খোঁজ নেই বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকার।
তিনি কি শিগগির দেশে ফিরবেন?
‘জানি না কবে ফিরবেন। প্রথম প্রথম মোবাইলে কথা হতো। চার-পাঁচদিন ধরে তাও হচ্ছে না’, বলছিলেন খোকার ঘনিষ্ঠ এক বিএনপি নেতা।
চারদলীয় জোট সরকারের আমলে বেশ প্রভাবশালী ছিলেন খোকা। সরকারি দলের সংসদ সদস্য, সাবেক মন্ত্রী, দলের ভাইস চেয়ারম্যান, ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি, পাশাপাশি ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র, এতসব পদ এক ব্যক্তির দখলে। বিএনপির দুঃসময়ে এখন খোঁজ নেই এই নেতার।
দলের কেউ জানেন না তাদের ভাইস চেয়ারম্যানের কী অবস্থা।দলে তার অনুগামী-অনুসারী হিসেবে পরিচিতদের সঙ্গেও যোগাযোগ কমে গেছে। বিএনপির সাংগঠনিক এই দুর্যোগের দিনে ‘পরীক্ষিত’ খোকা যুক্তরাষ্ট্রে বসে চুপচাপ দিন পার করবেন, এমনটাও মেনে নিতে পারছেন না দলের নেতা-কর্মীরা।
গত ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের কয়েক দিন আগে গ্রেপ্তার হন সাদেক হোসেন খোকা। তখন অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। পরে জামিনে মুক্ত হয়ে ঢাকার বারডেম হাসপাতালে ভর্তি হন। উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। সেখানে তার কিডনিতে ক্যান্সার ধরা পড়ে। তার বামদিকের কিডনি কেটে ফেলা হয়। চিকিৎসকদের পরামর্শে গত ১ জুলাই খোকা যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখানেই চিকিৎসা চলছে তার।
মুক্তিযোদ্ধা খোকা ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দারুণ চমক সৃষ্টি করেছিলেন। হেভিওয়েট প্রার্থী শেখ হাসিনাকে ধরাশায়ী করে ঢাকার সংসদ সদস্য হন তিনি। বিএনপি ক্ষমতায় এলে যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী, পরে মৎস্য ও পশু সম্পদ মন্ত্রণালয়েরও দায়িত্ব পালন করেন কিছুদিন। এই খোকাকে নিয়ে সন্দেহ ও অবিশ্বাস অনেক আগেই বাসা বেঁধেছে বিএনপিতে। এক-এগারোর সময় যখন প্রায় সব রাজনৈতিক নেতা অস্তিত্ব রক্ষায় ব্যস্ত ছিলেন, তখন খোকা বহাল তবিয়তেই ছিলেন ঢাকার মেয়র পদে। টানা ১০ বছর সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে তিনি মেয়র পদে টিকেছিলেন, এমন অভিযোগও আছে। বিএনপির সংস্কারপন্থিদেরও একজন তিনি। যে কারণে তার ব্যাপারে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে দলের শীর্ষ পর্যায়েও।
বিএনপি নেতাদের অনেকে মনে করেন ‘সময় ভালো নয়’ বুঝেই বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন খোকা। নিজের ব্যবসা-বাণিজ্য, টাকাকড়ি রক্ষার জন্যই তিনি এ কৌশল নিয়েছেন। তা না হলে দীর্ঘদিন ধরে তার মতো একজন নেতা বিদেশে পরে রইবেন কেন? চাইলে তো দলের এই দুঃসময়ে কয়েকটা দিনের জন্য হলেও দেশে আসতেন। চাইলে যুক্তরাষ্ট্রে বসেও দলের জন্য কিছু করতে পারতেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক নেতা বলেন, ঢাকা মহানগর বিএনপিতে খোকার শক্ত অবস্থান রয়েছে। দীর্ঘদিন ঢাকার মেয়র ছিলেন তিনি। তার অনুপস্থিতিতে তার অনুসারী-অনুগামীরা তো মাঠে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারতেন। তারা তো ৫ জানুয়ারির আগে এবং পরের কোনো আন্দোলন-কর্মসূচিতেই সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়নি। এমনটাও শোনা যায় খোকা নিজে তার অনুসারী নেতা-কর্মীদের মাঠে নামার ব্যাপারে কোনো নির্দেশনা দেননি। ‘ঢাকা মহানগর কমিটি ইতিপূর্বে আন্দোলনে ব্যর্থ হয়েছে’ দলের চেয়ারপারসনের মুখে এ ধরনের মন্তব্য শোনার পর ক্ষুব্ধ হয়েছেন তিনি।
