বুধবার সকাল সাড়ে ৯টা। ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটের পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র। যারা সজ্ঞানে আছেন মাঝেমধ্যেই তাদের যন্ত্রণাকাতর চিৎকার শোনা যায়। এই ইউনিটের ৭টি বেডের মধ্যে ৬ জন রোগী ভর্তি আছেন। তাদের মধ্যে চারজন হরতাল-অবরোধকারীদের বাসে দেওয়া আগুনে দগ্ধ। মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে যাওয়ার সময় চোখে পড়ল পায়ে, শরীরে, মুখম-লে সাদা ব্যান্ডেজে মোড়া বহু রোগী। এক একটি মানুষ যেন এক একটি জীবন্ত মমি।
২০ জানুয়ারি মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৭টায় গাজীপুরের নন্দনপার্ক বাড়ইপাড়ায় বাসে আগুন দেয় অবরোধকারীরা। এ ঘটনায় দগ্ধ ৪ জনের ঠাঁই হয় ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটের অবজারভেশন ইউনিটে। কথা হয় আগুনে দগ্ধ আবদুর রশীদ মোল্লা ওরফে বুদ্ধি মিয়ার সঙ্গে। তিনি কাতর কণ্ঠে এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘বইনের বাড়ি আরিচা থেকে জিরাবো পর্যন্ত কোনোভাবে আসছি, তারপর কালিয়াকৈর যাবো কিন্তু বাসে ভিড় থাকায় একটা গাড়িতে না উঠে, পরের গাড়িতে উঠি।’
বুদ্ধি মিয়ার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে তারপরও কাতরকন্ঠে বলছিল, ‘আমি বের হইবার পারতাম কিন্তু ওই ব্যাটার কারণে বের হইতে পারলাম না।’
কাতর কণ্ঠে বলছেন পানি খাব। বুদ্ধি মিয়াকে পানি খাওয়াতে পানি আনতে বের হলেন তার মেঝ ছেলে হাছান। বাবার জন্য পানি আনলেন, কিন্তু তিনি শুয়ে পানি খেতে পারছিলেন না। পরে তিনজনের সাহায্যে উঠে হাঁটু গেড়ে বসে পানি খেলেন। বললেন, ‘এভাবে থাকলেই ভালো লাগতেছে।’
বুদ্ধি মিয়ার বেডে বসে কাঁদছেন তার স্ত্রী রাশিদা খাতুন। তিনি বিলাপ কণ্ঠে বলছেন, ‘ওনি মারা গেলে আমরা কই যামু, নিজ বাড়ি ছাইরা আরেকজনের বাড়িতে ঠাঁই নিছি। এহন ওনি না থাকলে আমরা কই যামু।’
রাশিদা খাতুনের পাশে বসেছিল চার বছরের ছেলে রাহাত। কিছুই বুঝে না ছেলেটি, শুধু বাবার দিকে চেয়ে আছে। সে হয়ত বুঝছে না তার বাবার কি হয়েছে।
রাশিদা খাতুন বলেন, ‘ওনার বইনের বাড়ি থেকে বাসায় আসতেছে। সাড়ে ৬টার দিকে আমারে বলছে আমি বাসে উঠতেছি। কিন্তু ৭টার সময় হুনলাম গাড়িতে আগুন দিছে।’ আপনার স্বামী কি করে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভ্যান গাড়ি চালায়।
একই ইউনিটে কথা হয় দগ্ধ কলেজ ছাত্র রাজীব কর্মকার এবং পৃথ্বীরাজের সঙ্গে। তার সঙ্গে বোনের বাড়িতে যাচ্ছিলেন বন্ধু রাজীব। পৃথ্বীরাজ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় কলেজে হিসাববিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। গতবারই বোন জামাইয়ের এলাকায় ডিগ্রিতে ভর্তি হয়েছিলেন, এখন ভর্তি হওয়ার জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের নম্বরপত্র লাগবে। এগুলো আনতে বোনের বাড়িতে যাচ্ছিলেন পৃথ্বীরাজ, সঙ্গী হয়েই যাচ্ছিলেন বন্ধু রাজীব, যিনি গত বছরই একই কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন।
