logo ১১ জুন ২০২৫
কপর্দকহীন থেকে কোটিপতি
হাবিবুল্লাহ ফাহাদ
৩০ এপ্রিল, ২০১৫ ০০:২৪:০১
image


বিশ্বাস করে সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) হিসেবে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সত্যজিত মুখার্জিকে নিয়োগ দিয়েছিলেন প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন। আওয়ামী লীগের আরেক নেতা মোকাররম মিয়া বাবুর ওপরও রেখেছিলেন আস্থা। কিন্তু মন্ত্রীর সরল বিশ্বাসের পুরো ফায়দা লুটেছেন এই দুইজন। অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। অথচ আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার আগে রিকশায় ওঠার পয়সাও ছিলনা দু’জনের। সম্প্রতি দু’জনের অনিয়ম, দুর্নীতির ব্যাপারে দালিলিক প্রমাণ পান প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী।

বর্তমান মন্ত্রিসভার অন্যতম সফল এবং আলোচিত মন্ত্রী তিনি। সরকারি কাজে ব্যস্ত খন্দকার মোশাররফ হোসেনের কাছে সততার মূল্য আলাদা। দক্ষ এই মন্ত্রী নিজের সততার কারণে সব মহলেই অত্যন্ত শ্রদ্ধার পাত্র। তাই তারই এপিএসের বিরুদ্ধে যখন অভিযোগ শুনলেন, সিদ্ধান্ত নিলেন খতিয়ে দেখার। প্রমাণ পাওয়ার পর আর দেরি করলেন না। নির্দেশ দিলেন ব্যবস্থা নেওয়ার।

কপর্দকহীন সত্যজিতের ধনাঢ্য হয়ে ওঠার নেপথ্যে

বাবা ছিলেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। বছর সাতেক আগেও টিনের ঘরে ভাড়া থাকতেন তারা। নিজেদের বাড়ি তো দূরে থাক কোনো জায়গা-জমিও ছিল না। সেই সত্যজিত মুখার্জিদের দিনবদলের কাহিনি রূপকথার গল্পকেও হার মানিয়েছে। অতীত আর বর্তমানের তফাতটা এক কথায় রাত আর দিন। প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রীর অপসারিত এই সহকারী একান্ত সচিবের (এপিএস) সম্পদের বাড়-বাড়ন্ত বিস্ময় ছড়িয়েছে ফরিদপুরবাসীর চোখেমুখে।

‘এই তো সেদিনও সত্যজিতের বাবাকে দেখা গেছে সাইকেলে করে জ্বালানি কুড়াতে। আর এখন তার ছেলে হাঁকায় গাড়ি। সেই সত্যজিত আর এই সত্যজিতে মিল পাওয়া ভার।’ বলছিলেন ফরিদপুর শহরের পুরনো একজন কাপড় ব্যবসায়ী।

স্থানীয় একাধিক সূত্র ও তার ঘনিষ্ঠদের কাছে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, উৎকোচ, নিয়োগ-বাণিজ্য, স্বজনপ্রীতি, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, টাকার বিনিময়ে ছাত্রলীগের কমিটিসহ নানা মাধ্যমে বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিক বনে গেছেন সত্যজিত মুখার্জি। ফরিদপুর শহরে চোখ ধাঁধানো দালান, ঢাকায় ফ্ল্যাট, ব্র্যান্ড নিউ গাড়ি, দোকানপাট, জায়গা-জমি কিছুই বাদ দেননি তিনি। দুর্নীতি-অনিয়মের মাত্রা গিয়ে এমন পর্যায়ে ঠেকেছে যে, ঐতিহ্যবাহী ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক থেকেও বহিষ্কার করা হয়েছে। ছাত্রলীগ নেতৃত্ব স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, সত্যজিতের কোনো অপকর্মের দায় সংগঠন নেবে না। বরং সত্যজিতের অপকর্মের শাস্তি নিশ্চিতে সব ধরনের সহযোগিতা করবে সংগঠনটির নেতা-কর্মীরা।

