logo ২৮ এপ্রিল ২০২৫
বিএনপি কতটা সংগঠিত

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ
১০ জানুয়ারি, ২০১৫ ১৮:০৭:৪৮
image


খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তাকে ছায়ার মতো ঘিরে থাকতেন মোসাদ্দেক আলী ফালু। স্রেফ এই সুবাদেই কোনোরকম রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড না থাকা সত্ত্বেও সরকার ও দলে ব্যাপক ক্ষমতাধর হয়ে ওঠেন ফালু। রাতারাতি বিপুল বিত্তের মালিক বনে যান। টিভি চ্যানেল, সংবাদপত্রের মালিক তো বটেই রিয়েল  এস্টেট, শেয়ারবাজার, বীমা, সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিসহ বিভিন্ন খাতে বিপুল বিনিয়োগ করেন। মধ্যপ্রাচ্যে পাঁচ তারকা হোটেলসহ বিভিন্ন খাতেও অঢেল বিনিয়োগ করেন। অখ্যাত থেকে বিখ্যাত হয়ে ওঠেন বিএনপি চেয়ারপারসনের ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুবাদে।



 



গুলশান, বারিধারাসহ রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকায় গড়ে তোলেন একাধিক অট্টালিকা। সাভার, আশুলিয়াসহ বিভিন্ন স্থানে শত শত বিঘা জমির মালিক বনে যান রাতারাতি। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব, পরে রমনা-তেজগাঁও থেকে উপ-নির্বাচনে সাংসদও নির্বাচিত হন। ১/১১’র পর মোসাদ্দেক আলী ফালুকে করা হয় বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা। বিস্ময়কর হলো, গত ছয় বছরে বিএনপির কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে দেখা যায়নি তাকে। অথচ বেসরকারি টেলিভিশন মালিক সমিতির সভাপতি হিসেবে দেশে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যথারীতি উপস্থিত থেকেছেন। নিজের টিভি চ্যানেল দেশের বাইরে অনুষ্ঠান করলে সেখানেও সগৌরবে ফালুর উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। অথচ গত কয়েকদিন ধরে বেগম জিয়া গুলশান কার্যালয়ে ‘অবরুদ্ধ’ হয়ে পড়লেও দেখা মিলছে না তার। বিএনপিকে ব্যবহার করে কাঁড়িকাঁড়ি টাকা কামালেও দলের চেয়ারপারসনের চরম দুঃসময়ে দেখা মিলছে না ফালুর মতো অধিকাংশ বিএনপি নেতার।



 





দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির সদস্যসহ বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টাম-লীর সদস্য, যুগ্ম মহাসচিব, সাংগঠনিক সম্পাদক, সম্পাদকম-লীর সদস্য ও জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য সব মিলিয়ে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির নেতার সংখ্যা দুই শতাধিক। কিন্তু এদের সিংহভাগই রাজনৈতিক কর্মকা-ে কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন। বিএনপিতে আলোচনা এই নেতাদের অনেকেই ভয়ে, আতঙ্কে আছেন এবং সম্পদ ভোগ-বিলাসিতাও রক্ষার চেষ্টা করছেন। মাঠে নেমে আন্দোলন-সংগ্রাম করে কারাগারে যেতে মোটেও আগ্রহ নেই তাদের।



 





খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটিতে নাম আছে ১৮ জনের। শুরুতে আছেন দলের চেয়ারপারসন এবং শেষে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান। মাঝে থাকা ১৬ জন নেতার প্রায় সবাই গত ছয় বছরে সাংগঠনিক কোনো দক্ষতার প্রমাণ রাখতে পারেননি। বয়স ও জটিল শারীরিক অসুস্থতার কারণে নুয়ে পড়েছেন এমন একাধিক নেতা এখনও আছেন স্থায়ী কমিটিতে। গত ছয় বছরে একদিনের জন্যও দলীয় বৈঠক, সভা-সমাবেশে দেখা যায়নি এমন নেতারাও আছেন নীতিনির্ধারণী ফোরামে।



