logo ২৮ এপ্রিল ২০২৫
সাইবার নিরাপত্তা: সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন
হাবিবুল্লাহ ফাহাদ
২৭ জানুয়ারি, ২০১৫ ১৯:১৬:৫৭
image


কাতার প্রবাসী মিজানুর রহমান। দেশে আছেন মা, ভাই, বোন ও স্ত্রী। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলার সহজ মাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেট বেছে নিয়েছিলেন তিনি। ম্যাসেজিং অ্যাপ্লিকেশন্স ভাইবারের মাধ্যমে বিনামূল্যে কথা বলতেন যখন খুশি তখন। পরিবারের সদস্যদের ছবিও দেখতে পেতেন সহজে। কিন্তু দেশে ভাইবার সুবিধা বন্ধ করে দেওয়ার পর পরিবারের সঙ্গে আগের মতো যোগাযোগ করতে পারছেন না তিনি। টাকা খরচ করে ফোন করতে হচ্ছে। যে কারণে যখন-তখন কথাও বলতে পারছেন না।

ভাইবার, ট্যাঙ্গোর মতো পাঁচটি জনপ্রিয় ইনস্ট্যান্ট ম্যাসেজিং অ্যাপ্লিকেশন বন্ধ করে দেওয়ার পর এমন বিপাকে পড়েছেন প্রবাসী মিজানুর রহমান। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেওয়া একটি স্ট্যাটাসে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াও জানিয়েছেন তিনি। পরে যোগাযোগ করা হলে কাতারে একটি আইটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মিজানুর বলেন, ‘যখন ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে সরকার এগিয়ে যাচ্ছে, তখন নিরাপত্তার অজুহাতে প্রযুক্তিগত সুযোগ-সুবিধার অযাচিত নিয়ন্ত্রণ আমাদের সাইবার নিরাপত্তার বিষয়টিকে প্রশ্নের মুখে ছুঁড়ে দিচ্ছে। সাইবার অপরাধ তো নতুন কিছু নয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতিনিয়তই হচ্ছে। তাই আগেভাগেই এগুলো নিয়ন্ত্রণে যথাযথ সক্ষমতা অর্জন করা দরকার ছিল। কিন্তু আমরা সেটি করতে ব্যর্থ হয়েছি।’

একমত প্রযুক্তিবিদরাও। তারা  বলছেন, তথ্যপ্রযুক্তির মন্দ দিক থাকবেই। এটা মোকাবিলা করতে হবে প্রযুক্তি দিয়েই। ইন্টারনেটের বিভিন্ন ধরনের সেবা বন্ধ করে দিয়ে তো এই মোকাবিলা সম্ভব নয়। তথ্যপ্রযুক্তিবিদ মোস্তাফা জব্বারের ভাষায়, ‘আপনার মাথা ব্যথা হয়েছে, আপনি চিকিৎসা না করে মাথাই কেটে ফেলেছেন। প্রযুক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তলোয়ার নিয়ে মাঠে নামলে তো আর সমস্যার সমাধান হবে না। দেশে সরকারি পর্যায়ে প্রযুক্তির সক্ষমতা বাড়াতে হবে। যখন থেকে দেশের তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ হতে শুরু করেছে তখন থেকেই এটা নিয়ে চিন্তার দরকার ছিল। ভাইবার, ট্যাঙ্গোর মতো শত শত অ্যাপ্লিকেশন তরুণরা তৈরি করতে পারে। সরকার কয়টা বন্ধ করবে? তাছাড়া বন্ধ করার পরও বিকল্প পথেও এসব অ্যাপ ব্যবহার করা যায়। তাই এসব অ্যাপ ব্যবহার করে কী ধরনের অপরাধ করা হচ্ছে সেটা খুঁজে বের করতে হবে।’