প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রীর এপিএস পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার পর ফরিদপুরে আনন্দ মিছিল করেছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। অবিলম্বে সত্যজিতকে গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করার দাবিও তুলেছেন তারা। এছাড়া সাড়ে সাত লাখ টাকার চাঁদাবাজির অভিযোগ এনে মামলাও হয়েছে সত্যজিতের বিরুদ্ধে। ফরিদপুর শহরের লক্ষ্মীপুর মহল্লার বাসিন্দা ঠিকাদার সালেহ আহমেদ এ মামলাটি করেছেন। তার দ্বারা নির্যাতিত একাধিক ভুক্তভোগী এখন সাহস করে মামলা করেছেন। চাঁদাবাজি, হত্যা হুমকি, ছিনতাই ও ধর্ষণের পাঁচ থেকে সাতটি মামলা হয়েছে তার বিরুদ্ধে।

জানতে চাইলে ফরিদপুর ছাত্রলীগের সভাপতি মনিরুজ্জামান মনির বলেন, ‘সত্যজিত মুখার্জির কারণে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের অনেক কথা শুনতে হয়েছে। তার অপকর্মের দায় আমরা নেব না। তার সঙ্গে ছাত্রলীগের সব ধরনের সম্পর্ক শেষ। এখন কীভাবে তিনি রাতারাতি বিপুল সম্পদের পাহাড় গড়েছেন সেই তদন্তই হওয়া প্রয়োজন।’

ফরিদপুরের বিভিন্ন পর্যায়ে অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে সত্যজিতের বিপুল সম্পদের তথ্য। যেগুলো সত্যজিত গড়েছেন ক্ষমতার অপব্যবহার করে।

জেলা আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, সত্যজিতের দাপটের কাছে জেলা আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতারাও হেরে যেতেন। টাকা কামানোর এমন কোনো পথ নেই যেদিকে তার চোখ পড়েনি। বৈধ-অবৈধ সব উপায়েই রাতারাতি ধনী বনে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন তিনি।

টিনের ছাপড়া থেকে বহুতল বাড়ি, ঢাকায় ফ্ল্যাট

বছর সাতেক আগেও টিনের ঘরে ভাড়া থাকতেন সত্যজিত মুখার্জি ও তার পরিবার। এখন আর সেই অবস্থা নেই। সময় পাল্টেছে। পাল্টে গেছে সত্যজিতের ভেষভুষা। স্থানীয় সূত্র জানায়, ফরিদপুর শহরের গোয়ালচামটের হাউজিং এস্টেটে জায়গা কিনে পাঁচতলা বাড়ি করেছেন তিনি। যার হোল্ডিং নম্বর-১/২৩/৪। বাড়িটি ২০ তলার ভিত দেওয়া। এছাড়া ঢাকার মিরপুর-১২-এর ৬/ডি ব্লকে ফ্ল্যাটেরও মালিক তিনি।

আছে ব্যক্তিগত গাড়িও

বাবা চড়তেন সাইকেলে, নিজে চলতেন পায়ে হেঁটে। সেই সত্যজিতের এখন আছে ব্যক্তিগত গাড়ি। দুটি মাইক্রোবাসের মালিক তিনি বনে গেছেন গত কয়েক বছরে।

ব্যাংক হিসাবে কোটি কোটি টাকা

সত্যজিতের নিজের পরিবারের অন্যান্য সদস্যের নামে-বেনামে কোটি কোটি টাকা গচ্ছিত আছে ব্যাংক হিসাবে। ফরিদপুরের সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে তার হিসাবে খোঁজ নিয়ে তথ্য বেরিয়ে আসবে বলে জানিয়েছেন তার ঘনিষ্ঠরাই। নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডের রাজধানীর কাকরাইল শাখায় ১৫ কোটি টাকার আমানত আছে সত্যজিতের। স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের এলিফেন্ট রোড শাখায় গচ্ছিত আছে বিপুল অর্থ। আরও কয়েকটি সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে নগর জমা আছে অন্তত ৫০ কোটি টাকা। প্রশ্ন, সত্যজিত এত টাকা কোথায় পেলেন?

