বিরুপাক্ষ পাল, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে অবস্থিত স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্কের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর। ১৯৮৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইকোনমিক্সে মাস্টার্স করে অস্ট্রেলিয়ার সিডনির ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলোজি থেকে ফিন্যান্সে এমবিএ করেন। বিংহ্যামটনের স্টেট ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক থেকে ২০০৪ সালে অ্যাপ্লাইড ইকোনমিক্সে মাস্টার্স করে একই বিশ্বদ্যিালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন ২০০৭ সালে ।
মুদ্রাস্ফীতি, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, বাণিজ্য উদারীকরণ ও আর্থিক (মনিটারি) অর্থনীতির ওপরে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশনা আছে তার। ব্যাংকিং, অর্থনৈতিক সাংবাদিকতা, কনসালটেন্সি, শিক্ষকতা ও গবেষণায় আছে অভিজ্ঞতা। ঢাকা টাইমস টোয়েন্টিফোরের সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন আসন্ন বাজেট, প্রবৃদ্ধি এবং ব্যাংকিং খাতের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছে সৈয়দ বাকের।
ঢাকাটাইমস: বরাবরই বাজেট ঘোষণার পর তা উচ্চাভিলাষী বলে অভিযোগ উঠে। এ প্রেক্ষাপট থেকে আগামী বাজেট কেমন হতে যাচ্ছে?
বিরুপাক্ষ: উচ্চাভিলাষী বাজেট খারাপ না। বরং উদীয়মান অর্থনীতিতে বাজেট সব সময় উচ্চাভিলাষী হয়। এবং সেটা না হলেই অর্থনীতির মধ্যে একটা ম্যাড়ম্যাড়ে ভাবে চলে আসে। এটা হলো আকাঙ্ক্ষাকে আরও উপরে তোলা।
তাই বাজেটটা বরাবরের মতোই হবে, আকারটাও বড় হতে থাকবে। কারণ আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৬ থেকে ৭ শতাংশের মাঝামাঝি, আর তার সাথে মূল্যস্ফীতি আছে। তাই ১২ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বাজেটের সবগুলো আকারই বেড়ে যাওয়া উচিত। এটা হলো সাধারণ একটা মাপের মধ্যে আসা।
ঢাকাটাইমস: প্রবৃদ্ধি যা ধরা হয় তা পূরণ হয় না। এটা কি শুধু রাজনৈতিক কারণেই পূরণ হয় না, নাকি অর্থনৈতিক কোনো প্রতিবন্ধকতা আছে?
বিরুপাক্ষ: ব্যাপারটা হচ্ছে, আমরা যখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বলি, প্রবৃদ্ধি সাড়ে ছয় হবে, এটা কিন্তু পূর্বাভাস। বাজেট কিন্তু পূর্বাভাস না, লক্ষ্যমাত্রা। দুটোর মধ্যে একটু পার্থক্য আছে। সব সময় একটা ইতিবাচক লক্ষ্যমাত্রা সরকার দিতে পারে। এটা খারাপ কিছু না। এবং সে টার্গেটটা শুধু রাজনৈতিক কারণেই শুধু ব্যর্থ হচ্ছে না। প্রকল্প বাস্তবায়নের ব্যর্থতার কারণে এমনটা হয় বেশি। আমাদের কোনো কিছুই যেন ধাক্কা না দিলে এগোতে চায় না। আমাদের সমাজের মধ্যে গতিশীলতা কম। যেমন ঢাকা। একটা দেশের রাজধানী দেখে একটা স্মার্ট জেনারেশনের মানসিকতা গড়ে উঠে। আমাদের রাজধানীকে দেখলে একটা মানুষের স্মার্টনেসসহ সমস্ত কিছু উবে যায়। যেমন আমি যদি আজকে বাংলাবাজারে, পুরান ঢাকার কথা বলি, যেটা এককালে ব্যবসাকেন্দ্র ছিলো, সেখানে কেউ যেতে চায় না, এটা দুর্ভেদ্য একটা জায়গা। বাংলাবাজার থেকে কেউ এদিকে আসতে চায় না। আমরা একটা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছি। অথচ শুধু রাজধানীর উন্নয়ন করে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ১% বাড়ানো সম্ভব। শুধু ট্রাফিক আর মোবিলিটি, রাস্তাঘাটগুলো ঠিক করলেই এটা বাড়বে। আবার আমরা প্রকল্পগুলো সময় মত বাস্তবায়ন করতে পারি না। এটা একটা বড় ব্যর্থতা।
ঢাকাটাইমস: তাহলে কি আমাদের অন্য উন্নয়নগুলো অর্থনৈতিক অগ্রগতির সাথে সামঞ্জস্য না? যেমন বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিবি) বাস্তবায়নে দেখা যায়, তা সবসময় কাঁটছাঁট করতে হয়।
বিরুপাক্ষ: দুটো কথাই একইভাবে সত্য। উন্নয়ন হচ্ছে না বলেই প্রবৃদ্ধি এইভাবে হচ্ছে। কেননা, উন্নয়নটা আগে অবকাঠামো দেবে। তারপর এর ওপর ভিত্তি করে প্রবৃদ্ধি আসবে। তাই সরকারের বাজেটের একটাই লক্ষ্য হওয়া উচিত, বাজেটের উন্নয়ন ব্যয়ের সক্ষমতা বৃদ্ধি। রাস্তা-ঘাট বানাচ্ছি, আমারা তো খামাখা ওই জায়গাগুলোতে টাকা ঢালতে পারব না। ওই ব্যয় বৃদ্ধির সক্ষমতা বাড়ালে অর্থনীতির সম্ভাবনা বাড়ে। যেমন- মেট্রোরেল, ফ্লাইওভার, চারলেন রাস্তার কাজ শেষ করলেই প্রবৃ্দ্ধি এক থেকে দেড় শতাংশ বেড়ে যাবে। যেমন ইন্দোনেশিয়া নতুন সরকার আসার পরেই অনেকগুলো বিমান ও সমুদ্রবন্দর স্থাপনের কাজ হাতে নিয়েছে। আমাদেরও এ ধরনের কিছু বড় কাজ হাতে নিতে হবে।
ঢাকাটাইমস: নতুন বেতন স্কেলের কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এর যৌক্তিকতা কতটুকু?
