logo ২৮ এপ্রিল ২০২৫
রাজনীতি কার জন্য?

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ
০৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ ১২:৪৭:১৯
image


২৭ জানুয়ারি মঙ্গলবার। ঘড়ির কাঁটা সকাল ৯টা ছুঁই ছুঁই। হালকা কুয়াশায় ছেয়ে আছে চারপাশ। মানুষের আনাগোনা বাড়ছে রাজধানীর উত্তরার আজমপুর বাসস্ট্যান্ডে। কিন্তু বাসের সংখ্যা কম। অনেক সময় পর পর দু-একটি বাস আসছে জোরে ভেঁপু (হর্ন) বাজিয়ে। থামছেও না, গতি কমানো হচ্ছে। এর মধ্যেই ভিড় ঠেলে উঠছেন কেউ। যারা না পারছেন তারা থাকছেন পরের বাসের অপেক্ষায়। কিন্তু বাসস্ট্যান্ডের অদূরে গুটিসুটি হয়ে বসে থাকা মানুষজনের অপেক্ষার প্রহর যেন কাটছে না। কোদাল, বেলচা, বাঁশের তৈরি ঝুড়ি (টুকরি) হাতে তাদের অপেক্ষা বলে দিচ্ছে তারা দিনমজুর, নির্মাণ শ্রমিক।

একটু দূরে কাঠের বেঞ্চিতে বসে ঝিমুচ্ছিলেন একজন। পাক ধরা দাড়ি-চুল আর শরীরের ঢিলে হয়ে আসা চামড়া বলে দিচ্ছে বয়স পঞ্চাশ ছাড়িয়েছে এই বৃদ্ধের। কাছে যেতেই দাঁড়িয়ে গেলেন। বললেন, ‘স্যার, লোক নিবেন?’

: কীসের লোক?

: আমরা জোগালির কাম করি।

: না, আমি তো আসলে এ জন্য আসিনি। আপনারা অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছেন দেখছি, যাবেন কোথায়?

: কই যামু। কাম তো নাই। চাইরদিন ধইর‌্যা বেকার। অবরোধ-হরতালে কাম পাওন যায় না।

বলতে বলতে চলে যাচ্ছিলেন তিনি। ঠিক এই সময় এগিয়ে আসেন মধ্য বয়সী একজন। জানতে চান,

‘কী দরকার ভাই? আমি হেগো সর্দার, আজগর আলী।

: ও আচ্ছা, তা আজ কোথাও কাজ পাননি?

: নারে ভাই। এমন দিন সকাল সাতটায় আইলে ২০ মিনিট কি আধা ঘণ্টা দাঁড়াইলেই ট্রাক আইয়্যা সাইটে (কাজের ক্ষেত্র) লইয়্যা যায়। অহন হরতাল-অবরোধে কাম নাই। চাইরদিন ধইর‌্যা প্রায় বেকার। যাও কাজ পাওয়া যায় তাও এত লোক লাগে না। মজুরিও কম। হরতাল আমগোরে মাইর‌্যা হালাইলো ভাই।

৬ জানুয়ারি থেকে চলছে বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বে ২০ দলীয় জোটের অবরোধ। দফায় দফায় হরতালের ডাকও এসেছে গত তিন সপ্তাহে। জ্বালাও-পোড়াওয়ে স্থবির হয়ে পড়েছে জনজীবন। অস্বস্তিতে আছে দেশের মানুষ। কম আয়ের শ্রমজীবী মানুষের অবস্থা খুবই নাজুক। আয় কমে যাওয়ায় খেয়েপরে বেঁচে থাকাও রীতিমতো কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের জন্য। যানবাহনের ওপর হামলায় বেকায়দায় আছেন পরিবহন শ্রমিকরাও। পরিবহন চলাচল কমে যাওয়ায় বেকার সময় কাটছে অনেকের। পেটের দায়ে বাধ্য হয়ে যারা গাড়ি নিয়ে পথে নামছেন, আতঙ্ক তাদের পিছু ছাড়ছে না। যেকোনো মুহূর্তে দুর্বৃত্তদের ছোড়া পেট্রল বোমায় ঝলসে যেতে পারে শরীর, বিপন্ন হতে পারে জীবন। তবুও খেয়েপরে বেঁচে থাকতে পথই তাদের একমাত্র ভরসা। নদীপথেও আছে হামলার আতঙ্ক। দুর্বৃত্তদের হাত থেকে রেহাই মেলেনি লঞ্চযাত্রীদেরও।