 





পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, স্থায়ী কমিটির সদস্য আর এ গণি দীর্ঘদিন ধরে হৃদরোগে ভুগছেন। বার্ধক্যজনিত কারণে ঘর থেকে বেরোনো তো দূরে থাক, চলাফেরা করাই কষ্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে তার। দিন কাটছে শুয়ে বসে। কোনোভাবেই আন্দোলনের মাঠে থাকা সম্ভব নয় তার পক্ষে। আর দল থেকে কখনোই কিছু পাননি বলে পরিবারের সদস্যরাও তাকে আর রাজনীতিতে সক্রিয় দেখতে চান না বলে জানা গেছে।  



 





এক সময় বিএনপিতে দোর্দ-প্রতাপ নেতা ছিলেন ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। দুর্নীতির মামলায় কারাগারে থাকা বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্যকে আর বিশ্বাস করেন না খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান। বিএনপিতে তার ভূমিকা এখন গৌণ।    



 





গত বছরের শেষ দিকে প্রকাশিত বইয়ে মওদুদ আহমদ লিখেছেন, এক-এগারোর সময় বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া দেশের কথা চিন্তা না করে তার দুই ছেলের কথা চিন্তা করেছেন। এ নিয়ে বিএনপিতে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা দিলেও আওয়ামী লীগ থেকে ‘ধন্যবাদ’ দেওয়া হয় তাকে। যা নিয়ে দলে নতুন করে আস্থার সংকট তৈরি হয় মওদুদ আহমদকে নিয়ে। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে থাকা বিএনপির নীতিনির্ধারণী ফোরামের অন্যতম এই সদস্য এখন বিদেশে। দলের দুঃসময়ে দেশে ফেরার কোনো সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। তার ঘনিষ্ঠরাও বলতে পারছেন না কবে ফিরবেন তিনি।



 





অসুস্থতার কারণে আড়ালে চলে যাওয়াদের একজন সাবেক মন্ত্রী এম শামছুল ইসলাম। বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় কাবু এই নেতার পক্ষে আর রাজনীতির মাঠে সক্রিয় হওয়া সম্ভব নয় বলে পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে।  



 





রাজনীতিতে ‘সজ্জন’ বলে পরিচিত সাবেক সেনাপ্রধান লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান। কিন্তু এক-এগারো সরকারের সময় গায়ে লাগা সংস্কারপন্থির তকমা এখনও পুরোপুরি মুছে যায়নি তার গা থেকে। চেয়ারপারসনের ‘গুডবুকে’ নাম না থাকায় দলের নীতিনির্ধারণীতে তার ভূমিকা রাখার সুযোগও কম। পাশাপাশি দলের মূলধারার রাজনীতির সাথে খাপ খাওয়ানোর ইচ্ছে তারও নেই বলে সূত্রে জানা যায় ।



 





ইতিপূর্বে বিএনপির আন্দোলন-কর্মসূচিতে দক্ষ নেতৃত্বের প্রমাণ দিয়েছেন তরিকুল ইসলাম। দলের মূলধারার নেতাদের একজন তিনি। ‘দুঃসময়ের কা-ারি’ হিসেবে খালেদা জিয়ার পূর্ণ আস্থাও আছে তার প্রতি। কিন্তু শ্বাসকষ্ট, ডায়াবেটিসসহ নানা রোগেশোকে ভুগে এখন প্রায়ই শয্যাশায়ী থাকতে হয় তরিকুল ইসলামকে। যে কারণে ইচ্ছে থাকলেও দলীয় সব কর্মসূচিতে সামনের কাতারে থাকতে পারেন না স্থায়ী কমিটির এই সদস্য।



 





গোড়ার দিকে বিএনপির রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন না আ স ম হান্নান শাহ। এক-এগারোর সময় থেকে ধীরে ধীরে সামনে আসার চেষ্টা করেন তিনি। দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের বিশ্বাস অর্জনের চেষ্টা করেছেন নানাভাবে। বক্তৃতা-বিবৃতিতে পটু হলেও এখন বিএনপির আন্দোলনে মাঠে পাওয়া যাচ্ছে না তাকে।



