ঢাকা: দীর্ঘ দিন ধরেই রাজপথে একরকম নিষ্ক্রিয় বিএনপি ও তার অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনগুলো। বিশেষ করে গত পাঁচ জানুয়ারি থেকে তিন মাসের আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার পর রাজপথ থেকে উধাও বিএনপি।
আর এই সুযোগে পুরো মাঠই যেন আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোর দখলে। তবে বিরোধীদল শূন্য মাঠে থেমে নেই সংঘাত ও সংঘর্ষ।
আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগী সংগঠনের নেতারা আধিপত্য বিস্তারসহ ব্যক্তি স্বার্থে নিজেদের মধ্যে সংঘাত ও হানাহানিতে জড়িয়ে পড়ছে। সম্প্রতি এই সংঘাত ও হানাহানি যেন বেড়ে গেছে। প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও নিজেদের মধ্যে সংঘাতে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। বিচারহীনতা বা বিলম্বিত বিচার সংস্কৃতি চলতে থাকায় এই সমস্যা বাড়ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সর্বশেষ গত মঙ্গলবার সকালে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে মাদারীপুরে স্থানীয় যুবলীগ কর্মী আরশেদ মাতবরকে কুপিয়ে হত্যা করেছে নিজ দলের অন্য একটি গ্রুপ। আরশেদের সঙ্গে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে মুদি দোকানি শাজাহান দরানীকেও।
এর একদিন আগে সোমবার রাতে আরেক যুবলীগ নেতা আজিজুল হককে গুলি ও কুপিয়ে হত্যা করে আওয়ামী লীগ। এ ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন আরও দুইজন। একইদিন পাবনার ঈশ্বরদীতে এক ছাত্রলীগ নেতার বাম হাত কেটে নিয়ে উল্লাস করেছে একই দলের প্রতিপক্ষ গ্রুপের নেতাকর্মীরা।
২৯ মে রাজশাহীতে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের সংঘর্ষে জীবন বিশ্বাস (২২) নামে এক ছাত্রলীগ কর্মী নিহত হয়েছেন। এ সংঘর্ষে আহত হয়েছেন আরো দুইজন।
এভাবে প্রতিদিনই আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের মধ্যকার সংঘর্ষে নিজ দলের কেউ না কেউ প্রাণ হারাচ্ছেন। এসব ঘটনায় বিচার না হওয়ায় ক্রমেই বাড়ছে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে খুনের সংখ্যা। দোষীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও কার্যকর দলীয় ব্যবস্থা না নেয়ায় এসব ঘটনা বাড়ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এক বছর আগে গাজীপুরের শ্রীপুরে আওয়ামী লীগের দুই চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় মারা যান উপজেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি আল আমিন। ধামাচাপা পড়ে যাওয়া আলোচিত ওই মামলাটি এখন উচ্চ আদালতে স্থগিত রয়েছে। চলতি বছরের ৫ এপ্রিল কুমিল্লায় দিবালোকে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান শহর ছাত্রলীগ সভাপতি এম সাইফুল ইসলাম। এ ঘটনায় একটি মামলা হলেও প্রতিপক্ষ প্রভাবশালী হওয়ায় কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
একইভাবে সরকার পরিচালনায় আওয়ামী লীগের গত সাড়ে ছয় বছরে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে খুনের শিকার অন্তত দুই শতাধিক নেতা-কর্মী। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মামলার চার্জশিটও দাখিল করেনি পুলিশ। যেগুলোর চার্জশিট হয়েছে সেগুলোর বিচার প্রক্রিয়াও চলছে শ্লথগতিতে।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী গত সাড়ে ছয় বছরে (২০০৯-১৪) সরকারি দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের অন্তত ১৭২ জন নেতা-কর্মী খুন হয়েছেন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও চরমপন্থিদের হাতে খুন হয়েছেন আরও অন্তত ৭৫ জন।
গত ৫ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচনের পর থেকে এ পর্যন্ত আরও প্রায় ৫০ জন নেতা-কর্মী অভ্যন্তরীণ কোন্দলে খুনের শিকার হওয়ার প্রতিবেদনও গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। এসব খুনের ঘটনায় মামলা হলেও বিচার পাচ্ছেন না ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা। অধিকাংশ মামলাই ধামাচাপা পড়ে গেছে। এসব খুনের ঘটনায় সরকারি দলের নেতা-কর্মী যুক্ত থাকায় পুলিশ তাদের গ্রেপ্তারও করতে পারছে না। প্রকাশ্যেই ঘুরে বেড়াচ্ছেন আসামিরা।
সর্বশেষ গত দুই মাসে হাজী দানেশ বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর মেডিকেল কলেজ, কুমিল্লাসহ বিভিন্ন স্থানে গোলাগুলি ও সংঘাত-সংঘর্ষে ১১ জন খুনের শিকার হন। অভিযোগের তীর সরকার সমর্থকদের বিরুদ্ধে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকায় ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরে পদ-পদবি ও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা লাভের লড়াই এবং দলীয় সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড স্তিমিত হয়ে যাওয়ার ফলেই এ জাতীয় ঘটনা ঘটছে। প্রতিকারের জন্য সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি এবং জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ ও আইনের আওতায় আনা দরকার।’