প্রতিকূল আবহাওয়ার সঙ্গে যুদ্ধ করে মাঠে ফলানো ফসল নিয়েও বিপাকে পড়েছেন কৃষক। মাঠে সবজি রেখে ক্রেতার অভাবে তুলতে পারছেন না তারা। যারা সবজি বাজারে নিচ্ছেন, দু-একজন ক্রেতা পাচ্ছেন ঠিকই, তবে দাম পাচ্ছেন না। ২০ টাকার ফুলকপি বিকাচ্ছে ৩ থেকে ৪ টাকা কেজিতে। যা সবজি বাজারে নেওয়ার খরচও উঠছে না অনেকের। পণ্য নিয়ে গ্রাম থেকে শহরে আসা ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় অনেক মালিক গাড়ি বের করছেন না। চালকরাও সাহস করছেন কম। যে কারণে টনকে টন সবজি পচে-গলে নষ্ট হচ্ছে ক্ষেতেই। অথচ সরবরাহ কম থাকায় ঢাকার বাজারে সবজি থেকে শুরু করে দৈনন্দিন পণ্যের দাম গত কয়েক সপ্তাহে বেশ বেড়েছে। দ্বিগুণও হয়েছে কিছু কিছু পণ্যের দাম। এসব কারণে স্বল্প আয়ের মানুষের জীবনযাত্রায় উঠেছে নাভিশ্বাস।

যাপিতজীবনের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া তুলে ধরছিলেন তাওহীদুল ইসলাম। বলছিলেন, ‘বলা হয় মানুষের জন্য রাজনীতি, গণতন্ত্র। মানুষের কল্যাণেই নাকি সব। মানুষের জানমালের নিরাপত্তার জন্যই নাকি আন্দোলন। তাহলে মানুষের ওপর নির্বিচারে এমন হামলা কেন? কেন রাজনীতির আগুনে পুড়ে মরতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে? কেন সব হারিয়ে নিঃস্ব হতে হচ্ছে? এর নামই কি শান্তির রাজনীতি? আসলে রাজনীতি কার জন্য?’

বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের চাকুরে তাওহীদুল ইসলামের শেষ প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব নেই রাজনীতিকদের কাছেও। এ ধরনের কর্মকা-ে বিব্রতই তারা। প্রশ্ন এড়িয়ে বলেন এক পক্ষ দায় চাপাচ্ছেন অপর পক্ষের ওপর। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বলছেন বিএনপি-জামায়াতের লোকেরা এসব ধ্বংসাত্মক ঘটনা ঘটাচ্ছে। এর আগেও তারা দিন-দুপুরে বাসে আগুন দিয়ে জীবন্ত মানুষ পুড়িয়ে মেরেছে। ধরাও পড়েছে হামলাকারীরা। এখনো ধরা পড়ছে। অন্যদিকে বিএনপির দাবি, সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও দলীয় লোকজন এসব নাশকতা ছড়িয়ে তাদের ঘাড়ে দায় চাপাতে চাইছে। বিএনপিকে জনগণের কাছে বিষিয়ে তুলতে এমন অপরাজনীতির পথ বেছে নিয়েছে।

জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য রফিকুল ইসলাম মিয়া বলেন, ‘আমাদের বক্তব্য পরিষ্কার। দেশে এখন যে সহিংসতা-নাশকতা হচ্ছে তার কিছুই বিএনপি করছে না, যা করছে ক্ষমতাসীনরা। তারাই বলেছে, বিএনপির নামে কিছুই এদেশের মাটিতে থাকবে না। যেকোনো মূল্যে তারা বিএনপিকে নিঃশেষ করে দেবে। এ ধরনের হুমকি থেকেই তো পরিষ্কার বোঝা যায়, কারা করছেন এসব।’ তিনি বলেন, ‘সহিংসতা ক্ষমতায় যাওয়ার পথ মনে করে না বিএনপি। বরং সরকারই ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে মানুষ মেরে চারদিকে ভয় সৃষ্টি করতে চাইছে। যেন মানুষ আন্দোলনের মাঠে নামতে সাহস না পায়।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমানের মতে, বিএনপির আন্দোলনকে বিপথে নিতে যারা এসব নাশকতা সৃষ্টি করছে তাদের খুঁজে বের করতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে। তিনি বলেন, ‘জনগণের জানমাল রক্ষার দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু সরকার তা না করে উল্টো মানুষের জীবনকে বিপন্ন করে দিচ্ছে। বিএনপি তো সহিংসতায় বিশ্বাসী কোনো দল নয়। আমরা জনগণের জন্য রাজনীতি করি। জনগণের জন্যই এই আন্দোলন। জনগণকে সঙ্গে নিয়েই এই আন্দোলন। এখানে সহিংসতা সৃষ্টির তো প্রশ্নই আসে না। বরং সরকারের লোকজনই এসব করে উদোর পি-ি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা চলছে।’

তবে এসব অভিযোগ এক কথায় নাকচ করে দিয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। দলটির প্রচার সম্পাদক হাছান মাহমুদ বলেন, ‘মানুষ মারার রাজনীতি কারা করে তা দেশের মানুষ ভালো করেই জানে। অবরোধ ডেকেছেন তারা আর সহিংসতা করছে অন্যরা, এ কথা তো পাগলেও বিশ্বাস করবে না। এভাবে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা জনগণ ঠিকই বোঝে।’ তিনি বলেন, ‘অবরোধের নামে পেট্রল বোমা দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারার প্রতিবাদে জনগণ সোচ্চার হয়েছে। যারা হামলা করছে তাদের ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সমাজের মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছে অপরাধীদের ধরিয়ে দিতে। বিএনপি বেশিদিন আর এসব করতে পারবে না।’

টানা অবরোধ-হরতালে বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে দেশের অর্থনীতিও। ক্ষতির মুখে পড়েছে দেশের আর্থিক খাত।  অর্থনীতিবিদ ও বিভিন্ন সূত্রের তথ্যমতে, গত ২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৫ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকার বেশি। ব্যবসায়ীরাও প্রতিনিয়ত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানাচ্ছেন। বিশেষ করে ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে তৈরি পোশাকসহ রপ্তানিনির্ভর শিল্পকে। দেশজুড়ে সহিংসতার চিত্র দেখে ক্রেতারা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। বিমানবন্দর পর্যন্ত এসে ফিরে যাচ্ছেন বিদেশিরা। অনেকে আগেভাগেই পূর্ব নির্ধারিত সফরও বাতিল করছেন।

এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘বিদেশ থেকে ক্রেতারা এসে যদি দেখেন বিমানবন্দর থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে গন্তব্যে যেতে হচ্ছে, তাহলে তারা তো ভয় পাবেনই। তাদের তো এত দায় নেই। রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল না হলে বিদেশি ক্রেতারা বিকল্প কোনো দেশ খুঁজে নেবেন। এতে দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’

বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ মনে করেন, দেশের উন্নয়নের স্বার্থে হলেও প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের মধ্যে সমঝোতা করতে হবে। একসঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। অতীতে কোনো সংলাপে ভালো ফল আসেনি, এই দৃষ্টান্ত দাঁড় করিয়ে সামনের দিনকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেওয়া যাবে না।

নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের সব মহল ও শ্রেণি-পেশার মানুষের ভেতর এখন নিরাপত্তা নিয়ে চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। মানুষের জন্য যদি রাজনীতি হয় তাহলে তাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে লাভ কী? এ প্রসঙ্গে মেজর জেনারেল (অব.) এ কে মোহাম্মদ আলী শিকদার বলেন, মানুষের জন্য রাজনীতি, না রাজনীতির জন্য মানুষ? মানুষের জন্য যদি রাজনীতি হয়, তবে সেই মানুষ মেরে, দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে আজ বিএনপি যদি ক্ষমতায় যেতে চায়, তা কি এই একবিংশ শতাব্দীতে সম্ভব হবে?’ তিনি বলেন, ‘১৯৯০ সালে আন্দোলনের মাধ্যমে এরশাদ সরকারের পতন হয়েছিল। তার প্রধান কারণ সেই আন্দোলনে সাধারণ মানুষ ব্যাপকভাবে রাস্তায় নেমে এসেছিল। এর অন্যতম কারণ ছিল নতুনভাবে আবির্ভূত আওয়ামী লীগ ও বিএনপির রাষ্ট্র পরিচালনা মানুষ দেখতে চেয়েছিল। এখনকার পরিস্থিতি ওই সময়ের সঙ্গে তুলনা করলে বিএনপি ভুল করবে।’  

