logo ২৮ এপ্রিল ২০২৫
এক বছর আগের সেই বাংলাদেশ!
হাবিবুল্লাহ ফাহাদ
০৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ ২০:০০:১১
image


দৃশ্যপট ২০১৩। নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে চলছে আন্দোলন। তখনও বিএনপি-জামায়াতের ডাকে সারা দেশে চলছে অবরোধ। দেশের আনাচে কানাচে প্রতিদিনই আসছে বিএনপি-জামায়াত জোটের সহিংসতার খবর। বাসে আগুন, পণ্যবাহী আওয়ামী লীগকর্মীদের বাড়িঘরে হামলায় সারা দেশে তৈরি হয় এক রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতি। আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস-সহিংসতায় ব্যাপক সমালোচনার মুখে বিএনপি-জামায়াত জোট দায় অস্বীকার করে এসব ঘটনাকে বিরোধী জোটের আন্দোলন দমন করতে সরকারের অন্তর্ঘাত বলে দাবি করতে থাকে। এই সময় শিবিরের একটি বিজ্ঞপ্তি রীতিমতো বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে দেয় জোটকে।

২৭ ডিসেম্বর দেশজুড়ে জ্বালাও-পোড়াওয়ের পর বিএনপির পক্ষ থেকে যখন আবারও সরকারের অন্তর্ঘাতের দাবি প্রচার করা হচ্ছে তখন শিবিরের বিজ্ঞপ্তিতে রীতিমতো গর্ব করে একদিনে ৫৯০টি এলাকায় সহিংসতার দায় স্বীকার করে জামায়াতের ছাত্রসংগঠনটি।

সে সময়ের আন্দোলনের সময় জামায়াত অধ্যুষিত হিসেবে পরিচিত সাতক্ষীরা এবং চট্টগ্রামের সীতাকু-ে প্রতিদিনের সন্ত্রাস খবর হয়ে আসত গণমাধ্যমে। চট্টগ্রাম বন্দরকে অচল করে দিতে সীতাকু-ে পণ্যবাহী গাড়িতে একের পর এক আগুন দিয়ে এসেছে পিকেটাররা। যথারীতি কর্মসূচি ঘোষণাকারী বিএনপি-জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতাদের দায় স্বীকার করে অস্বীকৃতির মধ্যে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশ দলের সমাবেশে প্রকাশ্যে এই হামলার কৃতিত্ব দাবি করে বক্তব্য রাখেন জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতা সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। সীতাকু-ে পণ্যবাহী গাড়িতে একের পর এক আগুন দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, এটা নমুনা মাত্র। দাবি মানা না হলে সারা দেশে একই রকম সহিংসতা ছড়িয়ে দেওয়া হবে।’

এক বছর পর আবার একই রকম দৃশ্যপট। ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এক বছর পূর্তিতে ঘোষিত সমাবেশ করতে না পারা ও দিনভর গুলশান কার্যালয়ে অবরুদ্ধ থাকার পর দেশজুড়ে অনির্দিষ্টকালের অবরোধের ডাক দেন বেগম খালেদা জিয়া। আবার শুরু হয় বাস-ট্রাকে পেট্রল বোমায় মানুষকে ঝলসে দেওয়ার ঘটনা। প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোনো না কোনো জায়গা থেকে আসছে এমন খবর। হাসপাতালের বার্ন ইউনিটগুলো হয়ে উঠেছে মৃত্যুপুরী। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, পূর্ণ ক্ষমতা ব্যবহার করেও রোগীদের চিকিৎসা দিতে পারছেন না চিকিৎসকেরা।

আন্দোলনের নামে এ রকম নাশকতায় আবারও দেশজুড়ে তৈরি হয়েছে ধিক্কার। সরকার এবং আওয়ামী লীগ বলছে, বিএনপি-জামায়ত পৈশাচিকতা চালাচ্ছে। তবে কর্মসূচি আহ্বানকারী বিএনপি আগের মতোই বলছে, জনগণের আন্দোলনকে ভিন্নখাতে নিতে সরকারের এজেন্টরা পরিকল্পিতভাবে এই কাজ করে যাচ্ছে।