নিরাপত্তার কারণে বাংলাদেশ টেলিকম রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি) গত ১৭ জানুয়ারি ইন্টারনেটভিত্তিক ম্যাসেজিং অ্যাপ্লিকেশন্স ভাইবার ও ট্যাঙ্গো বন্ধ করে দেয়। তার দুদিন বাদে ১৯ জানুয়ারি নিষেধাজ্ঞা আসে হোয়াটসঅ্যাপ, লাইন ও মাই পিপলের ওপর। এ ঘটনার পরপরই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে তুমুল সমালোচনার ঝড় তোলেন প্রযুক্তিপ্রেমীরা। বিটিআরসির এমন সিদ্ধান্তকে ‘হঠকারী’,  ‘অদূরদর্শী’, ‘দুর্বল’ ও ‘প্রযুক্তিবিমুখ’ বলেও আখ্যায়িত করেন তারা। যতদ্রুত সম্ভব ইন্টারনেটে ভয়েস কল ও ম্যাসেজিংয়ের এই অ্যাপ্লিকেশনগুলো খুলে দেওয়ার দাবি করেন তারা। নানামুখী বিতর্কের মুখে গত ২২ জানুয়ারি থেকে এসব অ্যাপ্লিকেশন্স সচল হয়েছে। তবে বন্ধ করার সময় বিটিআরসি যেভাবে নির্দেশনা জারি করেছিল, তেমনি খুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে এ ধরনের কোনো ঘোষণা ছিল না। এর আগেও দীর্ঘদিন ইন্টারনেটের ভিডিও পোর্টাল ইউটিউব বন্ধ করে দিয়েছিল বিটিআরসি। ওই ঘটনার পরও তুমুল সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছিল সরকারকে।

সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, হঠাৎ হঠাৎ এমন অদূরদর্শী সিদ্ধান্তে সরকার রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জনগণের বিরাগভাজন হচ্ছে। এর পেছনে দায়ী যারা এসব বিষয়ে না বুঝেই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তারা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে সরকারের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে যারা বসে আছেন, তাদের অনেকেরই এ বিষয়ে সঠিক জ্ঞান নেই।

জানতে চাইলে বুয়েটের ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজির অধ্যাপক এস এম লুৎফুল কবির বলেন, ‘ভাইবার বন্ধ করলে কী হবে? ইন্টারনেটভিত্তিক এ ধরনের আরও অনেক মাধ্যম তো খোলা আছে। বিটিআরসি কতগুলো বন্ধ করবে?’

তবে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক বলেন, ‘তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষের পাশাপাশি এর নিরাপত্তার দিকটিও গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে সরকার। এরই মধ্যে সাইবার অপরাধ দমনে একটি হেল্পডেস্ক খুলেছে সরকার। তাছাড়া সরকার নজরদারি না করলে তো অপরাধ ধরা পড়ত না। সাইবার অপরাধ করার কারণে তো আইসিটি আইনে অনেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতেও যারা এ ধরনের অপরাধ করবেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’   

সাইবার অপরাধ দমনে নেই আইন!     

সাইবার অপরাধ শনাক্তের পর আসে বিচারের মাধ্যমে শাস্তির বিষয়টি। কিন্তু দেশের বিদ্যমান আইনে সাইবার অপরাধের বিচার করা সহজ নয়। কারণ এখনো দেশের আদালতে ইলেকট্রনিক অ্যাভিডেন্স বা সাক্ষ্যপ্রমাণ গ্রহণযোগ্য নয়। তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের উপাচার্য অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী বলছিলেন সেই কথা। তিনি বলেন, ‘উন্নত বিশ্বে আদালতে ইলেকট্রনিক অ্যাভিডেন্স গ্রহণযোগ্য। আমরা এখনো ওই জায়গায় পৌঁছতে পারিনি।’

বিটিআরসির তথ্য অনুযায়ী, গত নভেম্বর শেষে দেশে ইন্টারনেট সংযোগ সংখ্যা চার কোটি ২৯ লাখ ৯৬ হাজার ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে সিংহভাগই সেলফোন অপারেটরদের ডাটাভিত্তিক সেবার গ্রাহক। ছয় সেলফোন অপারেটরের ইন্টারনেট সেবার সংযোগ সংখ্যা চার কোটি ১৫ লাখ ১৩ হাজার। দিনদিন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়লেও সাইবার অপরাধ দমনে এখনো দেশে আইন করাও সম্ভব হয়নি। এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে এমন তথ্যও প্রযুক্তি-সংশ্লিষ্টদের কাছে আছে। মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘দেশে একটা সাইবার অপরাধ দমন আইন নেই। আইসিটি আইনের নামে যেটা আছে সেটা মোটেও সাইবার অপরাধ দমনে সক্ষম নয়। কোনটা সাইবার অপরাধ সেই সংজ্ঞাও নেই আইসিটি আইনে। তাহলে এটা দিয়ে কীভাবে অপরাধ দমন করা সম্ভব?’