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য নূহ উল আলম লেনিন ঢাকাটাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ একটি বড় দল। এখানে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা আছে। এসব নিয়ে দলের মধ্যে কোন্দল থাকতে পারে। সেই কারণে। হয়তো খুনাখুনি হচ্ছে। তবে অপরাধের সঙ্গে যারাই জড়িত থাকবে তাদেরকে আইনের আওতায় আনলে এসব কমবে বলে আমি মনে করি।’
২০১৪ সালের ২০ মে ফেনী শহরে প্রকাশ্যে ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা একরামুল হক একরামকে গুলি করে গাড়িতে আগুন দিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডে ৫৬ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিটও গঠন করা হয়। কিন্তু এখনো বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা এ নিয়ে কোনো কথা না বললেও আল্লাহর কাছে ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করেছেন।
অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে ২০১১ সালের ১ নভেম্বর নরসিংদী পৌর মেয়র লোকমান হোসেন খুন হন। ওই খুনের ঘটনায় তৎকালীন সরকারের ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর ভাই সালাউদ্দিন বাচ্চুকে প্রধান আসামি করেন লোকমানের ভাই কামরুজ্জামান। পরে অবশ্য এ মামলায় বাচ্চুসহ ১১ জনের নাম চার্জশিট থেকে বাদ দেওয়া হয়। সর্বশেষ উচ্চ আদালতে এ মামলাটি স্থগিত রয়েছে। এ ছাড়াও জেলার শিবপুরের কাড়ারচর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি দুলাল ভাণ্ডারী, পুটিয়া ইউপি মেম্বার আরিফুল ইসলাম, জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মাহীনও অভ্যন্তরীণ কোন্দলে খুন হন। কিন্তু এসব খুনের মামলা হিমাগারে। কোনো বিচার পাচ্ছেন না ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা।
২০১৩ সালের ২৯ জুলাই ঢাকা মহানগর যুবলীগ (দক্ষিণ) সাংগঠনিক সম্পাদক রিয়াজুল হক খান মিল্কীকে গুলশানের একটি বিপণি বিতানের সামনে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করে তার দলের অপর নেতা জাহিদ সিদ্দিক তারেক। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িতদের মধ্যে সাতজনকে গ্রেফতারও করে র্যাব। মূল আসামি জাহিদ সিদ্দিক তারেক অবশ্য র্যাবের সঙ্গে ‘কথিত’ বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন। পুলিশের পক্ষ থেকে চার্জশিট দাখিল করা হলেও পরিবারের পক্ষ থেকে নারাজি আবেদন করা হয়। বর্তমানে ওই মামলার কোনো অগ্রগতি নেই বললেই চলে।
২০১৪ সালের ৮ আগস্ট দলীয় কোন্দলে খুন হয়েছেন রাজধানীর ৪০ নম্বর ওয়ার্ড নেতা জাহাঙ্গীর কবীর। এ ঘটনায় মামলা দায়ের হলেও তদন্তে কোনো অগ্রগতি নেই বলে পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে। ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল দুপুরে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন আওয়ামী লীগ সমর্থিত ২ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজন অপহৃত হন। পরে ৩০ এপ্রিল বিকালে শীতলক্ষ্যা নদী থেকে প্যানেল মেয়র ও কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, স্বপন, অ্যাডভোকেট চন্দন সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহিমসহ ছয়টি লাশ উদ্ধার করা হয়। চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলার বিচার চলছে।
২০১৪ সালের ১১ জুলাই সিলেট জেলায় ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে উদয় সিংহ পলাশ নিহত হন। পলাশ হত্যা মামলায় ছাত্রলীগের ছয়জনকে আসামি করে চার্জশিটও দেওয়া হয়। প্রত্যেকেই সরকারি দলের প্রভাবে জামিনে রয়েছেন। একই বছরের ২০ নভেম্বর শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই গ্রুপের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে নিহত হন সুমন চন্দ্র দাশ। এ ঘটনায় মামলা হলেও এজাহারভুক্ত কোনো আসামিই গ্রেপ্তার হননি।
চলতি বছরের ১৪ মে কুমিল্লার তিতাসে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে কুমিল্লা উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি মাসুম সরকার নিহত হন। এ ঘটনায় ৪০ জনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা করা হয়। উল্লেখযোগ্য কোনো আসামিই গ্রেপ্তার হননি। এর এক মাস আগে কুমিল্লা শহর ছাত্রলীগ সভাপতি এম সাইফুল ইসলামকে হত্যা করা হয়। এ হত্যাকাণ্ডে মামলাও হয়। এ ছাড়া ২০১৪ সালের ২৯ মে আওয়ামী লীগের এমপি আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের ভাতিজা আহসান হাবিব সুমু ও ২০১২ সালের ৩ ডিসেম্বর ছাত্রলীগ নেতা পলাশও দলীয় কোন্দলে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। এ ঘটনায় মামলা হলেও কোনো অগ্রগতি নেই।
(ঢাকাটাইমস/৩জুন/এমএম/এআর/ ঘ.)