 





দক্ষ আমলা হিসেবে নাম ছিল এম কে আনোয়ারের। নব্বইয়ের পটপরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগে ভেড়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়ার পরে বিএনপিতে যোগ দেন। একাধিকবার সাংসদ, মন্ত্রী হলেও কখনোই বিএনপির মূলধারার নেতা হিসেবে তাকে মেনে নেননি দলের তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা। তার ওপর ১/১১’র সময় সংস্কারপন্থিদের প্রস্তাবের খসড়া তিনিই লিখে দেন বলে অভিযোগ আছে। বিএনপির সাবেক মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূইয়া বেঁচে থাকতেও আক্ষেপ করে তার ঘনিষ্ঠদের কাছে না কি বলতেন-‘আনোয়ার সাহেব প্রস্তাবনা লিখে দিলেন। কিন্তু পরে সুযোগ বুঝে সরে পড়লেন।’



 





বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য বেগম সারওয়ারী রহমান মার্জিত ও ভদ্রজন। কিন্তু আন্দোলন- সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়ায় কতখানি পারদর্শী তা নিয়ে সন্দিহান দলের সর্ব স্তরের নেতা-কর্মীরাই। পাশাপাশি বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে রাজনীতিতে যতটুকুই বা সক্রিয় ছিলেন এখন অসুস্থতার কারণে তাও হয়ে উঠছে না।



 





স্পিকারের দায়িত্ব পালন করা জমির উদ্দিন সরকারকে বিএনপির দুঃসময়ে কার্যত খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না। স্থায়ী কমিটির সদস্য হলেও নিজ জেলা পঞ্চগড়ের বাইরে খুব বেশি নিজেকে মেলে ধরতে পারেননি বয়োবৃদ্ধ এই নেতা। আন্দোলন-সংগ্রাম করে কারাগারে যাওয়ার চিন্তা করেন না তিনি, ঘনিষ্ঠদের একথা প্রায়ই বলেন জমির উদ্দিন সরকার।



 





১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বিএনপির পরাজয়ের পর বেসামাল আচরণ করে দল ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া। ১/১১’র পর বেগম জিয়ার পক্ষে মামলা লড়ে আবার দলে ফিরে স্থায়ী কমিটির সদস্য পদ পেয়েছেন ঠিকই কিন্তু দলের নেতা-কর্মীদের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি মোটেও। আন্দোলনের মাঠে রফিকুল ইসলাম মিয়াকে মাঝেমধ্যে দেখা গেলেও নিজ এলাকা কুমিল্লার মুরাদনগরে তাকে ফিরতে না দেওয়ার হতাশাবোধ নিয়েই বেশি সময় কাটে তার।



 





যুবদলের সভাপতি হিসেবে ’৯০-এর গণআন্দোলনে মির্জা আব্বাস গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হয়ে উঠেন বিএনপিতে। এরপর তর তর করে মেয়র, মন্ত্রীও হন। ‘ভেঙে পড়া’ ঢাকা মহানগর বিএনপিকে টেনে তুলতে তার নেতৃত্বে আহ্বায়ক কমিটি করে দেওয়া হয়। কিন্তু দায়িত্ব পাওয়ার পর এই কমিটি দলের আন্দোলন-কর্মসূচিতে বলার মতো কিছুই করতে পারেননি। আন্দোলন করার শক্তি যে মির্জা আব্বাস এভাবে হারিয়ে ফেলেছেন তা কি আর বিএনপির সর্বোচ্চ নেতৃত্ব জানতেন? সংশ্লিষ্টরা বলছেন ’৯০-এর আগে কিছু বিষয় সম্পত্তি থাকলেও মেয়র ও মন্ত্রী হিসেবে পরবর্তীতে নামে-বেনামে যে বিপুল সম্পত্তির মালিক তিনি হয়েছেন তা রক্ষার কাজেই মির্জা আব্বাসকে নানাভাবে ব্যস্ত থাকতে হয় ও সরকারের বিভিন্ন চাপ সামলাতে নানা রফা করতেও হচ্ছে সময়-সময়ে। আন্দোলন তো দূরে থাক, গ্রেপ্তার আতঙ্কে গত ৪ জানুয়ারি থেকে গা-ঢাকা দিয়ে আছেন তিনি। ‘অবরুদ্ধ’ খালেদা জিয়াকেও দেখতে যাননি একটিবার। দল ঘোষিত অবরোধ-কর্মসূচিতেও মাঠে পাওয়া যায়নি ঢাকা মহানগরীর কোনো নেতাকে।



