সাতক্ষীরা: ‘সামান্য বৃষ্টিতে তলায় যাতো বেতনা নদী তীরের জনপদ। মানুষ উঠতো গিয়া উঁচু রাস্তায়। টোংঘর বানিয়ে তার ওপর থাকা লাগতো। মানুষ মারা গেলিও কবর দেওয়ার জায়গা ছিল না। কলাগাছের ভেলায় করে সৎকার হতো লাশের। ছেলেমেয়ের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাতো। দুর্ভোগ দূর করার নামে নদী খননের যে কাজ করা হয়েছে, তাতে উপকার হবে বলে মনে হচ্ছে না। এবারও বর্ষায় বুঝি তলায়ে যাবে।’ চোখেমুখে উদ্বেগ নিয়ে এ কথাগুলো বলছিলেন রহিম মিয়া।
সাতক্ষীরার বেতনা নদীর পাড় ঘিরে গড়ে ওঠা জনপদের বাসিন্দা তিনি। দুই যুগের বেশি সময় কাটে বেতনা পাড়ে। প্রায় ১০ লাখ লোক বাস করে এই জনপদে।
উপকূলীয় অঞ্চলের উন্নয়নে সাতক্ষীরার বেতনা নদী খনন ও পাড় বাঁধাই করার জন্য ২৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিল সরকার।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ প্রকল্পের জন্য অর্থ বরাদ্দ দিয়েছিলেন। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্বে আছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। কিন্তু জনগুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্পের কাজে বড় ধরনের ঘাপলার অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ গেছে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় ও দুর্নীতি দমন কমিশনেও (দুদক)। বিষয়টি আমলে নিয়ে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও ভাবছে মন্ত্রণালয়।
পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, ২৫ কোটি টাকার ওই প্রকল্পে নামমাত্র কাজ করে টাকা তোলার অভিযোগ আছে ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে। পানি উন্নয়ন বোর্ড, পওর-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী ও এক কর্মকর্তা এই অনিয়মে মদদ দিয়েছেন। যারা মোটা অঙ্কের ঘুষের বিনিময়ে এসব অনৈতিক কাজে সায় দিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে।
বেতনা নদীবর্তী জনপদ উন্নয়ন প্রকল্পের অনিয়ম নিয়ে অনেক আগে থেকেই সরব রয়েছে স্থানীয়রা। নানা কর্মসূচিতে এর প্রতিকার চেয়েছেন তারা। প্রকল্পের কাজ যথাযথভাবে যেন শেষ হয় এ জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দুয়ারেও ঘুরেছেন। কিন্তু কোনোভাবেই আশ্বস্ত হতে পারছেন না তারা।
বেতনা নদীর প্রকল্পের অনিয়ম নিয়ে সরব বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিও (ন্যাপ)। স্থানীয় জনসাধারণকে সঙ্গে নিয়ে প্রকল্পে অনিয়মের প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে দলটি।
জানতে চাইলে ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক কাজী সাইদুর রহমান বলেন, ‘সাতক্ষীরা এলাকার মানুষের দুর্দশা লাঘবের কথা চিন্তা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেতনা নদী খননের জন্য যে টাকা বরাদ্দ দিয়েছিলেন তা নিয়ে এখন হরিলুট চলছে। লোক দেখানো কাজ করে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে ঠিকাদাররা। এসব চলছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অসাধু কর্মকর্তাদের জন্য।’