হ্যাকারদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া

ভাইবারের ওপর নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন সাইবার হ্যাকাররা। নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্ত আসার পরপরই বিটিআরসির অফিসিয়াল ওয়েবসাইটটি হ্যাক করে ‘অ্যানোনিমাস’ নামের একটি হ্যাকিং গ্রুপ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও টুইটারে হ্যাকিংয়ের খবরও জানান দেন তারা। বিটিআরসি অবশ্য এটাকে ‘স্পমিং’ বলে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। তবে ওয়েবসাইটে হ্যাকারের আক্রমণের কথা স্বীকার করে বিটিআরসির সহকারী পরিচালক (মিডিয়া উইং) জাকির হোসেন খান বলেন, ‘ওয়েব দুনিয়ায় এমন ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে। এটা মূলত স্পমিং।’

তবে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার বিষয়টি সামনে এনে বিটিআরসির এই সিদ্ধান্তকে যথার্থ মনে করেন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। তারা বলছেন, ইন্টারনেট সংযোগ ব্যবহার করে এসব ওটিটি (ওভার দ্য টপ) সেবার মাধ্যমে ভয়েস এবং ভিডিও কল করা যায়। এই ওটিটি সেবা জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের বেশি পছন্দ। কারণ এখনো ভাইবার, ট্যাঙ্গোর মতো অ্যাপ্লিকেশনগুলোকে পুরোপুরি নজরদারির মধ্যে আনা সম্ভব হয়নি। আর এই সুযোগটাই কাজে লাগাচ্ছে সন্ত্রাসী ও জঙ্গিরা। যোগাযোগের নিরাপদ মাধ্যম হিসেবে তারা এগুলোকে বেছে নিয়েছেন। কে কোথায় আছেন তাও শনাক্ত করা যাচ্ছে না। এসব মাধ্যম ব্যবহার করে নানা ধরনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। বিরোধী দলের হরতাল-অবরোধে নাশকতা সৃষ্টির নির্দেশনাও দেওয়া হচ্ছে এই মাধ্যমগুলো ব্যবহার করে। যে কারণে রাষ্ট্রীয় স্বার্থে এই অ্যাপ্লিকেশনগুলো সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়।

তরুণদের মধ্যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া

প্রযুক্তিপ্রেমীদের সিংহভাগই তরুণ-তরুণী। যাদের অনেকেই শিক্ষা ও দৈনন্দিন কাজের যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন ভাইবার, ট্যাঙ্গো, হোয়াটসঅ্যাপকে। এসব অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করে সহজেই বার্তা পাঠানো, ভয়েস রেকর্ড পাঠানো, দরকারি কাগজপত্র স্ক্যান করে পাঠাতে পারে। ছবিও শেয়ার করতে পারেন মুহূর্তেই। কিন্তু হঠাৎ করে এমন গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমগুলোতে নিয়ন্ত্রণ আরোপে বেকায়দায় পড়তে হয়েছে তাদের।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী শেহনাজ আক্তার এক টুইট বার্তায় লেখেন, ‘খেয়াল-খুশিমতো যেকোনো সময় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা মোটেও সমর্থনযোগ্য নয়। যেকোনো সমস্যার তো সমাধান আছে। তাই বলে বন্ধ করে দিতে হবে কেন? তাহলে কি আমাদের রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ভাইবার, হোয়াটসঅ্যাপের কাছে জিম্মি।’

একটি বেসরকারি সফটওয়ার ফার্মে কাজ করেন মাজেদুল ইসলাম। বিটিআরসির এই সিদ্ধান্তে বিপাকে পড়েছেন তিনি। কাজেও বেশ সমস্যা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক ক্লাইন্টদের সঙ্গে যোগাযোগে বেশ সমস্যা হচ্ছে। উপায় না পেয়ে ই-মেইলেই কাজ সারছেন। মাজেদুল বলেন, ‘বিটিআরসি চাইলেই কি এসব মাধ্যম বন্ধ রাখতে পারবে? একটা না একটা উপায় বাতলে ঠিকই এগুলো খুলে ফেলবেন প্রযুক্তির ব্যবহারকারীরা। তখন তারা কী করবে?’

