logo ২৯ এপ্রিল ২০২৫
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ
২৯ ডিসেম্বর, ২০১৪ ২১:৩৬:২৫
image


মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কে? বছরের পর বছর শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবইয়ে পড়েছে এম এ জি ওসমানী। অথচ তিনি ছিলেন মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান কারাগারে বন্দি প্রবাসী সরকারের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই ছিলেন সর্বাধিনায়ক।

মুক্তিযুদ্ধে এস ফোর্সের প্রধান ও সেক্টর কমান্ডার কে এম সফিউল্লাহ বলেন, ‘অনেকেই এই ভুলটা করছেন। এর কিছু ইচ্ছাকৃত, কেউ ভুল করে করেন। একটি দেশ আর যুদ্ধের সর্বাধিনায়ক সবসময় রাষ্ট্রপতি। এম এ জি ওসমানী ছিলেন মুক্তিফৌজের প্রধান সেনাপতি।

বাঙালির হাজার বছরের স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়েছিল ১৯৭১ সালে। সেই গর্বকে ঘিরেই আবার তৈরি হয়েছে নানা বিকৃতি। মুক্তিযুদ্ধের নানা পক্ষ এমনকি বিরুদ্ধাচরণ করা নানা শক্তিও এখন নিজেদের মতো করে ইতিহাস চর্চা করছে। স্বাধীনতার পর থেকেই এই শুরু হয়ে আসা বিকৃতি যেন এবার ন্যক্কারজনক অবস্থায় পড়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ককেও এবার বলা হচ্ছে রাজাকার। দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডনে বসে সম্প্রতি যে বক্তব্য দিচ্ছেন তা ইতিহাস বিকৃতির চূড়ান্ত রূপ বলে মন্তব্য করেছেন ইতিহাসবিদেরা।

কেবল তারেক রহমান বক্তব্য দিচ্ছেন তা নয়, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষে অস্ত্র ধরা দল জামায়াতে ইসলামী রীতিমতো মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র খুলে নানা বই প্রকাশ করেছে। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় নাম উঠানোদের দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সংগঠনও ছয় বছর আগে খুলেছিল জামায়াত। গণমাধ্যমে এ নিয়ে নানা সংবাদ প্রকাশের পর সে সংগঠনের কথা আর তেমন শোনা যায়নি। তবে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিকৃত বই আর তথ্য ছাপিয়ে যাচ্ছে জামায়াত। আর এসব বইয়ের নানা তথ্য তুলে ধরছেন তারেক রহমান।

গত ১৬ ডিসেম্বর লন্ডনে বিজয় দিবসের এক আলোচনা অনুষ্ঠানে এই গবেষণা সংস্থার লেখক আসাদ বিন হাফিজের একটি বইয়ের উদ্ধৃতি তুলে ধরেছেন তার বক্তৃতায়। বঙ্গবন্ধুকে ‘রাজাকার’, ‘খুনি’ ও ‘পাকবন্ধু’ বলেও সম্বোধন করেছেন।

একাত্তরে অস্ত্রহাতে শত্রুর মোকাবিলা করেছেন এমন কয়েকজন সমর সৈনিক মনে করেন, তারেক রহমানের এই বক্তব্যকে হেলাফেলা করে দেখার সুযোগ নেই। এর পেছনে যে বড় ধরনের ষড়যন্ত্র আছে তা বুঝতে খুব বেশি জ্ঞানী হওয়ার দরকার নেই।

জানতে চাইলে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির নির্বাহী সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘জামায়াতের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে নেমেছেন তারেক রহমান। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব নিয়ে যে ষড়যন্ত্র থেমে নেই এটি তার প্রমাণ। এভাবে বলতে বলতে যদি কোনোভাবে মানুষের মধ্যে অসত্যটা প্রতিষ্ঠা করা যায় তবেই তাদের সার্থকতা।’ তিনি বলেন, ‘এভাবে দিনের পর দিন অসত্য প্রচারের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নেওয়া হলে এক সময় আরও বড় কোনো ক্ষতি করার চেষ্টা হবে। ভুলে গেলে চলবে না, জামায়াত তাদের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও মরণকামড় দিতে চাইবে। এই কামড় যে শুধু রাজনীতির মাঠে আসবে তা নয়, ইতিহাসের ওপর নগ্ন হস্তক্ষেপও এর অংশ। তাই জামায়াতকে শুধু শক্তি নয়, বুদ্ধি দিয়েও মোকাবিলা করতে হবে।’

