logo ২৮ এপ্রিল ২০২৫
মুক্তিযোদ্ধা সনদ: সভাপতিতে আটকে আছে কমিটি!
হাবিবুল্লাহ ফাহাদ
২০ জানুয়ারি, ২০১৫ ০০:১৪:০৩
image


মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় নতুন করে নাম লেখাতে জমা পড়া আবেদন যাচাই-বাছাইয়ের কাজ সহসাই শুরু করা যাচ্ছে না। যাচাই-বাছাইয়ের জন্য উপজেলা পর্যায়ে কমিটি গঠনে দেরি হওয়ায় এ সমস্যা দেখা দিয়েছে। একাধিকবার চাওয়ার পরও স্থানীয় পর্যায় থেকে কমিটি প্রধানের নাম মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে দেরি করায় এ জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সাত সদস্যবিশিষ্ট কমিটির প্রধান হিসেবে স্থানীয় সংসদ সদস্যদের নাম চাওয়া হয়েছে। তবে সংসদ সদস্যকে অবশ্যই মুক্তিযোদ্ধা হতে হবে। তিনি যদি মুক্তিযোদ্ধা না হন তবে মন্ত্রণালয় থেকে ঠিক করে দেওয়া একজন প্রতিনিধি কমিটির প্রধান হিসেবে কাজ করবেন। গত ২১ অক্টোবর জেলা প্রশাসককে চিঠি দিয়ে তার অধীনস্থ উপজেলাগুলোর যাচাই-বাছাই কমিটির সভাপতির নাম চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু ওই চিঠি দেওয়ার তিন মাস পার হলেও সভাপতিদের সবার নাম মন্ত্রণালয়ে আসেনি। যে কারণে গত ৭ জানুয়ারি পুনরায় আবারও সভাপতির নাম চেয়ে জেলা প্রশাসকদের চিঠি দিয়েছে মন্ত্রণালয়।   

সভাপতির বাইরেও কমিটিতে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের মুক্তিযোদ্ধা প্রতিনিধি, জেলা কমান্ডার বা তার মনোনীত প্রতিনিধি, উপজেলা কমান্ডার, যুদ্ধকালীন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার, জামুকার সদস্য ও ইউএনও থাকবেন। মহানগর কমিটিতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিকে সভাপতি করে আরও পাঁচজন সদস্য থাকবেন। তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের সময় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা উপস্থিত থাকবেন বলে সম্প্রতি জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) এক সভায় সিদ্ধান্ত হয়।

জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘নতুন আবেদন যাচাই-বাছাইয়ের কাজ কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হবে। সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই শেষে স্বাধীনতা দিবসের আগে মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হবে।’

মুক্তিযুদ্ধ না করেও যারা সনদ নিয়েছেন বা আবেদন করেছেন তাদের ব্যাপারে মন্ত্রী বলেন, ‘যারা জালিয়াতি ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে সনদ নিয়েছেন এবং প্রমাণিত হয়েছে তাদের সনদ বাতিল করা হয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, উপজেলা পর্যায়ের কমিটি দিয়ে এগুলো যাচাই করা হবে। এছাড়া লাল মুক্তিবার্তার বাইরে সবগুলো তালিকাই যাচাই-বাছাই করবে সরকার।’

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘আবেদনকারীদের সব তথ্য যাচাই-বাছাই করে মুক্তিযোদ্ধা নির্ধারণ করে গেজেট প্রকাশের পাশাপাশি কে কোন ক্ষেত্রের জন্য মুক্তিযোদ্ধা সেজন্য আলাদা তালিকা করার সিদ্ধান্ত দিয়েছে জামুকা। মুক্তিযোদ্ধার জন্য যেকোনো আবেদন উপজেলা ও মহানগর কমিটি যাচাই-বাছাইয়ের পর ওই ব্যক্তি মুক্তিযোদ্ধা কি না তা নির্ধারণ করা হবে।

তৎকালীন ইপিআর, শিল্পী, বীরাঙ্গনা কিংবা জনমত গঠনে যারা ভূমিকা রেখেছিল, এমন বিভিন্ন ক্যাটাগরির আলাদা তালিকা হবে। এতে মুক্তিযুদ্ধ ক্ষেত্রের বিষয়টি স্পষ্ট হবে।