পৃথ্বীরাজ বলেন, সাড়ে ৬টা থেকে ৭টার মধ্যে নন্দনপার্ক এলাকার বাড়ইপাড়া এলাকায় আসার পর বাসে ঢিল মারা শুরু হয়। বাস থামানো হলে তারা চিৎকার করে বলেন, ‘নামেন দিলাম।’ অর্থাৎ আগুন দিলাম। আমি তাদের বলি, ‘ভাই নেমে যাচ্ছি।’ কিন্তু তারা শুনল না। প্রথমে একটা পেট্রল বোমা মারল, সেটা আমার গায়ে লাগল না। সিঁড়ির কাছে আসতেই আমার পিছন থেকে একটি পেট্রল বোমা আসলে হাত দিয়ে ঠেকাতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু পারলাম না। দুই হাত পুড়ে গেছে। জ্যাকেট, শার্ট সবই পুড়ে গেছে। ঈশ্বরের দয়ায় হয়ত গায়ে আগুন লাগেনি, কিন্তু আমার দুই হাতই পুড়ে গেছে।
একই ঘটনায় দগ্ধ হয়েছেন আশুলিয়ার নিতাই সরকার। তিনি জিরাবোর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। নিতাই সরকার বলেন, পেট্রল বোমাটা প্রথমে আমার মাথায় এসে পড়ে। সেখান থেকে আমি হাত দিয়ে সরানোর কারণে বাম হাত দগ্ধ হয়ে যায়। তিনি যখন কথা বলছেন, তার বেডের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তার শ্যালিকা গীতা রানী বলেন, ‘দুই নেত্রী ক্ষমতার জন্য লড়াই করেন। তাদের সেই ক্ষমতার আগুনে আমাদের পুড়তে হয়। এদেশে আসলে কোনো গণতন্ত্র নেই, আছে রাজতন্ত্র।’ গীতা রানী ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘আন্দোলন মানে কি? আন্দোলনের নাম যদি হয় মানুষ পুড়িয়ে মারা, তাহলে আমরা সেই আন্দোলন চাই না।’
সকাল সাড়ে ১১টার সময় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে প্রবেশ করতে হাসপাতালের রাউন্ডে আসেন চার চিকিৎসক এবং কয়েকজন মেডিকেল ছাত্রছাত্রী। ডাক্তাররা পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের সব রোগী দেখলেন। ওই চিকিৎসক দলের নেতৃত্বে ছিলেন অধ্যাপক রায়হেনা আউয়াল। তার কাছে জানতে চাই রোগীদের অবস্থা সম্পর্কে। জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা তাদের পর্যবেক্ষণ করছি, একবারেই তাদের উন্নতি হবে না, ধাপে ধাপে উন্নতি হবে। এই চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি।’
ডাক্তাররা ফিরে যাওয়ার পর আবারো কোলাহলপূর্ণ হয় পর্যবেক্ষণ ইউনিট। টেলিভিশনের ক্যামেরা দেখেই একজন বলে উঠেন, ‘আমরা আমাদের নিরাপত্তা চাই। এদেশ আমাদের জন্য নিরাপদ নয়, এ দেশ মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীন করেছিল আমাদের নিরাপত্তার জন্য, কিন্তু সেই নিরাপত্তা কোথায়। তাহলে কি আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ভুল ছিল।’
দুপুর ১২টার সময় পঞ্চম তলার ‘পেইং ওয়ার্ডে’ গিয়ে শোনা গেল রোগীদের কাতর চিৎকার। দশজনের এই ওয়ার্ডে ৯টি বেডেই রোগী আছে। বাকি খালি বেডেও রোগী উঠবেন। যিনি মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ফেনীর দাগুনভূইয়ায় পেট্রল বোমার আগুনে দগ্ধ হয়েছেন। তার নাম মাঈন উদ্দিন। কথা হয় মাঈন উদ্দিনের বড় বোন লুৎফর নাহার আলোর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমার ভাই কোনো রাজনীতি করে না, সে কাপড়ের দোকান করে এলাকায়। দোকান বন্ধ করে বাড়ি যাওয়ার সময় অবরোধকারীদের কবলে পড়ে।’
