১৩ জানুয়ারি গভীর রাত। কুড়িগ্রাম থেকে ছেড়ে একটি বাস আসছে ঢাকার দিকে। জামায়াত অধ্যুষিত হিসেবে পরিচিত রংপুরের মিঠাপুকুরে আসার পর বীভৎসতা। দুর্বৃত্তদের পেট্রল বোমায় এক শিশুসহ নিহত হয় ছয়জন। দগ্ধ হয় আরো কয়জন। আগুনে পোড়া অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে আজও তারা হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কাতরাচ্ছে।
মিঠাপুকুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির বলেন, এ ঘটনায় জামায়াত-শিবিরের ৮৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন তারা, আটকও হয়েছে ৩৫ জন।
এ রকম নাশকতা ঘটছে অহরহ, হচ্ছে মামলা। কোনো কোনো ঘটনায় আসামি আটকের দাবি করছে পুলিশ। কিন্তু বিচার কি আগায়? সহজ জবাব হচ্ছে, না। ২০১৩ সালেও আলোচিত বেশ কয়েকটি নৃশংসতার বিচার শুরুই করা যায়নি এক বছরে।
রাতের আঁধারে কারা এমন হামলা করে, সে বিষয়ে অনেকটাই অন্ধকারে থাকে পুলিশ। সুনির্দিষ্ট আসামিদের বদলে প্রায় সবই মামলা হয় রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে। তাদের করা হয় হুকুমের আসামি। কিন্তু সে মামলাও প্রমাণ করা যায় না কখনো।
বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় থাকাকালে ২০০৪ সালে আওয়ামী লীগের ডাকা হরতালের দিন হোটেল শেরাটনের সামনে গানপাউডার ছিটিয়ে আগুন দিয়ে হত্যা করা হয় ১১ জনকে। ওই ঘটনায় পুলিশ মামলা করে যুবলীগের সে সময়ের সভাপতি জাহাঙ্গীর কবির নানক ও সাধারণ সম্পাদক মির্জা আজমের বিরুদ্ধে। কিন্তু আদালতে নির্দোষ প্রমাণ হন তারা। আর দিন-দুপুরে করা ওই হত্যার জন্য সাজা পেতে হয়নি কাউকে।
২০১৩ সালের নজিরবিহীন সহিংসতায় বহু মৃত্যুর পরও দেশের বিভিন্ন থানায় করা সহিংসতার মামলায় বিচার শুরু করা যায়নি পুলিশ প্রতিবেদন দিতে পারেনি বলে। ২০০৪ সালের ঘটনার মতোই বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের আসামি করা হয়েছে একাধিক মামলায়। প্রায়ই তাদের গ্রেপ্তার করা হয় এসব মামলায়, রিমান্ডে নিয়ে করা হয় জিজ্ঞাসাবাদ। কিন্তু প্রতিবেদন দেওয়া যায়নি কোনো মামলারই।
বিচার পাওয়ার আশা নেই!
রংপুরের মিঠাপুকুরে বাসে আগুনে পুড়ে নিহতদের একজন বাদাম বিক্রেতা রহিম বাদশা। তার বড় ছেলে লিটন বলেন, ‘আমাদের মতো গরিব মানষ্যের লাইগ্যা কোনো বিচার নাই। দেশে সরকার আসবে, সরকার যাবে। কোনোদিনও আমাদের মতো মানষ্যেরা বিচার পাবে না।’
গত বছরের ৪ নভেম্বর নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে বিএনপি-জামায়াত জোটের আন্দোলন চলাকালে গাজীপুরে আগুনে পোড়া মনিরের কষ্ট ছুঁয়েছিল গোটা দেশবাসীকে। তিনদিন পর মৃত্যু হয় মনিরের। মনিরের কী হলো, তা জানতে এই তিনটি দিন মানুষের ছিল রদ্ধশ্বাস অপেক্ষা। কেন মনিরকে চলে যেতে হলো আর কারা এই মৃত্যুর জন্য দায়ী তা জানেন না এই কিশোরের বাবা রমজান আলী।
একটু বেশি বয়সে স্কুলে গিয়েছিল মনির। ১৪ বছর বয়সে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ত সে। তবু তাকে ঘিরে কাভার্ড ভ্যানচালক বাবার স্বপ্ন ছুঁয়েছিল আকাশে। আদরের ছেলেটি ঢাকা দেখবে, অবরোধের মধ্যে ঝুঁকি জেনেও ছেলেকে নিয়ে রওয়ানা হয়েছিলেন তিনি ঢাকার পানে। কিন্তু গাজীপুরের জয়দেবপুর চৌরাস্তায় গাড়ি রেখে সামনের অবস্থা দেখতে আসাই কাল হলো রমজানের। ফিরে দেখেন তার ছেলেটিকে গাড়ির ভেতরে রেখে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা।
এই মর্মান্তিক মৃত্যুর পর কেটে গেছে এক বছরেরও বেশি সময়। এর মধ্যে হয়েছে অনেক কিছুই। বিরোধী দলের বর্জনের মুখে জাতীয় নির্বাচন, নতুন সরকার গঠন, দেশ-বিদেশে আলোড়নÑঅনেক কিছুরই সাক্ষী রমজান আলী। তার কেবল জানা হলো না ছেলেটিকে কারা পুড়িয়ে মারল, জানা হলো না আদৌ এই খুনিদের বিচার তিনি দেখতে পারবেন কি না।
