ঢাকা:২০১৪ সালের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন। বিরোধীদল ছাড়া নানা নাটকীয়তা ও সহিংসতার মধ্য দিয়েই দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।সারা দেশে প্রায় সাড়ে চার লাখ নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যের উপস্থিতিতে ১১ জেলায় সহিংসতায় নিহত হয় ১৯ জন। এর মধ্যে ১৫ জনই মারা গেছেন পুলিশের গুলিতে। নির্বাচনপূর্ব সহিংসতার দিক থেকেও ৫ জানুয়ারির নির্বাচন অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।গত বছরের ২৫ নভেম্বর তফসিল ঘোষণার পর থেকে ভোটের আগের দিন পর্যন্ত ৪১ দিনে মারা গেছেন ১২৩ জন। ভোটের দিন এতসংখ্যক মানুষের প্রাণহানি এর আগে দেখা যায়নি। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপির একতরফা নির্বাচনের দিন সারা দেশে ১২ জন মারা যান, সংঘর্ষ-সহিংসতায় আহত হন প্রায় পাঁচ শতাধিক। আর অষ্টম সংসদ নির্বাচনের ভোটের দিন ২০০১ সালের ১ অক্টোবর তিন জেলায় পাঁচজন নিহত হন। সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ ভোট হয় ২০০৮ সালে।২৯ ডিসেম্বরের ওই নির্বাচনের দিনটি কোনো রক্তপাত ছাড়াই শেষ হয়।
তত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন:
আওয়ামী লীগ ২০১১ সালের ৩০ জুন তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পর থেকেই তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও তার শরিক জোটগুলো নির্দলীয় তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। কিন্তু সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচনের ঘোষণা দেন। আর বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন না বলে ঘোষণা দিয়ে নির্বাচন বর্জন করেন।
এমতাবস্থায় গঠনমূলক সংলাপের মাধ্যমে নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় আসেন জাতিসংঘের রাজনীতি সংক্রান্ত সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো। তিনি প্রধান দুই দল বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের মাঝে সংলাপের উদ্যোগ নেন। কিন্তু শাসকগোষ্ঠী সবাইকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে তাদের নিজ নিজ সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। প্রথম দিকে জাতীয় পার্টি নির্বাচন বর্জনের কথা বললেও শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ নেয়।
সহিংসতার মুখেই নির্বাচন:
তৎকালীন বিরোধীদল বিএনপি নির্বাচন বর্জন করলেও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা দেখিয়ে ৫ জানুয়ারি দশম সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়া হয়। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্রসহ ১২টি দল নির্বাচনে অংশ নেয়।
ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত এ নির্বাচনে নির্বাচনের আগেই বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় ১৫৩ আসনে জয় পায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বাকি ১৪৭ টি আসনে ভোট হয়।৩০০ আসনের মধ্যে ২৩২ টিতে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ জয় লাভ করে।ভোটের দিন সারা দেশে প্রায় সাড়ে চার লাখ নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যের উপস্থিতিতে ১১ জেলায় সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ১৯ জন। এর মধ্যে ১৫ জনই মারা গেছেন পুলিশের গুলিতে। গত বছরের ২৫ নভেম্বর তফসিল ঘোষণার পর থেকে ভোটের আগের দিন পর্যন্ত ৪১ দিনে মারা গেছেন ১২৩ জন।
ভোটের আগের দিন শুরু হওয়া সহিংসতা ভোট গ্রহণের দিনেও বজায় ছিল। আগের দিন আগুনে পুড়েছে ১১১টি ভোটকেন্দ্র। নির্বাচনী কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উপস্থিতিতে নির্বাচনী সরঞ্জাম ছিনতাই হয়েছে, কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে নির্বাচনী কর্মকর্তাকে। ভোটের দিনও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন নির্বাচনী কর্মকর্তা।
