধানীর বিয়াম স্কুলে আগে অতিরিক্ত টাকা নিলেও এখন কোনো টাকাই নিচ্ছে না। এ বিষয়ে এক অভিভাবক বলেন, ‘এখন বোর্ড ফিও নেয়নি। কিন্তু পরিস্থিতি ঠা-া হলে এর যে কয়েক গুণ আদায় করবে না সে বিষয়ে নিশ্চয়তা পাচ্ছি না। কারণ এর আগেও নানা সময় এমনটি ঘটেছে।’
রাজধানীর নিম্নমাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয় গত ১৪ ডিসেম্বর একটি নীতিমালা জারি করে। এতে বলা হয়, ভর্তির আবেদন ফরমের জন্য সর্বোচ্চ ১০০ টাকা নেওয়া যাবে। সেশন চার্জসহ ভর্তি ফি সর্বসাকুল্যে মফস্বল এলাকায় ৫০০ টাকা, উপজেলা সদর এলাকায় ১ হাজার টাকা, জেলা সদর এলাকায় ২ হাজার টাকা, ঢাকা মেট্রোপলিটন ছাড়া অন্যান্য এলাকায় ২ হাজার টাকা এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় ৫ হাজার টাকার বেশি নেওয়া যাবে না। ভর্তি ফি ও ফরম বাবদ সরকার নির্ধারিত টাকার চেয়ে বেশি আদায় করলে এমপিও বাতিলসহ আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর ইতিমধ্যে বাড়তি ফি আদায়কারী সব প্রতিষ্ঠানকেই অর্থ ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বাড়তি অর্থ ফেরত না দিলে স্কুলের এমপিও স্থগিত, শিক্ষার্থী ভর্তির অনুমোদন বাতিল, বিভিন্ন পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন ও ফরম পূরণ বন্ধের মতো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা আছে এই নীতিমালায়।
এসএসসির নির্ধারিত নিবন্ধন ফি যেন এক কৌতুক
মানবিক, বাণিজ্য আর বিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষার্থীদের জন্য এসএসসি পরীক্ষার নিবন্ধনে ১ হাজার ১৫০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৪০০ টাকা ফি নেওয়ার নির্দেশনা ছিল শিক্ষাবোর্ডের। কিন্তু শহর কি গ্রাম বা প্রত্যন্ত জনপদ, কোথাও দুই বা আড়াই হাজার টাকার নিচে টাকা আদায় করেনি স্কুল কর্তৃপক্ষ। যাদের আর্থিক অবস্থা খারাপ তারাও ধারকর্জ করে বাধ্য হয়েছে টাকা দিতে। টাকা দিতে না পারলে শিক্ষার্থীদের নিবন্ধন করার দরকার নেই, এমন কথাও বলেছেন শিক্ষকরা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নির্ধারিত ফির ৬ থেকে ৭ গুণ পর্যন্ত আদায়ের অভিযোগ উঠেছে রাজধানীসহ বড় শহরগুলোতে।
ঢাকার উদয়ন স্কুল চলতি বছর বাণিজ্যের প্রতি শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ১০ হাজার ৯৫০ টাকা এবং বিজ্ঞান বিভাগের প্রতি শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ৯ হাজার ৮৯০ টাকা করে আদায় করেছে। এ ছাড়া মডেল টেস্টের কথা বলে নিয়েছে আরও ৬ হাজার টাকা করে।
এ বিষয়ে সাংবাদিকরা যোগাযোগ করলে অধ্যক্ষ উম্মে সালমা বেগম বলেন, স্কুলের উন্নয়নের স্বার্থে এবং এমপিওভুক্ত শিক্ষক কম হওয়ায় অতিরিক্ত টাকা নিচ্ছেন তারা। এতে বোর্ডের নির্দেশনা ভঙ্গ হয়নি বলেও দাবি করেন তিনি। কেবল উদয়ন স্কুল নয়, ঢাকার ৪০টি স্কুল পরিদর্শন করে ঢাকা শিক্ষাবোর্ড দেখেছে অর্ধেকের বেশি স্কুলে এভাবে দেদারসে যার যার খুশি মতো টাকা আদায় চলছে।
সরকারের চেয়ে শক্তিশালী মণিপুর স্কুল!
২০১২ সালে শিক্ষার্থী ভর্তির সময় ৩ হাজার ৫৪ ছাত্রছাত্রীর কাছ থেকে উন্নয়ন ফির নামে অতিরিক্ত ৫ কোটি ২৩ লাখ টাকা আদায় করে মিরপুরের এই স্কুলটি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় বারবার তাগাদা দিলেও সে টাকা অভিভাবকদের ফেরত দেয়নি কর্তৃপক্ষ। বরং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চিঠির জবাবে স্কুলের অধ্যক্ষ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, এই টাকা ফেরত দেবেন না তারা। প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ ফরহাদ হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে বলেন, তারা অন্যায় কিছু করেননি, মন্ত্রণালয় অযথা তাদের দোষ দিচ্ছে।
কয়েক দফা নির্দেশের পরও ভর্তির সময় নেওয়া অতিরিক্ত টাকা ফেরত না দেওয়ায় ২০১২ সালের ১২ ডিসেম্বর মণিপুর স্কুল, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল এবং ভিকারুননিসা নূন স্কুলের এমপিও স্থগিত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এরপর মতিঝিল আইডিয়াল এবং ভিকারুননিসা কর্তৃপক্ষ আদায় করা অতিরিক্ত টাকা শিক্ষার্থীদের বেতনের সঙ্গে সমন্বয় করতে শুরু করে। কিন্তু মণিপুর স্কুল করেনি কিছুই। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য কামাল আহমেদ মজুমদার প্রভাব খাটিয়ে এমনটি করেছেন বলে অভিযোগ ছিল শুরু থেকেই।
এ বিষয়ে জানতে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও ফোন ধরেননি এই সংসদ সদস্য।
মণিপুর স্কুলে আন্দোলনের পর ২০১২ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি তদন্তে দেখে যে, রাজধানীর ১৭টি নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই একইভাবে অভিভাবকদের কাছ থেকে ইচ্ছামতো টাকা আদায় করেছে। কেবল এক বছরে তিনটি বিদ্যালয় অতিরিক্ত আদায় করেছে ৯ কোটি ১২ লাখ ৮১ হাজার টাকা।
(ঢাকাটাইমস/২৫ডিসেম্বর/ইরা/এমআর)