ঢাকা মহানগর কমিটিকে ‘ব্যর্থ’ আখ্যা দেওয়ার পর প্রকাশ্যেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন খোকা। সংবাদ সম্মেলন করে ঢাকা মহানগর বিএনপির সভাপতি পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণাও দেন তিনি। ওই সময় থেকে নিষ্ক্রিয় খোকা আর সক্রিয় হননি রাজনীতির মাঠে, বিএনপির নীতি নির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা এমনটাই মনে করেন।
গত ২৮ জুলাই ঢাকা মহানগরীতে নতুন আহ্বায়ক কমিটি করে দেন বেগম খালেদা জিয়া। আহ্বায়ক করা হয় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে। সদস্য সচিবের দায়িত্ব চাপে হাবিব-উন নবী খান সোহেলের ঘাড়ে। কথা ছিল নতুন এই কমিটি তিন মাসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করে দেবে ঢাকা মহানগরীতে। নতুন আহ্বায়ক কমিটিতে ১৪ নম্বর পদে আছে সাদেক হোসেন খোকার নাম। যে কারণে শুরু থেকেই ‘মনঃক্ষুণœ’ খোকার কাছ থেকে ওই ধরনের কোনো সহযোগিতা পায়নি নতুন কমিটি। এমনকি ঢাকা মহানগরীর ওয়ার্ড ও ইউনিট কমিটিগুলো টুকটাক গোছানোর কাজ শুরু হলেও খোকার নিজ এলাকায় কমিটি পুনর্গঠনে কোনো উদ্যোগই নেই।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, খোকার অবর্তমানে তার নিজের এলাকার ওয়ার্ড ও ইউনিটের মেয়াদোর্ত্তীণ কমিটি পুনর্গঠন করা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, স্থানীয় নেতারা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, খোকা ফিরে না আসা পর্যন্ত তারা এসব নিয়ে ভাবতে চান না।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব হাবিব-উন নবী খান সোহেল বলেন, ‘একসঙ্গে তো সব জায়গায় নতুন কমিটি করে দেওয়া সম্ভব নয়, সময় লাগবে। খোকা ভাইয়ের কারণে কমিটি আটকে আছে এই কথা পুরোপুরি ঠিক নয়। খোকা ভাই অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা। ঢাকা মহানগর বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক হিসেবে আমরা তো প্রয়োজনে তার সঙ্গে পরামর্শ করব। তিনি সুস্থ হয়ে দ্রুত আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন, এটাই আশা করছি।’
সহসাই ফিরছেন না খোকা
চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত খোকা সহসাই দেশে ফিরবেন না, এমনটাই বলছেন তার ঘনিষ্ঠরা। তারা বলছেন, এখন তার মুখে কেমোথেরাপি দেওয়া হচ্ছে। ওই চেকআপের আড়াই মাস পর আরেকটি চেকআপ করা হবে। যেহেতু তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে তাই তিনি দেশে ফিরলে আটকে যেতে পারেন। এতে তিনি শারীরিকভাবে আরও ক্ষতির মুখে পড়বেন, এই ভেবে চিকিৎসা শেষ হওয়ার আগে দেশে ফেরার কথা চিন্তা করছেন না।
তবে বিএনপির দলীয় সূত্র জানায়, খোকা বুঝতে পেরেছেন আওয়ামী লীগের সরকারকে সহজে আন্দোলন করে দমানো যাবে না। সহসা ক্ষমতা পরিবর্তন সম্ভব নয়, এই ভেবে আরেকটি নির্বাচন আয়োজনের আগে দেশে না ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। যে কারণে যুক্তরাষ্ট্রে বাসা ভাড়া করে স্ত্রীকে নিয়ে থাকছেন সেখানে। বিদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলেও বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে কানাঘুষা আছে।
খোকার ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আপাতত দেশে ফিরে কোনো ধরনের ঝামেলায় জড়াতে নারাজ তিনি। দলের চেয়ে নিজের শরীর নিয়ে বেশি চিন্তিত। জীবনের এই পর্যায়ে এসে জেল-জুলুমে ভয় পাচ্ছেন। রাজনীতির কারণে অহেতুক হয়রানি হতে চান না খোকা। কয়েকদিন আগে মুঠোফোনে তার এক ঘনিষ্ঠকে নাকি তিনি এও বলেছেন, ‘আগে নিজে বাঁচি তার পর দল। শরীর না চললে আন্দোলন করব কীভাবে? দলের জন্য তো কম করিনি। কিন্তু ব্যর্থতার দায় নিয়ে ফিরতে হয়েছে। এখন যারা আছে তারা কতটা সফল হয় সেটাও তো দেখতে হবে।’