এরশাদের নাটক:
বিএনপির নির্বাচন বর্জনের আহ্বানে সাবেক রাষ্ট্র্রপতি ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সারা দিলেও পরবর্তিতে তিনি নানা নাটকীয়তার জন্ম দেন। নির্বাচনে জাতীয় পার্টির অবস্থান নিয়ে চলে নাটকের পর নাটক। দলের একাংশের প্রেসিডিয়াম সদস্য রওশন এরশাদের নেতৃত্বে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। অপরাংশ দলের চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ঘোষণা অনুযায়ী নির্বাচন 'বর্জন' করে। এরশাদ রুহুল আমীন হাওলাদারকে নির্বাচন বর্জনকারীদের নেতা করলেও মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের একদিন পর কুমিল্লা-৩ আসনে আক্তার হোসেনকে লাঙ্গল প্রতীক বরাদ্দ দিতে চিঠি দেন। এর দু'দিন আগে ওই আসনে দলের অপর মনোনয়নপ্রত্যাশী জামাল উদ্দিনকেও লাঙ্গল প্রতীক বরাদ্দ দিতে চিঠি দেন। একই দিনে অপর চিঠিতে আক্তার হোসেনকেও লাঙল প্রতীক দিতে সুপারিশ করেন।
১৩ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিনে রুহুল আমীন হাওলাদার বলেছিলেন, তিনি মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। প্রাণ থাকতে নির্বাচনে যাবেন না।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই শোনা যাচ্ছিল এরশাদ গ্রেপ্তার হতে পারেন। এরশাদ নিজেও এই আশঙ্কার কথা উল্লেখ করে বলেন,সরকার যদি তার সঙ্গে চালাকির চেষ্টা করে তাহলে তিনি আত্মহত্যা করবেন।
নানা নাটকীয়তার পর ১২ডিসম্বর মধ্যরাতে র্যা বের একটি দল এরশাদকে তার বারিধারার বাসা থেকে তুলে সিএমএইচে নিয়ে যায়। তখন র্যা বের পক্ষ থেকে বলা হয়, এরশাদ অসুস্থ, তাই হাসপাতালে নেওয়া ভির্তি করা হয়েছে। ‘আটক’ এরশাদকে সিঙ্গাপুর অথবা মালয়েশিয়া পাঠানো হতে পারে বলে জাপা সূত্রে জানা যায়।
পরে সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে নির্বাচনে অংশ নেয় এরশাদ এবং নির্বাচনে জাতীয় পার্টির ৪০ জন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
এদিকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের দায়িত্ব পেলেও প্রায় এক বছর হতে চলল বিশেষ দূত হিসেবে কিছুই করেননি এরশাদ। কাজ না থাকলেও একজন পূর্ণমন্ত্রীর বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন এরশাদ। নিয়মিত বেতনও তুলছেন। সব কিছু মিলিয়ে তার পেছনে প্রতি মাসে সরকারি কোষাগার থেকে খরচ হয় প্রায় ৫ লাখ টাকা।
অথচ তিনি কী করতে চান, তার দায়িত্বের বিস্তারিত কী হবে সে বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যাই দেওয়া হয়নি সরকার বা এরশাদের দপ্তর থেকে। বিষয়টি নিয়ে অন্ধকারে জাতীয় পার্টির নেতারাও। নানা নাটকীয়তার পর প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে এ বিষয়ে একেবারেই চুপ এরশাদ। অনেকে আবার মনে করছেন তার মুখ বন্ধ করতেই তাকে শুধু একটি পদ দেওয়া হচ্ছে।
এ বিষয়ে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের প্রেস সচিব সুনীল শুভ রায় ঢাকাটাইমসকে বলেন, মন্ত্রণালয় স্যারকে কাজ দিক বা না দিক সেটা তাদের ব্যাপার। তবে যেহেতু তাকে একটি দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তাই তার পারিশ্রমিকও দেওয়া হবে এবং প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে সব সুযোগ-সুবিধাই তিনি পাচ্ছেন।এরশাদের বেতন তোলার বিষয়টি নিশ্চিত করে সুনীল শুভ রায় বলেন, তিনি প্রয়োজন মতো অবশ্যই বেতন তুলবেন।
৪র্থ উপজেলা নির্বাচন:
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো ৪র্থ উপজেলা নির্বাচনেও নানা নাটকীয়তা ও সহিংসতা লক্ষ করা গেছে। জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি দল অংশ না নিলেও ৪র্থ উপজেলা নির্বাচনে ঠিকই অংশ নিয়েছিলো দলটি। ছয় দফায় নেওয়া এ নির্বাচনেও হতাহতের ঘটনা ঘটে।
এছাড়া বহুল বিতর্কিত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনের ফলে সমালোচিত হয় বর্তমান নির্বাচন কমিশন।
(ঢাকাটাইমস/ ২৯ ডিসেম্বর/ইরা/ জেডএ.)