মুহূর্তেই তৈরি করা যায়, রন্ধনপ্রণালিও বেশ সহজ। স্বাদও ভালো। তাই বাংলাদেশে বাজার ধরতে কষ্ট করতে হয়নি ইনস্ট্যান্ট নুডলস ম্যাগির। তাদের জনপ্রিয়তায় বাজারে আসে আরও নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান। গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বাজারের এই রমরমা অবস্থায় বুঝি ছেদ পড়ল এবার।
শুরুটা হয়েছে ভারতের উত্তরপ্রদেশে। সেখানকার বাজার থেকে ম্যাগি সংগ্রহ করে মাত্রাতিরিক্ত সিসা থাকার প্রমাণ পাওয়ার পর বাজার থেকে পণ্যটি তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রদেশটির খাদ্যের মাননিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত দপ্তর ‘ফুড সেফটি অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’। তথ্য প্রবাহের যুগে খবরটি দাবানলের মতো ছড়িয়েছে বাংলাদেশেও। আর নুডলসটি নিয়ে উদ্বেগ ছড়িয়েছে ভালোভাবেই।
খাদ্যে ভেজাল নিয়ে এমনিতে দেশের মানুষ উৎকণ্ঠিত। নানা সময় খাবারে ক্ষতিকর রাসায়নিকের ব্যবহার নিয়ে তোলপাড় হয়েছে দেশে। এর বিচার বা প্রতিকার কতটা হয়েছে বা আদৌ হয়েছে কি না, সে নিয়ে জনমনে আছে প্রশ্ন। এই অবস্থায় সামর্থ্যবানরা মানসম্মত খাবার খেতে বাড়তি পয়সা খরচ করতে দ্বিধা করেন না। আর এই অবস্থায় নামিদামি প্রতিষ্ঠানের বিক্রি বেড়ে যায়। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর পণ্যের মান নিয়ে কখনও সেভাবে প্রশ্ন উঠেনি বাংলাদেশে। নেসলের মতো প্রতিষ্ঠানের তো নয়ই।
কিন্তু ভারতের উত্তরপ্রদেশে এই নেসলের পণ্য ম্যাগির সিসাকাকাণ্ডের পর বাংলাদেশে নুডলসটির বিক্রিতে নেমেছে ধস। নিয়মিত ভোক্তারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন জনপ্রিয় এই খাবার থেকে। এতদিন এ নিয়ে কোনো মাথা ব্যথাই ছিল না কারো। নিয়ম হচ্ছে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে বাজারে যাবে পণ্য। অথচ ভারতের উত্তরপ্রদেশে ম্যাগিতে অতিরিক্ত সিসা ও অন্যান্য ক্ষতিকারক দ্রব্যের অস্তিত্ব পাওয়ার পর নতুন করে নুডলস পরীক্ষায় নামে বিএসটিআই। এ থেকেই বোঝা যায় তাদের কাছে আগে থেকে ভারতের বহুজাতিক কোম্পানি নেসলের তৈরি ম্যাগি নুডলস সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোনো তথ্য ছিল না।
খাদ্য ও পুষ্টিবিদরা বলেন, যেকোনো খাবার বাজারজাত করার আগে অবশ্যই তার গুণগতমান নির্ণয় যথাযথভাবে হওয়া উচিত। এমনকি নিয়মিত রুটিন করে বাজারের খাবার মাঝেমধ্যেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা দরকার। একবার কোনো মতে দায়সারা পরীক্ষার পর দিনের পর দিন বাজারে পণ্য বিক্রি হচ্ছে, অথচ সরকারি কর্তৃপক্ষ জানেনই না বাজারে কে কী বিক্রি করছে।