বিরুপাক্ষ: প্রথমত, এটা আমার এতটা বাড়বে বলে মনে হয় না। কারণ এটা অনেক আকাঙ্ক্ষিত। পাঁচ বছর ধরে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাড়ে না। সরকারের উচিত প্রতি বছর একটু করে বাড়ানো। যেটা বিদেশে মুদ্রাস্ফীতের সাথে ইনজেক্ট করা হয়। এমনটি হলে বোধ হয় এই জিনিসটা নিয়ে কেউ কোনোদিন আলোচনাও করবে না। কিন্ত এখন যদি হঠাৎ করে একটা ধাক্কা দেয় তার একটা তাঁৎক্ষণিক প্রভাব পড়তে পারে। আবার আকাঙ্ক্ষার কারণেও এটা হতে পারে। এটা মানুষের মধ্যে প্রত্যাশ্যা বা ভীতি তৈরি করে দেয়। কিন্তু অতীতের পে স্কেলে আলোচনা থেকে দেখা যায় এটা কখনো বেড়েছে, কখনও বাড়েনি। সুতরাং ওরকম নিশ্চিত করে বলা যায় না যে পণ্যমূল্য বাড়বে।
ঢাকাটাইমস: আপনি জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির কথা বলেন। এক্ষেত্রে আমাদের অগ্রগতি -
বিরুপাক্ষ: আমাদের জ্ঞান ভিত্তিক অর্থনীতির চরম তাগিদ অনুভব করা উচিত। কেননা এশিয়া প্যাসিফিকের ২৮টি দেশের মধ্য যে ইনডেক্স করা হয়, তাতে আমাদের অবস্থান ২৭। বলতে গেলে একেবারে নিচে। এমনকি প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তান থেকে আমাদের স্কোর খারাপ। এই অবস্থার পরিবর্তন করতে হলে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা বাড়ানো উচিত, যেটাকে আরঅ্যান্ডডি (রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) বলে। বিদেশে এটাকে প্রচুর উৎসাহিত করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে রিসার্চকে ওইভাবে উৎসাহ দেয়া হয় না। আর শিক্ষকদের নিয়োগ প্রক্রিয়াও অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ, বলতে গেলে স্বজনপ্রীতি বা দলপ্রীতি। এসব কারণে প্রতিষ্ঠানের মান পড়ে যাচ্ছে।
এজন্য আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচিত আন্তর্জাতিক বাজার থেকে শিক্ষক ভাড়া করে নিয়া আসা। শুধু যে বিদেশিদের আনতে হবে তা না, অনেক বাঙালিও আছে। আমি পাকিস্তানের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কথা জানি তারা শিকাগো থেকে যায়, আমেরিকার আরও জায়গা থেকে ভাড়া করে নিয়ে আসে। কেননা তারাও শিক্ষার মান নিয়ে সজাগ। অথচ আমরা মাস্টার্স ডিগ্রির পরেই শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিই। এতে যে ক্ষতিটা হলো, আমি যা শেখালাম সেও তাই শেখাল। কিন্তু আমেরিকা-ইউরোপে পিএইচডি করা এবং অ্যাসোসিয়েট প্রফেসরের নিচে চাকরি হিসেবে নিয়োগ দেয় না। এতে শিক্ষার মান বাড়ে। যেমন আমরা পরামর্শকদেরকে বাইরে থেকে নিয়ে আসি এটা নিয়ে যে যত কথাই বলুক না কেন। দ্বার রূদ্ধ করে নিজেরে জ্ঞানী ভাবলে তো লাভ হবে না। এটা আমাদের মানসিকতার একটা বড় বাধা। সব সময় আবেকের কথা বলি, রাজনীতি করি, বলি যে যে বিদেশিরা করছে। অথচ বিদেশিরাই আমাদের কাছ থেকে শিখছে। ওরা যেখানেই জ্ঞান পায় সেটাই নিয়ে নেয়। জ্ঞানী এবং জ্ঞান বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষকে যথাযোগ্য স্থানে গ্রহণ না করা- এ ঘাটতির কারণে আমাদের প্রবৃদ্ধি দীর্ঘমেয়াদি হুমকিতে পড়বে। যদি এ ঘাটতি পূরণ করা না যায় তবে গ্রোথ তো থাকবে না।
ঢাকাটাইমস: আমাদের আয়ের প্রধান দুই খাত রেমিট্যান্স এবং রেডিমেট গার্মেন্ট নিয়ে কোনো শঙ্কা আছে কিনা?