এ বছরের শুরুর দিকে ভারতে মুক্তি পাওয়া ‘গুণ্ডে’ ছবি নিয়ে বেশ তোলপাড় শুরু হয়েছিল বাংলাদেশে। কারণ ছিল ইতিহাস বিকৃতি। তাও আবার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। ছবিটির শুরুর অংশে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার যুদ্ধ বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ওই যুদ্ধের ফলে বাংলাদেশ নামে একটি নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল বলে দাবি করা হয় ছবিটিতে। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে বিভিন্ন মহলে নিন্দার ঝড় উঠেছিল জোরেশোরেই। শেষমেশ কুলকিনারা না পেয়ে ছবিটির প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান যশরাজ ফিল্ম বাধ্য হয়ে ক্ষমা চেয়েছে নিজস্ব ওয়েব সাইটে ও ফেসবুকের পাতায় বিবৃতি দিতে। এটি গেল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের ওপর আঘাতের আরেকটি ছোট্ট নমুনা। কিন্তু দেশের মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে যেভাবে ছিনিমিনি খেলা হয়েছে, তা রীতিমতো বিস্ময়ের।

সময় ও রাজনীতির পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে একাত্তরের রক্তক্ষয়ী ইতিহাসও পাল্টে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। যে যেভাবে ইচ্ছে সেভাবেই ইতিহাসের বিকৃতি করেছেন। রাজনীতির মাঠে ফায়দা হাসিলে বারবার খাটো করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের জন্য আত্মত্যাগী জাতির অর্জনকে। এমনকি মুক্তিযুদ্ধে উপপ্রধান সেনাপতি এ কে খন্দকারের সাম্প্রতিক একটি লেখা নিয়েও তৈরি হয়েছে বিতর্ক। রাজনৈতিক নেতারা মুক্তিযুদ্ধের সময় দিক-নির্দেশনা দিতে পারেননি এমন দাবির পাশাপাশি ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলেছিলেন, এমন দাবিও করেন এ কে খন্দকার।



স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে বিকৃতি

জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর থেকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে জিয়াউর রহমানের নাম বলতে থাকে বিএনপি। ক্ষমতায় আসার পর পাঠ্যবইয়ে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে জিয়াউর রহমানের নাম ছাপা হয়। অথচ ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালোরাতে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার বিষয়টি পাকিস্তানের সামরিক নথিপত্রেও ছাপা হয়। পরদিন বিভিন্ন দেশের পত্রিকা এবং টেলিভিশনেও গ্রেপ্তারের আগে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার কথা ছাপা এবং প্রচার করা হয়।

জিয়াউর রহমান বেঁচে থাকতে তিনিও কখনো নিজেকে স্বাধীনতার ঘোষক বলেননি। ২৭ মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতার ঘোষণার অডিও রেকর্ড এখনও সংরক্ষিত আছে সরকারের কাছে। কিন্তু এ নিয়ে বিতর্ক চলতে থাকায় উচ্চ আদালতে মামলাও করেন এক আইনজীবী। আর রায়ে বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতার ঘোষক বলার পাশাপাশি ইতিহাস বিকৃতি না করারও অনুরোধ করে আদালত। কিন্তু এরপরও এই ইতিহাস বিকৃত চলছেই।

মুক্তিযুদ্ধকালীন ৩ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার ও সেক্টরস কমান্ডার্স ফোরামের চেয়ারম্যান কে এম সফিউল্লাহ বলেন, ‘ঘোষণাপত্র পাঠ করলেই তাকে ঘোষক বলা যাবে না। কাউকে না পেয়ে জিয়াউর রহমানকে তো ঘোষণাপত্রটি রেডিওতে পড়ে শোনানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এই ঘোষণাপত্র তো বঙ্গবন্ধুই প্রস্তুত করে গিয়েছিলেন। ধারেকাছে কাউকে না পেয়ে জিয়াকে এ দায়িত্ব দেওয়া হয়। অন্য কাউকে পাওয়া গেলে তো সেই এটা পড়ত।’