তার ভাইয়ের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, ‘ডাক্তাররা বলছে শরীরের ৯ শতাংশ পুড়ে গেছে।’
৫ জানুয়ারি বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছে ময়মনসিংহের অটোরিকশাচালক সিদ্দিকুর রহমানকে। তার শরীরের ১৭ শতাংশ পুড়ে গেছে। দগ্ধ সিদ্দিক বলেন, ‘এই রাজনীতি আমাগো বাঁচতে দেয় না। বিপদ জাইনাও বাইর হইতে হয় পেটের টানে।’
বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন কুমিল্লার লাকসামের কান্দিরপাড়ের ট্রাকচালক পিয়ার আহমেদ বলেন, ‘শহরের রাস্তায় আগুন দেয় শুনছিলাম। ভাবছিলাম এইখানে হইব না। আমাগোর জন্য কোথাও শান্তি নাই। তারা পারে খালি আমাগো মারতে!’ গত ১০ জানুয়ারি লাকসামের পরানপুরে দুর্বৃত্তরা তার ট্রাকে পেট্রল বোমা ছুঁড়ে মারে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, পিয়ারের শরীরের ১৫ শতাংশ পুড়ে গেছে। পিয়ার আহমেদের বেডের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন তার স্ত্রী শামসুন নাহার। তিনি বলেন, ‘যারা এ কাজ করছে তাদের বলুন আমার স্বামীর হাত বালা করি দিতে। যাগো লাই আমার স্বামী এত কষ্ট করছে, আল্লাহ তুমি এই অপরাধীদের শাস্তি দিও।’
পিয়ার আহমেদের পাশের বেডে ১৪ জানুয়ারি থেকেই আছেন নরসিংদীর গাড়ির হেলপার মাসুম। মাসুমের সেবা করছেন তার মা। পরিবারের উপার্জনক্ষম ছেলে আগুনে দগ্ধ হয়ে হাসপাতালের বেড়ে শুয়ে আছে। তার কাছে ছেলের অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বাজান দোয়া কর যেন আমার পোলা বালা হয়া যায়। সে আমার পরিবারের সম্বল।’
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের প্রকল্প পরিচালক সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘চার থেকে সাড়ে চার শ রোগীর চিকিৎসা দিতেই আমরা হিমশিম খাচ্ছি। তার মধ্যে নাশকতার রোগীদের নিয়ে বেকায়দায় পড়তে হচ্ছে।’
তিনি জানান, রাজনৈতিক সহিংসতায় এখন পর্যন্ত (বুধবার দুপুর) ৪০ জন ভর্তি হয়েছে, যার মধ্যে এখনও ২১ জন আছে। ১৩ জন সুস্থ হয়ে চলে গেছে। আর তিনজন মারা গেছে। যারা এখনো আছে তাদের মধ্যে চার-পাঁচজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
তিনি আরও বলেন, এই ঘটনায় যারা আসছে, তাদের বেশির ভাগই খেটে খাওয়া মানুষ। আমার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, এরা হয়ত সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যাবে, কিন্তু মানসিক যন্ত্রণা থেকে রেহাই পাবে না। তাদের মনে সবসময় ভয় কাজ করবে। এরা আর পূর্বের পেশায় ফিরেও যেতে পারবে না।
তিনি সরকার ও সমাজের বিত্তবানদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, এদের পুনর্বাসনের জন্য সরকার এবং সমাজের বিত্তবানদেরই এগিয়ে আসতে হবে। পুনর্বাসন না হলে ভিক্ষাবৃত্তি ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না তাদের।
সাপ্তাহিক এই সময়ের সৌজন্যে