বিরুপাক্ষ: আমাদের গার্মেন্টসের প্রবৃদ্ধি থাকবেই। কেননা যে দেশগুলো উন্নত হয়ে যায়, তারা আর গার্মেন্টের কাজ করে না। তবে শ্রমিকদের বেতন এখন যা আছে তার দ্বিগুণ করা উচিত।
আর রেমিট্যান্স আরও বাড়ানোর সুযোগ আছে। মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমিক না পাঠিয়ে আমেরিকা ইউরোপে ডাক্তার-ইকোনমিস্ট-ইঞ্জিনিয়ারের মতো দক্ষ লোক পাঠাতে হবে। তাদের আয়ও বাড়ে। এজন্য মানবউন্নয়ন করতে হবে।
ঢাকাটাইমস: স্পেড বা গড় সুদের হারের ব্যবধান ৫ শতাংশের নীচে হলেও একক হিসেবে কোনো কোনো ব্যাংকের ব্যাংকের স্পেড এখনো বেশি। বিশেষ করে বিদেশি ব্যাংকগুলো, এটা কি পরিবর্তন সম্ভব?
বিরুপাক্ষ: বিদেশি ব্যাংকগুলোতে আধুনিক সুবিধাগুলো বেশি। দেশীয় ব্যাংকগুলোও এসব সুবিধা দিতে পারলে এ অবস্থার পরিবর্তন হবে।
ঢাকাটাইমস: রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর সোনালী অতীতের তুলনায় বর্তমান অবস্থা অনেকটা শোচনীয়-
বিরুপাক্ষ: রাষ্ট্রীয় মালিকানার হওয়ার কারণে এরা লাভ করে কম। এর সাথে বেসরকারি ব্যাংকের তুলনা করা চলে না। এরা সব জায়গায় শাখা খুলে এদিকে এরা একটু লোকসান করে। আর যেহেতু রাষ্ট্রীয় ব্যাংক, তাই মানুষ লোন নিতে গেলে রাজনৈতিক প্রভাব খাটায়, যেটা বেসরকারি ব্যাংকে করতে পারে না। এসব ব্যাংকের সামাজিক দায়বদ্ধতা আছে এর সাথে রাজনৈতিক প্রভাব বা অদক্ষতার প্রভাব না থাকলে এরা আরও ভালো করতে পারবে।
ঢাকাটাইমস: সামগ্রিকভাবে ব্যাংকিং খাতের বর্তমান অবস্থার মূল্যয়ন এবং ভবিষ্যত উন্নয়নে করণীয়।
বিরুপাক্ষ: অবস্থা কিছুটা ভালোর দিকে ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে। খেলাপি ঋণ এবং স্পেড সহ অন্যান্য প্রতিবন্ধকতাগুলো আস্তে আস্তে কমে আসছে, যার মানে ইফিশিয়েনসি বাড়ছে। বছরের প্রথম তিন মাস তো অশান্তি ছিলো, এখন বাজেট হচ্ছে এতে কিছু আশাবাদ থাকবে, এতে মানুষের স্পেন্ডিং বাড়বে ফলে ব্যাংকিং খাত আরও চাঙ্গা হবে। সাথে সাথে রুলস অ্যান্ড রেগুলেশনগুলো যাতে ঠিকভাবে প্রতিপালিত হয় সেদিকটা খেয়াল রাখতে হবে এবং বিচারিক সংস্কারের কথা চিন্তা করতে হবে। কারণ মামলা-মোকাদ্দমা কোর্টে যখন আটকে যায় তখন খেলাপিরাও এক ধরনের আশ্রয় পেয়ে যায়। এতে ব্যাংকগুলো বছরের পর বছরের ক্ষতির শিকার হচ্ছে। এজন্য ব্যাংকিং খাতের জন্য আলাদা আদালত বসানো যেতে পারে।
ঢাকাটাইমস: ধন্যবাদ
বিরুপাক্ষ: আপনাকেও ধন্যবাদ।