logo ২৮ এপ্রিল ২০২৫
বিএনপি চায় ক্ষমতা, জামায়াত চায় নেতাদের বাঁচাতে
তানিম আহমেদ
৩১ ডিসেম্বর, ২০১৪ ০০:০৩:১৯
image


জামায়াতের সাংগঠনিক দক্ষতা আর আন্দোলনে কর্মীদের সক্রিয়তা নিয়ে অতি ধারণা প্রচলিত আছে রাজনৈতিক মহলে। নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় দলের কর্মীদের নজিরবিহীন সহিংসতা হলেও বলার মতো কোনো শোডাউন করতে পারেনি তারা। সহিংসতা হলেও নির্বাচন ঠেকাবেÑএমন একটি ধারণাও ছড়িয়ে দিয়েছিল তারা। কিন্তু হয়নি কিছুই। ৫ জানুয়ারি ভোটের পরদিন থেকে কমে আসতে থাকে সহিংসতা। ধীরে ধীরে একেবারে গর্তে ঢুকে যাওয়ার অবস্থাই হয়েছে দলটির।  

মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষে অস্ত্র ধরা দলটি ’৭৫ সালের পটপরিবর্তনের সুযোগ নিয়ে রাজনীতিতে ফেরার পর থেকেই নানা সময় সন্ত্রাসের কারণে আলোচনায় এসেছে। বিশেষ করে তাদের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের রগ কাটার রীতির কারণে ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করেছে আশির দশকের শুরু থেকে। আর রাষ্ট্রীয় মদদে জামায়াতও ধীরে ধীরে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠা পায়। কিন্তু মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় দলের শীর্ষ নেতাদের বিচার শুরু হওয়ার পর থেকে নানা হুমকি-হুংকার দিয়েও দলটির অন্য নেতারা আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় ধীরে ধীরে কর্মীরা হতোদ্যম হয়ে পড়ে। এখন কেবল বিএনপির সঙ্গে একজোট হয়ে কোনো কর্মসূচি দিলেই চোখে পড়ে নেতা-কর্মীদের।  

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক গোবিন্দ চক্রবর্তী বলেন, ‘বিএনপি ভেবেছিল জামায়াত তাদের হয়ে আন্দোলন করে দেবে। কিন্তু বিএনপি আর জামায়াতের লক্ষ দুই। বিএনপি চায় ক্ষমতা আর জামায়াত চায় যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত তাদের নেতাদের বাঁচাতে। দুই লক্ষ এক না হওয়ায় জামায়াত পিছুটান দিয়েছে।

জামায়াত কি তাহলে আসলে কাগুজে বাঘ? জানতে চাইলে এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেন, ‘আমি ঠিক ওভাবে বলব না, ক্যাডারভিত্তিক সংগঠন হিসেবে তারা একেবারে ফুরিয়ে যাবে না, তবে তাদের শক্তি কমেছে অনেকাংশে।’  

মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের দুদিন পর রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সহিংসতা করে জামায়াত। কিন্তু এক বছরের ব্যবধানে সম্প্রতি আপিল বিভাগ দলের আরেক নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদ- দিলেও সেভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি দলের নেতা-কর্মীরা।  

মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষে অস্ত্র ধরার দায়ে ১৯৭২ সালে নিষিদ্ধ জামায়াত প্রকাশ্য রাজনীতিতে ফেরে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ১৯৭৯ সালের ২৫ মে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপির সঙ্গে গোপন সমঝোতা করে জামায়াতটি। আর ২০০১ সালে প্রকাশ্য জোট বেঁধে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়ও আসে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরা রাজনৈতিক দলটি। চারদলীয় জোট সরকারে মন্ত্রিত্বও পান দু আলবদর নেতা মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ। ক্ষমতায় থাকার কারণে ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত দেশে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে দলটি। আর এই সুবাদেই নানা অতিশয়োক্তি করা হতে থাকে জামায়াতকে নিয়ে।  

কিন্তু মানবতাবিরোধী অপরাধে দলের শীর্ষ নেতাদের বিচার শুরু এবং ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর থেকে দলটির এই কথিত আন্দোলনের ক্ষমতা নিয়ে ধারণা ভাঙতে থাকে। আর সরকারের কঠোর অবস্থানে বলতে গেলে পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে দলটি। বিএনপির কর্মসূচিতে অংশ নিলেও আগের মতো তেমন সক্রিয়তা দেখায় না দলের নেতা-কর্মীরা। এ নিয়ে বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে এক ধরনের দূরত্বও তৈরি হয়েছে জামায়াতের।