দেশজুড়ে সহিংসতায় ব্যাপক প্রাণহানি

দেশজুড়েই থেমে থেমে চলছে সহিংসতা। দিনের বেলায় যেমন-তেমন, রাত মানেই আতঙ্কের নগরীতে পরিণত হচ্ছে ঢাকা। ঢাকার বাইরের চিত্র আরও ভয়াবহ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কড়া পাহারার মধ্যেও হচ্ছে পেট্রল বোমা হামলা। নদীপথের যাত্রীদেরও নেই নিরাপত্তা। লঞ্চেও লাগছে সহিংসতার আগুন। দুর্বৃত্তদের ছোড়া আগুনে পুড়ছে জীবন্ত মানুষ। পুড়ছে যানবাহন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বার্ন ইউনিটের আশপাশের এলাকায় পোড়া মানুষের উৎকট গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসার জোগাড়। এ পর্যন্ত সারা দেশে সহিংসতায় মারা গেছেন ৩৪ জন (২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত)। এর মধ্যে আগুনে পুড়ে প্রাণ হারিয়েছেন ১৭ জন। বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা নিতে এসেছেন ৮৬ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন ছয়জন। সংঘর্ষে মৃত্যু হয়েছে ১২ জনের।

শ্রমজীবীদের হতাশা, দিনমজুররা অশ্রুসজল

‘রাজনীতি কী বুঝি না বাপু। বুঝি কাজ না করলে পেটত ভাত যাবার লয়। হামাক এনা কয়া দেওতো বাপু, হামরা কি মানুষ নও?’ চোখে পানি নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন, আমেনা বেগম। মঙ্গলবার চল্লিশোর্ধ্ব এই নারীর সঙ্গে কথা হয় রাজধানীর বাড্ডা এলাকায়। তার মতো আরও আট-দশজন নারী-পুরুষ বসে আছেন রাস্তার ধারে। দিনমজুরের কাজ করেন। তখন বেলা ১২টা পার হয়েছে। কিন্তু কোনো কাজই জুটেনি।

আমেনা বেগমের ঘরে স্বামী আছেন। কিন্তু আয় করতে পারেন না। রিকশা চালাতেন। একবার গাড়ির চাপায় বাম পা ভেঙে যায়। অনেক চিকিৎসা করে কোনোমতে সুস্থ হয়েছেন। এখন হাঁটতে পারেন তাও ক্র্যাচে ভর দিয়ে। তিনটি মেয়ে আছে তাদের। বড় মেয়ে একটি পোশাক কারখানায় কাজ করে। বাকি দুইজনের একজন ঘর সামলায়। অন্যজন ছোট। পাঁচ সদস্যের এই পরিবারটি থাকে মহাখালীর কড়াইল বস্তিতে। আমেনা জানান, হরতাল-অবরোধে তার অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে পড়েছে। কাজ পাওয়া যাচ্ছে না। পেলেও ছোট কাজ, মজুরি কম। আয় কমে যাওয়ায় হিমশিম খেতে হচ্ছে। অসুস্থ স্বামীর জন্য ওষুধ কিনতে পারছেন না। প্রতিবেশী, পরিচিতদের কাছে ধার করে চলছেন। কিন্তু সেই পথও প্রায় বন্ধ হওয়ার পথে। দেনার টাকা কবে পরিশোধ করতে পারবেন, তার ঠিক নেই। যে কারণে টাকাও ধার পাওয়া যাচ্ছে না।