নামে-বেনামে আছে দোকান

ব্যবসায়ী নন, তবু দোকান বরাদ্দ নিতেও ভুল করেননি সত্যজিত। সূত্র জানায়, ফরিদপুর শহরের স্বর্ণকুটির মার্কেটে দুটি, তিতুমীর বাজারে (নির্মাণাধীন) নামে-বেনামে আটটি এবং হেলিপোর্ট বাজারে তিনটি দোকান নিয়েছেন সত্যজিত।

রঘুনন্দনপুরে ২০ শতাংশ জমি

ফরিদপুরের রঘুনন্দনপুরে ২০ শতাংশ জায়গাও কিনেছেন এক সময় জায়গা-জমিহীন সত্যজিত। তার ঘনিষ্ঠসূত্রে জানা যায়, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নামে-বেনামে বাড়ি, গাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সে প্রায়ই তার ঘনিষ্ঠদের বলতেন, দেশে সমস্যা হলে ওপারে চলে যাবো। এই দেশেই থাকবো না।  

গাজীপুরে কারখানা

একাধিক সূত্রে জানা গেছে, গাজীপুরে একটি কারখানা আছে তার। নামে-বেনামে অনেক প্রতিষ্ঠানের মালিকানার সঙ্গেও আছেন সত্যজিত। সূত্রে জানা গেছে, তার একটি ডেভেলপার কোম্পানিও আছে।

চাকরি দেওয়ার নাম করে টাকা নেওয়া

চাকরি দেওয়ার নাম করে কমপক্ষে পাঁচশ মানুষের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা অগ্রিম নেওয়ার অভিযোগও আছে সত্যজিতের বিরুদ্ধে। একাধিক ভুক্তভোগী জানান, চাকরি তো দূরে থাক টাকাও ফেরত পাননি তারা। ফরিদপুর শহরে খোঁজ করে এমন শত শত ঘটনার অভিযোগ পাওয়া গেছে। যাদের অনেকে সত্যজিতের বিরুদ্ধে মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এছাড়া অস্ত্রের লাইসেন্স করে দেয়ার নাম করে একজন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের  কাছ থেকে এক লাখ টাকা উৎকোচ নিয়েছেন তিনি। এছাড়া বিসিএস, পুলিশসহ নানা বিভাগে চাকরি দেয়ার কথা বলে লাখ লাখ টাকা উৎকোচ নিয়েছেন সত্যজিত।

চারিত্রিক নৈতিকতা নিয়েও আছে মুখোরোচক আলোচনা

সত্যজিতের চারিত্রিক নৈতিকতা নিয়েও ফরিদপুরের বিভিন্ন মহলে আছে মুখোরোচক আলোচনা। অনেকে সুযোগ পেলেই এসব নিয়ে খোশগল্পে মেতে ওঠেন। স্থানীয় একটি সূত্রে জানা গেছে, বহুনারীর সতিত্বহরণের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে সত্যজিতের বিরুদ্ধে। তার নারী কেলেঙ্কারির স্বভাব ছিল ছাত্রজীবন থেকেই। ক্ষমতার আশপাশে এসে এই স্বভাব আরও চাঙ্গা হয়।

চাঁদাবাজির অভিযোগে মামলা

ঠিকাদারি কাজ পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে টাকা নেওয়ার অভিযোগ আছে সত্যজিতের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় চাঁদাবাজির মামলাও হয়েছে। গত ১৯ এপ্রিল শহরের লক্ষ্মীপুর মহল্লার বাসিন্দা ঠিকাদার সালেহ আহমেদ কোতোয়ালি থানায় মামলাটি করেন। মামলার বিবরণীতে বলা হয়, বিভিন্ন ঠিকাদারি কাজ পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে সত্যজিৎ তার কাছে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। তিনি বাধ্য হয়ে তাকে সাড়ে সাত লাখ টাকা দেন।

আঙুল ফুলে কলাগাছ মোকাররম বাবু

তার পেশা কী সেই কথা জানে না কেউ। ‘পুঁজি’ কেবল রাজনীতি। এই পুঁজি খাটিয়ে যে এত সহজে টাকা কামানো যায়-ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের নেতা পরিচয় দেওয়া মোকাররম মিয়া বাবুকে না দেখলে বুঝতে পারবে না কেউ। গত ছয় বছরে তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে হু হু করে। একসময় পথে পথে ঘুরে বেড়ানো বাবু এখন চড়েন ব্যক্তিগত গাড়িতে। বহুতল বিশিষ্ট বাড়ি, ফ্ল্যাট, ব্যাংক হিসাবে নামে-বেনামে কাড়ি কাড়ি টাকা, জমিজিরাত কোনো কিছুরই কমতি নেই। যেন আলাদিনের চেরাগ পেয়েছেন বাবু।