ভাইবার বন্ধ হয়েছিল আরও অনেক দেশে, ঠেকানো যায়নি

শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের আরও কয়েকটি দেশে এসব অ্যাপ্লিকেশন্স বন্ধ রাখা হয়েছিল। কিন্তু কাজে আসেনি। ঠিকই বিকল্প পথ বের করেছেন তরুণরা। কলম্বোভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান লার্ন এশিয়ার সিনিয়র রিসার্চ ফেলো আবু সাঈদ খান বলেন, ‘কারো অবস্থান ট্র্যাকিং করতে হলে যে ডিভাইস বা যন্ত্রে কথা বলছেন সেটা ট্র্যাক করা এক ধরনের প্রযুক্তি। তবে এ ধরনের সরকারি নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয় না। পাকিস্তান, সৌদি আরব, তুরস্কে এ ধরনের অ্যাপ্লিকেশনের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। কাজে আসেনি।’

প্রযুক্তির ব্যবহার সহজে বশে আনা সম্ভব নয় মন্তব্য করে সাঈদ খান বলেন, ‘তরুণরা অত্যন্ত চালাক। জিপিএন প্যানেলিং করে সরকারের নিষেধাজ্ঞা বাইপাস করে তারা বিদেশে কথা বলে, ভাইবারে কথা বলে।’

এই প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ মনে করেন, টেলিযোগাযোগে আড়িপাতা নতুন কিছু নয়। তবে এসব বিষয় যত গোপন রাখা যায় তত ভালো। তা না হলে অপরাধীরা সচেতন হয়ে যাবে। সাঈদ খান বলেন, ‘পৃথিবীতে এমন কোনো টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা নেই যেখানে আড়িপাতা যায় না। তবে এটি কারিগরি সক্ষমতার ওপর নির্ভর করে। তবে কোথাও কেউ বলে না কোনটায় তারা আড়ি পাতবে।’

সহজ নয় নজরদারিও

ইন্টারনেট টেলিফোন সার্ভিস বা বার্তা পাঠানোর মাধ্যমগুলোকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা সহজ নয় বলে মনে করেন প্রযুক্তিবিদরা। কারণ প্রযুক্তির একটি মাধ্যম বন্ধ হলে খুলে যায় নতুন বাতায়ন। দিনদিন প্রযুক্তির উৎকর্ষ মানুষকে পরিচিত করিয়ে দিচ্ছে নিত্যনতুন উদ্ভাবনের সঙ্গে। প্রযুক্তিবিদ আবু সাঈদ খান আন্তর্জাতিক একটি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘ম্যাসেজিং অ্যাপ্লিকেশনগুলো বন্ধ করে দেওয়ার মানেই হলো সরকার কার্যকরভাবে মনিটর করতে পারে না। সেটা সম্ভবও নয়। এ ধরনের অ্যাপ্লিকেশন্সগুলো কুটির শিল্পের মতো। যারা কোডার আছে এমন ১০-১২ জন ছাত্র যদি মনে করে অ্যাপস তৈরি করবে, সেটা তারা করেও ফেলতে পারে।’

রাষ্ট্রযন্ত্রে যারা বসে আছেন তাদের মধ্যে প্রযুক্তি জানাশোনা লোকের অভাব রয়েছে। যে কারণে যেকোনো সময় প্রযুক্তির ওপর নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্ত চলে আসে। তারা বুঝে কিংবা না বুঝেই নানা সিদ্ধান্ত দেন। আর এর ধকল পোহাতে হয় নাগরিককে।

দেশের স্বনামধন্য একজন প্রযুক্তিবিদ বলেন, ‘প্রযুক্তির কোনো বিষয় গোপন রাখা সম্ভব নয়। যারা একটু সচেতন তারা ঠিকই পথ বের করে নেবে। আমাদের আমলাতন্ত্রের ধারকবাহকরা যদি এটা বুঝতেন তাহলে চটজলদি এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিতেন না, যা হাস্যকর প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়।’