তাহলে কারা জড়িত এবারের নাশকতায়? গত বছর শিবির যেভাবে বিবৃতি দিয়ে দায় স্বীকার করেছিল, এবার আসেনি তেমন কোনো বক্তব্য। তবে সরকার ও বিরোধী দলের পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের মধ্যে গত এক সপ্তাহ ধরে নাশকতাকারীদের হাতেনাতে ধরার বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়। বাসে আগুন দেওয়ার চেষ্টাকালে ভয় না পেয়ে যাত্রীরা একজোট হয়ে গণপিটুনি দিয়েছেন নাশকতাকারীদের। বেশ কয়েকটি এলাকায় নাশকতার দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দিও দিয়েছেন বেশ কয়জন। এদের বেশিরভাগই শিবিরকর্মী। কোনো কোনো ক্ষেত্রে যুবদল আর ছাত্রদলকর্মীদের নামও এসেছে। বোমা বানাতে গিয়ে বিস্ফোরণে এক ছাত্রদল নেতা নিহতের ঘটনাও ঘটেছে রাজধানীতে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আবার দেখা গেছে, টাকার বিনিময়ে বাসে আগুন দেয় রাজনৈতিক পরিচয় না থাকা তরুণরা। আর এ ক্ষেত্রে সরাসরি নেতার নামও জানে না তারা।

আগের মতোই ভয়ংকর শিবির

নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার কাশিপুর এলাকায় বাসে পেট্রল বোমা মেরে পালিয়ে যাওয়ার সময় স্থানীয় জনতা ধরে ফেলে শিহাব উদ্দিন ও আবু সাঈদ নামে দুইজনকে। পিটুনি দিয়ে তাদের তুলে দেওয়া হয় পুলিশের হাতে। সঙ্গে থাকা পাঁচটি পেট্রল বোমা ও গানপাউডারও পেয়েছে পুলিশ। পরে জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন তারা দুইজনই শিবির নেতা। ঘটনার চারদিন পর গত ২৮ জানুয়ারি তাদের তোলা হয় আদালতে। সেখানে দেওয়া জবানবন্দিতে নাশকতার পরিকল্পনা, বোমা তৈরি ও হামলার কথা স্বীকার করেছেন দুইজন।

বরিশাল, মানিকগঞ্জ, রাজশাহী, রংপুরসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় সহিংসতা চালানোর সময় কিংবা প্রস্তুতির সময় ধরা খেয়েছে শিবির নেতা-কর্মীরা। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকারও  করেছে নিজেদের জড়িত থাকার বিষয়টি।

সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে এরই মধ্যে বিশ্বে বেশ আলোচিত-সমালোচিত ছাত্রশিবির। ‘আইএইচএস জেনস ২০১৩ গ্লোবাল টেরোরিজম অ্যান্ড ইনসার্জেন্সি অ্যাটাক ইনডেক্স’-এ বিশ্বের দশটি সশস্ত্র সন্ত্রাসী সংগঠন সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হয়। ওই তালিকায় তিন নম্বরে ছিল ছাত্রশিবির। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইএইচএস তথ্য ও মতামত সরবরাহের মুক্ত সোর্স হিসেবে বেশ পরিচিত।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরুর পর থেকেই দেশজুড়ে নানাভাবে সহিংসতা ও নাশকতা সৃষ্টি করেছে জামায়াত-শিবির। বিএনপি জোটের আন্দোলনকে পুঁজি করেও ব্যাপক ধ্বংসাত্মক কা- চালিয়েছে একাত্তরে মানবতাবিরোধী দলের ছাত্র সংগঠনটি। বিএনপি যেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করছে, সেখানে জামায়াত-শিবির মাঠে নামছে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগের মামলায় আটক ও মৃত্যুদ-াদেশ কার্যকরের অপেক্ষায় থাকা শীর্ষ নেতাদের বাঁচাতে। তাদের এই সহিংসতার দায় কি নেবে জোটবন্ধু বিএনপি?

এই প্রশ্নের জবাব দলটির নেতারা যেন ঠোঁটেই এনে রেখেছেন। ‘মোটেও না। বিএনপি শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে বিশ্বাসী। কে বা কারা সহিংসতা করছে তার দায় কেন বিএনপি নেবে?’ বলছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য রফিকুল ইসলাম মিয়া।

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা তো কাউকে সহিংসতা করতে বলিনি। বরং এসব থেকে বিরত থাকতে বলেছি। জনগণই আমাদের শক্তি। জনগণ আজ আমাদের আন্দোলনে মাঠে নেমে এসেছে। মানুষ একটা নিরপেক্ষ নির্বাচনের অপেক্ষায় আছে। নির্বাচন হলেই সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে তারা।’

বিএনপি ভাবছে শান্তিপূর্ণ উপায়ে নির্বাচনের কথা, কিন্তু জামায়াত? এ ব্যাপারে কথা বলতে রাজি হননি দলটির কোনো নেতাই। নিজের পরিচয় গোপন রাখার শর্তে এক জামায়াত নেতা বলেন, ‘সরকারের ভয় বিএনপিকে নয়, জামায়াতকে। তারা মনে করছে জামায়াত যদি নির্বাচনে যায় তবে বিএনপিকে ক্ষমতায় আনা কেউ ঠেকাতে পারবে না। যে কারণে জামায়াতকে নিঃশেষ করে দেওয়ার নীল-নকশার বাস্তবায়ন চলছে।’ কিন্তু জামায়াত-শিবির যে দেশজুড়ে আন্দোলনের নামে নির্মম গণহত্যা চালাচ্ছে, এর দায় কে নেবে?

