রীতিমতো আঁতকে উঠার মতো তথ্য। অসাবধানে রাস্তা পারাপারে বছরে হারিয়ে যাচ্ছে দুই শরও বেশি প্রাণ। পুলিশের হিসাবে গত চার বছরে এভাবে মারা গেছে সাড়ে নয় শরও বেশি মানুষ। বিমানবন্দর মোড়ে এমন তথ্য সম্বলিত বিলবোর্ড বসিয়ে যখন-তখন বিশৃঙ্খলভাবে রাস্তা পার না হতে জনগণকে অনুরোধ করেছে পুলিশ। কিন্তু কে শোনে কার কথা? এই বিলবোর্ডের পাশ দিয়েই মানুষ চলছে যেনতেনভাবে। যেকোনো সময় ঘটতে পারে প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা, কিন্তু ভ্রƒক্ষেপ নেই পথচারীদের।
রাজধানীর অন্য এলাকার তুলনায় বিমানবন্দর সড়কে গাড়ি চলে অপেক্ষাকৃত দ্রুত গতিতে। তাই স্বভাবতই পথচারীদের থাকার কথা অনেক বেশি সতর্ক। কিন্তু দ্রুতগামী গাড়ি চলার পথেই দৌড় দিয়ে আবার কখনও পিছিয়ে এসে বা হাত তুলে একসঙ্গে একদল লোকের সড়ক পার হতে দেখা গেল। হঠাৎ করে গাড়ি ব্রেক কষতে পারবে কি না বা কষলে দুর্ঘটনার কোনো আশঙ্কা থাকে কি না, সে বিষয়েও কোনো চিন্তাই নেই পথচারীদের।
মোড়টিতে দায়িত্ব পালন করেন বেশ কয়েকজন সার্জেন্ট ও কনস্টেবল। এভাবে সড়ক পারাপারে বাধা দিতে দেখা গেল না কাউকে। কেন এমনটি হচ্ছে, জানতে চাইলে এক কনস্টেবল বলেন, ‘ভাই রে, এতো মানুষকে কীভাবে বাধা দেব, নিজের বিপদ কেউ কেউ নিজে না বুঝলে আপনি কয়দিন তাকে বলে দেবেন। আর সারা দিন এই মানুষের ঠেকাতে গেলে গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না আর। তখন আবার লেগে যাবে যানজট।’
এই পুলিশ কর্মকর্তার বক্তব্য একেবারে অস্বীকার করার জো নেই। মোড়গুলোতে যে কয়জন পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করেন, যান চলাচলে শৃঙ্খলা রাখতেই হিমশিম খেতে হয় তাদের। নিজেদের বিশ্রাম আর খাওয়া-দাওয়াই কঠিন হয়ে পড়ে এদের পক্ষে। এই অবস্থায় পথচারী নিয়ন্ত্রণ করা তাদের জন্য দুঃসাধ্য।
নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ক্ষেত্রে নগরবাসীদের নিজেদের সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই।
জানতে চাইলে নগর বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, এ বিষয়ে জনগণকেই সচেতন হতে হবে। জনগণকে আগে নিজের জীবনের নিরাপত্তার বিষয়টি ভেবে রাস্তা পারাপারে ফুটপাত, ফুট ওভারব্রিজ অথবা জেব্রা ক্রসিং ব্যবহার করতে হবে। তবে ফুটপাত, ফুট ওভারব্রিজগুলো হকারদের দখলে হওয়ায় জনগণ তা ব্যবহার করতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। ফুটপাত, ফুট ওভারব্রিজগুলো হকারদের দখলমুক্ত করতে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
নগরীর কাকরাইলে বছর তিনেক আগে ঘটা এক দুর্ঘটনা নাড়া দিয়েছিল গোটা দেশকে। বাস চাপায় সেদিন এক শিশুর মৃত্যু কাঁদিয়েছিল বহু মানুষকে। কিন্তু সেই মৃত্যুর জন্য কাকে দায়ী করা যাবে? স্কুলের পাশেই একটি ফুট ওভারব্রিজ থাকলেও শিশুটির মা তাকে নিয়ে দৌড়ে পার হতে চেয়েছিলেন রাস্তা। আর এক পাশে একদিক থেকে আসা গাড়ি দেখে পার হলেও অপর পাশে অন্যদিক থেকে আসা গাড়ির দিকে নজর রাখতে ভুলে গিয়েছিলেন ওই মা। আর সেই চাকায় শিশুটির পাশাপাশি পিষ্ট হন তার মাও।
ফুট ওভারব্রিজ আবার ফাঁকা