মনির হত্যা মামলাটির কী হলো খোঁজ করতে জয়দেবপুর থানায় যোগাযোগ করে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্যই পাওয়া গেল না। অথচ মনিরের মৃত্যুর পর জয়দেবপুর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) হাফিজুর রহমান বাদী হয়ে মামলা করেছিলেন। তবে এই মামলায় আসামি করা হয় জেলার বিএনপি-জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের। তাদের করা হয় হুকুমের আসামি। কারা এই আক্রমণের সঙ্গে জড়িত ছিল, তা চিহ্নিত না হওয়ায় ৫৪ জনের নাম উল্লেখের পর অজ্ঞাত আসামি করা হয় আরও ২৫ থেকে ৩০ জনকে। আর দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দেশের পরিস্থিতি শান্ত হয়ে গেলে মনির হত্যা মামলার তদন্তও থেমে যায় বলতে গেলে।
জানতে চাইলে জয়দেবপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খন্দকার রেজাউল আহসান বলেন, ‘এ মামলার ব্যাপারে আমার কাছে কোনো তথ্য নেই।’
কেবল মনির নয়, বিএনপি-জামায়াত জোটের আন্দোলন চলাকালে যানবাহনে আগুন দেওয়ার ঘটনায় কেবল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মারা গেছে ৩০ জনেরও বেশি। এর বাইরে আগুনে পোড়ানোর পর অনেকের মৃত্যু হয়েছে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে, ঘটনাস্থলেও। কিন্তু এর একটিরও বিচার শুরু হয়নি এখন পর্যন্ত। কোনো মামলারই তদন্ত শেষ করতে পারেনি পুলিশ।
শাহবাগে বাসে আগুনের সেই মামলারও তদন্ত শেষ হয়নি
২৯ নভেম্বর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের সামনে যাত্রীবোঝাই বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনা আলোড়ন তোলে সারা দেশে। আহত ১৯ জনকে তখন ভর্তি করা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে। এদের নিয়ে উদ্বেগ ছড়ায় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত। আহতদের দেখতে মন্ত্রীদের পাশাপাশি ছুটে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। দেন বিচারের আশ্বাস।
আহত এই ১৯ জনের মধ্যে মারা যান চারজন, বাকি ১৫ জনের অনেকেরই আর কখনো ‘স্বাভাবিক’ জীবনযাপন করা সম্ভব হবে না। কারও ফুসফুস, কারও কণ্ঠনালী, কারও হাত-পা এমনভাবে পুড়ে গেছে যে, স্বাভাবিক কাজকর্ম করা কঠিন হবে এদের জন্য।
কী অপরাধে এই পরিণতি ভোগ করতে হলো, কারা কী ক্ষোভে তাদের পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিল, এই প্রশ্নের জবাব নেই এক আহতের স্বজন গীতা সরকারের কাছে। প্রধানমন্ত্রীকে কাছে পেয়ে রাজনীতি নিয়ে ক্ষোভ ঝেড়েছিলেন তিনি। এই ক্ষোভের আগুন এখনো মনে জ্বলছে গীতা সরকারের। এই ঘটনায়ও বিচার শুরু হয়নি কারও। আসলে শেষই হয়নি তদন্ত।
এক বছরেও শেষ হয়নি পুলিশ হত্যা মামলা
বিচার শুরু হয়নি পুলিশ সদস্যকে পুড়িয়ে মারার মামলারও। ২০১৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর রাজধানীর বাংলামোটরে পুলিশের গাড়িতে ছোঁড়া পেট্রল বোমায় পুড়ে মারা যান কনস্টেবল খলিলুর রহমান। এরপর তিনজনকে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ। সে সময় আটক তিনজনের বরাত দিয়ে পুলিশ জানায়, ছাত্রদলের পদ পাওয়ার লোভে পুলিশের গাড়িতে এভাবে বোমা মারে তারা। পুলিশ তখন এই ঘটনায় পরামর্শদাতা ও অর্থের যোগানদাতার নাম জানার দাবিও করেছিল। কিন্তু এরপর পেরিয়ে গেছে এক বছর। কিন্তু তদন্তও শেষ করতে পারেনি পুলিশ। এই মামলায়ও হুকুমের আসামি করা হয়েছে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের।
নিহত পুলিশ কনস্টেবল খলিলের স্ত্রীর বড় ভাই আবদুল জলিল জানান, খলিলের মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে একটি সাত লাখ টাকার চেক পেয়েছিল তার স্ত্রী। এছাড়া পুলিশ সদর দপ্তর থেকেও টাকা পেয়েছেন তারা। খলিলের বড় মেয়ে অন্নি এবার গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের একটি কলেজে ইন্টারমেডিয়েট দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। আর ছোট ছেলে অনিক স্থানীয় একটি স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। পুলিশ সদস্য খলিলের মৃত্যুর ঘটনায় রাজনৈতিক নেতাদের নামে মামলা করায় তিনি ন্যায় বিচার না পাওয়া নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন।