 





বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকার ব্যাপারে অবিশ্বাসের পাল্লা দিন দিন ভারী হচ্ছে দলের ভেতরে। আসলেই কি তিনি অসুস্থতার কারণে দেশে ফিরতে পারছেন না, নাকি এর পেছনে অন্য কোনো কারণ আছে? গত বছরের জুলাইয়ে সেই যে বিদেশে গেলেন, এর মধ্যে কি একবারও সুযোগ পাননি দেশে ফেরার? কান পাতলেই এসব প্রশ্ন শোনা যাচ্ছে বিএনপির অনেক নেতা-কর্মীর মুখে। দলীয় সূত্র জানা গেছে, ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার পর দারুণভাবে মনঃক্ষুণœ হয়েছেন খোকা। এমনকি গত বছরের ৫ জানুয়ারির আগে ও পরে দলের কর্মসূচিতে নিজের অনুসারী-অনুগামীদের নামার ব্যাপারে কোনো নির্দেশনাও দেননি তিনি। কমিটি বদলালেও এখনও ঢাকা মহানগর বিএনপিতে খোকার ছায়া দেখতে পাচ্ছেন নেতা-কর্মীরা।   



 





স্থায়ী কমিটির সদস্যদের মধ্যে গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান ভালো বক্তা হলেও আন্দোলন-সংগ্রামে সামনের কাতারে থেকে দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো কর্তৃত্ব দলে কখনোই প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি।



 





রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, কাগজে-কলমে বিএনপিকে যতটুকু সংগঠিত মনে হয়, আদতে তার ধারেকাছেও নেই একাধিকবার ক্ষমতায় থাকা দলটি। ক্ষমতায় থেকে দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা মন্ত্রী-সাংসদ হিসেবে নানা সুযোগ নিয়েছেন ঠিকই। কিন্তু তা এখন ব্যক্তিগত কাজে লাগছে, দলের কাজে নয়। এ জন্যই দলের চেয়ারপারসনের চরম বিপদে পাশে পাওয়া যাচ্ছে না কাউকে।



 





খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের এক শ গজের ভেতরে অন্তত এক শ কেন্দ্রীয় নেতার বাস। বিস্ময়কর হলো, এদের কেউই দলের চেয়ারপারসনের খোঁজ নিচ্ছেন না। এমনকি বেগম জিয়া ঘোষিত অবরোধ কর্মসূচিতেও মাঠে নামেননি কেউ।



 





খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, বেগম জিয়ার কার্যালয়ের কয়েক শ গজ দূরত্বের মধ্যে এম এ কাইয়ুম (স্বদেশ প্রপার্টিজ), হাফিজ ইব্রাহিম, ইঞ্জিনিয়ার ফারুক আহমেদ তালুকদার, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আনোয়ার হোসেন চৌধুরী, আবুল হোসেন খান, জিবা খান, ফয়সাল মাহমুদ ফয়েজী, সরফুদ্দিন আহমেদ সান্টু, শফি আহমেদ চৌধুরী, কাজী সলিমুল হক কামাল, আবুল হোসেন আজাদ, ড. মো. জালালউদ্দীন, জি এম ফজলুল হক, নুরুল হুদা, মঞ্জুরুল আহসান মুন্সী, শফিকুর রহমান কিরন, শামা ওবায়েদ, শেখ আলী আশরাফ, কাজী মনিরুজ্জামান, অধ্যাপক রেজাউল করিম, জামাল আহমেদ চৌধুরী, খন্দকার আবু আশফাক, মেজর (অব.) মিজানুর রহমান, সুলতানা আহমেদ, ডা. দেওয়ান সালাউদ্দীন আহমেদ বাবু, বাবুল আহমেদ, নূরে আরা সাফা, ইলিয়াস আহমেদ পাল, ডা. মাহবুবুর রহমান লিটন, ইঞ্জিনিয়ার শামসুদ্দীন আহমেদ, খুররম খান চৌধুরী, শাহিদা আক্তার রিতা, রশিদুজ্জামান মিল্লাত, ফকির মাহবুব আনাম স্বপন, রাবেয়া সিরাজ, মেজর (অব.) হানিফ, এম আকবর আলী, তাসভীর-উল-ইসলাম, কমোডর (অব.) শফিকুর রহমান, আবু নাছের মো. ইয়াহিয়া, আশরাফউদ্দীন নিজান, আমিন-উর রশিদ ইয়াছিন, সাহাবুদ্দিন আহমেদ, শরীফ শাহ কামাল তাজ, এস এ কে একরামুজ্জামান, মেজর (অব.) রেজাউল হক, গাজী মাজহারুল আনোয়ার, লে. কর্নেল (অব.) আবদুল লতিফ, এ কে এম মোশাররফ হোসেন, জাকারিয়া তাহের সুমন, লুৎফর রহমান খান আজাদ, গোলাম আকবর খোন্দকার প্রমুখের বাড়ি কিংবা অফিস। অথচ গত ৪ জানুয়ারি থেকে বিএনপি চেয়ারপারসনকে তার কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করে রাখা হলেও এই নেতাদের কাউকেই গুলশানের কার্যালয়ের আশপাশে দেখা যায়নি।

অধ্যাপক মাজিদুল ইসলাম, শামসুজ্জামান দুদু, সাবিহ উদ্দিন আহমেদ, আমান উল্লাহ আমান, বরকতউল্লাহ বুলু, মিজানুর রহমান মিনু, ফজলুল হক মিলন, নাজিমউদ্দীন আলম, মশিউর রহমানের খোঁজ মিলছে না কেন এ নিয়ে তৃণমূল স্তরের নেতা-কর্মীদের মধ্যে নানা আলোচনা আছে।    



 





মির্জা ফখরুল কারাগারে

গত ৪ জানুয়ারি বিএনপি চেয়ারপারসনকে গুলশানের কার্যালয় থেকে বের হতে না দেওয়ার পর থেকে আত্মগোপনে ছিলেন দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। পর দিন ৫ জানুয়ারি জাতীয় প্রেসক্লাবে সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের একটি সভায় যোগ দিতে দিয়ে প্রেসক্লাবে আটকা পড়েন তিনি। বাইরে বের হলে পুলিশ গ্রেপ্তার করবে এই ভয়ে ৫ জানুয়ারি রাত থেকে পরদিন দুপুর পর্যন্ত প্রেসক্লাবের ভেতরেই অবস্থান করেন তিনি। ৬ জানুয়ারি দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে ফখরুল বলেন, ‘ব্যক্তিগত নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে তিনি প্রেসক্লাবে অবস্থান করেছেন।’ সংবাদ সম্মেলন শেষে তিনি প্রেসক্লাব থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। এখন তিনি কাশিমপুর কারাগারে আছেন।



 