নগরবাসীকে ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করতে গত ২৫ নভেম্বর থেকে এক সপ্তাহের জন্য অভিযান করেছিল পুলিশ। কিন্তু এরপর রাস্তা পারাপারে ফিরেছে আগের সেই নৈরাজ্য। চলন্ত গাড়ির সামনে দিয়ে হাত উঁচিয়ে দৌড়ে পার হচ্ছে মানুষ। নিজের জীবনের পরোয়া নেই, আবার সেই গাড়িটিও যে দুর্ঘটনায় পড়তে পারে সে দিকেও নেই ভ্রƒক্ষেপ।
নগরবাসীর রাস্তা পারাপারে এমন বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে পুলিশের অভিযান প্রথম দিন প্রশংসিত হলেও বাহিনীটির কিছু সদস্যের বাড়াবাড়ির কারণে সমালোচনায় পড়ে দ্বিতীয় দিনেই। রাস্তায় নামার সঙ্গে সঙ্গে পথচারীদের পাকড়াও, মারধর আর টেনে-হেঁচড়ে নিয়ে আসার পাশাপাশি একাধিক পথচারীকে কারাদ- দেওয়ার পর আবেদন হারায় পুলিশের অভিযান।
আবার জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা, আশপাশে ফুট ওভারব্রিজ না থাকলে জেব্রা ক্রসিংয়ের ব্যবস্থা না করাসহ নানা কারণে সড়ক পারাপার আগের মতোই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে। আর অভিযান শেষে এ ক্ষেত্রেও ফিরেছে নৈরাজ্য।
২০০৭ সালের এক-এগারোর পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ও একই ধরনের উদ্যোগ নিয়েছিল পুলিশ। তখন বিশৃঙ্খলভাবে রাস্তা পারাপারে পাঁচ টাকা জরিমানার বিধান করা হয়েছিল। কিন্তু কয়েকদিন চলার পর পথচারীদের নিয়ন্ত্রণে হাল ছেড়ে দেয় পুলিশ।
বাংলামোটর এলাকায় ফুট ওভারব্রিজ থাকলেও এক পথচারী রাস্তা পার হলেন দৌড়ে। তখন গাড়ি চলছিল ওই পথে। এভাবে কেন আসলেন, ভয় করে না? জানতে চাইলে ওই পথচারী জবাব দিলেন, ‘ব্রিজে উঠতে কষ্ট লাগে, আর সময়ও নষ্ট হয়।’ এই এলাকায় এভাবে রাস্তা পার হতে গিয়ে তো একাধিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছেÑএই মন্তব্যের জবাবে মৃদু হেসে ওই পথচারী বললেন, ‘রাস্তায় নামলে এতসব মনে থাকে না গো বোন।’ বলেই সোজা হেঁটে চলে গেলেন তিনি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার বেনজীর আহমেদ (বর্তমানে র্যাবের মহাপরিচালক) বলেন, ‘এটা একটি প্রতীকী অভিযান ছিল। ঢাকার মতো বড় শহরে কেবল পুলিশ দিয়ে অভিযান চালিয়ে এই বিশৃঙ্খলা দূর করা সম্ভব নয়। এ ব্যাপারে নাগরিকদের সচেতন ও দায়িত্বশীল হতে হবে।’ বনানীর চলন্ত ফুট ওভারব্রিজের মতো নগরীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় একই ধরনের উদ্যোগ নিতে ঢাকা সিটি করপোরেশনকে। পুলিশ অনুরোধ করবে বলেও জানান বেনজীর আহমেদ।
অপরিকল্পিত ফুট ওভারব্রিজ
নিরাপদে সড়ক পারাপার করতে নগরীর বিভিন্ন মোড়ে ফুট ওভারব্রিজের পাশাপাশি আছে বেশ কিছু আন্ডারপাস। কিন্তু যে জায়গা দিয়ে মানুষ বেশি পারাপার হয়, সেখানকার বদলে বেশিরভাগ এলাকাতেই ফুট ওভারব্রিজগুলো বসানো হয়েছে দূরে। ফলে অতদূর হেঁটে মানুষ সেগুলো ব্যবহার করতে চায় না।
বিমানবন্দর মোড়ের কথাই ধরা যাক। সড়ক দিয়ে পার না হতে চাইলে এক পথচারীকে অন্তত ২০০ গজ হেঁটে ওঠতে হবে ফুট ওভারব্রিজে। তারপর রাস্তা পার হয়ে আবার ফিরতে হবে একইভাবে।
সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে যে ফুট ওভারব্রিজটি বসানো হয়েছে তার সিঁড়িগুলো বসানো হয়েছে এমন জায়গায় যেখানে যেতেই বেশ ভোগান্তি পোহাতে হয় মানুষকে। আবার সিঁড়ির গোড়ায় মলমূত্রের গন্ধের কারণে ওই পথ মাড়াতে চায় না মানুষ।
ফার্মগেটের পুলিশ বক্সের পাশ দিয়েও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পথচারী পার হয় সড়ক ধরে। মাঝেমধ্যে পুলিশ এভাবে যেতে বাধা দেয় পথচারীদের। কিন্তু এমনটি করলে বিজয় সরণির দিকে খানিকটা এগিয়ে গিয়ে রাস্তা পার হয়ে আবার ফিরতে হয় পথচারীদের।
শাহবাগ মোড়েও একই চিত্র। চার রাস্তার মোড় দিয়ে মানুষ পারাপারে নেই কোনো ওভারব্রিজ। যে ব্রিজটি আছে সেটি কাজে লাগতে পারে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় আর বারডেম হাসপাতালের মধ্যে যোগাযোগে।
আবার বহু ফুট ওভারব্রিজ পথচারীদের ব্যবহার করাই কঠিন হকার আর ভিক্ষুকের জন্য। নিউমার্কেটে গেলেও দেখা যাবে হকাররা পণ্যের পসরা নিয়ে বসে আছেন ব্রিজে। সিঁড়িতেও তাদের অবস্থানের কারণে পথচারীদের উঠতে হয় বিরক্তি আর ধাক্কাধাক্কি করেই। কোথাও কোথাও আবার ওভারব্রিজের পাটাতন ভেঙে গেছে, রাতে মলত্যাগ করে রাখতেও দেখা যায় কোনো কোনো ওভারব্রিজে।
কারওয়ানবাজারের আন্ডারপাস কেউ ব্যবহার করতে চাইলেও তাকে করতে হবে একই ধরনের কষ্ট। যে মোড় দিয়ে মানুষ রাস্তা পার হয় তার চেয়ে অনেক দূরে করা হয়েছে আন্ডারপাসটি। যে কারণে সেটি ব্যবহারে আগ্রহ কম মানুষের। আবার এক দিকে সড়কের পাশে এর মুখ থাকলেও অন্যদিকে আবার আন্ডারপাস থেকে বের হয়ে আবার সড়ক পার হতে হয় পথচারীদের। সেখানেও আছে ঝুঁকি।
নগরীতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ফুট ওভারব্রিজ নিঃসন্দেহে ফার্মগেটের মূল ওভারব্রিজটি। এর সিঁড়ি বেশ প্রশস্ত আর হকারদের দখলেও নেই তেমন। আর এটি ব্যবহার না করে সরাসরি সড়ক নিয়ে পারাপার করবে সেই উপায়ও নেই। সড়ক বিভাজকে উঁচু প্রতিবন্ধ করার কারণে মানুষ রাস্তা পার হয় ওভারব্রিজ দিয়েই।
জেব্রা ক্রসিং কোথায়?
সবাই যে ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহার করবে এমনটি নয়। কারও কারও থাকতে পারে অসুস্থতাজনিত সমস্যা। তাছাড়া শিশু এবং প্রবীণদের পক্ষে সিঁড়ি ব্যবহার করা বেশ কষ্টকর। এদের জন্য সড়ক পারাপারে থাকার কথা জেব্রা ক্রসিং, যেখানে গাড়ি বন্ধ করে পথচারী পারাপারের ব্যবস্থা করে দেবে পুলিশ। কিন্তু নগরীর এই জেব্রা ক্রসিংগুলো একে একে নাই হয়ে গেছে কবে তা বলতে পারে না কেউ। পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বারবার তাগাদা দিলেও এ নিয়ে নগর কর্তৃপক্ষ বা পুলিশের নেই কোনো উদ্যোগ।
ডিএমপি হেড কোয়ার্টারে কর্মরত এসআই মামুন বলেন, সেটা ঠিক যে, নগরের কিছু কিছু জায়গায় জেব্রা ক্রসিং মুছে গেছে, কিন্তু যেসব জায়গায় জেব্রা ক্রসিং আছে সেসব এলাকায় জনগণই জেব্রা ক্রসিং দিয়ে পার হচ্ছে না। জনগণ নিজেরা সচেতন না হলে পুলিশ দিয়ে কতদিন? তবে রাস্তা পারাপারে ফুট ওভারব্রিজ ব্যবহারে অভিযান সামনে আবারো করার পরিকল্পনা আছে। পুলিশ বাধা দিলে অনেক সময় উল্টো পুলিশের ওপরই হামলা আসে বলে অনেক পুলিশ সার্জন জানান।-সাপ্তাহিক এই সময়-এর সৌজন্যে।