জবাবে এই নেতা বলেন, ‘শিবিরের ছেলেরা গাড়িতে আগুন দিচ্ছে এটা সরকারের অসত্য প্রচার। এসব প্রচার চালিয়ে জামায়াত-শিবিরকে কোণঠাসা করার চেষ্টা হচ্ছে।’ শিবির তো রীতিমতো বিবৃতি দিয়ে এর আগে দায় স্বীকার করেছে...। কথা শেষ করার আগেই মুঠোফোনটি কেটে দেন ওই নেতা।

গত ৬ জানুয়ারি থেকে লাগাতার অবরোধ চলছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের। জোটনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া অবরোধের ঘোষণা দেওয়ার আগ থেকেই গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে ‘অবরুদ্ধ’ হয়ে পড়েন। দলটির নেতা-কর্মীদের এমন অভিযোগের মুখে গত ১৯ জানুয়ারি কার্যালয়ের সামনে থেকে অতিরিক্ত পুলিশ তুলে নেওয়া হয়। দিনটি ছিল প্রয়াত রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ৭৯তম জন্মবার্ষিকী। অতিরিক্ত পুলিশ তুলে নেওয়ার পর ধরে নেওয়া হয়েছিল বিএনপি চেয়ারপারসন শেরে বাংলানগর এলাকায় জিয়াউর রহমানের সমাধিতে ফুল দিতে যাবেন। কিন্তু তিনি সেদিনও কার্যালয় থেকে বের হননি। তবে বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, জিয়ার সমাধিস্থলে ঢুকতে দেওয়া হয়নি কাউকে। যে কারণে বিএনপি চেয়ারপারসনও সেখানে যাওয়ার আগ্রহ দেখাননি।

সেদিন কার্যালয় থেকে বের না হলেও সন্ধ্যায় গুলশানের কার্যালয়ে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডাকেন খালেদা জিয়া। অনেকে ধরে নিয়েছিলেন হয়ত ঘোষণা দিয়ে এবার অবরোধ কর্মসূচি থেকে সরে আসবেন তিনি। কিন্তু হয়েছে তার উল্টোটা। বিএনপি নেত্রী ‘পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া’ পর্যন্ত অবরোধ চালিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দেন।

বিএনপি জোটের টানা প্রায় এক মাসের অবরোধ-হরতালে জনগণের জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। নাশকতার আগুনে পুড়ে বীভৎস মৃত্যু হয়েছে অনেকের। পত্রপত্রিকায় আসা খবর বিশ্লেষণ করে পাওয়া তথ্য বলছে, টানা ২৩ দিনের অবরোধে পেট্রল বোমা, ককটেল ও আগুনে পুড়ে হতাহত হয়েছেন বহু মানুষ। নিহত হয়েছেন ৩৮ জন। এর মধ্যে পেট্রল বোমার আগুনে ঝলছে মারা গেছেন ১৯ জন, সংঘর্ষে ১০ জন ও অন্যান্য তিনজন। যানবাহনে আগুন-ভাঙচুর হয়েছে ৭৭০টিতে। রেলে নাশকতা হয়েছে পাঁচ দফায়। অবরোধ চলাকালে পুলিশ, বিজিবি ও র‌্যাবের যৌথ অভিযানের মধ্যেও দফায় দফায় হামলা হয়েছে যানবাহনে। এমনকি পুলিশি প্রহরায় দূরপাল্লার বাস চলাচলের মধ্যেও পেট্রল বোমা হামলা চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা।

বোমা মারতে গিয়ে শিবিরকর্মী নিহত

গত ২০ জানুয়ারি রাতে সাকিব ও অন্য এক যুবক ব্যাটারিচালিত একটি রিকশা চড়ে যাওয়ার সময় চট্টগ্রাম নগরীর কদমতলীর কাছে আটমাসিং মোড়ে একটি হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটান। দ্বিতীয় হাতবোমাটি ছোড়ার সময় সেটি রিকশার হুডে লেগে বিস্ফোরিত হলে সাকিব আহত হয়। এরপর রিকশায় থাকা অন্য যুবক পালিয়ে যায়। আহত অবস্থায় সাকিবকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাকে চট্টগ্রাম শহরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখান থেকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয় উন্নত চিকিৎসার জন্য। চিকিৎসাধীন অবস্থান ২৮ জানুয়ারি সকালে মৃত্যু হয় তার। সাকিব ছাত্রশিবির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে জানিয়েছে পুলিশ।