গাজীপুর থেকে সায়েদাবাদ রুটে চলাচলকারী বলাকা সার্ভিসের বাসচালক আলমগীরের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তার মনেও সুখ নেই। রাস্তায় গাড়ি নিয়ে নামলে ভীষণ ভয় পান। তবুও পরিবারের লোকজনের মুখের দিকে চেয়ে জীবনের এই ঝুঁকি তাকে নিতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বলছিলেন, ‘রাস্তায় নামলে বারবার বাসা থাইক্যা মাইয়্যাডায় ফোন দেয়। আব্বা তুমি কই? আমি ঠিক আছি কি না জানতে চায়। হেরা তো টিভিতে দেখে বাসে আগুন দিয়া মানুষ মারতাছে। তাই ভয়ে থাহে। আমি কই আল্লাহর নাম নে মা, আল্লাহরে ডাক। দোয়া কর আমার জানি কিছু না অয়।’

এত ভয় নিয়ে গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে বসা আলমগীর দিন শেষে গাড়ির জমা, সহযোগীর মজুরি, খরচ বাদ দিয়ে যে টাকা নিয়ে বাড়ি ফেরেন তা দিয়ে একটা হলে অন্যটা হয় না। আগে দিন-রাত গাড়ি চালিয়ে দুই হাজার টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরতেন, এখন এক হাজার পান খুব টেনে- হেঁচড়ে। টঙ্গীর কলেজগেট এলাকায় থাকেন। ঘরভাড়া বাকি পড়েছে। এভাবে চলতে থাকলে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে পথে বসতে হবে তাকে, এই শঙ্কা তার।  

যাত্রাবাড়ী পরিবহনের চালকের সহযোগী মিরাজুল ইসলাম। বয়স চৌদ্দ কি পনের বছর। যে বয়সে বইপত্র নিয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা সেই বয়সে জীবনযুদ্ধে নামা মিরাজের কাছে যাত্রাবাড়ী এখন আতঙ্কের এলাকা। সারা রাস্তা যেমন-তেমন, যাত্রাবাড়ী যেতেই নাকি তার বুক কাঁপে। ‘ভাই আমার ভয় লাগে। যাত্রাবাড়ী গেলে আমি আল্লাহরে ডাহি। গাড়িত্তোন নাইম্যা যাই। দৌড়াই। ওইদিন রাইতে আমার সামনে একটা গাড়িতে আগুন দিছে। অনেক মানুষ পুড়ছে। ওইডা দেহার পর আর ভাল লাগে না।’  

হরতাল-অবরোধে মফস্বলে রিকশা চলাচল স্বাভাবিক থাকলেও কমেছে এই শ্রমিকদের আয়ও। কথা হচ্ছিল কিশোরগঞ্জের রিকশাচালক ফখরুল মিয়ার সঙ্গে।

: সারা দিনে কত পান?

: কামাই পাঁচ তে ছয় শ টাকা। আগে বেশি কামাইতাম।

: এখন কমেছে কেন?

: আর কইয়েন না, আগের মতো বাস আয় না। বাসস্ট্যান্ডে গেলে-আইলে বেশি ভাড়া পাওয়া যায়।

: আগে কত কামাতেন?

: এই ধরেন আট তে নয় শ টাকা।

ফখরুল মিয়ার মতো রিকশা শ্রমিকের আয়ই কেবল এভাবে এক-তৃতীয়াংশ কমায়নি অবরোধ-হরতালে, কমিয়েছে ঢাকার মৌচাক এলাকায় ফুটপাতে শীতের কাপড় বিক্রেতা জসিম উদ্দিনের আয়ও। আগে প্রতিদিন তিন থেকে চার হাজার টাকা বিক্রি হতো। এখন হরতাল-অবরোধে বিক্রি গিয়ে ঠেকেছে হাজার টাকায়। কোনোদিন তারও কম। ‘কেনার মানুষ নাই। তাই বেচা কম। অবরোধ তাই সন্ধ্যা হইলেই মানুষ ঘরে ঢোকে। আমাগোও ভয় লাগে। কখন কে আগুন দেয় কওয়া তো যায় না। খুব খারাপ অবস্থায় আছি ভাই। যা বেচি তা দিয়া তো জায়গার ভাড়াই দিবার পারি না মাঝে মধ্যে। এই অবস্থার কি পরিবর্তন নাই?’ আক্ষেপ নিয়ে বলছিলেন জসিম।

নিঃস্ব হচ্ছেন খেটে খাওয়া মানুষ, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ

অবরোধ-হরতালের টানা সহিংসতায় নিঃস্ব হয়েছেন অনেকে। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে পথে বসেছে অনেক পরিবার। কেউ আবার বেঁচে থাকলেও অঙ্গহানির শিকার হয়েছেন। চোখের আলো হারিয়ে অন্ধ জগতে পা বাড়িয়েছেন, খেটে খাওয়া এমন মানুষের নির্মম কাহিনিও তুলে ধরা হচ্ছে পত্রপত্রিকায়।  

৮ জানুয়ারি গাইবান্ধার পলাশবাড়ী এলাকা দিয়ে কাঁচামাল বোঝাই ট্রাক চালিয়ে বগুড়া যাচ্ছিলেন মো. জাহিদ হোসেন লাকী। কিন্তু পলাশবাড়ী এলাকায় পৌঁছলে দুর্বৃত্তদের ছোড়া পেট্রল বোমায় আগুন লেগে যায় ট্রাকে। অন্যদিকে দুর্বৃত্তদের ছোড়া ইটপাটকেলে  টিকতে না পেরে চলন্ত ট্রাক থেকে বাইরে ঝাঁপ দেন চালক লাকী। ততক্ষণে আগুনের লেলিহান শিখা তার মুখম-ল পুড়িয়ে দিয়েছে। সেখান থেকে উদ্ধার করে তাকে প্রথমে নেওয়া হয় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এরপর উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। হাসপাতালটির বার্ন ইউনিটের চিকিৎসকরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেন লাকির ডান চোখ আগুনে পুড়ে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি আর এই চোখে দেখতে পাচ্ছেন না। বাম চোখের অবস্থাও সঙ্গিন। এখন তিনি আছেন রাজধানীর চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে। দিন-রাত পার করছেন আহাজারি করে। নিভে যাওয়া চোখের আলো ফিরিয়ে দিতে যারতার কাছেই করছেন মিনতি। ‘স্যার আমার সংসারে আর কেউ নাই।  স্ত্রী, এক ছেলে, এক মেয়ে আছে। ছেলেটা নবম শ্রেণিতে পড়ে, মেয়েটা তৃতীয় শ্রেণিতে। পোড়াইয়্যা দেওয়া ট্রাকটা আমারই ছিল। এই ট্রাক চালাইয়া সংসার চলত। এহন আমার ট্রাক নাই। চোখেও দেখি না। আমার পোলাপানের কী হইব? কেউ আমারে বাঁচান, সংসারটারে বাঁচান।’ এভাবেই কেঁদে চোখের পানি ফেলছেন তিনি।

বাড়ছে পণ্যের দাম, ভোগান্তি মানুষের

বাইরের বিভিন্ন জেলা থেকে হাতেগোনা পণ্যবাহী ট্রাক ঢুকছে ঢাকায়। যে কারণে চাহিদার তুলনায় পণ্যের জোগান কমেছে। বেড়েছে পণ্যের দাম। শীতের সবজি কিনতে হচ্ছে অন্যান্য সময়ের তুলনায় দ্বিগুণ দামে। তাও সময় মতো না গেলে পাওয়া যাচ্ছে না। কারওয়ান বাজার, মহাখালী, মোহাম্মদপুর, হাতিরপুল ও নিউমার্কেট এলাকার সবজি ও দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় দ্রব্যের বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে অবরোধের বিরূপ প্রভাবের কথা। আর বাজারে আসা ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে মিলেছে ভোগান্তির চিত্র।

কারওয়ান বাজার এলাকায় সবজির গদি আছে নাজমুল হকের। দীর্ঘ আট বছর ধরে কাঁচা সবজির ব্যবসা করছেন তিনি। বলেন, আগে দিনে বিক্রি হতো ছয় থেকে সাত হাজার টাকা। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি লাভ থাকত। কিন্তু হরতাল-অবরোধে তার বিক্রি খুবই হতাশাজনক। ঢাকার বাইরে থেকে সবজি আনতে পারছেন না। ট্রাকে আগুন দেওয়া হচ্ছে। ভয়ে কেউ পণ্য পরিবহন করতে রাজি হচ্ছে না। সরবরাহ কমেছে। ক্রেতা থাকলেও মালামালের অভাবে বিক্রি কম হচ্ছে।