এর আগে জামুকার এক সভায় একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় বয়স ১৫ বছরের নিচে হলে কেউ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্তির আবেদন করতে পারবেন না বলে সিদ্ধান্ত ছিল। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষ থেকে আপত্তির পর বয়সের বিষয়টি বাদ দিয়েছে জামুকা।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় জানায়, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্তির জন্য অনলাইনে এক লাখ ২৩ হাজার ৫৪টি এবং সরাসরি ১০ হাজার ৯০০টি আবেদন জমা পড়েছে। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সারা দেশে উপজেলা, জেলা ও মহানগর পর্যায়ে আবেদন যাচাই-বাছাইয়ের জন্য ৪৮৮টি উপজেলা ও ৮টি মহানগর কমিটি গঠন করা হবে। যাচাই-বাছাই ও স্থায়ী মুক্তিযোদ্ধা সনদ দেওয়ার কাজ চলতি বছরের ২৬ মার্চের মধ্যে শেষ করা হবে।

যে কারণে দেরি হচ্ছে কমিটি গঠন

নিয়ম অনুযায়ী স্থানীয় সংসদ সদস্য মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় নাম লেখানোর আবেদন যাচাই-বাছাই কমিটির সভাপতি হওয়ার কথা। তবে তাকে অবশ্যই মুক্তিযোদ্ধা হতে হবে। সব ঠিক থাকলেও এই শর্ত নিয়ে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে স্থানীয় পর্যায়ে। কারণ, বেশির ভাগ সংসদ সদস্যই মুক্তিযোদ্ধা নন। সেক্ষেত্রে তাদের বাদ দিয়ে নাম পাঠানো নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে।

মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা জানান, যদি স্থানীয় সংসদ সদস্য মুক্তিযোদ্ধা না হন তবে যুদ্ধকালীন সময়ে উপজেলা কমান্ডার যিনি ছিলেন তিনিই কমিটির সভাপতি হবেন। তবে সেটা মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়কে জানাতে হবে। মন্ত্রণালয় তাকে প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ দেবে।

তদন্ত হবে গেজেটভুক্তদের ব্যাপারেও

দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ঠিক কতজন সরাসরি অংশ নিয়েছে তার প্রকৃত তথ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে নেই। যুদ্ধের সময় ভারতে প্রশিক্ষণের তালিকা, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পত্রিকা লাল মুক্তিবার্তায় প্রকাশিত তালিকা আর প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষর করা তালিকা মিলিয়ে আছে প্রায় দেড় লাখ মুক্তিযোদ্ধা। এছাড়া গেজেটে প্রকাশ হয়ে আরো পঞ্চাশ হাজার মুক্তিযোদ্ধা আছে দেশে। তবে সচিব পর্যায়ে জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়ার পর এখন গেজেটে প্রকাশ হওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপারে আরো তদন্ত করবে মন্ত্রণালয়। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সময় ১৫ বছরের নিচে বয়স ছিল এমন প্রায় দুই শ মুক্তিযোদ্ধা সনদধারীর ব্যাপারেও তদন্ত হবে।

সরকারি হিসাবে দেশে এখন প্রায় দুই লাখ মুক্তিযোদ্ধা আছে। এছাড়া অনলাইনে আরো লাখের বেশি ব্যক্তি নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা দাবি করে সনদের জন্য আবেদন করেছে। তাদের তালিকা তৈরিও শেষ হয়েছে।

জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘সচিবদের মুক্তিযোদ্ধা সনদ ভুয়া প্রমাণের পর গেজেটভুক্ত পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি মুক্তিযোদ্ধার সনদের ব্যাপারে আবারও তদন্ত হবে। দেশের প্রতিটি উপজেলায় একটি করে কমিটি এই তদন্তের কাজ করবে। কোনো মুক্তিযোদ্ধা ভুয়া প্রমাণিত হলে শাস্তির ব্যবস্থা করবে মন্ত্রণালয়।’ তিনি জানান, অভিযোগ পাওয়া গেলে লাল মুক্তিবার্তার তালিকায় থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপারেও তদন্ত হবে। এছাড়া ২৬ মার্চে যাদের বয়স ১৫ বছরের নিচে ছিল, এমন দুই শ মুক্তিযোদ্ধা সনদধারীর ব্যাপারেও তদন্ত করবে সরকার।