অতিরিক্ত সিসার খবর ছড়িয়ে যাওয়ার পর ম্যাগির বিক্রি যে কমেছে তা প্রতিষ্ঠানটিও হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। ব্যবসায়ী নীতি ও কৌশলও নিতে ভুল করেনি প্রতিষ্ঠানটি। সঙ্গে সঙ্গে প্রতি প্যাকেট নুডলসের দাম ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে আনা হয়েছে। মানুষকে আকৃষ্ট করতে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও টেলিভিশনেও নিয়মিত চমকপদ বিজ্ঞাপনও প্রচার করা হচ্ছে। তবে নেসলে কর্তৃপক্ষের দাবি, বিক্রি কমে যাওয়ায় তারা দাম কমিয়ে দেয়নি, এটা তাদের ‘প্রোমোশনাল ক্যাম্পেইন’।
চাহিদা কমে যাওয়ায় বাজার ধরে রাখতেই এই দাম কমানো কি না সে প্রশ্ন উঠছে জোরেশোরে। তবে বিষয়টি স্বীকার করে না ম্যাগির বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান নেসলে বাংলাদেশ। জানতে চাইলে নেসলে বাংলাদেশের করপোরেট কমিউনিকেশন ম্যানেজার ফারাহ শারমীন আওলাদ বলেন, ‘নিয়মিত প্রোমোশন হিসেবেই বাজারে গত এপ্রিল মাসে সীমিত সময়ের জন্য ক্রেতাদের জন্য এই বিশেষ ছাড় দেওয়া হয়, যা সাধারণত তিন থেকে ছয় মাস আগেই পরিকল্পনা করা হয়।’ তিনি দাবি করেন, তারা নিয়মিত আন্তর্জাতিক মানের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত পরীক্ষাগারে পণ্য নিরীক্ষণ করে থাকে।
তার এই বক্তব্যের সঙ্গেই আছে বাস্তবের অসঙ্গতি। এপ্রিল মাসের দিকে ‘সীমিত সময়ের’ জন্য বিশেষ ছাড়ের কথা বলা হলেও ভারতের উত্তরপ্রদেশে ম্যাগি নিয়ে তোলপাড়ের পর দেশের বাজারে নতুন করে বিশেষ ছাড় দেয় ম্যাগি। গত এক সপ্তাহ ধরে বিক্রেতারা ক্রেতাদের কাছে ম্যাগি বিক্রিতে এই কৌশল বেছে নেন।
নুডলস শিশুদের কাছে বেশ জনপ্রিয় একটি খাবার। চমকপ্রদ বিজ্ঞাপন আর ঘন ঘন বিশেষ ছাড়ের কারণে অন্যান্য নুডলসের তুলনায় বাজারে ম্যাগির চাহিদা বেশি। এর অন্যতম ভোক্তাদের একটা বড় অংশ শিশু। যে কারণে যদি ম্যাগিতে সত্যিকার অর্থেই সিসা কিংবা রাসায়নিক পদার্থ থাকে তাহলে শিশুদের স্বাস্থ্যঝুঁকিই বেশি থাকে। এ দিয়ে তারাই বেশি আক্রান্ত হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য ও পুষ্টি বিজ্ঞান অনুষদের অধ্যাপক নাজমা শাহীদ বলেন, ‘অতিরিক্ত সিসা শিশুর স্বাভাবিক মানসিক গঠন ও বিকাশকে মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত করে। এ থেকে শিশু নিউমোনিয়াসহ জটিল রোগে আক্রান্ত হতে পারে। যে কারণে বিএসটিআইয়ের উচিত হবে যতদ্রুত সম্ভব বাজারের ম্যাগি নুডলসসহ অন্যান্য নুডলস পরীক্ষা করে দেখে এ ব্যাপারে করণীয় ঠিক করা।’
রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী রাইশা বিনতে মতিন গত এক সপ্তাহে নিত্যদিনকার রুটিনে পরিবর্তন এনেছে। আগে সকালে বাসা থেকে বেরোনোর সময় মা চটজলদি একটা ম্যাগি নুডলস সেদ্ধ করে দিয়ে দিতেন স্কুল ব্যাগে। এখন আর তিনি এ কাজ করেন না। মেয়েকে দুপুরের জন্য অন্য খাবার দিয়ে দেন। জানতে চাইলে মা নাসরিন বেগম বলেন, ‘সিসা ও রাসায়নিক দ্রব্যের কথা শোনার পরও মেয়েকে কীভাবে ম্যাগি নুডলস খেতে দেই বলুন? প্রতি মাসে একসঙ্গে প্রায় চল্লিশ প্যাকেট নুডলস আনিয়ে রাখি। এখনও বাসায় ২০ প্যাকেটের ওপরে আছে। এগুলো ফেলে দিতে হবে।’