ইতিহাসের নতুন রূপ দিচ্ছেন তারেক রহমান

২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণের পর ভারতে চলে গিয়ে প্রবাসী সরকার গঠনে উদ্যোগী ভূমিকা নেন আওয়ামী লীগ নেতারা। আর তাদের নেতৃত্বেই ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল গঠিত হয় প্রবাসী সরকার। বাংলাদেশ ভূখ-েই মেহেরপুরের মুজিবনগরে এই সরকার শপথ নেয়। আর এই সরকারের রাষ্ট্রপতি করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। তাঁর অবর্তমানে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে করা হয় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি।

এ নিয়ে কোনো বিতর্ক কখনো ছিল না। কিন্তু চলতি বছরে লন্ডনে এক আলোচনায় তারেক রহমান দাবি করে বসেন, বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। এরপর বিএনপির কয়েকজন নেতা কথা বলেছেন তার সুরে। যদিও এ নিয়ে হাস্যরসই হয়েছে বেশি, তারপরও তারেক রহমান চালিয়ে যাচ্ছেন এ ধরনের বক্তব্য।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর এসে তারেক রহমানের মতো মানুষের কাছে ইতিহাস শিখতে হবে জাতিকে? তারেক রহমান রাজনীতির কারণে অন্ধ হতে পারেন, তাই বলে দেশের মানুষকে অন্ধ ভাবার কারণ নেই। তারা সব জানেন এবং বোঝেন।’ তিনি বলেন, ‘একাত্তরে কী ঘটেছিল, কার অবদান কি ছিল এই ব্যাখ্যা ৪৩ বছর পর এসে দেওয়ার দরকার নেই। বরং গত ৪৩ বছরে প্রকৃত ইতিহাসে যেভাবে বিকৃত তথ্য ঢোকানোর চেষ্টা হয়েছে তা বাদ দিতে হবে।’

তারেক রহমানের এই ইতিহাস বিকৃতি কখনো যেন থামার নয়। বিভিন্ন বই, রেফারেন্সের আলোকে কথা বলার দাবি করছেন তিনি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিস্ফোরক মন্তব্য করেছেন ১৫ ডিসেম্বর। লন্ডনে এক আলোচনা সভায় তিনি বলেন, স্বাধীনতার ঘোষণা আসার ঠিক আগে ইয়াহিয়া খানকে প্রেসিডেন্ট মেনে তার সঙ্গে সমঝোতা করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি ‘রাজাকার, খুনি ও পাকবন্ধু।’

তারেক রহমানের এই বক্তব্য আসার পর কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তারেক রহমানকে জিহ্বা সামলে কথা বলার জন্য বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। নইলে সমুচিত জবাব দেওয়ার কথা বলেছেন তিনি।

এ ঘটনায় তারেক রহমানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন জেলায় মামলা করেছেন ছাত্রলীগ নেতারা। ঢাকাসহ দেশের  বিভিন্ন স্থানে একাধিক আদালত তার বিরুদ্ধে জারি করেছে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। সমনও জারি করেছে একাধিক আদালত।

এ নতুন ইতিহাস বর্ণনা বিএনপি নেতাদের মধ্যে বিস্ময়ের জন্ম দিলেও দলের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতার হয়ে কথা না বলার কোনো উপায় দেখছেন না অন্য নেতারা। যদিও বেশিরভাগ নেতাই এ নিয়ে কথা বলতে বিব্রত হচ্ছেন। কেন তারেক রহমান হঠাৎ নতুন ইতিহাস রচনার চেষ্টা করছেন, তাও বুঝে উঠতে পারছেন না নেতারা।