খোকা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটনের মেমোরিয়াল স্লোয়েন কেটেরিং ক্যান্সার সেন্টারে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ জেমস শেইয়ি তার চিকিৎসা করছেন। তার শারীরিক অবস্থা এখন কিছুটা উন্নতির দিকে।
খোকার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা
গত বছর নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে বোমা নিক্ষেপের মামলায় আদালত খোকার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। খোকা উন্নত চিকিৎসার জন্য গত ১ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে দেশ ত্যাগ করেন। স্ত্রীসহ নিউইয়র্কের একটি ভাড়া বাড়িতে থাকছেন তিনি। দুই পুত্র থাকছেন লন্ডনে। বড় ছেলে ইসরাক হোসেন একজন প্রকৌশলী। ছোট ছেলের পড়াশোনা এখনো চলছে। ঢাকার ব্যবসা দেখছেন তার বিশ্বস্ত অনুসারীরা। খোকা যে বাড়িতে থাকতেন তা এখন ফাঁকা। সেখানে আছেন শুধু তত্ত্বাবধায়ক।
খোকায় অবিশ্বাস শীর্ষ নেতৃত্বের
খোকাকে নিয়ে সন্দেহ ও অবিশ্বাস বিএনপিতে বাসা বেঁধেছে অনেক আগেই। দলের হাইকমান্ডও তার ওপর পুরোপুরি আস্থা রাখতে পারেনি অনেক আগে থেকেই। এক-এগারোর সংস্কারপন্থিদের মধ্যে তিনিও ছিলেন। খোকাই প্রথম দলে চেয়ারপারসনের একক ক্ষমতা নিয়ে প্রকাশ্যে প্রশ্ন তোলেন। পরে খালেদা জিয়াকে কারাবাসে যেতে হলেও বহাল তবিয়তে ঢাকা সিটির মেয়রের দায়িত্ব পালন করে যেতে থাকেন তিনি।
তার কারণেই রাজধানীতে বিএনপির একের পর এক আন্দোলন ব্যর্থ হয় বলেও অভিযোগ আছে দলের ভেতরই। মার্চ ফর ডেমোক্রেসিতে নিজের অনুসারীদের মাঠে নামতে দেননি তিনি। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বাতিলের দাবিতে সারাদেশে যখন দুর্বার আন্দোলন গড়েছে বিএনপি, তখনও তিনি ও তার অনুসারীরা মাঠেই নামেননি।
তৃপ্ত নন দলের নেতা-কর্মীরা
কেবল অসুস্থতার কারণেই খোকা মার্কিন মুলুকে অবস্থান করছেন, এই যুক্তি মানতে নারাজ দলের নেতা-কর্মীরা। তারা বলছেন, এর পেছনে আরও কারণ আছে। তা না হলে তিনি কবে আসবেন তারও কোনো ঠিক নেই। এভাবে তার দেশে ফেরার অনিশ্চয়তাই বলে দিচ্ছে তিনি দেশের এই অরাজক পরিস্থিতি এড়িয়ে আরামে জীবন কাটাতে যুক্তরাষ্ট্রে আছেন।
এদিকে খোকা দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা বিদেশে পাচার করে নিয়ে গেছেন বলে সরকারের একটি সূত্র এই সময়কে জানিয়েছে। সূত্র বলছে, খোকা বিদেশে যাওয়ার সময় এবং পরে কয়েক ধাপে বিপুল টাকা বিদেশে পাচার করেছে এমন অভিযোগ আছে। এই অভিযোগ খতিয়ে দেখার ব্যবস্থা হচ্ছে। দুদক শিগগির এ ব্যাপারে উদ্যোগী হতে পারে বলে সরকারি সূত্র জানিয়েছে।
নেতারাও বিব্রত
খোকাকে নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতেও বিব্রতবোধ করছেন বিএনপির নীতিনির্ধারণীদের অনেকে। নিজেদের নাম গোপন করে কথা বলতেও নারাজ অনেকে। তবে কেউ কেউ উগরে দিলেন ভেতরের ক্ষোভ। বললেন, আজ বিএনপির কারণেই খোকা এত গুরুত্বপূর্ণ হয়েছেন। দল তাকে ঠকায়নি। তিনি দলের জন্য যতটুকু করেছেন, দলও তার জন্য অনেক করেছে। এত এত টাকাকড়ি, ব্যবসা-বাণিজ্যের পেছনে দলীয় পরিচয় বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু এখন দলের দুঃসময়ে, চেয়ারপারসনের দুঃসময়ে তিনি পাশে না থেকে বিদেশে বসে আছেন। ফোন করে দলের নেতা-কর্মীদের সমবেদনা দেবেন, এতটুকু তার কাছ থেকে পাওয়া যাচ্ছে না। -সাপ্তাহিক এই সময়-এর সৌজন্যে।