নেতারা হয় কারাগারে, নয় পলাতক

জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের ২২ সদস্যের ৯ জনই এখন কারাগারে। বাইরে থাকা ১৩ সদস্যের মধ্যে ৯ জন একাধিক মামলার আসামি হয়ে আত্মগোপনে। বাকিরা অসুস্থ, নয়ত রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয়। অন্যজন ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক কাদের মোল্লার রায় কার্যকরের পর থেকেই বিদেশে।

কর্মপরিষদেরও একই অবস্থা। ১৪ জন কারাগারে। বাকিরা হয় গ্রেপ্তার, পলাতক, নয়ত নিষ্ক্রিয়। পাঁচ নায়েবে আমিরের দুজনের মৃত্যু হয়েছে। অন্যরা কারাগারে, নয়ত পলাতক। এ পরিস্থিতিতে সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুজিবুর রহমানকে নায়েবে আমির পদে পদোন্নতি দিয়ে আনুষ্ঠানিকতা রক্ষা করা হচ্ছে।

মহানগরে রাজপথে দলকে সক্রিয় রাখার দায়িত্বে ছিলেন সহকারী সেক্রেটারি শফিকুল ইসলাম মাসুদ, শিবিরের সাবেক সভাপতি ফখরুদ্দিন মানিকের মতো তরুণ নেতারা। তারা দুজনই গত আগস্ট থেকে কারাগারে।  মহানগরের নায়েবে আমির আবদুল হালিম ছিলেন সামনের সারিতে। তিনিও গ্রেপ্তার হয়েছেন।

জামায়াতের মধ্যম সারির এক নেতা বলেন, ‘জামায়াত তার ইতিহাসে সবচেয়ে দুঃসময় পার করছে।  কেন্দ্র থেকে তাই সবাইকে ধৈর্য ধরতে বলা হয়েছে।’

দলের অস্তিত্ব নিয়েই সংশয়

মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দলের শীর্ষ নেতাদের বিচার বা সাজা ঠেকানো যাবে, এটা এখন আর মনে করে না জামায়াতের কর্মী-সমর্থকেরা। বরং ১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধের দায়ে দল হিসেবে জামায়াতের বিচার কখন শুরু হয়, কখন নিষিদ্ধ হয় সে ভয় পেয়ে বসেছে তাদের।  

এ কারণেই জামায়াত এখন সহিংস আচরণ না করার কৌশল নিয়েছে। কারণ তারা মনে করেন, নতুন করে সহিংসতা করলে জামায়াতকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সন্ত্রাসী দল হিসেবে চিহ্নিত করতে সরকারের সুবিধা হবে। আর তাহলে জামায়াতের অস্তিত্বই নাজুক হয়ে যেতে পারে। এরই মধ্যে আদালতের নির্দেশে নির্বাচন কমিশন জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল দলটির নেতা-কর্মীদের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি তৈরি করেছে। তার ওপর আইনমন্ত্রী আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন ১৯৭৩ সংশোধন করে দল হিসেবে জামায়াতের বিচারের কথা বলায় দুশ্চিন্তা ভর করেছে নেতা-কর্মীদের মধ্যে।  

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক জামায়াত নেতা এ বিষয়ে বলেন, ‘আমরা তো আমাদের দলীয় কার্যক্রমই চালাতে পারছি না। সরকার আমাদের সঙ্গে নিষিদ্ধ সংগঠনের মতো আচরণ করছে।’

তাহলে এখন কীভাবে দল চালান আপনারা?-জানতে চাইলে ওই নেতা বলেন, ‘রেস্টুরেন্টে, সামাজিক কোনো অনুষ্ঠানে বা কারো ব্যক্তিগত অফিসেই আমাদের কার্যক্রম চলে।’ জামায়াতের একজন সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল জানান, পুলিশ প্রশাসনের কঠোর অবস্থানে প্রকাশ্যে বের হওয়া দূরের কথা, ঘরের ভেতরও পাঁচ সদস্য এক হতে পারছেন না। এমনকি পারিবারিক কোনো অনুষ্ঠানে গেলেও আটক করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে।

