মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও সনদ নিয়েছেন আর তা দেখিয়ে চাকরির সময় বাড়িয়েছেন। নিয়ম না মেনে পদোন্নতি নেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। দরপত্র ছাড়াই আত্মীয়স্বজনকে দিয়ে কয়েকগুণ বেশি ব্যয়ে অবকাঠামোগত কাজ করিয়েছেন। টাকাকড়ি ভালোই এসেছে নিয়োগ বাণিজ্যে। পরিবারের কাজে অফিসের গাড়ি ব্যবহারেও তার জুড়ি মেলা ভার। নামে-বেনামে বাড়ি ও ফ্ল্যাটের মালিকও হয়েছেন তিনি। এতসব অভিযোগ বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নূরুল আলম তালুকদারের বিরুদ্ধে।
হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন সূত্র জানায়, দুর্নীতি-অনিয়ম-স্বেচ্ছাচারিতা আর স্বজনপ্রীতির রামরাজত্ব কায়েম করেছেন এমডি। মুক্তিযুদ্ধকেও ব্যবহার করেছেন নিজের স্বার্থ হাসিলে। চাকরি থেকে অবসরে গিয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষার সনদে জন্ম তারিখ ভুল হয়েছে এমন ঘোষণা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সনদ জোগাড় করেছেন। অবসরে যাওয়ার সাত মাসের মাথায় সেই সনদ দেখিয়ে আবারও বহাল হয়েছেন সরকারি চাকরিতে।
এমডির স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ে রাখঢাক না রেখেই বিরোধিতা করছেন করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। যেকোনো মূল্যে করপোরেশনকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার জন্য প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়েও বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন। লিখিত অভিযোগ করে নূরুল আলম তালুকদারের বিরুদ্ধে তদন্তের দাবি জানিয়েছেন তারা। বিষয়টি আমলে নিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এখন চলছে তদন্ত।
করপোরেশনের একজন কর্মকর্তা জানান, এমডি কোনো ধরনের দরপত্র ছাড়াই বিভিন্ন ধরনের কেনাকাটা, অবকাঠামো নির্মাণ ও ভবন রঙ করিয়েছেন। অফিস চত্বরে একটি শহীদ মিনার বানানো হয়েছে। এ কাজ করেছেন তার শ্যালক। কাজটিতে কোনো ধরনের দরপত্র আহ্বান করা হয়নি। যে কারণে রাষ্ট্রের অর্থের অতিরিক্ত ব্যয় করার সুযোগ পেয়েছেন তিনি। নূরুল আলম তালুকদার যোগ দেওয়ার আগেই এমডির দপ্তরটি সাজসজ্জার কাজ করানো হয়। কিন্তু এমডি যোগ দিয়েই আবার নিজের মনের মতো করে সাজসজ্জা করান। এ কাজ পেয়েছিলেন তার শ্যালক। প্রায় ৯ থেকে ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে এ কাজ করা হয়।
সূত্রে জানা গেছে, করপোরেশন ভবনটির প্রথম থেকে পঞ্চম তলা পর্যন্ত রঙের কাজটিও হয়েছে বিনা দরপত্রে। এ কাজও করেছেন তারা আত্মীয়। এছাড়া করপোরেশনের মূল ভবনের দুটি ও উত্তরা স্টাফ কোয়ার্টারের একটি গেট দরপত্র ছাড়া তৈরি করা হয়। এ কাজে নি¤œমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ আছে। পাশাপাশি এসব কাজের ব্যয় স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি দেখিয়ে বিল আদায় করা হয়েছে। এমডি নিজেও এ থেকে বড় একটি অংশ পেয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগেও বড় অঙ্কের বাণিজ্য হয়েছে, এ নিয়েও অভিযোগ আছে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। তার নিজ জেলা টাঙ্গাইলের বাসিন্দাদের অগ্রাধিকার দেন সব ধরনের নিয়োগে। আর উৎকোচের টাকা সংগ্রহের জন্যও আছে এমডির আস্থাভাজন কর্মকর্তারা। অফিসার, সিনিয়র অফিসার ও ডাটা এন্ট্রি অফিসার পদের বিপরীতে সর্বনি¤œ তিন লাখ টাকা পর্যন্ত উৎকোচ লেনদেন হয়েছে বলে জানা গেছে। এ নিয়ে পত্রপত্রিকাতেও খবর ছাপা হয়েছে। মজা করে কর্মকর্তাদের অনেকে বলেন, ‘হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনে যতবেশি নিয়োগ, ততবেশি বাণিজ্য।’