চারদলীয় জোট সরকারের আমলে গেজেট প্রকাশ শুরু

২০০১ সালের নভেম্বরে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠনের পর ২০০৩ সাল থেকে চারদলীয় জোট সরকার গেজেট প্রকাশ শুরু করে। মন্ত্রণালয় গঠনের পর আলাদা দুটি তালিকা থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের নাম সংগ্রহ করা হয়। একটি মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট সংরক্ষিত ভারতীয় ভলিউম বুক। এ তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল ৬৯ হাজার ৮৩৩ জন। এর আগে এরশাদ সরকারের আমলে যে তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছিল তাতে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল এক লাখ দুই হাজার ৪৫৮ জন। ১৯৯৪ সালে প্রণয়ন করা তালিকায় ৮৬ হাজার মুক্তিযোদ্ধার নাম ছিল।

১৯৯৮ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের খসড়া তালিকায় মুক্তিযোদ্ধা ছিল এক লাখ ৮৬ হাজার ৭৮০ জন। আবার চারদলীয় জোট সরকারের আমলে প্রকাশিত গেজেট অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়ায় এক লাখ ৯৮ হাজার ৮৮৯ জন। তবে ওই সময় গঠিত জাতীয় কমিটির তালিকা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ছিল দুই লাখ দশ হাজার। আর বর্তমান সরকারের তথ্য মতে, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা এক লাখ ৮৬ হাজার ৭৯০ জন।

বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ঢাকা জেলা ইউনিটের কমান্ডার মো. আবু সাঈদ মিয়ার দৃষ্টিতে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তছনছ হয়েছে। তিনি বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধারা দেশের গৌরব। তারা দেশের অহংকার। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি যখনই ক্ষমতায় এসেছে তখনই এর ওপর আঘাত হেনেছে। সরকারের সঙ্গে সঙ্গে তালিকাও পরিবর্তন হয়েছে। অনেক অমুক্তিযোদ্ধা রাজাকার নাম লেখিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাকে কলুষিত করেছে।’

আবু সাঈদ মিয়া বলেন, ‘যে বা যারাই মুক্তিযোদ্ধাদের অর্জনকে অসম্মান করেছে, তাদের শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে। স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর এসে এভাবে মুক্তিযুদ্ধকে কলুষিত করার চেষ্টা রাষ্ট্রদ্রোহিতার সমান। এটা আমাদের জন্য লজ্জারও।’

জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার লে. কর্নেল (অব.) মো. আবু ওসমান চৌধুরীর মতে, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা এক লাখ ২৫ হাজারের বেশি হওয়ার কথা নয়। তিনি বলেন, ‘যারা অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছে এবং যারা সহযোগী মুক্তিযোদ্ধা তাদের তালিকা করলে কোটি ছাড়িয়ে যাবে। কারণ গুটিকয়েক রাজাকার-আলবদর ছাড়া সবাই মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছে। যারা তালিকা তৈরি করেছে তাদের উদ্দেশ্য সৎ ছিল না।’

সাবেক সেনাপ্রধান ও বাংলাদেশ সেক্টর কমান্ডার ফোরামের সাবেক মহাসচিব লে. জেনারেল (অব.) হারুন অর রশীদ বলেন, ‘রাজনৈতিক কারণে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা করা যায়নি। কারণ যারাই তালিকা করেছেন তারাই কোনো এজেন্ডা বাস্তবায়ন করেছেন। উদ্দেশ্য মোটেও ভালো ছিল না। এখন সঠিক তালিকা করা হলেও এ নিয়ে যে ভবিষ্যতে প্রশ্ন উঠবে না এটা হলফ করে কেউ বলতে পারবেন না।’

নতুন আবেদন যাচাই-বাছাইয়ের কাজ কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হবে। সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই শেষে স্বাধীনতা দিবসের আগে মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হবে। যারা জালিয়াতি ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে সনদ নিয়েছেন এবং প্রমাণিত হয়েছে তাদের সনদ বাতিল করা হয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, উপজেলা পর্যায়ের কমিটি দিয়ে এগুলো যাচাই করা হবে। এছাড়া লাল মুক্তিবার্তার বাইরে সবগুলো তালিকাই যাচাই-বাছাই করবে সরকার।



সাপ্তাহিক এই সময়-এর সৌজন্যে।