সূত্রে জানা গেছে, দেশকে ১৫টি সাংগঠনিক অঞ্চলে বিভক্ত করে দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতারা গোপনে সফর করে তৃণমূল কর্মীদের হতাশা দূর করার চেষ্টা করছেন।  

বিএনপি-জামায়াত সম্পর্কের টানাপড়েন

জোটবন্ধু বিএনপির সঙ্গে দিনদিন সম্পর্কের দূরত্ব বাড়ছে জামায়াতে ইসলামীর। বলতে গেলে জামায়াতের কোনো কর্মসূচিতেই নেই বিএনপির প্রকাশ্য সমর্থন। একই অবস্থা জামায়াতের ক্ষেত্রেও। বিএনপির ডাকা আন্দোলনে আগে জামায়াতই থাকত রাজপথে। কিন্তু এখন জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীদের ওই অর্থে সক্রিয় হতে দেখা যায় না। কয়েক মাস আগে জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম মারা যাওয়ার পর কোনো শোকবার্তাও দেয়নি বিএনপি। আলোচনা আছে, বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশেই গোলাম আযমের মৃত্যুতে শোকবার্তা দেওয়া ও তার জানাজায় অংশ নেওয়া থেকে দূরে থেকেছে বিএনপি। এ নিয়ে গোলাম আযমের ছেলে আমান আযমী ফেসবুকে বিএনপিকে ‘অকৃতজ্ঞ’ উল্লেখ করে স্ট্যাটাসও দিয়েছেন। চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন জামায়াতকে ছাড়া বিএনপি কোনো নির্বাচনে জয়ী হতে পারবে না। যদিও জামায়াত বলছে, এটি তাদের দলীয় বক্তব্য নয়। বিএনপিও এটিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে বলে মনে হয়নি। পরে অবশ্য এই মন্তব্যের জন্য ক্ষমা চেয়েছেন গোলাম আযম-পুত্র।

জামায়াতের কেন্দ্রীয় একজন নেতা বলেন, ‘বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের জোট শুধু নির্বাচনের জন্য নয়,  সুখে-দুঃখে আমরা একে অপরের পাশে থাকব, এটা ছিল উদ্দেশ্য। কিন্তু এখন অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, বিএনপি গা বাঁচিয়ে চলতে চাচ্ছে। তৃণমূল জামায়াতের নেতা-কর্মীদের মনেও এ নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। ঢাকার বাইরে গেলেই এসব প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়।  রাজনীতিতে বিএনপি ও জামায়াত দুই দলই ঝুঁকির মধ্যে আছে। এই পরিস্থিতি থেকে উঠে আসতে হলে সুবিধাবাদী আচরণ পরিহার করতে হবে। তা না হলে আগামী দিনে বিএনপি আন্দোলনে জামায়াতকে পাশে না পেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।’

হুংকার ভুলে চুপচাপ

৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর প্রায় এক বছর ধরে জামায়াতের হঠাৎ নীরবতা ভাবিয়ে তুলেছে জোটে তাদের শরিক দলগুলোকে। দলের মাঠ পর্যায়ের নেতাদের অনেকেই রাজনীতি ছেড়ে ব্যবসা-বাণিজ্য বা অন্য কাজে মনোনিবেশ করছেন। দলটি সরকারের সঙ্গে কোনো ধরনের সমঝোতায় গেছে কি না তা নিয়েও কথা উঠেছে।  

বিএনপি নেতারা প্রকাশ্যে কিছু না বললেও দলের বিভিন্ন বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে কথা হয়েছে। জোটের বৈঠকে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াও জামায়াতকে আন্দোলনে সক্রিয় হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।  কিন্তু সক্রিয় হয়নি জামায়াত।  

জামায়াতের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের এক নেতা বলেন, ‘সরকার চাইছে জামায়াত সহিংসতা করুক। শিবিরের ছেলেরা অস্ত্র হাতে মাঠে নামুক, যাতে তাদের উগ্রবাদী কিংবা জঙ্গি হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। কিন্তু আওয়ামী লীগ তাতে সফল হয়নি।’ সাপ্তাহিক এই সময়-এর সৌজন্যে।