কথা বলার জন্য এমডি নূরুল আলম তালুকদারের মুঠোফোনে বৃহস্পতিবার সকালে ফোন করা হলে তিনি মিটিংয়ে আছেন বলে জানান। পরে ফোন করতে বলেন। ঘণ্টা দুয়েক পর ফোন করা হলে তিনি আবারও মিটিংয়ের অজুহাত দিয়ে পরে ফোন করতে বলেন।
অফিসের গাড়ি ব্যবহারেও রেকর্ড
অফিসের গাড়ি ব্যবহারেও অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছেন নূরুল আলম তালুকদার। নিজে এবং পরিবারের সদস্যরা মিলে হাউস বিল্ডিং করপোরেশনের ছয়টি গাড়ি ব্যবহার করেন, যা অতীতে কোনো এমডিকে করতে দেখা যায়নি। সূত্র জানায়, সরকারিভাবে এমডির একটি গাড়ি ব্যবহারের অনুমতি আছে। অথচ তার স্ত্রী-ছেলেময়ে এবং মেয়ের জামাতাও গাড়ি চড়েন করপোরেশনের। গাড়ির নম্বরগুলো হচ্ছে-ঢাকা মেট্টো গ-৩৩-৬৬০৯, ৩৩-০৭৩৪, ৩৩-০৭৩৫, ৩৭-৭৫৩৮, ঢাকা মেট্টো ঘ-১৪-৭৪৯৩, ১৩-৫৬৯৪। এসব গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণেও ব্যয় হয় করপোরেশনের টাকায়। ভুয়া ভাউচারের মাধ্যমে লাখ লাখ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে এমডির বিরুদ্ধে।
নামে-বেনামে বাড়ি, ফ্ল্যাটের মালিক সরকারি কর্মকর্তা
সরকারি চাকরি করে কীভাবে এত বিত্তবৈভবের মালিক হলেন নূরুল আলম তালুকদার এ প্রশ্ন তার ঘনিষ্ঠদের মনে। সৎ উপায়ে এত অর্থকড়ির মালিক হওয়া যে সম্ভব নয়, এটাও বিশ্বাস করেন তারা। নূরুল আলমের ঘনিষ্ঠ সূত্র এই সময়কে জানায়, নামে-বেনামে একাধিক ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে তার। এসব অ্যাকাউন্টে বিপুল টাকাও জমা আছে। এছাড়া রূপনগর আবাসিক এলাকায় সাত তলা বাড়ি, মিরপুর-১ নম্বর সেকশনে মাজার লাগোয়া টিনশেড বাড়ি ও প্লট, মিরপুর ডিওএইচএসে কোটি টাকার বেশি দামের ফ্ল্যাট, মিরপুরে অন্য জায়গায় আরও দুটি ফ্ল্যাট আছে। আমিন বাজারের পশ্চিমে দুই বিঘার ওপরে জমি আছে। যার দাম কয়েক কোটি টাকা। এছাড়া নিজ এলাকা টাঙ্গাইলের ঘাটাইলেও অনেক জমিজমা কিনেছেন তিনি।
মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও সনদ গ্রহণ
চাকরিতে ঢোকার সময় মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঘোষণা দেননি নূরুল আলম তালুকদার। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে ডিএমডি হিসেবে অগ্রণী ব্যাংক থেকে অবসরে যান। তার সাত মাস পর এসএসসি পরীক্ষার সনদে জন্মতারিখ ভুল আছে এমন ঘোষণা দেন তিনি। সূত্র জানায়, পরে মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়ে সরকারি চাকরিতে ফেরেন নূরুল আলম। একই সঙ্গে এই সরকারের গত মেয়াদের শেষ দিকে তথ্য গোপন করে হাউস বিল্ডিং করপোরেশনের এমডি পদে দুই বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগও বাগিয়ে নেন।
পদোন্নতিতে নিয়ম ভাঙার অভিযোগ
নূরুল আলম তালুকদার একসময় অরিজিনাল কৃষি ব্যাংকের উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) হিসেবে আনসার ভিডিপি ব্যাংকে বদলি হন। মহাব্যবস্থাপক (জিএম) হিসেবে পদোন্নতি পেতে ডিজিএম হিসেবে যে ধরনের অভিজ্ঞতা প্রয়োজন তার সেটি ছিল না। কিন্তু সরকারের অর্থ বিভাগের বিভিন্ন পর্যায়ের লোকজনের হাত করে আনসার ভিডিপি ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত জিএম হিসেবে পদোন্নতি নেন বলে অভিযোগ রয়েছে। পরে পূর্ণাঙ্গ জিএম হিসেবেও দায়িত্ব পান। এখানেই থেমে থাকেননি তিনি। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে পর্যন্ত দৌড়ঝাঁপ আর তদবিরের জোরে পদোন্নতির জন্য অপেক্ষমাণ ডিএমডি তালিকায় জ্যেষ্ঠতায় এক নম্বর হিসেবে নিজেকে তালিকাভুক্ত করে ডিএমডি পদ পান। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে অগ্রণী ব্যাংকে বদলি হয়ে সেখান থেকে অবসরে যান।