ফরিদপুর শহরে কান পাতলেই শোনা যায় মোকাররম বাবুর নানা অপকর্মের ফিরিস্তি। স্থানীয় পর্যায়ে অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে বাবুর সম্পদ গড়ে তোলার পেছনের চাঞ্চল্যকর তথ্য। আওয়ামী লীগের রাজনীতিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে কীভাবে ফরিদপুরে দুর্নীতির মচ্ছব গড়ে তুলেছেন তিনি, সে চিত্রও ফুটে ওঠেছে স্থানীয়দের বর্ণনায়। আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতি, ঘুষ কেলেঙ্কারি, স্বজনপ্রীতি, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, মাদকব্যবসা কোনোটাই আর বাদ রাখেননি বাবু। অভিযোগ আছে পাসপোর্ট অফিসসহ সরকারি দপ্তর থেকে নিয়মিত মাসোহারা আদায়েরও। দুর্নীতি এমন পর্যায়ে ঠেকেছে যে, স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাই প্রকাশ্যে সমাবেশ ও মিছিল করেছে মোকাররম বাবুর গ্রেপ্তার দাবিতে। পাশাপাশি হঠাৎ সম্পদের উল্লম্ফনের পেছনের রহস্য তদন্ত করে কঠোর শাস্তির দাবিও জানিয়েছেন তারা। এছাড়া ২০ লাখ টাকা চাঁদাবাজির অভিযোগ এনে মামলাও হয়েছে বাবুর বিরুদ্ধে।   

স্থানীয় আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, ‘মোকাররম বাবুর মতো লোকেরা আওয়ামী লীগের ক্ষতি ছাড়া ভালো করতে পারেনি, পারবেও না। এদের রাজনীতি মানুষের জন্য নয়, নিজের জন্য। দলের জন্য মায়াকান্না কেঁদে পদ-পদবি বাগিয়ে নেওয়ার পর আসল চেহারা বেরিয়ে আসে। একেবারে ছাপোষা জীবনযাপন করতো বাবু। আর এখন সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। বৈধ উপায়ে টাকা কামানো যে এত সহজ নয়-এটা মানুষকে বুঝিয়ে দিতে হয় না।’

স্থানীয় এক ব্যবসায়ী সুযোগে ক্ষোভ ঢাললেন। বলেন, ‘চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলদারিত্ব ছাড়া বাবু ও তার সাঙ্গোপাঙ্গদের আর কোনো কাজ নেই। এদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া উচিত। যেন ভবিষ্যতে কেউ এ ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা করতে না পারে।’

রাতারাতি বনে গেছেন বহুতল ভবনের মালিক

ফরিদপুরের মাঠ পর্যায়ে অনুসন্ধানে মিলেছে বাবুর স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ গড়ে তোলার পেছনের তথ্য। স্থানীয়রা জানান, ফরিদপুরের মিয়াপাড়া সড়কে চার ইউনিটের পাঁচ তলা একটি বাড়ি রয়েছে তার। যার হোল্ডিং নম্বর ২৭/২৯/৮/১। বাড়িটি ১০তলা ভিত দেওয়া। এছাড়া মিয়াপাড়া সড়কে আরও একটি দোতলা ও একটি তিনতলা বাড়ি করেছেন বাবু। নিজের টাকায় করা এই বাড়ির মালিকানায় আছেন তার ভাইয়েরাও।

হয়েছেন ফ্ল্যাটের মালিকও

ফরিদপুর শহরে মাছরাঙ্গার শপিংমলের ওপরে ১৫০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট  রয়েছে তার। যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ৫০ লাখ টাকা। এছাড়া ঢাকার মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডের কাছে কসমোপলিটন ড্রিমের দ্বিতীয় তলায় ১৫০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট কিনেছেন। যার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় এক কোটি টাকা। ঢাকায় শ্যামলীর আদাবরেও আছে একটি ফ্ল্যাট। তাজমহল রোডে আছে আরও একটি। এসব ফ্ল্যাটের সবকয়টি নিজের নামে কেনেননি বাবু। স্ত্রী, নিকটাত্মীয়দেরও ব্যবহার করেছেন কায়দা করে।