কিন্তু তারেক রহমান তার এই বক্তব্যের বিষয়ে এখনও অটল আছেন। শেখ হাসিনার বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় এক বিবৃতিতে তিনি দাবি করেন, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বইপত্র এবং দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও জার্নালের রেফারেন্স তুলে ধরে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের ভূমিকা তুলে ধরেছিলেন। সেসব বক্তৃতায় অত্যন্ত প্রাসঙ্গিকভাবেই সেই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের ভূমিকাও তার বক্তৃতায় উঠে এসেছে। তিনি বলেন, ওইসব বক্তব্যে তিনি যা বলেছেন  এর কোনো কথাই তার মনগড়া কিংবা বানোয়াট ছিল না।

আওয়ামী লীগই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করছে দাবি করে তারেক রহমান বলেন, গত ৪০ বছর ধরে আমরা একটি দলের মিথ্যা মিথ্যা মিথ্যা বারবার শুনে এসেছি।... বিপদে পড়লেই জনগণকে ধোঁকা দিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দোহাই দিয়ে তাদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে।’



জামায়াতের লেখা ইতিহাস বলছেন তারেক

জামায়াতে ইসলামীর মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নানা ধরনের বিভ্রান্তিকর গবেষণা করেছে। যার আলোকে বিভিন্ন বই প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে নতুন করে বিকৃত করার চেষ্টা হয়েছে। এর মধ্যে একটি ‘দৃশ্যপট একাত্তর : একুশ শতকের রাজনীতি ও আওয়ামী লীগ।’ বইটির লেখক জামায়াতপন্থি আসাদ বিন হাফিজ। স্বাধীনতার ঘোষক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে কটাক্ষ করা হয়েছে বইটির পাতায় পাতায়। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার বিভিন্ন ছবি দিয়ে তার ক্যাপশনে জুড়ে দেওয়া হয়েছে বিকৃত তথ্য। আর এসব বইয়ের নানা বিকৃত তথ্যই ‘বিশ্বাসযোগ্য’ ইতিহাস দাবি করে তুলে ধরছেন তারেক রহমান।

দৃশ্যপট একাত্তর বইটির ১৩ নম্বর পাতায় বঙ্গবন্ধু, ভুট্টো এবং ইয়াহিয়ার ছবি একসঙ্গে দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, ভুট্টো ও ইয়াহিয়ার মতো নরপশুদেরও সম্বোধন করা হয়েছে ‘একাত্তরের নায়ক’ বলে। একই পাতায় বলা হয়েছে, ‘শেখ মুজিব স্বেচ্ছায় বন্দিত্ব কবুল করে নিয়ে চলে গেলেন পাকিস্তানে। আওয়ামী লীগ নেতারা জনগণকে তোপের মুখে ফেলে রেখে ভারত পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করেন।’

একই বইয়ের ১৪ নম্বর পাতায় সিমলা চুক্তি, কামাল হোসেন ও যুদ্ধাপরাধী প্রসঙ্গ নিয়েও জল ঘোলার চেষ্টা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরনসিং ও তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল হোসেনের ছবি দিয়ে তার নিচে লেখা ক্যাপশনে বলা হয়েছে, ‘ড. কামাল কেন এবং কোন যুক্তিতে সেদিন পাক হানাদার বাহিনীকে মুক্তি দিয়েছিলেন আজো তা জাতিকে জানাননি। যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দেওয়ার অপরাধে তার কোনো বিচারও হয়নি। প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের তাজিমের সঙ্গে পাকিস্তান পাঠিয়ে দিয়ে সেই আওয়ামী লীগ আজ আটত্রিশ বছর পর হঠাৎ করে কেন হন্যে হয়ে তস্য যুদ্ধাপরাধী খুঁজছে, জাতি কি আজ এ প্রশ্ন করতে পারে না? আমরা জানি, ধৃত অপরাধীকে যারা পালাতে সাহায্য করে তারা অপরাধীদেরই সহায়ক শক্তি, অপরাধীদের মতোই তারা সমান অপরাধী। তাহলে যুদ্ধাপরাধীদের যারা বিনা বিচারে ছেড়ে দিল তারা কি যুদ্ধাপরাধী নয়? আজকে যদি জাতি যুদ্ধাপরাধীদের বিনা বিচারে মুক্তিদান করার অপরাধে আওয়ামী লীগের বিচার দাবি করে, তা কি খুব অন্যায় ও অসঙ্গত হবে?    