তবে ক্রেতা জাহিদ হাসানের অভিযোগ, বিক্রেতারা সুযোগ বুঝে দাম কষছেন। যে ফুলকপি অন্য সময় ২০ টাকায় পাওয়া যায় সেটা কিনতে হচ্ছে ৪০ থেকে ৫০ টাকায়। বলেন, ‘কী আর বলব ভাই, আমাদের ব্যবসায়ীরা সুযোগ পেলেই হলো, দাম বাড়িয়ে দেবে। পচে গেলে সবজি ফেলে দিচ্ছে কিন্তু কম দামে ছাড়ছে না। বলছে সরবরাহ কম, কিন্তু সবজি পচে যাচ্ছে কেন? কম দামে দিলেই তো বিক্রি হয়ে যেত।’

তবে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বিক্রেতা মাসুদ মিয়া। তার যুক্তি, সেই কুড়িগ্রাম, রংপুর থেকে সবজি আনেন তারা। পথে থেমে থেমে আসতে হয়েছে। যেখানে একরাতে সবজি ঢাকায় পৌঁছে সেখানে দুপুর গড়িয়েছে। যে কারণে সবজি আনার পথেই অর্ধেক পচে যাওয়ার জোগাড় হয়েছে।

কৃষকের মাথায় হাত

হরতাল-অবরোধে মাথায় হাত উঠেছে কৃষকের। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফলানো ফসল বিক্রি করতে পারছেন না তারা। বিক্রি হলেও যা দাম পাচ্ছেন তাতে বাজার পর্যন্ত পণ্য বয়ে নিয়ে যাওয়ার খরচও উঠছে না। ১০ টাকার সবজি বিক্রি করতে হচ্ছে দুই-তিন টাকায়। সবজি বিক্রি করে খুশি হওয়ার চেয়ে উল্টো পানি চলে আসছে চোখে। রংপুরের পীরগঞ্জের কৃষক গোলাম রাব্বানী কয়েক মণ ডাঁটাশাক নিয়ে বাজারে যান বিক্রি করতে। কিন্তু প্রতি কেজি ডাঁটাশাক ১০ টাকার বদলে বিকিয়েছেন মাত্র দুই টাকায়।

বগুড়ার মহাস্থানগড়ের ফুলকপির চাষি সিরাজুল ইসলামের মন ভালো নেই। কারণ, ক্ষেত থেকে তুলে যে ফুলকপি বিক্রি করে কেজিপ্রতি পেতেন ২০ টাকা, সেই ফুলকপি এখন দাম হাঁকছে তিন টাকা। তাও কেনার লোক কম। আলুর দামও কমে গেছে উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোতে। আগে প্রতি কেজি আলু বিক্রি হতো ২৫ থেকে ৩০ টাকায়। এখন তা বিক্রি হচ্ছে সাত থেকে আট টাকায়।

সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট অঞ্চলে মাছ চাষিদের অবস্থাও ভালো নয়। বেশি দাম পাওয়ার আশায় ঢাকায় মাছ পাঠান তারা। কিন্তু অবরোধের কারণে গত দুই সপ্তাহ ধরে কোনো মাছ ঢাকায় পাঠাতে পারছেন না। খুবই সীমিত আকারে কিছু মাছ আসছে দক্ষিণাঞ্চল থেকে। ক্রেতার অভাবে চাষিরা মাছ ধরছেন না। আবার অতিরিক্ত টাকা দিয়ে লোক রেখে তা ঘের বা জলাশয় পাহারা দিতে হচ্ছে। তা না হলে মাছ চুরি হওয়ার ভয়ও থাকছে।

সিরাজগঞ্জসহ ওই অঞ্চলের দুগ্ধ খামারিদের মন ভালো নেই। গাভী থেকে দুধ সংগ্রহ করছেন ঠিকই, কিন্তু ঢাকায় পাঠাতে পারছেন না। অনেক দুধ নষ্ট করে ফেলে দিতে হচ্ছে। কম দামেও বিক্রি করছেন কেউ কেউ। কয়েকদিন আগে রাস্তায় দুধ ঢেলে হরতাল-অবরোধের প্রতিবাদও জানিয়েছেন তারা।



-সাপ্তাহিক এই সময়-এর সৌজন্যে।