এবার বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলন চলাকালে দেশের বিভিন্ন এলাকায় সহিংসতা হয়েছে নজিরবিহীন। গাড়িতে আগুন দিয়ে যাত্রীদের হত্যা, সরকার সমর্থকদের বাড়ি-ঘরে হামলা করে ভাঙচুর, লুটপাট ও হত্যা, নির্বিচারে গাছ কাটা, ট্রেনে হামলার ঘটনায় উদ্বেগ ছড়িয়েছে দেশে-বিদেশে। কেবল সাধারণ মানুষ নয়, আক্রমণ হয়েছে পুলিশের ওপরও। এতে পুলিশ বাহিনীতে ব্যাপক হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে। যেখানে নিজেদের ওপর আক্রমণের মামলাগুলোর তদন্তও শেষ করতে পারেনি পলিশ, সেখানে সাধারণ মানুষের ওপর আক্রমণের মামলাগুলোর অবস্থা কী তা সহজেই অনুমেয়।
দায়ীরা চিহ্নিত হয় না, ‘হুকুমের’ আসামিকে নিয়ে পুলিশের দৌড়ঝাঁপ
একাধিক মামলা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, হঠাৎ হওয়া আক্রমণে দায়ীদের চিহ্নিত করার তেমন কোনো চেষ্টা পুলিশের মধ্যে থাকে না। এর বদলে বিরোধী দলের নেতাদের হুকুমের আসামি করে পুলিশ। আর এসব মামলার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে উচ্চ আদালতে যান নেতারা। পরে মামলার তদন্ত আর আগায় না।
২৩ জানুয়ারি যাত্রাবাড়ীতে বাসে আগুন দিয়ে ২৯ জনকে কারা পুড়িয়ে দিয়েছে তা জানা না গেলেও নির্দেশদাতাদের নাম-ঠিকানা ঠিকই জেনে ফেলেছে পুলিশ। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াসহ বিএনপির ১৮ জন শীর্ষ নেতাকে হুকুমের আসামি করে মামলা করেছে পুলিশ।
২০১৩ সালেও শাহবাগে বাসে আগুন দেওয়ার পরপরই ১৮ দলীয় জোটের ১৬ নেতার বিরুদ্ধে মামলা করে পুলিশ। এই নেতাদের একেক জনের কারও বিরুদ্ধে এ রকম ‘হুকুম’ দেওয়ার মামলা আছে ২০টি, কারও ২৫টি, কারও বা তার চেয়ে বেশি। এ ব্যাপারে শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ওই মামলার তদন্ত এখনো শেষ হয়নি।
বেশিরভাগ মামলায় নাম থাকে যত মানুষের, অজ্ঞাত আসামি থাকে তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। আর এই সুযোগে যাকে-তাকে মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়ের অভিযোগও আছে পুলিশের বিরুদ্ধে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান স্বয়ং এই অভিযোগ তুলেছেন।
জানতে চাইলে ড. মিজানুর রহমান বলেন, রাজনৈতিক সহিংসতায় যাদের প্রাণ যায় তারা কোনোদিনই বিচার পায় না। কারণ সহিংসতার সঙ্গে জড়িতদের কখনোই শনাক্ত করা সম্ভব হয় না। মামলা করা হয় রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নামে হুমকিদাতা হিসেবে। কিন্তু এই পর্যন্ত কাউকেই এজন্য বিচারের মুখোমুখি হতে হয়নি। আর এসব মামলার অজ্ঞাত আসামিরাও সব সময় অজ্ঞাত থেকে যায়। পুলিশ তাদের কখনো খুঁজে বের করতে পারে না।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলেও একই কাজ হয়েছিল
বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় থাকতে ২০০৪ সালে বিরোধী দল আওয়ামী লীগের হরতাল চলাকালে হোটেল শেরাটনের (বর্তমানে রূপসী বাংলা) সামনে বাসে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারা হয় ১১ জনকে। এই ঘটনায় তখন সরকার মামলা করে যুবলীগের তৎকালীন নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানক, মির্জা আজম ও আওয়ামী লীগ নেতা সাঈদ খোকনসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে। অথচ এই ঘটনার সময় এই নেতাদের একটি বড় অংশ অন্য একটি মামলায় ঢাকার একটি আদালতে হাজিরায় ছিলেন। কিন্তু ‘প্রকৃত’ অপরাধীদের বদলে মামলাটিতে রাজনৈতিক নেতাদের ফাঁসাতে পুলিশের চেষ্টার কারণে পার পেয়ে যায় আসল অপরাধীরা। আর আদালতে অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি পুলিশ। ২০১৩ সালে এই মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় পুলিশ। ঢাকা মহানগর ম্যাজিস্ট্রেট কেশব রায় চৌধুরী সিআইডি পুলিশের দাখিল করা প্রতিবেদন গ্রহণ করলে আসামিরা এ মামলা থেকে অব্যাহতি পান।-সাপ্তাহিক এই সময়-এর সৌজন্যে।