উৎকোচ নিয়ে পদোন্নতি
চার জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে ডিঙিয়ে আতিকুল ইসলামকে ডিজিএম হিসেবে পদোন্নতি দিয়েছেন এমডি। বিনিময়ে পাঁচ লাখ টাকা উৎকোচ নেওয়ার অভিযোগ আছে। আতিকুল ইসলাম হাউস বিল্ডিং করপোরেশন জিয়া পরিষদের সভাপতি এবং জাতীয়তাবাদী অফিসার কল্যাণ সমিতির সদস্য। এছাড়া পাঁচ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে ডিঙিয়ে পারভিন আক্তার নামে এক নারী কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেন।
নারী সহকর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার
এমডি নূরুল আলমের বিরুদ্ধে নারী সহকর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার এবং অকথ্য ভাষায় গালাগাল দেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন হাউস বিল্ডিং করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এমডি নারী কর্মীদের নিজের কক্ষে ডেকে নিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখেন। এমনকি সভার মধ্যও নারী কর্মকর্তাদের হেয় করেন। সূত্র জানায়, এমডির দুর্ব্যবহার ও গালাগাল দেওয়ার কারণে করপোরেশনের আইন বিভাগের ডিজিএম ফাহমিদা খানম গত ১৬ ডিসেম্বর থেকে স্বেচ্ছায় অবসরে যাওয়ার আবেদন দেন। তার আবেদনটি এখনও প্রক্রিয়াধীন আছে।
জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গেও এমডি দুর্ব্যবহার করেন বলে অভিযোগ আছে। সূত্র জানায়, তার ব্যবহারে টিকতে না পেরে গত বছরের এপিলে স্বেচ্ছায় অবসরে যান পিএইচআরডি বিভাগের ডিজিএম এ কে এম মান্নান ভূঁইয়া। এছাড়া অর্থ বিভাগের ডিজিএম মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন নতুন বছরের শুরুতে অবসরে যাওয়ার জন্য আবেদন দিয়েছেন।
করপোরেশনের কর্মচারী বাসায়
হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনের কর্মচারীদের দিয়ে নিজের বাসায় নিরাপত্তা প্রহরী এবং ঝিয়ের কাজ করান এমডি নূরুল আলম। সূত্রে জানা গেছে, ওই দুজনের একজন করপোরেশনের পালম্বার মো. আবুল কালাম আজাদ। যাকে দিয়ে বাসায় নিরাপত্তা প্রহরীর কাজ করান তিনি। ফটোকপি মেশিনের অপারেটর রুমিয়া আক্তারকে দিয়ে করান বাড়ির ঝিয়ের কাজ। এরা মাসে দু-একবার অফিসে এসে হাজিরা খাতায় সই করে চলে যান। এমডির কারণে কেউ এ ব্যাপারে কিছু বলতেও সাহস করেন না।
আরও যত অভিযোগ
করপোরেশনের তহবিলের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির অভিযোগ আছে এমডির বিরুদ্ধে। তিনি করপোরেশনের তহবিল বিভিন্ন ব্যাংকে এফডিআর করে রেখেছেন। এছাড়া ঋণ কার্যক্রম বন্ধ করে করপোরেশনের কোটি কোটি টাকা অল্প সুদে পছন্দের বেসরকারি ব্যাংকে এফডিআর করেছেন। বিনিময়ে নিজের আত্মীয়স্বজনকে বিভিন্ন ব্যাংকে নিয়োগের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন বলে জানান করপোরেশনের কর্মকর্তাদের অনেকে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পদে আজ্ঞাবহদের বসিয়ে প্রশাসনিক জটিলতা সৃষ্টি করেছেন নূরুল আলম। যে কারণে হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনে ঋণ ও প্রশাসনিক কার্যক্রমে স্থবিরতা নেমেছে।-সাপ্তাহিক এই সময়-এর সৌজন্যে।