তিনি বলেন, ‘কিছু সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীর দুর্নীতির কারণে দেশের উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে। সরকারের উন্নয়নের সিংহভাগ টাকা তাদের পকেটে যাচ্ছে।’
স্থানীয় সূত্র জানায়, সাতক্ষীরার এক সময়ের প্রমত্তা বেতনা নদী কমপক্ষে ১৫০ থেকে ২০০ মিটার চওড়া ছিল। নদীটি এখন পরিণত হয়েছে নালায়। স্থানীয়দের অভিযোগ, যাচ্ছেতাইভাবে নদীটি খনন করায় দুর্ভোগ আরও বাড়বে। বেতনা নদীর মাঝ বরাবর খনন করার কথা ছিল ১০ থেকে ১৮ ফুট। কিন্তু বাস্তবে তার কিছুই হয়নি। কেবল বিনেরপোতা ব্রিজের কাছে দুই থেকে তিন ফুট গভীর করে খোঁড়া হয়েছে। কোথাও এক ফুটের বেশি মাটি তোলা হয়নি।
খালের ঢালুকে পাড় বাঁধাই করে দেওয়ার কথা থাকলেও শুধু কাদার প্রলেপ দেওয়া হয়েছে। চর কেটে মাঝ দিয়ে উঁচু বেড়িবাঁধ তৈরি করায় নদী সরু হয়ে এসেছে। যেটি বর্ষার পানি পুরোপুরি নিষ্কাশন করতে পারবে কি না সন্দেহ আছে।
কাগজে-কলমে এখন পর্যন্ত প্রকল্পের প্রায় অর্ধেক কাজ হয়েছে। অথচ বাস্তবে শেষ হয়নি ১০ শতাংশের কাজও। এরই মধ্যে ঠিকাদারদের তিন কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।
এসব অনিয়মের সঙ্গে সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড, পওর-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী এস এম শহিদুল ও কর্মকর্তা (এসও) ওয়াজেদ আলী চাকলাদার জড়িত বলে অভিযোগ আছে। ওয়াজেদ আলী চাকলাদার গত ২০ বছর ধরে এই জায়গায় চাকরি করছেন। তিনি অতীতে নামে-বেনামে সাব-কনট্রাক্টে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অনেক কাজ করেছেন বলে প্রচার আছে।
জানতে চাইলে এস এম শহিদুল বলেন, ‘বেতনা নদী খনন কাজ তো শেষ হয়নি। এখানে দুর্নীতি করার প্রয়োজন নেই, সুযোগ নেই, সম্ভবও নয়। যারা দুর্নীতির অভিযোগ করছেন তারা তো আমার কাছে আসেনি, কিছু জানতে চায়নি। তাদের আমি ম্যানেজ করবো কীভাবে?’
ম্যানেজ বলতে কী বোঝাতে চাইছেন? জবাবে এস এম শহিদুল বলেন, ‘কেউ হয়তো তাদের ম্যানেজ করেনি। তাই এখানে সেখানে অভিযোগ করে বেড়াচ্ছেন।’
তবে কর্মকর্তা ওয়াজেদ আলী চাকলাদারের দাবি নিয়ম মেনেই ঠিকাদারের বিল পরিশোধ করা হয়েছে। তিনি জানান, এখন পর্যন্ত তিন কোটি ১৫ লাখ টাকা ঠিকাদারকে দেয়া হয়েছে। বাকি বিল দেয়া হবে মাপঝোঁকের পর। কমিশন নিয়ে অতিরিক্ত বিল পরিশোধের অভিযোগের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘আমি এসবের কিছুই জানি না।’
স্থানীয়রা জানান, সাতক্ষীরায় বেতনা ছাড়াও মরিচ্চাপ নদী অদক্ষ পরিকল্পনার বলি হয়েছে। এক সময়ের স্রোতসিনী নদী এখন নালা। এছাড়া কপোতাক্ষ, যমুনা, শালতা, শালিখা, সাপমারাসহ বিভিন্ন নদী-খালের অবস্থাও একই। জেলা সদরের লাবসা ইউনিয়নের বিনেরপোতা থেকে ব্রহ্মরাজপুর হয়ে ধুলিহর ইউনিয়নের সুপারিঘাটা পর্যন্ত বেতনা নদী সরু নর্দমায় পরিণত হয়েছে।
মাছখোলা, দামারপোতা, শালো, বেড়াডাংগী, বড়দল, মাটিয়াডাংগা, নেহালপুর, তেঁতুলডাংগা গোবিন্দপুরসহ বিভিন্ন এলাকার পানি নিষ্কাশনের খালগুলো প্রভাবশালীরা দখল করে মাছের ঘের তৈরি করেছে। ফলে বন্ধ হয়ে গেছে পানি নিষ্কাশনের সব পথ। বেতনা নদীর চর দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে ইটের ভাটা।
সাপ্তাহিক এই সময়ের সৌজন্যে