বেড়েছে ছাড় কমেছে বিক্রি
সিসার অস্তিত্বের খবরে দেশের বাজারে অস্বাভাবিকভাবে কমেছে ম্যাগি নুডলসের বিক্রি। সেখানে নেসলেও তাদের পণ্যের বাজার ধরে রাখতে কৌশল নিয়েছে মুহূর্তে। কমিয়ে দিয়েছে নুডলসের দাম। বিশেষ ছাড়ের নামে নতুন প্যাকেট করে বাজারে ছাড়ছে নুডলস। বর্তমানে আট পিস প্যাকেটের মূল্য ১৩০ টাকার পরিবর্তে ১০০ টাকা, চার পিস প্যাকেটের মূল্য ৬৬ টাকার পরিবর্তে ৫০ টাকা এবং ১২ পিসের প্যাকেট ১৯৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এর মধ্যে চার ও আট পিসের প্যাকেটের দাম সপ্তাহ তিনেক আগে কমানো হয়েছিল। এ প্যাকেট দুটির দাম ছিল যথাক্রমে ৮৫ ও ১৩০ টাকা।
ছাড়ের পরিমাণ বাড়লেও বাড়েনি বিক্রি। আগে যারা দিনে ৩০ থেকে ৪০ প্যাকেট নুডলস বিক্রি করতেন এখন তারা দিনে পাঁচ প্যাকেটও বিক্রি করতে পারেন না। মগবাজারের একটি সুপার শপের কর্মী জামাল হোসেন বলেন, ‘গত এক সপ্তাহ ধরে ম্যাগি নুডলস বিক্রি হচ্ছে না বললেই চলে। মানুষ আর এগুলো নিচ্ছে না। তবে অন্য কোম্পানির নুডলসের বিক্রি বেড়েছে। ম্যাগি এত ছাড় দিচ্ছে তারপরও মানুষ নিতে চাইছে না।’ কারণ কী? জবাবে তিনি বলেন, ‘জানি না ভাই, শুনেছি কি নাকি বিষ পাইছে ম্যাগি নুডলসে।’
কারওয়ান বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী ফারুকুজ্জামান বলেন, ‘খুচরা ব্যবসায়ীরা এখন আর ম্যাগি নুডলস নিতে চাইছে না। কী নাকি পাওয়া গেছে। আগের গুলাও অনেকে ফেরত দিতে চাইতাছে।’ তবে কী কারণে ম্যাগির বিক্রি কমে গেছে তা ঠিকঠাক জানেন না তিনি। শুধু এটুকুই বললেন, ‘ম্যাগিতে নাকি কী ভেজাল পাইছে, তাই বিক্রি কইমা গেছে।’
অতিরিক্ত সিসা যে কারণে ক্ষতির কারণ
স্বাস্থ্যবিদরা জানান, অতিরিক্ত সিসা থাকলে রক্তে হিমোগ্লোবিন তৈরির প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। এতে নিউমোনিয়া হতে পারে। ফুসফুসের বায়ুথলির পর্দা ফেটে যাওয়ার আশঙ্কাও থাকে। শরীরের রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতাও কমে যায়। তবে মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক কি না এই বিষয়ে এখনও বিতর্ক রয়েছে। মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট যুক্ত খাবার খাওয়ার ফলে মাথাব্যথা, বমি বমি ভাব, হজমের অসুবিধা হয় অনেকেরই। যেখানে খাবারে এই রাসায়নিকের অনুমোদিত পরিমাণ ০.০১ পিপিএম, সেখানে ম্যাগিতে মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট রয়েছে ১৭ পিপিএম।
পুষ্টিবিদরা আরও বলছেন, মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট মূলত কোনো খাবারে মেশানো হয় স্বাদ বাড়ানোর জন্য, যা টেস্টিং সল্ট নামে বাজারে মিলে। অল্প পরিমাণে মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট খাবার এবং মানুষের শরীরের পক্ষে নিরাপদ হলেও অতিরিক্ত ও দীর্ঘদিন ব্যবহারে শরীরের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হয়।