জমিও কিনেছেন শহরে

মওকা পেয়ে হাতছাড়া করেননি বাবু। ফরিদপুর শহরে একাধিক প্লটের মালিক তিনি ও তার স্ত্রী। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ফরিদপুর পৌরসভার পেছনে পাঁচ শতাংশ জায়গাও আছে তার। এছাড়া ঝিলটুলি পানির ট্যাংকির পাশে স্ত্রীর নামে আছে আরও পাঁচ শতাংশ জায়গা।

দোকান আছে ফরিদপুর শহরে

নিজের কোনো ট্রেড লাইসেন্স আছে কি না সন্দেহ-অথচ প্রায় অর্ধশত দোকান নিয়েছেন ফরিদপুর শহরের বিভিন্ন মার্কেটে। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বাদ দেননি দোকান দখলও। তার ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে, ফরিদপুর শহরে নিউমার্কেটের তৃতীয় তলায় দুটি, স্বর্ণকুটির মার্কেটে তিনটি, তিতুমীর বাজারে (নির্মাণাধীন) নামে-বেনামে পাঁচটি, হেলিপোর্ট বাজারে আটটি এবং রকিবউদ্দিন পৌর মার্কেটে দুটি দোকানের মালিক তিনি। ফরিদপুর শহরের মধ্যে বিগত ছয় বছরে যত সরকারি দোকান তৈরি হয়েছে সেখান থেকে জোরপূর্বক, পেশিশক্তির বলে এবং বিভিন্ন লোকের নাম ভাঙিয়ে ২০ থেকে ২৫টি দোকান নিজ নামে এবং বেনামে বন্দোবস্ত নিয়েছেন।

আছে ব্যক্তিগত একাধিক গাড়ি

একসময় পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়ানো মোকাররম বাবুর এখন একাধিক ব্যক্তিগত গাড়ি আছে। কয়দিন বাদে বাদে মডেল পরিবর্তনের বিলাসিতাও করেন তিনি। তার ঘনিষ্ঠরাই দিয়েছে এসব তথ্য। সূত্র জানায়, একটি ব্যক্তিগত গাড়ি আছে বাবুর। এছাড়া শ্যালকের ব্যবহারের জন্য দিয়েছেন একটি মাইক্রো। স্ত্রীকে কিনে দিয়েছেন টয়োটা এলিয়ন মডেলের গাড়ি। যার নম্বর ঢাকা মেট্রো-১১-৪৮৮৬। সম্প্রতি আরও একটি টয়োটা প্রিমিয়ো কিনেছেন প্রায় ৫০ লাখ টাকা দিয়ে। যার শো-রুম নম্বর-৫৬১। এখনো নিবন্ধন হয়নি।

ব্যাংকে আছে কোটি টাকা

স্থাবর সম্পদের পাশাপাশি নগদ টাকাও জমা করেছেন বেশ। অনুসন্ধানের জানা গেছে, ফরিদপুরের সরকারি ও বেসরকারি একাধিক ব্যাংকে কোটি কোটি টাকা জমা আছে বাবুর। গত ১৫ এপ্রিল প্রাইম ব্যাংক লিমিটেডের ফরিদপুর শাখা থেকে ৭০ লাখ টাকা নগদ তুলেছেন তিনি। ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডের ফরিদপুর শাখায় অন্তত ১০ কোটি টাকা জমা আছে। তার ঘনিষ্ঠ একজন জানান, ২০১৩ সালে দুটি নতুন হিনো ৪২ সিটের বাস কিনে পরে তা কোটি টাকায় বিক্রি করে দেন বাবু। টাকা রেখেছিলেন মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট এবং ইস্টার্ন ব্যাংকে।

 পেশিশক্তির বলে মাসোহারা আদায়

রাজনৈতিক ও পেশিশক্তির বলে সরকারি ঠিকাদারিতে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছেন মোকাররম বাবু। ফরিদপুর জেলার সরকারি সব কাজ কব্জা করে মোটা অঙ্কের উৎকোচের বিনিময়ে তা বড় বড় ঠিকাদারদের মধ্যে ভাগ করে দেন বলে অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয় একজন ঠিকাদার বলেন, বাবু ও তার লোকজনদের উৎপাতের মুখে সহসাই সরকারি ঠিকাদারি কাজ পাওয়া কঠিন। তাদের অতিক্রম করে কিছুই করা সম্ভব নয়। কোনো কাজ করতে গেলেই মোটা অঙ্কের উৎকোচ দিতে হয় তাদের। ছয় বছর ধরে এসব করে কোটি কোটি টাকা আয় করেছেন তিনি।