গ্রেপ্তার আতঙ্কে গুটিসুটি নেতারা

বিএনপির মাঠ পর্যায়ের নেতাদের কেউ কেউ মনে করেন, গ্রেপ্তারের ভয়ে এত ভীত হলে সরকার তার সুযোগ নেবে এটাই স্বাভাবিক। বিএনপির নেতৃত্বের ওপরের দিকে যাদের বসানো হয়েছে তাদের বড় অংশই আন্দোলনের মাঠে নেতৃত্ব দেওয়ার উপযুক্ত কি না এই প্রশ্ন জোরেশোরে উঠেছে। যেমন সাইফুল আলম নীরবকে যুবদলের সাধারণ সম্পাদক বানানো হয়েছিল এই বিবেচনায় যে, জ্বালাও-পোড়াওয়ের রাজনীতিতে তার জুড়ি মেলা ভার। কিন্তু গত ছয় বছর গ্রেপ্তার আতঙ্ক তাকে এতটাই পেয়ে বসেছিল যে, তিনি প্রকাশ্যের চেয়ে অপ্রকাশ্যেই ছিলেন বেশি। যুবদলের প্রচার সম্পাদক এস এম জাহাঙ্গীর রাজধানীর উত্তরায় না  কি এমপি প্রার্থী হতে চান। কিন্তু জাতীয় পার্টির নেত্রী শাশুড়ির কল্যাণে পুরো সরকারের গত মেয়াদের পাঁচ বছরই বেশ আরাম-আয়েশে কাটিয়েছেন। আর আন্দোলন আন্দোলন খেলায় সময় পার করে দিয়েছেন। ছাত্রদলের বর্তমান কমিটি বেছে নেওয়া হয়েছিল এই বিবেচনায় যে তারাও ভাঙচুরের রাজনীতিতে সিদ্ধহস্ত। কিন্তু তারা সমান ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন বলে ছাত্রদলের সাবেক নেতারাই দলের বিভিন্ন পর্যায়ে বলে বেড়ান।



 





রাজনীতি করতে এসে জেল, মামলার ভয়ে পিছিয়ে যাওয়া কতটুকু যুক্তিসঙ্গত? জানতে চাইলে বিএনপির কেন্দ্রীয় স্বনির্ভরবিষয়ক সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু এই সময়কে বলেন, ‘রাজনীতিতে জেল-জুলুম থাকবে। এ বিষয় মাথায় নিয়েই রাজনীতিতে এসেছি। কিন্তু বিনা কারণে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর জেলে আটকে রাখা হবে এটা তো হতে পারে না। আমি সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলব, সত্য কথা বলব এই কারণে আমাকে জেলে আটক করা হবে, এটা তো গণতন্ত্র নয়। গত ছয় বছরে আমাকে চার বছর জেলে থাকতে হয়েছে।’

ঢাকাসহ সারা দেশে বিএনপির সাংগঠনিক দুরবস্থার পেছনে দলের রাতারাতি ‘ধনাঢ্য’ নেতৃত্বই দায়ী বলে মনে করেন দলটির মাঠ পর্যায়ের কর্মী-সমর্থকরা। বিগত সময়ে বিএনপির রাজনৈতিক কর্মসূচির ব্যর্থতার কারণ কি? একাধিকবার ক্ষমতায় থাকা দলটির বড় নেতারা মাঠে নামেন না কেন? স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনে যারা সামনের কাতারে ছিলেন তারা এতটা ¤্রয়িমাণ কেন? এমনকি ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ওই সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মাঠে সক্রিয় থেকে যেসব বিএনপি নেতা পরবর্তী সময়ে সরকারে ও দলে বড় বড় পদ পেয়েছেন তারাও এভাবে নিজেদের গুটিয়ে রেখেছেন কেন? বিএনপির ভেতরে ও বাইরে প্রতিদিনই এই প্রশ্ন উঠছে। বিএনপির নেতা-কর্মী, সমর্থকরা মনে করেন, দলটির সাংগঠনিক বিপর্যয়ের মূল কারণ এক শ্রেণির নেতার অতিমাত্রায় আর্থিকভাবে ফুলে ফেঁপে ওঠা।



 