সাইবার অপরাধ ঠেকাতে উদ্যোগ

সাইবার অপরাধ ঠেকাতে সরকার বিভিন্ন সময় কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। অথচ প্রচার-প্রচারণার অভাবে এ ব্যাপারে কারোই কিছু জানা নেই। এমনকি তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরাও জানেন না কিছু। তবে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সাইবার অপরাধের ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ায় সরকার আলাদা সাইবার সিকিউরিটি বিভাগ প্রতিষ্ঠার কথা চিন্তা করছে। এ বিভাগের অধীনে থাকবে একাধিক কম্পিউটার ইনসিডেন্ট রেসপন্স টিম (সার্ট)। যারা কম্পিউটারে ইন্টারনেট ব্যবহারের ফলে সাইবার আক্রমণের ঘটনা জানার সঙ্গে সঙ্গে তা সমাধান করবে।

মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা জানান, বিগত পাঁচ বছরে আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও সরকারি-বেসরকারি অনেক সেবা ডিজিটালাইজেশন এবং ই-সেবা (অনলাইন সেবা) ও ই-কমার্স চালুর ফলে সাইবার নিরাপত্তা ঝুঁকি বেড়ে গেছে। বিভিন্ন ধরনের সাইবার অপরাধের প্রবণতা দিনদিন বাড়ছে। এ কারণে সাইবার নিরাপত্তা ঝুঁকি কমাতে ও অনলাইনে নিরবচ্ছিন্ন সেবা নিশ্চিত করার জন্য আলাদা একটি বিভাগের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। এই বিভাগ সাইবার অপরাধের সঙ্গে জড়িত সব বিষয়ের তদারকি, মানুষকে সচেতন এবং সাইবার অপরাধ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানাবে।

‘জাতীয় পর্যায়ে সাইবার নিরাপত্তা ও আইসিটি আইন ২০১৩ সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি প্রকল্প সূত্র জানায়, প্রায় সাড়ে ছয় কোটি টাকা ব্যয়ের এ প্রকল্প শিগগিরই বাস্তবায়ন করা হবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে মানুষকে সাইবার অপরাধ বিষয়ে সচেতন করে তোলা সম্ভব হবে এবং আইসিটি আইনের দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করা সম্ভব হবে। এ প্রকল্পের অধীনে দেশের ৬৪ জেলায় বিভিন্ন স্তরের মানুষকে সাইবার অপরাধ ও নিরাপত্তা বিষয়ে সচেতন করা হবে।

তবে গত বছরের শেষ দিকে তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক তার ফেসবুকের পাতায় দেওয়া এক স্ট্যাটাসে জানান,  সাইবার অপরাধ প্রতিরোধে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। সম্প্রতি চালু করা হয়েছে সাইবার নিরাপত্তার হেল্পলাইন ০১৭৬৬৬৭৮৮৮৮। সপ্তাহের সাত দিন ২৪ ঘণ্টা এ নম্বরে ফোন করে সাইবার সংশ্লিষ্ট হয়রানির অভিযোগ করা যাবে।

সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করে ইনসাইট বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের তথ্য মতে, দেশে প্রতি ২০ সেকেন্ডে একটি সাইবার অপরাধ সংঘটিত হয় এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এগুলোর ৯৫ শতাংশ শনাক্ত করতে পারে। ২০০৪ সালে ই-মেইলের মাধ্যমে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনাকে প্রাণনাশের হুমকির মাধ্যমে সাইবার অপরাধ আলোচনায় আসে। দেশে সাইবার অপরাধ ও সাইবার আইন নিয়ে জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে ইনসাইট বাংলাদেশ। এরই মধ্যে মোবাইল হেল্পডেস্কও চালু করেছে তারা। সাইবার অপরাধে দুই থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের শাস্তি এবং পাঁচ লাখ থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ কোটি টাকা জরিমানা দিতে হতে পারে। টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনের ৬৯ ধারা অনুযায়ী এ শাস্তি দেওয়া হতে পারে।-সাপ্তাহিক এই সময়-এর সৌজন্যে।