স্থানীয় সূত্র জানায়, মাসোহারা আদায়েও এগিয়ে বাবু বাহিনী। বাসস্ট্যান্ড, আবাসিক হোটেল, মদের দোকান এমনকি পতিতাবৃত্তি থেকেও মোটা অঙ্কের মাসোহারা নেন তিনি। এছাড়া সরকারি বড় বড় কর্মকর্তাদের নানাভাবে ব্ল্যাকমেইল করে মোটা অঙ্কের টাকা আদায়ের অভিযোগও আছে। ফরিদপুর পাসপোর্ট অফিস থেকে শুরু করে ফরিদপুরের সরকারি দপ্তরগুলো থেকেও মাসোহারা তোলে তার অনুসারী-অনুগামীরা।

অস্ত্রধারী লোক নিয়ে ঘুরে বেড়ায়

মোকাররম বাবুর বিরুদ্ধে আছে অবৈধ অস্ত্রের ভয় দেখানোর অভিযোগও। কার্য হাসিলে নানাসময় নিজ গাড়িতে অবৈধ অস্ত্রধারী লোক নিয়ে ঘুরে বেড়ান বাবু।

চাঁদাবাজির অভিযোগে মামলা

ঠিকাদারি কাজ পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে বেকায়দায় পড়েছেন বাবু। ২০ লাখ টাকা চাঁদাবাজির অভিযোগ এনে গত ১৯ এপ্রিল ফরিদপুরের কোতোয়ালি থানায় মামলা হয়েছে তার বিরুদ্ধে। মামলাটি করেছেন ফরিদপুর শহর যুবলীগের সভাপতি সাজ্জাদ হোসেন বরকত। তিনি বলেন, ‘ফরিদপুর সরকারি তিতুমীর মার্কেটে নির্মাণ কাজ পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে মোকাররম বাবু আমার কাছ থেকে এক কোটি টাকা চাঁদা দাবি করেন। এর মধ্যে মধ্যে ৫০ লাখ টাকা দিয়েছিলাম। বাকি ৫০ লাখ টাকার জন্য বাবু প্রায়ই তাকে হুমকি-ধামকি দিয়ে আসছিল। এ অভিযোগে তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলা করেছি।’

সরকারি রেস্ট হাউজে বাবুর ‘রঙমহল’

শুধু টাকার পেছনেই ছুটেননি মোকাররম বাবু। আরাম-আয়েশেও মন আছে তার। চিত্তবিনোদনে নারী আর মদ দুটোই ছিল তার সঙ্গী। তার ঘনিষ্ঠ সূত্রে জানা গেছে, ফরিদপুরের নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের রেস্ট হাউজ ছিল তার অস্থায়ী রঙমহল। জোরপূর্বক এসব দপ্তর অনৈতিক কাজে ব্যবহার করতেন বাবু। কেউ কিছু বললে নানাভাবে হুমকি-ধমকির অভাব হতো না।   

সত্যজিত মুখার্জির কারণে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের অনেক কথা শুনতে হয়েছে। তার অপকর্মের দায় আমরা নেব না। তার সঙ্গে ছাত্রলীগের সব ধরনের সম্পর্ক শেষ। এখন কীভাবে তিনি রাতারাতি বিপুল সম্পদের পাহাড় গড়েছেন সেই তদন্তই হওয়া প্রয়োজন।

মনিরুজ্জামান মনির

সভাপতি, ফরিদপুর জেলা ছাত্রলীগ
ফরিদপুর সরকারি তিতুমীর মার্কেটে নির্মাণ কাজ পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে মোকাররম বাবু আমার কাছ থেকে এক কোটি টাকা চাঁদা দাবি করেন। এর মধ্যে মধ্যে ৫০ লাখ টাকা দিয়েছিলাম। বাকি ৫০ লাখ টাকার জন্য বাবু প্রায়ই তাকে হুমকি-ধামকি দিয়ে আসছিল। এ অভিযোগে তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলা করেছি।

সাজ্জাদ হোসেন বরকত

সভাপতি, ফরিদপুর শহর যুবলীগ