পুলিশের উপপরিদর্শক পদে চাকরি নেওয়ার সময় শ্বশুর বাড়ি থেকে ১০ লাখ টাকা যৌতুক নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে মহিবুল ইসলামের বিরুদ্ধে। কেবল যৌতুক নয়, আইনের লোক হয়ে আইন লঙ্ঘনের আরও অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। স্ত্রী উম্মে মারিয়া মুক্তাকে না জানিয়ে আবার বিয়ে করেছেন তিনি। প্রতিবাদ করতে গেলে মুক্তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নানা নির্যাতনের পাশাপাশি প্রাণে মেরে ফেলার হুমকিও দিয়েছেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।
স্বামী ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা করতে চেয়েছিলেন মুক্তা। কিন্তু মামলার দীর্ঘসূত্রতায় বিচার দেরি হওয়ার আশঙ্কায় মহিবুলের বিরুদ্ধে সব ধরনের অভিযোগ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে লিখিত জানিয়েছেন তিনি। অভিযোগটির তদন্ত চলছে।
জানতে চাইলে মুক্তা জানান, তার ও মহিবুল দুজনেরই বাড়ি ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে। ২০০৯ সালে মহিবুলের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। মুসলিম শরীয়াহ অনুযায়ী তখন তারা কাবিন করেননি। পরে ২০১০ সালে পুলিশ বাহিনীতে তার চাকরি হলে কাবিনের প্রক্রিয়া আরও পিছিয়ে যায়। কারণ শিক্ষানবিস অবস্থায় বিয়ের কাবিন করলে চাকরি হারানোর ভয়ে এ কাজটি পিছিয়ে যেতে থাকে। তবে এই সময়ের মধ্যে মুক্তা মহিবুলদের বাড়িতেই ছিলেন। শিক্ষানবিসকাল শেষ করে চাকরিতে স্থায়ী হলে মুক্তার পরিবারের তরফে কাবিনের জন্য বলা হয়। কিন্তু তার শ্বশুর বাড়ির লোকেরা কাবিন না করে উল্টো আরও যৌতুকের টাকা চেয়ে চাপ দেয়। তার শ্বশুর-শাশুড়ি সাফ জানিয়ে দেয়, যৌতুকের টাকা না পেলে ছেলেকে আবারও বিয়ে করাবেন তারা।
এর বেশকিছু দিন পর মুক্তা খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, মহিবুল আবারও বিয়ে করেছেন। শ্রীপুর থানায় কর্মরত অবস্থায় দ্বিতীয় বিয়ে করেন। বর্তমানে তিনি মুন্সিগঞ্জের লৌহজং থানায় কর্মরত।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দাখিল করা অভিযোগে মুক্তা জানান, তিনি বিয়ের কথা জানার পর পারিবারিকভাবে মহিবুলের পরিবারের সঙ্গে কথা বলেন। তারা নমনীয়তা না দেখিয়ে উল্টো বিভিন্ন ধরনের হুমকি-ধামকি দেন। এক পর্যায়ে মুক্তা আইনের আশ্রয় নেবেন এমনটা জানানোর পর মহিবুলের পরিবারের লোকজন মুক্তার মুঠোফোনে কল করে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেন।
এমনকি মহিবুলের গ্রামের বাড়ি পাইথলের ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানকে দিয়েও নানা সময় সামাজিক ও মানসিকভাবে অত্যাচার করেন। শুধু তাই নয়, মহিবুলের নতুন স্ত্রীও বিভিন্ন সময় মুঠোফোনে কল করে হুমকি-ধামকি দিয়ে যাচ্ছে।
নিজের জীবনের অচলাবস্থার কথা তুলে ধরে মুক্তা বলেন, ‘দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই বাজারে আমার চলাফেরা দায়। তাছাড়া সামাজিকভাবেও আমাকে বিভিন্ন সময় হেনস্থা হতে হচ্ছে। এ থেকে কি আমার মুক্তির উপায় নেই?’ স্বরাষ্ট্র সচিবের কাছে জীবনের নিরাপত্তাও চেয়েছেন তিনি।
মহিবুলের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে পুলিশ বিভাগ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অপরাধের ধরন অনুযায়ী শাস্তি নির্ধারিত হবে। শাস্তির ধরন বিবেচনায় চাকরিও হারাতে পারেন এসআই মহিবুল। জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (পুলিশ) আখতার হোসেন ভূঁইয়া বলেন, ‘পুলিশের দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির কর্মকর্তাদের বিষয়গুলো পুলিশ সদর দপ্তর থেকে দেখা হয়। এসআই মহিবুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ এখানে এলেও সদর দপ্তরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘মহিবুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে বিভাগীয়ভাবে অপরাধের ধরন বুঝে শাস্তি ঠিক করা হবে। এ ক্ষেত্রে চাকরিও হারাতে পারেন তিনি।’
জানতে চাইলে মহিবুলের কর্মস্থল মুন্সিগঞ্জের লৌহজং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘আমি এ ব্যাপারে কিছু জানি না। মহিবুল আমার থানায় যোগদান করে ১৫ থেকে ২০ দিনের মতো কাজ করেছে। এখন অসুস্থতাজনিত ছুটিতে আছে।’
কথা বলার জন্য মহিবুলের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ফোনটি ধরেননি।
সাবেক তথ্য কমিশনার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাদেকা হালিমের মতে, সমাজে এ ধরনের ঘটনা অহরহ ঘটছে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা ও বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণে অনেকে মুখ বুঝে এসব সহ্য করছে। তিনি বলেন, ‘যিনি আইনের পোশাক গায়ে তুলেছেন তার বিরুদ্ধে বে-আইনি কাজের অভিযোগ রীতিমতো আতঙ্কের।
তাহলে বিপদে পড়লে আমরা কাদের কাছে ছুটে যাব? এই প্রশ্নতো এমনিতেই চলে আসে।’ তিনি বলেন, ‘নারী নির্যাতনের ঘটনায় বিচার হয় খুব কম। উল্টো বিচারপ্রার্থী নারী ও পরিবারকেই সামাজিকভাবে হয়রানি হতে হয়। হেয় হতে হয়।’
কারণ এই সমাজের মানুষ তো পুরুষের চেয়ে নারীর দোষকে বড় করে দেখে। তাদের মধ্যে এমন একটা বদ্ধমূল ধারণা জন্মেছে যে, নারীরাই নারীদের ওপর সহিংসতার জন্য দায়ী। এ ধরনের মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। নারী নির্যাতন করলে বিচার হয় এমন বার্তা সবার মধ্যে পৌঁছাতে পারলেই ঘরে-বাইরে নারীরা অনেক নিরাপদ থাকবেন।’
জানতে চাইলে উম্মে মারিয়ার ভাই এস এম আকাশ বলেন, ‘আমরা আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার চিন্তা করছি। সমঝোতা না হলে আইনের আশ্রয় ছাড়া তো কোনো উপায় নেই।’ (সাপ্তাহিক এই সময় এর সৌজন্যে)।
(ঢাকাটাইমস/৯জানুয়ারি/এফএইচ/এমএটি)