বিএনপির বিভিন্ন স্তরের কর্মীরা বলাবলি করছেন, ডাকসুর ভিপি আমান উল্লাহ আমান সামনের সারিতে ছিলেন। ওই সময় বয়সে তরুণ তার মতো নেতারা আর্থিকভাবে সচ্ছল হলেও বিলাসী জীবন-যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন না। জনশ্রুতি আছে, বিএনপি ক্ষমতায় আসার পরে এমপি, মন্ত্রী হওয়ার পর তারা নামে-বেনামে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন এবং অতিমাত্রায় বিলাসী জীবন-যাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এরশাদের সময় গ্রেপ্তার আতঙ্ক না থাকলেও এই নেতারা এখন আর গ্রেপ্তার হতে চান না। কেন? বিএনপি নেতা-কর্মীরাই বলছেন, আগে অঢেল সম্পদ না থাকায় তা রক্ষার চিন্তা ছিল না। কিন্তু এখন সম্পদ রক্ষার চিন্তাতেই অধিকাংশ সময় ব্যস্ত থাকেন দলের নীতিনির্ধারক বলে পরিচিত বেশিরভাগ নেতা। সরকারের দু-চারজন নীতিনির্ধারকের সঙ্গেও ভেতরে ভেতরে চমৎকার সম্পর্ক তাদের।



 





নাম প্রকাশ না করার শর্তে সাপ্তাহিক এই সময়কে বিএনপির জেলা পর্যায়ের এক নেতা বলেন, দলের চেয়ারপারসন স্থায়ী কমিটিতে এমন নেতাদেরই জায়গা করে দিয়েছেন যারা হয় বয়োবৃদ্ধ, না হয় জনবিচ্ছিন্ন অথবা আর্থিক কেলেঙ্কারিতে বিভিন্ন সময়ে যুক্ত।



 





সরকারবিরোধী আন্দোলনে বিএনপি জনগণকে কেন সম্পৃক্ত করতে পারল না এই প্রশ্ন যখন বিভিন্ন মহলে বারবার উচ্চারিত হচ্ছে তখন খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, নেতা-কর্মীদের কাছে যারা জননেতা হিসেবে খ্যাত তারাই মূলত আন্দোলনে কোনো না কোনোভাবে পিছুটান দিয়েছেন।



 





দলকে ঢেলে সাজাতে না পারলে স্বচ্ছ, দক্ষ, জনপ্রিয় নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা না গেলে বর্তমান নেতৃত্ব বিএনপিকে খাদের কিনারায় নিয়ে যাবে কি না এ প্রশ্নই বড় করে দেখা দিয়েছে।

বিএনপির নিরুত্তাপ আন্দোলনের পেছনে সাংগঠনিক দুর্বলতাকে দায়ী করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. এমাজউদ্দীন আহমদ। তিনি এই সময়কে বলেন, ‘অতীতে দলের প্রথমসারির নেতাদের আন্দোলনের মাঠে দেখা গেলেও এখন তারা আড়ালে থাকছেন। হতে পারে রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে বিএনপি নেতারা ভয় পাচ্ছেন। গ্রেপ্তারের হয়রানি এড়াতে মাঠে নামছেন না। শোনা যাচ্ছে, আন্দোলনের চেয়ে অনেকে হয়ত ব্যবসা-বাণিজ্য টিকিয়ে রাখার চেষ্টা বেশি করছেন। দলের জন্য সেই ত্যাগের মনোভাব হারিয়ে ফেলায় এই সংকট সৃষ্টি হয়েছে।’



 





অতীতে দলের প্রথমসারির নেতাদের আন্দোলনের মাঠে দেখা গেলেও এখন তারা আড়ালে থাকছেন। হতে পারে রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে বিএনপি নেতারা ভয় পাচ্ছেন। গ্রেপ্তারের হয়রানি এড়াতে মাঠে নামছেন না। শোনা যাচ্ছে, আন্দোলনের চেয়ে অনেকে হয়ত ব্যবসা-বাণিজ্য টিকিয়ে রাখার চেষ্টা বেশি করছেন। দলের জন্য সেই ত্যাগের মনোভাব হারিয়ে ফেলায় এই সংকট সৃষ্টি হয়েছে।



 





সাপ্তাহিক এই সময়-এর সৌজন্যে।