পরীক্ষায় নেমেছে বিএসটিআই
ম্যাগি নুডলসে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর উচ্চমাত্রায় সিসার উপস্থিতি পাওয়ার পর বাংলাদেশেও পণ্যটির মান পরীক্ষা করছে বিএসটিআই। বাড়তি সতর্কতা হিসেবে ম্যাগির সঙ্গে বাজারে থাকা নিউজিল্যান্ড ডেইরির ‘নুডলস’; কল্লোল থাই ফুডের ‘মামা’; ইফাদ মাল্টি প্রোডাক্টের ‘ইফাদ এগি’ ও প্রাণ গ্রুপের প্রতিষ্ঠান নাটোর এগ্রো লিমিটেডের ‘মিস্টার’ নুডলসও পরীক্ষা করা হচ্ছে বলে বিএসটিআইর সহকারী পরিচালক গোলাম বাকী জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘ম্যাগি নুডলসের পাঁচটি নমুনা সংগ্রহ করে রোববারই সেগুলো পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছে। চলতি সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবেদন পাওয়া যাবে।’
যেভাবে এলো নিষেধাজ্ঞা
ভারতের উত্তরপ্রদেশের নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবে ম্যাগি নুডলসও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হয়। এতে ধরা পড়ে অতিরিক্ত সিসা ও রাসায়নিক দ্রব্যের অস্তিত্ব। সঙ্গে সঙ্গে এক সপ্তাহের মধ্যে ম্যাগির সব প্যাকেট বাজার থেকে তুলে নেওয়ার নির্দেশ দেয় দেশটির খাদ্য নিরাপত্তা বিভাগ। গত বছর মার্চ মাসে তৈরি ম্যাগি ইনস্ট্যান্ট নুডলসের প্যাকেটের একটি ব্যাচে মাত্রাতিরিক্ত সিসা থাকার কারণেই তা বাজার থেকে তুলে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে ওই প্যাকেটগুলোতে মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে বেশি পরিমাণে থাকায় এ নির্দেশ দেওয়া হয়।
এফডিএ জানিয়েছে, সংশ্লিষ্ট ব্যাচের দু ডজন প্যাকেট রাজ্য সরকার পরিচালিত ল্যাবরেটরিতে রুটিনমাফিক পরীক্ষা করা হয়। দেখা যায়, তাতে সিসার পরিমাণ ১০ লক্ষ ইউনিটে ১৭.২ ভাগ। যদিও আদতে তা ০.০১ থেকে ২.৫ ভাগের বেশি থাকার কথা নয়। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে সিসার পরিমাণ সাতগুণ বেশি। পাশাপাশি নুডলসের স্বাদ বাড়াতে যে মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট যোগ করা হয়, তার পরিমাণও ছিল অনেক বেশি।
নেসলের অন্য পণ্য নিয়েও উদ্বেগ
মোড়কজাত খাদ্যপণ্যের ব্যবসায় বাংলাদেশে নিঃসন্দেহে এগিয়ে নেসলে। নুডলস ছাড়াও শিশুখাদ্য, গর্ভবতী নারীদের জন্য ফুড সাপ্লিমেন্ট, চকলেট, চিপস, চা, কফির মতো মুখরোচক খাবারের বাণিজ্যে এরই মধ্যে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত এক নাম নেসলে। এই প্রতিষ্ঠানটির এক পণ্য ম্যাগি নিয়ে যখন উঠেছে প্রশ্ন, তখন প্রতিষ্ঠানের অন্য পণ্যগুলোর মানও যাচাই-বাছাই করা উচিত বলে মনে করেন মাননিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বিএসটিআইয়েরই একাধিক কর্মকর্তা। তবে এ বিষয়ে এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানান তারা। -সাপ্তাহিক এই সময়-এর সৌজন্যে।