একই বইয়ে বঙ্গবন্ধুকে ‘লোভী’ বলেও সম্বোধন করা হয়েছে। স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়েও বিরূপ মন্তব্য আছে এতে। বইটির ২০ নম্বর পৃষ্ঠায় বলা হয়, ‘স্বাধীনতার ঘোষণা এদেশের মানুষ শেখ মুজিবের কাছ থেকে শুনতে চাইবে এটাই স্বাভাবিক। কারণ, সত্তরের নির্বাচনে মুজিবের দল আওয়ামী লীগকে মানুষ নিরঙ্কুশ সমর্থন দিয়েছিল। এই সমর্থনের মধ্য দিয়ে জাতি তাদের ভাগ্য তুলে দিয়েছিল শেখ মুজিবের হাতে। কিন্তু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার লোভ জনতার আকাক্সক্ষা পূরণের পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াল। ’

একই পাতায় দেওয়া একটি ছবির নিচে লেখা হয়েছে, ‘২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্রলীগ আনুষ্ঠানিকভাবে এ পতাকা উত্তোলন করে। তারপর স্বাধীনতা ঘোষণার দাবিতে উত্তাল ছাত্র-জনতা রাজপথ প্রকম্পিত করে নতুন পতাকা হাতে ছুটে যায় শেখ মুজিবুর ৩২ নম্বরের বাড়িতে। প্রচ- আবেগ নিয়ে তাঁর হাতে তুলে দেয় সেই পতাকা। কিন্তু মুজিব নির্বিকার। শত আবেদন নিবেদনের পরও তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন না।’

এর পরের পাতায় বলা হয়েছে, ‘নির্বাচনে বিজয়ের পর কেটে গেল ১০৮টি দিন। প্রতিটি দিন টান টান উত্তেজনা নিয়ে দেশবাসী তাকিয়ে রইল শেখ মুজিবের দিকে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর লোভের কাছে হেরে গেল জনতার আকাক্সক্ষা। কোনো দাবি, চাপ ও আবেদনই তার মুখ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা বের করতে পারল না। দেখতে দেখতে এলো ২ মার্চ। ততদিনে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ফেলেছে। কিন্তু তখনো শেখ মুজিব আর ইয়াহিয়ার রুদ্ধদ্বার বৈঠক চলছে। সেখানে পাকিস্তানের সামরিক জান্তার সঙ্গে শেখ মুজিবের একান্তে কি আলাপ হয়েছে তা কেবল তিনিই জানেন।’

জামায়াতের ইতিহাস গবেষণার বইটিতেও বিএনপির দাবিকে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা দেখা গেছে ভালোভাবেই। বইটির ২৮ নম্বর পাতায় বলা হয়েছে, ‘জাতির জীবনে যখন এমন দুর্যোগ নেমে আসে, যখন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ব্যর্থ হয় জাতিকে নেতৃত্ব দিতে, তখন সামরিক বাহিনীকে হাতে নিতে হয় নেতৃত্বের ভার। সেনাবাহিনীর একজন মেজরমাত্র হয়েও এ দায়িত্ব সেদিন কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। চট্টগ্রাম বেতারকেন্দ্র থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন প্রতিরোধ যুদ্ধে। তারপর দীর্ঘ ৯ মাস মুখোমুখি লড়াই করেছেন শত্রুর বিরুদ্ধে। তাড়া খাওয়া দিশেহারা জনগণকে নতুন করে সাহস যুগিয়েছেন, সংগঠিত করেছেন এবং তাদের নিয়ে ছিনিয়ে এনেছেন বিজয়ের সূর্য।’

বইটির ৩২ নম্বর পৃষ্ঠায় মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়েও কটাক্ষ হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘হয়ত মুক্তিযোদ্ধাদের আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করতে পারেনি এবং তাদের আপনও ভাবতে পারেনি। তাই তারা মুক্তিযুদ্ধের সুফল কুড়ানোর জন্য নিজস্ব একটি বাহিনীর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিল এবং মুজিব বাহিনী গঠনের মাধ্যমে তারা সেই অভাব পূরণ করে।’

আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি কি না তা নিয়েও বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা হয়েছে বইটির ৪১ নম্বর পাতায়। বলা হয়েছে, ‘যে জাতি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামিদের গলা থেকে ফাঁসির দড়ি খুলে তাদের বরণ করল জাতীয় নেতারূপে; স্বাধীনতা যুদ্ধে কিভাবে রক্ত দিতে হয় এটা চোখে দেখার সৌভাগ্য যাঁর হয়নি তাঁকে বরণ করল জাতির পিতা বলে; সেই নেতা যখন জনগণের ওপর দিয়ে লাল ঘোড়া দাবড়ে দেন; জনগণের বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতা হরণ করে সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে বাকশাল কায়েম করেন, তখন কোন সাহসে জনগণ তাঁর জানাজায় শরিক হবে? তোমরা যারা আওয়ামী লীগার, তোমরাই বা সেদিন কোথায় ছিলে? নিজেরা গর্তে লুকিয়ে থাকবে আর আশা করবে জনগণ তোমাদের সব বিপদ মাথায় তুলে নেবে, এটা ঠিক নয়। জনগণ নয়; গালি দিতে হলে নিজেদের দাও।’

মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণকে খাটো করে দেখা হয়েছে ‘দৃশ্যপট একাত্তর’ বইটিতে। ৫৫ নম্বর পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘যে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা দিতে ব্যর্থ হয়েছে, যে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে রণাঙ্গনে ছিল অনুপস্থিত, যে আওয়ামী লীগ বিশ হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করেছে যুদ্ধের সময়, যে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের কৃতিত্বপূর্ণ কোন পদক অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে, যে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের কৃতিত্ব হাইজ্যাক করে ভারতের হাতে তুলে দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সব কৃতিত্ব; সে আওয়ামী লীগকে কিছুতেই মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক তো দূরের কথা, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তি বলতেও আমরা নারাজ।’



ইতিহাস বিকৃতিতে মুক্তিযুদ্ধের সমরনায়কও

ইতিহাস বিকৃতির বিস্ময়কর নমুনা দেখিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের উপ-প্রধান সেনাপতি এ কে খন্দকারও। ‘১৯৭১ : ভেতরে বাইরে’ বই লিখে নতুন করে ইতিহাস নিয়ে বিতর্ক তুলেছেন। মুক্তিযুদ্ধের এত বছর পরে তিনি কেন এমন কাজ করেছেন সেই প্রশ্নের উত্তর আজও খুঁজে পায়নি কেউ।  

বইটিতে তিনি লিখেছেন, ‘কোন মাধ্যমে বা চিরকুট পাঠিয়ে বঙ্গবন্ধু যে স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হচ্ছে, ২৫ মার্চ রাতে তাঁর ঘনিষ্ঠ নেতা-কর্মীরা প্রায় শেষ পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে ছিলেন। অথচ তারা কেউ কিছু আঁচ করতে পারবেন না বা জানতে পারবেন না, এটা তো হয় না। তবে কি তিনি তাদের বিশ্বাস করতে পারেন নি? এটা তো আরও অবিশ্বাস্য। বঙ্গবন্ধু যদি স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেনই, তবে তিনি ৩২ নম্বর সড়কের বাসায় থাকবেনই বা কেন?’  