রংপুরে ছয় হত্যার নেপথ্যেও শিবিরের নাম

১৪ জানুয়ারি মিঠাপুকুরের ঢাকা-রংপুর মহাসড়কে ৩০টি বাস পাহারা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল পুলিশ। এমন পরিস্থিতির মধ্যেও যাত্রীবাহী একটি বাসে পেট্রল বোমা ছোড়ে দুর্বৃত্তরা। আগুনে পুড়ে মারা যান ছয়জন। আহত হন ২০ জন। এর নেপথ্যেও ছিল শিবির। ওই ঘটনায় করা মামলায় ৯ জামায়াত-শিবিরকর্মীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। যারা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে নাশকতা সৃষ্টির কথা শিকার করেছে। বোমা তৈরি কথাও জানিয়েছে গ্রেপ্তারকৃতরা।

অভিযানেও থেমে নেই হামলা

অনেক স্থানে যৌথ বাহিনীর অভিযানের মধ্যেও যানবাহনে পেট্রল বোমা হামলাসহ নাশকতা চালিয়ে যাচ্ছে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা। এমনকি পুলিশকে লক্ষ্য করেও বোমা ছুড়েছে দুর্বৃত্তরা।  পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, ৫ জানুয়ারি অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণার পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ২৯টি জেলায় যৌথ অভিযান চলছে। এর মধ্যে স্পর্শকাতর ২০ জেলায় যৌথ অভিযানে বিজিবি অংশ নিচ্ছে। বিশেষ করে জামায়াত-শিবির অধ্যুষিত এলাকায় এ অভিযান জোরদার করা হয়েছে। কারণ অতীতেও যেকোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে এই জেলাগুলোতে সহিংসতা বেশি ছিল। জানতে চাইলে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ বলেন, ‘বগুড়া, গাইবান্ধা ও লক্ষ্মীপুর জেলায় বিজিবি যৌথ অভিযানে অংশ নিচ্ছে। এর বাইরের অঞ্চলের আওতাভুক্ত এলাকাগুলোতে আঞ্চলিক কমান্ডার ও ব্যাটালিয়ন কমান্ডারদের তত্ত্বাবধানে বিজিবি যৌথ অভিযানে অংশ নিচ্ছে। রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও রংপুরে উত্তর-পূর্ব অঞ্চল থেকে এ অভিযানে অংশ নিচ্ছে। সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া কিংবা কক্সবাজারে সংশ্লিষ্ট ব্যাটালিয়ন থেকে স্থানীয় সিভিল প্রশাসনের চাহিদা অনুযায়ী বিজিবি সদস্যরা যাচ্ছেন।’  

রাজশাহী প্রতিনিধি সূত্রে জানা যায়, আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর পাহারার মধ্যেই চোরাগোপ্তা হামলা চালাচ্ছে শিবির। মহানগরীর ব্যস্ততম সড়ক দড়িখড়বনায় একের পর এক যানবাহনে বোমা হামলা করে তারা। ২২ জানুয়ারি শিবিরের বোমা হামলায় ১৫টি পণ্যবাহী যান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২০ থেকে ২৫টি হাতবোমা মেরে পালিয়ে যায়। ওই ঘটনার পর ভিডিও প্রকাশ হয়েছে। যেখানে প্রকাশ্যে শিবির নেতা-কর্মীদের হামলা করতে দেখা গেছে। অথচ এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি ওই ঘটনায়। অথচ প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ওইদিনের হামলার সঙ্গে রাজশাহী কলেজ শাখা শিবিরের সভাপতি জোহা ছিলেন। এ ছাড়া রাজশাহী মহানগর শাখার আরেক নেতা হাবিবুর রহমানকেও ভিডিওতে দেখা গেছে ট্রাকে বোমা মারতে।

জানতে চাইলে রাজশাহী মহানগর পুলিশের (আরএমপি) কমিশনার মো. শামসুদ্দিন বলেন, হামলাকারীদের ধরা হচ্ছে না, এটা ঠিক নয়। আমরা তো প্রতিনিয়তই সন্ত্রাসী, বোমাবাজদের ধরছি। আর পুলিশ তো কিছু জানান দিয়ে করবে না। এতে তো অপরাধী পালিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও থাকে।