এ বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক হারুন হাবীব বলেন, ‘একটি প্রশ্ন তাকে করতে চাই। তিনি  তো মুজিবনগর সরকার নিয়োজিত মুক্তিযুদ্ধের উপপ্রধান সেনাপতি ছিলেন। মুজিবনগর সরকার হয়েছিল ১০ এপ্রিল। শপথ হয় ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে। সে সরকার গঠনের শুরুতে স্বাধীনতার ঐতিহাসিক ঘোষণাপত্রটি পাঠ করা হয়। যাতে বলা আছে, ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণা হওয়ার পর আমরা এই সরকার গঠন করছি। সেখানে নতুন করে ৪৩ বছর পর বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি এ ধরনের কথা বলার কী যৌক্তিকতা আছে আমার বোধগম্য নয়।’ তিনি বলেন, খন্দকার সাহেব সেই সরকারের অধীনেই ছিলেন। তিনি যদি আজ স্বাধীনতার ঘোষণা বঙ্গবন্ধু দেননি বলেন তাহলে কে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিল তা তাকে বলতে হবে। উনি তা বলেননি। এক অর্থে তিনি সেদিনকার মেজর জিয়াউর রহমানের প্রশংসা করেছেন।’

তিনি দাবি করেছেন, বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ ‘জয় পাকিস্তান’ বলে তার ভাষণ শেষ করেছেন। ওইদিন রেসকোর্স ময়দানে ছিলেন হারুন হাবীব। বঙ্গবন্ধু সেদিন কি সত্যিই ‘জয় পাকিস্তান’ বলেছিলেন? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ওইদিন কম করে হলেও রেসকোর্স থেকে শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ, কার্জন হল এবং প্রেসক্লাব এলাকায় সবমিলিয়ে ১০ লাখ লোক ছিল। এ কে খন্দাকার সাহেবের এই দাবির সঙ্গে সেই বিশাল মানুষের কোনো মিল নেই। মনে আছে পরের দিন রেডিওতে প্রচার হওয়া ভাষণের কথা। সেটাও বাংলাদেশসহ বিশ্বের মানুষ শুনেছেন। বঙ্গবন্ধু ‘জয় পাকিস্তান’ বললে কেউ কি সেটা শুনত না? আমার বিশ্বাস, স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর এ রকম একটি চরম বিভ্রান্তিকর দাবি তুলে এ কে খন্দকার গণমানুষের ‘কালেকটিভ মেমোরি’ বা সম্মিলিত স্মৃতিতে আঘাত করেছেন।’

এ কে খন্দকারের বইটি নিয়ে তুমুল সমালোচনার ঝড় উঠেছিল দেশজুড়ে। তার সহযোদ্ধা সেক্টর কমান্ডাররাও এটিকে মেনে নিতে পারেননি। তারা এ কে খন্দকারের বক্তব্যের কোনো দায়ভার নেবেন না বলে প্রকাশ্যে জানিয়ে দেন। সমালোচনা গড়িয়েছিল জাতীয় সংসদ পর্যন্ত। এ কে খন্দকারকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলেও সম্বোধন করা হয়েছে। পরে অবশ্য তিনি বইটির দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকায় বলেছেন, ‘‘বইয়ের ৩২ পৃষ্ঠার দ্বিতীয় স্তবকে আমি লিখেছিলাম এই ভাষণের শেষ শব্দ ছিল ‘জয় পাকিস্তান’।’’ আসলে তা হবে, ‘‘এই ভাষণের  শেষ শব্দগুলো ছিল ‘জয় বাংলা, জয় পাকিস্তান’।’’

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গবেষকরা মনে করেন, এ কে খন্দকার ‘জয় বাংলা’ স্লোগানকে অনেক হালকা করে ফেলেছেন। এটা তার নিজস্ব মানসিকতা, উপলব্ধি ও রাজনৈতিক সচেতনতার ব্যাপার। এ কে খন্দকারের কাছ থেকে এসব কথা শুনতে হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর,  এটা সত্যিই বেদনাদায়ক।

বই নিয়ে বিতর্কের এক পর্যায়ে নিজের শারীরিক অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের চেয়ারম্যান পদ থেকে স্বেচ্ছায় সরে দাঁড়ান এ কে খন্দকার।

অনেকেই এই ভুলটা করছেন। এর কিছু ইচ্ছাকৃত, কেউ ভুল করে করেন। একটি দেশ আর যুদ্ধের সর্বাধিনায়ক সবসময় রাষ্ট্রপতি। এম এ জি ওসমানী ছিলেন মুক্তিফৌজের প্রধান সেনাপতি। -সাপ্তাহিক এই সময়-এর সৌজন্যে।