ভোটের আগেও তাণ্ডব ছড়িয়েছিল

ভোট ঠেকাতে ২০১৩ সালের শেষ দিকে সাতক্ষীরা, গাইবান্ধা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, লক্ষ্মীপুর, নীলফামারীসহ বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী ও হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর জামায়াতের নেতা-কর্মীরা একের পর এক হামলা চালিয়েছে। ধারাবাহিক হামলা চালিয়েছে তারা পুলিশের ওপরও। কেবল সাতক্ষীরাতেই গত দুই মাসে ১৭ জন আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীকে হত্যা করেছে দলটি। কিন্তু এসব সন্ত্রাসের পর সরকার যৌথবাহিনীর অভিযান চালিয়ে তাদের দমন করে। জামায়াত যৌথবাহিনীর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুললেও দলটির চালানো সন্ত্রাসের কারণেই এসব বক্তব্য প্রতিষ্ঠা পায়নি বলে মনে করেন বিএনপিরই একাধিক নেতা।

এর মধ্যে বিএনপি-জামায়াত জোটের প্রতিরোধের মধ্যেও ৫ জানুয়ারির ভোট শেষে নতুন সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। ভোটের পর যশোর, দিনাজপুর, লালমনিরহাটসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা করে জামায়াত-শিবিরকর্মীরা। তাদের হুমকির পরও ভোটকেন্দ্রে যাওয়ায় এই হামলা চালানো হয়। এটাও হিতে বিপরীত হয় জামায়াতের জন্য। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা প্রায় প্রতিটি শক্তিই এই ধরনের হামলার নিন্দা জানায়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের শুনানিতে স্পষ্টতই এই হামলার জন্য জামায়াতকে দায়ী করা হয়।

আসছে ছাত্রদল-যুবদলের নেতা-কর্মীদের নামও

জামায়াত-শিবিরের পাশাপাশি নাশকতা সৃষ্টিকারীদের তালিকায় উঠে আসছে বিএনপির ছাত্রসংগঠন ছাত্রদল ও যুবদলের নাম। ২১ জানুয়ারি রাজধানীর লালবাগ এলাকায় একটি বাড়িতে বোমা বানাতে গিয়ে ভয়াবহ বিস্ফোরণে হাতের কব্জি উড়ে যায় ছাত্রদল নেতা মাহবুবুর রহমান বাপ্পীর। এর একদিন বাদে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থান মারা যান তিনি। বাপ্পী নিউমার্কেট থানা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ওই ঘটনায় বাপ্পীর ভাগ্নী ও এক প্রতিবেশীর ছেলে আহত হয়।

২৫ জানুয়ারি ফেনীতে ম্যাজিস্ট্রেট ও দুই শিক্ষার্থীর ওপর বোমা হামলার ঘটনায় আলাদা আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন পেট্রল বোমাসহ গ্রেপ্তারকৃত যুবদলকর্মী মো. আজিম। পুলিশ সূত্র জানায়, প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. আবদুল কাদির মিয়া ও দুই স্কুল শিক্ষার্থীর ওপর বোমা হামলাসহ সাতটি নাশকতার মামলার আসামি আজিমকে আলাদা আদালতে তোলা হয়। জবানবন্দিতে ওই দিনের হামলার ঘটনার বিষয়ে আজিম গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন বলে জানা গেছে।

রাজধানীতে বড় নাশকতা যাত্রাবাড়ীতে

রাজধানীতেও সুযোগ পেলে বড় ধরনের নাশকতা সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা। গত ২৩ জানুয়ারি রাতে ঢাকার যাত্রাবাড়ী এলাকায় বড় সহিংসতা চালায় তারা। গুলিস্তান থেকে গ্লোরি পরিবহনের একটি বাস ডেমরা রোড দিয়ে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে যাওয়ার পথে রাত সাড়ে ৯টার দিকে পেট্রল বোমা ছুড়ে দুর্বৃত্তরা। এতে ২৭ জন আগুনে দগ্ধ হন। এছাড়া বাস থেকে হুড়োহুড়ি করে বেরোনোর সময় আহত হন আরও দুইজন। আগুনে দগ্ধদের মধ্যে পাঁচজন মারা গেছেন।  

ওই ঘটনার পর যাত্রাবাড়ী, ডেমরা ও কদমতলী এলাকায় যৌথ অভিযান চালানো হয়। অভিযানের প্রথম দিন ৩০ জন, দ্বিতীয় দিন ২২ জন ও মঙ্গলবার ৩১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। যাদের মধ্যে শিবিরের নেতা-কর্মীরা রয়েছেন বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে। -সাপ্তাহিক এই সময়-এর সৌজন্যে।